নমস্তুতের অন্তর্নিহিত অর্থ
নমস্তুতের অন্তর্নিহিত অর্থ
প্রাচীন ভারতীয় সংষ্কৃতি এবং আধ্যাত্মিকতা অনুসারে, অপর ব্যক্তিকে অভিবাদন করার ঐতিহ্যবাহী সংস্কার হল নমস্তুতে বা নমস্তে বলার সময় দুহাতের করতল বুকের সামনে সংযুক্ত করে মাথাটা অপর ব্যক্তির সামনে একটু নত করা। যখন আমরা এভাবে পারস্পরিক অভিবাদন বিনিময় করি, তা বলে দেয়, “আমাদের মনের মিলন ঘটুক।” মাথা নত করা হল ভালোবাসা, শ্রদ্ধা এবং নম্রতা প্রদর্শন বা প্রকাশ করার একটি পথ। নমস্কারের এই প্রথাটি এই বিষয়টিকে স্বীকৃতি দেয় যে আমার এবং তোমার মধ্যে যে দেবত্ব রয়েছে তা সবার মধ্যে সমানভাবে বিদ্যমান। এই অভিবাদন প্রতিটি মানুষের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য, তারা আমাদের চেয়ে বয়সে ছোট হোক, সমবয়স্ক হোক, বয়সে বড় হোক, বন্ধু হোক এবং এমনকি আগন্তুক হোক।
কি ভাবে এই রীতির প্রচলন হল? এ প্রসঙ্গে একটা সুন্দর গল্প আছে। হিমালয় পর্বতে এক আশ্রম ছিলো যেখানে এক মহান ঋষি তার শিষ্যদের নিয়ে বাস করতেন। শিষ্যগণ ঋষিকে যে শ্রদ্ধা করতো তা শুধু তার জ্ঞানের জন্য নয়, সকলের প্রতি তার দয়া ও ভালোবাসার জন্য। তার দয়ালু স্বভাবের কারণে তিনি প্রায়ই তাদের শিষ্য হিসেবে গ্রহণ করতেন যারা আধ্যাত্মিক ক্ষেত্রে অপরিণত বা পিছিয়ে রয়েছে। কিন্তু এর ফলেই ছাত্রদের মধ্যে অর্থহীন ভুলবোঝাবুঝি ও ঝগড়ার সৃষ্টি হল। এর ফলে আশ্রমের প্রশান্তি বিঘ্নিত হল।
একদিন ঋষি তার বারংবার উপদেশ দেবার পরও শিষ্যদের এধরণের অপরিণত আচরণ লক্ষ্য করে খুবই বিরক্তি বোধ করলেন কিন্তু তার স্নেহ ও দয়া কাউকে বহিষ্কার করা থেকে তাকে বিরত রাখলো। বরঞ্চ , একটা সমাধানের জন্য তিনি নিষ্ঠা সহকারে ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা জানালেন। তিনি অনেক দিন উপবাসে কাটালেন, এবং অনেক দিন ধ্যান ও প্রার্থনার মধ্য দিয়ে অতিবাহিত করলেন। কিছুদিন পরে তিনি ঈশ্বরের দর্শন পেলেন এবং ঈশ্বর তাকে জিজ্ঞাসা করলেন যে তিনি এত দুঃখী কেন। তিনি সবকিছু সবিস্তারে বললেন এবং ঈশ্বরকে আশ্রমে আসতে অনুরোধ করলেন এবং তার শিষ্যদের মন ঈর্ষা ও ক্রোধ থেকে মুক্ত করতে বললেন। ঈশ্বর তার প্রস্তাবে রাজী হলেন এবং বললেন তিনি একটি শর্তে আশ্রমে যেতে পারেন। তিনি যে কোনো একজন ছাত্রের ছদ্মবেশে এবং কেউ জানবেনা ঈশ্বর কে ।
ঋষি তার শিষ্যদের কাছে তার ঈশ্বর দর্শন এবং তাদের কারো একজনের রূপ ধরে ঈশ্বরের আশ্রমে আসার সিদ্ধান্তের কথা জানালেন। শিষ্যগণ খুব খুশি হল কিন্তু তারা জানে না তাদের মধ্যে কার রূপ ধরে ঈশ্বর আসবেন। সুতরাং তারা সকলেই একে অপরের প্রতি খুব নম্র ভদ্র ও সহানুভূতিশীল হয়ে উঠলো এই কথা ভেবে যে অপর শিষ্যটি ছদ্মবেশে স্বয়ং ঈশ্বর হতে পারে।
কয়েক মাস তারা এভাবেই বাস করলো এবং শীঘ্রই সকলের হৃদয় আশ্রম শান্তিতে পরিপূর্ণ হল। তারা তাদের পবিত্র হৃদয়ে ঈশ্বরের আনন্দময় উপস্থিতি অনুভব করতে লাগলো। তারা একে অপরকে স্বয়ং ঈশ্বর মনে করে সেইরূপ আচরণ করতে শুরু করলো। সম্পূর্ণ আশ্রম পরম আনন্দ পূর্ণ ইতিবাচক স্পন্দনে পুনরায় স্পন্দিত হতে লাগলো।
মহান ঋষি এবং তার শিষ্যগন একে অপরের সাথে তাদের অভিজ্ঞতা ভাগ করে নিতো এবং একে অপরকে উৎসাহিত করতো পরস্পরকে শ্রদ্ধা করার জন্য এবং প্রত্যেকের মধ্যে যে দেবত্ব রয়েছে তাকে শ্রদ্ধা করার জন্য। সেই সময় থেকে প্রত্যেকে একে অপরকে হাত জোড় করে ‘নমস্তে বা নমস্কার’ বলে অভিবাদন করা শুরু করলো।
এই প্রসঙ্গে ২০১১ সালে ২০ শে মার্চ সন্ধ্যায় ভগবান বাবা যা করেছিলেন তার বোধহয় ভীষণ প্রাসঙ্গিক। যদিও সেদিন তার শরীরী অভিব্যক্তি কুলবন্ত হলের উপস্থিত প্রত্যেককে ব্যথায় ও কষ্টে একরকম বিবশ করে তুলেছিলো, অতীতের দিকে দৃষ্টিপাত করলে তার এই আচরণ বা অভিব্যক্তি কিন্তু অর্থবহ হয়ে ওঠে। ঈশ্বরের কোনো অভিব্যক্তিই কিন্তু ক্ষুদ্র নয়; প্রতিটি অভিব্যক্তিই মানবজাতির জন্য গভীর ভাবে অর্থপূর্ণ ও তাৎপর্য পূর্ণ ।
সেদিন ছিলো রবিবার, বাস্তবিক, ভগবান শ্রী সত্য সাই বাবার শারীরিক উপস্থিতির শেষ রবিবার। ভজন সমাপ্ত হল ও আরতি নিবেদিত হল। ‘লোকা সমস্তা সুখীন ভবন্ত’ মন্ত্রে সাই কুলবন্ত হল পুণরায় স্পন্দিত হয়ে উঠলো এবং এমনকি মন্ত্রোচ্চারণ যখন চলছে, স্বামী আস্তে আস্তে তার ডান হাতটা তুললেন। বাস্তবিক পক্ষে তিনি তার সহ্য ক্ষমতার উর্ধ্বে উঠে চেষ্টা করে যাচ্ছিলেন কোনরকমে কয়েক সেকেন্ডের জন্য হাতটিকে ওপরে তোলার। আসলে তার হাতে একটা মৃদু কম্পন লক্ষ্য করা যাচ্ছিলো; হাতটা কাঁপছিলো।
আবার প্রচন্ড চেষ্টায় আর একটা হাতও উঠলো। কিন্তু তার বাঁ হাতের তালু খুলছিলো না এবং যে ভাবে তিনি দুহাত তুলে আশির্বাদ করেন সেভাবে হাত দুটো তুললেন । বহু চেষ্টার পরে বাঁ হাতের পাতা ডান হাতের পাতার সাথে যুক্ত হল । আমি ভেবেছিলাম, “ওহ্ , স্বামী তার বাঁ হাত দিয়ে দুর্বল ডান হাতকে সামলাচ্ছেন।” কিন্তু তারপরেই একেবারে অপ্রত্যাশিত ও অভূতপূর্ব কিছু ঘটে গেলো। ঠিক যখন প্রত্যেকে স্বামীর আশীর্বাদের মুদ্রায় ওপরে তোলা দুই হাত দেখবে আশা করেছিলো, ঠিক তখন স্বামী প্রত্যেককে অবাক করে দিয়ে নমস্কারের ভঙ্গিতে দুই হাতের পাতা একত্রিত করলেন। প্রথমে তিনি এই ভঙ্গিতে পুরুষদের দিকে তাকালেন এবং তারপর আস্তে আস্তে ডানদিকে ফিরলেন এবং মহিলাদের দিকে ফিরে একই কাজ, একই অভিব্যক্তির প্রকাশ ঘটালেন। ঠিক সেই সময়, বিস্মিত স্তম্ভিত হয়ে প্রত্যেকে স্বামীর দিকে এক দৃষ্টে তাকিয়ে ছিলো এবং স্বামীর চেয়ার চলতে শুরু করলো। শীঘ্রই তিনি গাড়িতে উঠলেন ও চলে গেলেন যেন অস্বাভাবিক কিছুই ঘটেনি। শুধু স্বামী পার্থিব শরীর ছেড়ে চলে যাবার পর, এই ঘটনার তাৎপর্য আমাকে বজ্রপাতের ন্যায় আঘাত করেছিলো কারণ ভারতে নমস্কার মুদ্রা সাধারণত ব্যবহৃত হয় শ্রদ্ধার সাথে অন্যদের অভিবাদন করার সময়। এবং এখানে ভগবান সেই আচরণ আমাদের সাথে করছিলেন! শুধু মাত্র যাতে এই বার্তাটি চিরস্থায়ী ভাবে আমাদের হৃদয়ে মনে মুদ্রিত হয়ে থাকে।
Source: http://media.radiosai.org/journals/vol_09/01SEPT11/05_ganesh_chaturthi_1.htm