পরিণামদর্শিতার অভাব
পরিণামদর্শিতার অভাব
অযোধ্যার রাজপুত্র দশরথের খ্যাতি বাইরে চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়েছিলো
শব্দভেদী হিসাবে তার পারদর্শিতার জন্যে তিনি অত্যন্ত গর্বিত ছিলেন; অন্ধকারের মধ্যে তিনি শুধু শব্দ শুনেই তাকে লক্ষ্য করে তীর ছুড়তে পারতেন এবং লোকের প্রশংসা শুনে আনন্দ পেতেন। গোধুলির আলো আঁধারিতে রথে করে তিনি একা বেরিয়ে পড়তেন ও বনের মধ্যে গিয়ে অপেক্ষায় থাকতেন। এক সময়ে তিনি মোষ বা হাতী জল খেতে এলে তার পায়ের শব্দ শুনতে পেতেন, আবার কখনো হরিণের হালকা পায়ের কিংবা বাঘের চুপি চুপি আসার শব্দ পেতেন।
একদিন রাত্রে তিনি ঝোপঝাড়ের মধ্যে থেকে পাতার কিংবা জলের শব্দ শোনার জন্য কান পেতে আছেন, হঠাৎ জলের ধারে কিছু নড়াচড়ার শব্দ পেলেন। অন্ধকারে কিছুই দেখা যাচ্ছিল না। কিন্তু দশরথ না শব্দভেদী! শবব্দই তাঁর কাছে যথেষ্ট। খুব সম্ভব ওটা একটা হাতী। তিনি তীর ছুঁড়লেন, আর সঙ্গে সঙ্গেই এক চীৎকার শুনে তিনি লাফিয়ে উঠলেন। “বাঁচাও! বাঁচাও! আমাকে কে যেন তীর ছুড়ে মেরেছে!” দশরথের হাত থেকে ধনুক পড়ে গেল। ভয়ে তার মাথা ঘুরে গেল। তিনি এ কী করেছেন, বন্য জন্তুর বদলে মানুষকে মেরেছেন? তিনি জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে জলাশ্যের দিকে ছুটলেন। জলের ধারে এক যুবক রক্তাক্ত দেহে লুটিয়ে পড়ে আছে, তার হাতে ধরা এক কলসী, তাতেই সে জল ভরছিল। সে আর্তনাদ করে বলল, “আপনি আমাকে মারাত্মক তীর ছুড়ে মেরেছেন। আমি আপনার কি ক্ষতি করেছি যে আমার এই অবস্থা করলেন? আমি একজন মুনির সন্তান। আমার বৃদ্ধ পিতা মাতা অন্ধ; আমি তাদের দেখাশোনা করি, যা কিছু দরকার এনে দিই। তাদের জন্য জল নিয়ে যেতে এসেছিলাম; আর তো আমি তাদের সেবা করতে পারবো না! আপনি এই পথ ধরে তাদের কুটিরে গিয়ে সব ঘটনা বলুন। তার আগে আমার বুক থেকে তীরটা টেনে বার করে দিন, আমার বড় যন্ত্রণা হচ্ছে।” দশরথ তার বুক থেকে তীর টেনে ফেলে দিলেন। মুনির পুত্র শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লো।
রাজপুত্র কলসীতে জল ভরে নিয়ে, যুবকের নির্দেশিত পথ ধরে কুটিরের সামনে গিয়ে দাঁড়াতে পিতা বলে উঠলেন, “পুত্র, আজ এত দেরি হল কেন? জলের মধ্যে সাঁতার দিচ্ছিলে? তোমার কিছু হলো নাকি ভেবে আমরা ভয় পাচ্ছিলাম। কিন্তু তুমি কোন উত্তর দিচ্ছে না কেন?”
কম্পিত স্বরে দশরথ উত্তর দিলেন, “হে মহামুনি, আমি আপনার পুত্র নই। আমি একজন ক্ষত্রিয়, এর আগে পর্যন্ত আমি আমার ধনুর্বিদ্যার গর্বে গর্বিত ছিলাম। আজ রাতে আমি যখন অপেক্ষায় ছিলাম, মনে হলো কোন হাতী জলের ধারে এসে জল খাচ্ছে, এ তারই শব্দ! তীর ছুড়ে মারলাম। হায় হায়! যাকে মারলাম সে আপনার সন্তান! এ পাপের প্রায়শ্চিত্ত কি, বলে দিন।”
বৃদ্ধ দম্পতি হাহাকার করে কেঁদে উঠলেন। তাদের একমাত্র সন্তান যেখানে শুয়ে পড়ে আছে, সেখানে তাদের নিয়ে যাবার জন্যে রাজপুত্রকে আদেশ করলেন। সেখানে তারা পবিত্র মন্ত্র উচ্চারণ করে, অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার জল তার শরীরের উপরে ছিটিয়ে দিলেন। তারপর মুনি বললেন “শোনো দশরথ! তোমার অপরাধের জন্য আমাদের প্রিয় পুত্র শোকে আমরা চোখের জল ফেলছি। একদিন তোমাকেও তমার প্রিয় পুত্রের জন্যে কাঁদতে হবে। সে দিন আসার আগে বহুদিন কেটে যাবে। কিন্তু দণ্ড নেমে আসবেই।”
তাঁরা মৃতদেহ দাহ করার জন্যে চিতা জ্বালালেন, তারপর নিজেরা তার মধ্যে ঝাঁপ দিয়ে মৃত্যুবরণ করলেন।
দিন কেটে যেতে লাগলো। দশরথ রাজা হলেন ও কৌশল্যা দেবীকে বিবাহ করলেন। মহিমময় রাম তাদের পুত্ররূপে জন্ম নিলেন। অযোধ্যানগরীর সকলেই রামকে ভালবাসতো, একমাত্র ভাল বাসতো না যে, সে হলো দশরথের দ্বিতীয় মহিষী কৈকেয়ী ও তার দাসী। এই দুজনে মহান চরিত্র রামের পতন ঘটায়, তাকে চোদ্দ বছরের জন্য বনে নির্বাসনে থাকার ব্যবস্থা করে।
এবার দশরথের শোকের পালা। বহুদিন আগে, মুনি পুত্রের মাঝরাতে জল নিতে গিয়ে মৃত্যু ঘটলে, বনের মধ্যে তার বৃদ্ধ পিতা মাতা যেভাবে শোক করেছিলেন, দশরথ তার সন্তানের জন্যে সেইভাবে শোক করতে লাগলেন।
দশরথ তার পারদর্শিতার জন্য এক কালে এত বেশি গর্বিত ছিলেন যে পরিণামদর্শিতার অভাব তার মধ্যে দেখা দিয়েছিল; অন্ধকারে কাউকে আঘাত করা যে বিপজ্জনক হতে পারে, সে কথা তিনি চিন্তা করেননি। শব্দভেদী হিসেবে নিজের নৈপুণ্যে নির্ভর না করে, দিনের আলোতে তীর ধনুক চালনা করলে তিনি ভালো করতেন। তিনি কোন অনিষ্ট করতে চাননি, কিন্তু তার দূরদৃষ্টির অভাব ঘটেছিলো।
প্রশ্ন :
- শব্দভেদী কে?
- দশরথ বৃদ্ধ মুনির পুত্রকে তীর ছুড়ে মারলেন কেন?
- তিনি এই ভুল কেন করলেন?
- এর প্রায়শ্চিত্ত তিনি কিভাবে করলেন?
- মুনি ও তাঁর পত্নী নিজেদের পুড়িয়ে মারলেন কেন?
- দশরথকে মুনি কি অভিশাপ দিয়েছিলেন?
- তোমার নিজের কোন পরিণামদর্শিতা বা অপরিণামদর্শিতার উদাহরণ দিয়ে, তার ফলাফল কি হয়েছিল বর্ণনা কর।