দিব্যবাণী থেকে বাসনার সীমিতকরণের ওপর কিছু অংশ, গুরুদের বিশদ পাঠের জন্য তুলে দেওয়া হল

Print Friendly, PDF & Email
দিব্যবাণী থেকে বাসনার সীমিতকরণের ওপর কিছু অংশ, গুরুদের বিশদ পাঠের জন্য তুলে দেওয়া হল

অন্নের অপচয় কোরনা
অর্থের অপচয় কোরনা
সময়ের অপচয় কোরনা
শক্তির অপচয় কোরনা
প্রকৃতির ওপর অত্যাচার কোরনা

ভগবান শ্রী সত্য সাই বাবার দিব্য ভাষণগুলি থেকে কিছু অংশ নীচে তুলে দেওয়া হলো। এখানে তিনি ‘বাসনার সীমিতকরণ ‘প্রকল্পটি ব্যাখ্যা করেছেন:

বাসনা জেলখানার সমান

‘বাসনার সীমিতকরণ বলতে কী বোঝায়? মানুষের অশেষ বাসনা তাকে ভ্রান্ত করে। তারা এক স্বপ্নের জগতে বাস করছে। পরম চৈতন্যের কথা তারা ভুলে যাচ্ছে। এইজন্যই বাসনার ওপর নিয়ন্ত্রণ থাকা উচিত; বাসনার সীমিতকরণ করা জরুরী। আমরা প্রয়োজনের চেয়ে অনেক বেশি অর্থ ব্যয় করে থাকি। নিজেদের সুখের জন্য অপরিমিত ব্যয় না করে, দরিদ্র ও আর্তের ত্রাণের জন্য ওই অর্থ ব্যয় করা উচিত। এটাই বাসনার সীমিতকরণের প্রকৃত অর্থ।

কিন্তু কেবল অর্থ দেওয়াটাই সব এমন ভ্রান্ত ধারণা পোষণ কোরনা। নিজের বাসনা যদি বেড়েই চলে তাহলের অন্যকে অর্থ দেওয়ার দরকার নেই। বাসনা সংযত কর, কারণ পার্থিব বাসনা, জীবনকে অশান্ত ও বিপর্যস্ত করে তোলে। বাসনা হলো কারাগার। একমাত্র চাহিদা কম করেই মানুষ মুক্তি পেতে পারে। জীবনে যেটুকু না হলেই নয়, সেটুকুর জন্য বাসনা থাকতে পারে।

বাসনা কী করে কম করা যায়?

প্রথমেই খাদ্য যেটুকু প্রয়োজন, কেবল সেইটুকুই খাও। লোভ কোরনা। যা খেতে পারবে তার চেয়ে বেশী নিয়ে, সেটা নষ্ট করো না। খাবার নষ্ট করা খুব বড় পাপ। বাড়তি খাবার আরেকটা লোকের পেট ভরাতে পারে। খাদ্যের অপচয় করো না কারণ অন্ন ঈশ্বর, প্রাণ ঈশ্বর এবং অন্ন থেকেই মানুষের জন্ম হয়। খাদ্য মানুষের প্রাণ, দেহ, মন ও চরিত্রের প্রধান উপকরণ।

খাদ্যের স্থুল অংশ, যেটা তার প্রধান ভাগ, সেটা দেহ গ্রহণ করে এবং পরে তা আবর্জনারূপে ত্যাগ করে। খাদ্যের এক ক্ষুদ্র অংশ হলো তার সূক্ষ্ম অংশ। সেটা দেহে মিশে রক্তরূপে প্রবাহিত হয়। তার চেয়েও ক্ষুদ্রতম অংশ, যা খাদ্যের সূক্ষতম ভাগ, তার থেকে মন তৈরী হয়। সুতরাং যেমন খাদ্য গ্রহণ করবে মনে তারই প্রতিফলন হবে। এখন মানুষের মনে যে পাশবিক বা দানবিক প্রবৃত্তি দেখা যায়, তার কারণ আমাদের খাদ্য। দয়া, মায়া, প্রেম, ধৈর্য না থেকে অসৎ গুণ, যেমন ঘৃণা, আসক্তি, এসবই বেড়ে চলেছে।

সুতরাং আমরা যে খাদ্য গ্রহণ করব, তা খুবই শুদ্ধ, পবিত্র, পরিচ্ছন্ন ও সাত্বিক হওয়া উচিত। এমন খাদ্য থেকেই মানুষ যথার্থ পুষ্টিলাভ করে।

আমরা যতটা জল পান করি, তার বেশিরভাগটাই প্রস্রাব হয়ে বেরিয়ে যায়। জলের একটা ক্ষুদ্র অংশ জীবনীশক্তিতে পরিণত হয়। সুতরাং আমরা যে ধরণের খাদ্য ও পানীয় গ্রহণ করি, তার দ্বারাই আমাদের চরিত্র গঠিত হয়। একমাত্র খাদ্য ও পানীয়ের গুণমানের নিয়ন্ত্রণের দ্বারাই আমরা দিব্যত্ব লাভ করতে পারি। এইজন্যই অন্নকে ব্রহ্ম বলা হয়েছে। সুতরাং খাদ্যের অপচয় করা মানে ঈশ্বরের অমর্যাদা করা। খাদ্যের অপচয় কোরনা। যতটুকু প্রয়োজন ততটুকু খাও এবং যা খাচ্ছ সেটা সাত্ত্বিক কিনা সে বিষয়ে নিশ্চিত হও। বাড়তি খাদ্য যার প্রয়োজন তাকে দাও।

দ্বিতীয়, অর্থ ভারতীয়রা অর্থ ও সম্পদকে দেবী লক্ষী বলে মনে করে। কখনো অর্থের অপব্যবহার কোরনা। অর্থের অপব্যবহার তোমাদের অসৎ গুণ, অসৎ ভাবনা এবং অসৎ অভ্যাসের দাস করে তুলবে। অর্থ বুদ্ধির সঙ্গে, ভালো কাজের জন্য ব্যয় করো। অর্থের অপচয় কোরনা। অর্থের অপচয় করা হীন কাজ। এমন কাজ তোমাদের ভুল পথে নিয়ে যাবে।

তৃতীয়, সময় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, সবচেয়ে প্রয়োজনীয় হলো সময়। সময়ের অপচয় কখনো করা উচিত নয়। সময়কে কাজে লাগানো উচিত। সময়কে পবিত্রভাবে ব্যবহার করা উচিত কারণ এই সৃষ্টিতে সমস্তকিছুই কালের ওপর নির্ভর করে আছে। এমনকি আমাদের শাস্ত্রেও ঈশ্বরকে ‘কাল”,কালাতীত ‘বলে বর্ণনা করা হয়েছে। ঈশ্বর কালের দ্বারা সীমিত নয়। তিনি কালাতীত; তিনি স্বয়ং কাল। কাল ঈশ্বরের মূর্ত বিগ্রহ। সবকিছুই কালের ওপর নির্ভর করে। মানুষের জন্ম ও মৃত্যুর প্রধান কারণও কাল। কালের অপচয় করা মানে জীবনেরও অপচয় করা। সুতরাং কাল আমাদের জীবনের এক অপরিহার্য অংশ। অপ্রয়োজনীয় কথোপকথন করে, অন্যদের ব্যক্তিগত বিষয়ে জড়িত হয়ে কালের অমর্যাদা করো না। “সময়ের অপচয় কোরনা ” এই প্রবচনের পিছনে যে সত্য লুকিয়ে আছে, তা হলো যে, অসৎ চিন্তা ও কর্মে কখনোই সময়ের অপচয় করা ঠিক নয়। তার পরিবর্তে সময়ের সুদক্ষ ব্যবহার করো।

চতুর্থ, শক্তি আমাদের শারীরিক, মানসিক বা আধ্যাত্মিক শক্তির কখনই অপচয় করা উচিত নয়। তোমরা আমাকে জিজ্ঞাসা করতে পারো যে, “আমরা কিভাবে এই শক্তির অপচয় করি?” যদি তোমরা খারাপ কিছু দেখ, তোমাদের শক্তির অপচয় হয়। খারাপ জিনিস শোনা, খারাপ কথা বলা, অসৎ চিন্তা করা এবং মন্দ কাজ করা, এগুলি সবই তোমাদের শক্তির অপচয় করে থাকে। এই পাঁচটি ক্ষেত্রেই নিজেদের শক্তির সংরক্ষণ কর এবং নিজেদের জীবনকে অর্থবহ করে তোলো।

খারাপ জিনিস দেখোনা – যা ভালো তাই দেখো
খারাপ কথা শুনোনা – ভালো কথা শোনো
খারাপ কথা বোলনা – ভালো কথা বলো
খারাপ চিন্তা করোনা – সৎ চিন্তা করো
খারাপ কাজ করোনা – ভালো কাজ করো
এটাই ঈশ্বরের কাছে পৌঁছনোর পথ।

খারাপ জিনিস না দেখা, শোনা, বলা ভাবা বা কোনোরকম অসৎ কর্মে না লিপ্ত হওয়া – এটাই দিব্যত্বের পথ। এই পথ যদি আমরা না অনুসরণ করি তাহলে আমরা শক্তির অপচয় করছি। আর এই শক্তি ক্ষয়ের জন্য আমরা আমাদের স্মৃতিশক্তি, ধীশক্তি, ভালো মন্দের ভেদ করার শক্তি এবং বিচারশক্তি হারিয়ে ফেলছি। আজকের মানুষ ভালো মন্দের মধ্যে পার্থক্য করতে পারেনা। সেটা না পারলে সৎ কর্মের পথে চলা কি করে সম্ভব; আমরা কিভাবে সময় নষ্ট করছি? একটা উদাহরণ দিই। তোমরা যখন কোনো একটি বিশেষ অনুষ্ঠান শোনার জন্য রেডিও চালাও তখন আওয়াজ জোরে হোক বা আস্তে, রেডিও যতক্ষণ চালু থাকবে, ততক্ষণ কারেন্ট চালু থাকবে। আমাদের মন হলো ওই রেডিওর মতন। তোমরা অন্যের সঙ্গে কথা বলো অথবা মনে চিন্তা করো, তোমরা শক্তি ব্যবহার করছো। তোমাদের মন সবসময় কাজ করে চলেছে। যেহেতু সেটা সবসময় চালু থাকছে, তোমরা অনেকটা শক্তি ব্যবহার করে ফেলছো। এইভাবে মনের এদিক ওদিক যাওয়ার পিছনে ক্ষমতা, শক্তি ও বল নষ্ট না করে, নিজেদের সময় সৎ চিন্তায় অতিবাহিত করা ভালো নয় কী? এই বাসনার সীমিতকরণ প্রকল্পটি এইজন্য চালু করা হয়েছে যাতে মানুষ খাদ্য, অর্থ, সময় ও শক্তি, কোনো ক্ষেত্রেই কোনো অপচয় না করে।

[সত্য সাই নিউজ লেটার (ইউ এস এ ) ভলিউম ১৩-৩ (স্প্রিং ১৯৮৯ ) সেবা ও সাই সংস্থার বিষয়ে দিব্য ভাষণ। (নভেম্বর ২১, ১৯৮৮)]

মনকে নিয়ন্ত্রণ করার সহজতম উপায়

ঈশ্বর সর্বদা উপস্থিত আছেন, এই বিশ্বাসকে ধরে রাখতে হবে। তোমাদের সকল কাজ তোমরা ঈশ্বরকে খুশি করার জন্য করছ, এই চিন্তা থেকেই কাজ করতে হবে। এটাই মনকে নিয়ন্ত্রণ করার সহজতম উপায়।

তোমার যদি এই বিশ্বাস থাকে যে তোমার দেহের মালিক ঈশ্বর, তাহলে সেই দেহ দিয়ে তুমি কোনো পাপ কাজ করতে পারবেনা। বরঞ্চ তোমার সকল প্রচেষ্টা, সকল শ্রম তোমায় দিব্যত্বের দিকে নিয়ে যাবে। তোমার সত্ত্বা যদি এমন বিস্বাসে সিক্ত হয় যে তোমার সকল শক্তির অধীশ্বর স্বয়ং ঈশ্বর, তাহলে তুমি আর তার অপব্যবহার করতে পারবেনা। এই কথা মাথায় রেখেই সত্য সাই কেন্দ্রগুলিতে বাসনার সীমিতকরণ প্রকল্প শুরু করা হয়েছিল।

প্রকল্পের চারটি ভাগ
বাসনার সীমিতকরণের প্রথম নির্দেশ হল-

“খাদ্যের অপচয় করো না, অন্ন ব্রহ্ম। তোমাদের দেহ অন্ন থেকে উৎপন্ন এবং তোমাদের পিতা-মাতা যে খাদ্য গ্রহণ করেছেন, তোমরা তারই ফল। খাদ্য ঈশ্বর। যতটা প্রয়োজন ততটা খাও। কিন্তু যা খেতে পারবে থালায় তার থেকে বেশী নিয়ে খাবার নষ্ট কোরনা। খাদ্য নষ্ট করলে দিব্য শক্তির অপচয় করা হয়।

দ্বিতীয় নির্দেশ হল

“অর্থের অপচয় কোরনা। “সম্পদ হলো ঈশ্বর। “যেহেতু অর্থ ঈশ্বর সুতরাং তার অপব্যবহার করা অন্যায়। অর্থ, অন্ন, বস্ত্র, গৃহ ইত্যাদি দান করার অভ্যাস গড়ে তোলো। বিলাসিতা করে অর্থের অপচয় কোরনা। অর্থের অপচয় করা শুধু অন্যায় নয় পাপ।

তৃতীয় নির্দেশ হল

“সময়ের অপচয় কোরনা। সময়ের অপচয় করা মানে জীবনের অপচয় করা।”
ঈশ্বর কাল বা সময় রূপে পূজিত হন। তিনি কালের অতীত, কালকে অতিক্রম করেন এবং কালস্বরূপ। পবিত্র নাম জপে কাল অতিবাহিত কর। সময় নষ্ট কোরনা, সময় নষ্ট করা মানে ঈশ্বরকে অবহেলা করা।

চতুর্থ নির্দেশ হল

“শক্তির অপচয় কোরনা “লোকে অসৎ চিন্তায়, খারাপ জিনিষ দেখে, খারাপ কথা শুনে এবং অসৎ কাজ করে শক্তির অপচয় করে।

সঠিক রাজপথ হল

মন্দ জিনিস দেখোনা – যা ভালো তাই দেখো
মন্দ কিছু শুনোনা – ভালো জিনিস শোনো
খারাপ কথা বলোনা – ভালো কথা বলো
অসৎ চিন্তা কোরনা – সৎ চিন্তা করো
মন্দ কাজ কোরনা – ভালো কাজ করো

এই উপদেশগুলি জীবনে অভ্যাস করলে, তোমরা পবিত্র ভাবে সময় কাটাতে পারবে। এই আধ্যাত্মিক অনুশীলন ও কর্মের পথ তোমাদের গ্রহণ করতে হবে। এই কাজটা তোমাদের করতে হবে। এমন সময় আসবে যখন মন বিনষ্ট হবে এবং ঈশ্বরের সঙ্গে তোমরা এক হয়ে যেতে পারবে।

[গ্রীষ্মকালীন শিক্ষাশিবির ১৯৯৩, ৬ষ্ঠ অধ্যায়: মনকে জয় করা]

অন্তরে প্রেমের দীপ জ্বাল

বর্তমান কালে মানুষ সুখে ও আনন্দে থাকার জন্য সবরকম চেষ্টা করছে। আনন্দ কোথা থেকে পাওয়া যায়? কোনো জাগতিক জিনিষ থেকে,পৃথিবীতে ,কোনো ব্যক্তির মধ্যে বা বই থেকে কী আনন্দ পাওয়া যায় ?একেবারেই নয়। আনন্দ থাকে অন্তরে। তোমাদের প্রকৃত স্বরূপ ,যা আনন্দের উৎস ,তাকে তোমরা ভুলে গেছ। তোমরা বাইরে থেকে কৃত্রিম আনন্দ লাভের জন্য কঠিন পরিশ্রম করছো। অন্তরে যে সত্য লুকিয়ে আছে ,সে সম্পর্কে তোমরা সচেতন নয়। বস্তুতঃ সকল আনন্দ সেখানেই আছে। প্রেম তত্ত্ব অন্তরে উৎপন্ন হয় ,বাইরের পৃথিবীতে নয়। প্রত্যেকের উচিত অন্তরে আরো বেশি করে প্রেম সঞ্চার করা। কিন্তু বর্তমানে সব জায়গায় ঘৃণা ও ক্রোধ প্রকাশিত হচ্ছে। যেখানেই দেখবে সেখানেই বাসনা ,শত্রুতা এবং ভয় দেখতে পাবে। এমন অবস্থায় কী করে আশা কর যে শান্তিতে থাকবে? কী করে ভাবলে যে আনন্দে থাকবে? অন্তরে প্রেমের প্রদীপ জ্বালো। তাহলে ভয় ও ভ্রান্তি দূরে সরে যাবে এবং তোমরা আত্মদৃষ্টি লাভ করবে। তা নাহলে দুঃখ ভোগ করতেই হবে। সতরাং বাসনায় সীমারেখা টানতেই হবে। জমি বা সম্পত্তির বেলায় আইন সীমা বেঁধে দিয়েছে। কিন্তু তোমাদের বাসনার আর কোনো সীমা নেই। বাসনার সীমিতকরণ মানে বাসনাকে নিয়ন্ত্রিত করা। বাসনা নিয়ন্ত্রিত হলে তোমরা সুখে থাকবে।

সঙ্গের মালপত্র কম থাকলে ভ্রমণ আরামপ্রদ ও সুখকর হয়

তোমাদের জীবন এক দীর্ঘ যাত্রাপথ। জীবনের এই দীর্ঘ যাত্রাপথে সঙ্গের জিনিস (বাসনা )কম করতে হবে। সুতরাং বলা হয়, “কম মালপত্র, আরামের ভ্রমণ, সুখকর যাত্রা।” অতএব এখন থেকে তোমাদের ‘বাসনার সীমিতকরণ’নীতি গ্রহণ করতে হবে। দিনে, দিনে নিজেদের বাসনাকে কমিয়ে ফেলতে হবে। বাসনা পূর্ণ হলে সুখ পাওয়া যায় , এ তোমাদের ভ্রান্ত ধারণা। প্রকৃতপক্ষে বাসনা যখন নির্মূল হয়, তখনই সুখের ভোর হয়।
তোমাদের বাসনা যখন কমে যাবে, তখনই তোমরা ত্যাগের অবস্থায় পৌঁছবে। তোমাদের অনেক বাসনা। তার থেকে কী পাও? যেই কোনোকিছুকে আমার বলে দাবী করবে, তখনই তোমাদের তার পরিণতির মুখোমুখি হতে হবে। এক খণ্ড জমিকে যদি নিজের বলে দাবী করো তাহলে সেখান থেকে তোমায় ফসল ঘরে তুলতে হবে। এই যে অহংকার ও আসক্তির প্রবণতা তাই তোমাদের জীবনে দুঃখ নিয়ে আসে। অহংকার ও আসক্তি ত্যাগ করলেই আনন্দ নেমে আসবে।

[শ্রী সত্য সাই দিব্যবাণী, ভলিউম ৩২, পার্ট ১ অধ্যায় ৬, Put a ceiling on your desires]

পৃথিবী ছেড়ে যখন যেতে হয়, তখন কিছুই সঙ্গে যায়না

বর্তমান কালে যেদিকেই তাকাও খালি বাসনা, আরো বাসনা আরো বাসনা। এইসব বাসনায় একটা সীমারেখা টান। একমাত্র তাহলেই তোমাদের মন শান্ত হবে। তোমরা বলো “আমার এটা চাই, ওটা চাই”I এইভাবে তোমাদের মনে অনেক বাসনা তৈরী হয়। এগুলি চলমান মেঘের মতন।, তার সংখ্যা কেন বাড়িয়ে তুলতে চাও? যখন জীবনের শেষে এই মরদেহ ত্যাগ করতে হয়, তখন কিছুই তোমাদের সঙ্গে যায়না।

কত বড়, বড় রাজা সম্রাট এই পৃথিবীতে রাজত্ব করে গেছেন। তাঁরা কত দেশ জয় করেছিলেন, প্রচুর ধনসম্পদ জড়ো করেছিলেন। মহান সম্রাট আলেক্সান্ডার, যিনি পৃথিবীর বহু দেশ জয় করেছিলেন, তিনিও নিজের সম্পদের এক কণাও সঙ্গে নিয়ে যেতে পারেননি। এই সত্যটি সকলের সামনে তুলে ধরার জন্য, তিনি তাঁর মন্ত্রীদের বলেছিলেন যে তাঁর মরদেহটি যেন শোভাযাত্রা করে রাজপথ দিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। তিনি আরো বলেছিলেন যে সেই সময় তাঁর হাতদুটি যেন তালু ওপরের দিকে করে গগনমুখী করে রাখা হয়; এই অদ্ভুত অনুরোধটির কারণ জানার জন্য মন্ত্রীদের খুব কৌতূহল হলো।

আলেক্সান্ডার বললেন, “আমি বহু দেশ জয় করেছি, এতো সম্পদ সংগ্রহ করেছি। আমার নিয়ন্ত্রণে এক বিরাট সৈন্যবাহিনী রয়েছে। কিন্তু আমি যখন এই দেহ ত্যাগ করে যাচ্ছি তখন কিছুই আমার সঙ্গে যাচ্ছেনা। আমি খালি হাতে যাচ্ছি। এই কথাটা সবার সামনে তুলে ধরতে হবে।”

[শ্রী সত্য সাই দিব্যবাণী ভলিউম ৪১, অধ্যায় ১৯: Contemplate on God, The Real Hero for Victory]

অতিরিক্ত বাসনা প্রকৃতির ভারসাম্য নষ্ট করে

বাসনার নিয়ন্ত্রণ করা মানুষের কর্তব্য। মানুষের চরিত্রের বিকৃতির জন্যই আজ প্রাকৃতিক দুর্যোগ নেমে আসছে। গুজরাটে যে ভূমিকম্প হয়েছে, তাতে কত ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে সে তোমরা জানো। হাজার হাজার মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। এর কারণ মানুষ অতিরিক্ত বাসনাকে প্রশ্রয় দিচ্ছে। ঈশ্বর তাঁর সৃষ্টিতে নিখুঁত ভারসাম্য বজায় রাখেন। ঈশ্বরের সৃষ্টিতে, পৃথিবী এবং সমুদ্রের ভারসাম্য আছে। কিন্তু তেল বার করার জন্য মানুষ নির্বিচারে প্রকৃতির ওপর অত্যাচার করছে।

প্রতিদিন সমুদ্র থেকে টন, টন মাছ ধরা হচ্ছে। প্রকৃতির ওপর এই নির্বিচার নিপীড়নের ফলে পৃথিবীর ভারসাম্য বিঘ্নিত হচ্ছে এবং মানুষের জীবন তছনছ হয়ে যাচ্ছে। মানুষের অন্তরের চঞ্চলতা থেকে সে যখন মুক্ত হবে তখন আর ভূমিকম্পের মতন দুর্যোগ তাকে বিব্রত করবেনা।

নিজেদের লালসা নিবৃত্তির জন্য প্রকৃতির সম্পদ কেড়ে নিওনা।

শুধু ভারতে নয়, বিশ্বের সকল দেশের সকল মানুষের, পৃথিবীর ভারসাম্য বজায় রাখার জন্য সচেষ্ট হয়ে উচিত। পঞ্চভূত ঈশ্বরের প্রকাশ ছাড়া আর কিছুই নয়। এই সত্য উপলব্ধি করলে এবং সেইমতো চললে তবেই মানুষের জীবন নিরাপদ হবে। কিছুদিন আগে লরী ভর্তি করে আমি গুজরাটের ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের জন্য চাল, ডাল ইত্যাদি পাঠালাম।

কিছু লোক আমাকে জিজ্ঞাসা করলো “স্বামী, এতো খরচ করে, এতো কষ্ট করে গুজরাটে ত্রাণসামগ্রী পাঠাবার কী দরকার ছিল? আপনি তো ভূমিকম্প আটকে দিলেই পারতেন। “আমি তাদের বললাম”, শোনো বাবা, ভূমিকম্পের জন্য মানুষ নিজে দায়ী। অতিরিক্ত লোভের ফলে তারা পৃথিবীর ভারসাম্য নষ্ট করছে। সেইজন্যই ভূমিকম্প হচ্ছে। এটা প্রকৃতির নিয়ম। “মানুষের প্রতি তোমাদের ভালোবাসার প্রকাশ ঘটাতে হবে। প্রেম তোমাদের স্বরূপ। প্রকৃতির ভারসাম্য বজায় থাকা যেমন প্রয়োজন, তেমনি মানুষের মধ্যে প্রেম থাকা প্রয়োজন। জেনে রেখো ঈশ্বরের সৃষ্টি তোমার মঙ্গলের জন্যই হয়েছে। প্রয়োজন অনুযায়ী প্রকৃতির সম্পদ ব্যবহার করা উচিত। নিজেদের লালসা তৃপ্তির জন্য প্রকৃতির সম্পদ কেড়ে নিওনা।

প্রয়োজন বুঝে বিজ্ঞানের ব্যবহার হয়ে উচিত।

একটা উদাহরণ দিই। একটি লোভী লোকের একটি হাঁস ছিল, যে রোজ একটা করে সোনার ডিম পাড়ত। একদিন লোকটি অনেক ডিম পাবার আশায় হাঁসের পেটটি চিরে ফেললো। এখন মানুষও এইরকম লোভী ও মূর্খের মতন আচরণ করছে। প্রকৃতি যা দিচ্ছে তাতে সন্তুষ্ট না হয়ে, সে আরো, আরো পেতে চাইছে। সেটা করতে গিয়ে মানুষ প্রকৃতির ভারসাম্য নষ্ট করে ফেলছে।

এখন বৈজ্ঞানিকেরা নিত্য নতুন আবিষ্কার করতে চায়। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অগ্রগতির ফলেও প্রকৃতির ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে। তার ফলে ভূমিকম্প হচ্ছে, সময়ে বৃষ্টি হচ্ছেনা। প্রয়োজন অনুযায়ী বিজ্ঞানের ব্যবহার হওয়া উচিত। বিজ্ঞানের কতকগুলি সীমা আছে, যা অতিক্রম করলে সেটা বিপজ্জনক হতে পারে।

তোমাদের অনেকটা পথ যেতে হবে। সত্য ও ধর্মে একনিষ্ঠ থাকো। আমাদের প্রাচীন শাস্ত্রে বলা হয়েছে ,”সত্য কথা বল, প্রিয় কথা বল ,অপ্রিয় সত্য বলা উচিত নয় “প্রাকৃতিক সম্পদগুলির যথাযথ ব্যবহার করো। তার অপব্যবহার কোরনা। সবাইকে সাহায্য করো, সবাইকে সুখী করার চেষ্টা করো। যা কিছু ভালো জিনিস শিখেছো ,তা অন্যের সঙ্গে ভাগ করে নাও। এটা তোমাদের সর্বপ্রথম কর্তব্য।

[শ্রী সত্য সাই দিব্যবাণী, ভলিউম ৩৪, অধ্যায় ৩ Vision of the Atma]

মানুষের সকল বিপত্তির মূল কারণ হল বাসনা

মানুষ যেসব আধ্যাত্মিক অনুশীলন করে সে সবেরই লক্ষ্য হলো মনকে স্থির করা। মন স্থির না হলে, অবিরাম নাম জপ, ধ্যান এবং আধ্যাত্মিক কৃচ্ছসাধন করে কোনো লাভ হয়না। পঞ্চ ইন্দ্রিয়কে বশ করতে পারলে, তোমরা ঈশ্বরের অভিজ্ঞতা লাভ করতে পারবে। তিনি তোমার থেকে দূরে নেই। তিনি তোমার মধ্যে আছেন, নিচে আছেন, ওপরে আছেন এবং তোমার চারপাশে আছেন। বস্তুতঃ ঈশ্বর মানুষের অন্তরে বাস করেন। তবুও মানুষ তাঁকে দেখতে পায়না। তার কারণ কী? মানুষের অশেষ এবং বিপথগামী বাসনাই তাকে ঈশ্বরকে দর্শন করতে বাধা দেয়।

মানুষের সকল বিপত্তির মুলে আছে তার বাসনা। ইন্দ্রিয়ের নিয়ন্ত্রণ ও বাসনার সীমিতকরণ তাকে তার চারপাশে ঈশ্বর দর্শন করতে ও আনন্দ পেতে সাহায্য করবে। সুতরাং আমাদের উচিত বাসনার রাশ টেনে রাখা। অন্যেরা মন্দ কথা বলছে বলে আমাদের বিচলিত হলে চলবেনা। বদনাম বা সমালোচনায় বিচলিত হলে চলবেনা।

পঞ্চ ইন্দ্রিয়কে নিয়ন্ত্রণ কর

বুদ্ধ পঞ্চ ইন্দ্রিয়কে নিয়ন্ত্রণ করতে চেয়েছিলেন।সর্বপ্রথমে তিনি সম্যক দৃষ্টি অর্জন করতে চেয়েছিলেন। মানুষ এখন মনের চঞ্চলতার কারণে দৃষ্টিকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনা। সিনেমা, টি, ভি, ভিডিও- এগুলি মানুষের মনকে দূষিত করে দেয়। সে ভালো জিনিস দেখা এবংগ ভালো জিনিস শোনা কোনোটাই করতে পারেনা। মানুষ নিজেই তার অশান্তির কারণ।

সম্যক দর্শন ছাড়াও বুদ্ধ সম্যক শ্রবণ, সম্যক বাক, সম্যক অনুভূতি ও সম্যক চিন্তার ওপর জোর দিয়েছিলেন। এইগুলির অভাবে মানবিকতা দ্রুত দানবিকতা ও পাশবিকতায় বদলে যাচ্ছে। মানুষের মধ্যে পাশবিক গুণ দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। পশুরা ঋতু ও নিয়ম মেনে চলে কিন্তু মানুষ কোনোটাই করেনা। মানুষ আজ নিজেকে পশুরও অধম করে ফেলেছে। তার মধ্যে মায়া, দয়া, ভালোবাসা ও সহ্যের মতন মানবিক গুণগুলি অনুপস্থিত থাকছে। মানুষকে অসৎ ভাবনা থেকে মুক্ত হতে হবে। এগুলিই তার দুশ্চিন্তার কারণ। তার জন্য সর্বদা একনিষ্ঠ অনুশীলন প্রয়োজন।

মনকে জয় করে মনের প্রভু হও

নিরন্তর ও একনিষ্ঠ প্রচেষ্টার দ্বারা মানুষ মনকে নিয়ন্ত্রণ করে শান্তি পেতে পারে। মন শান্ত হলে তবেই সেখানে মহৎ চিন্তার উদয় হতে পরে। মানুষের মনকে তার বশে রাখতে হবে। মনকে জয় করে মনের প্রভু হও। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশতঃ মনকে নিয়ন্ত্রণ না করে মানুষ নিজেই মনের দাস হয়ে গেছে। তার চঞ্চলতার এটাই প্রধান কারণ। এছাড়াও তার দেহের প্রতি আসক্তি আছে। এইজন্যই কেউ যদি তার সমালোচনা করে তাহলে মানুষ সহজেই অস্থির হয়ে যায়। দেহ যখন জলের বুদ্বুদের মতন তখন সেই দেহ নিয়ে দুশ্চিন্তা করবে কেন? দেহের প্রতি আসক্তি ত্যাগ করতে হবে।

[গ্রীষ্মকালীন শিক্ষাশিবির ২০০২, অধ্যায় ১১, Sense control is the highest sadhana]

প্রকৃতির কাছ থেকে শিক্ষা নাও

“বাসনার সীমিতকরণ” এই শব্দটির চারটি উপাদান আছে। অতিরিক্ত কথা বলা কমাতে হবে, অত্যধিক বাসনা কমাতে হবে, ব্যয় সংকোচ করতে হবে, খাদ্যের ওপর নিয়ন্ত্রণ রাখতে হবে এবং শক্তির অপচয় রোধ করতে হবে। বেঁচে থাকার জন্য মানুষের কিছু অত্যাবশ্যক সামগ্রীর প্রয়োজন আছে। তার বেশী চাওয়া ঠিক নয়।

এই বিষয়ে প্রকৃতির কাছ থেকে আমরা একটি শিক্ষা গ্রহণ করতে পারি। পর্যাপ্ত পরিমান বায়ু থাকলে তবেই তা স্বস্তি দেয় এবং সেটা উত্তম। কিন্তু বায়ুর পরিমাণ যদি খুব বেশি হয় এবং তা ঝড়ের আকার নেয়, তখম আর মানুষ স্বস্তি বোধ করেন। তেষ্টা পেলে তোমরা একটা সীমিত পরিমাণ জল খেতে পারো। গঙ্গার সমস্ত জল তো আর পান করতে পারোনা! দেহরক্ষার জন্য যতটুকু প্রয়োজন আমরা ততটুকুই গ্রহণ করতে পারি।

ডাক্তারের জানেন যে মানবদেহের স্বাভাবিক তাপমাত্রা হলো ৯৮.৬ ডিগ্রী .তাপমাত্রা যদি ৯৯ ডিগ্রীতে চলে যায়, তাহলে তাঁরা বলেন যে কোনো দৈহিক সমস্যার জন্য জ্বর এসে গেছে। আমরা স্বাভাবিক মাত্রায় শ্বাস -প্রশ্বাস নিয়ে থাকি।। তার যদি সামান্যতম হ্রাস বা বৃদ্ধি হয় ,তা দৈহিক কোনো সমস্যা সূচিত করে। রক্তচাপ বা নাড়ীর গতিতে পরিবর্তন হলেও ,কোনো সমস্যা হয়েছে এটাই ধরে নেওয়া হয়। তাহলে দেখো যে সীমা থেকে একটুও যদি বেশি হয় তাহলে তা দেহের পক্ষে বিপজ্জনক ও ক্ষতিকর হয়। সবকিছুই স্বাভাবিক ভাবে চলতে গেলে ,তাকে একটা সীমার মধ্যে থাকতে হয়। চোখের সামনে বিদ্যুৎ চমকালে বা ছবি তোলার সময় ফ্ল্যাশের ঝলকানি হলে , চোখ আপনা থেকে বন্ধ হয়ে যায়। কারণ অত আলো চোখ সহ্য করতে পারেনা। কানের পর্দাও একটি মাত্রার বেশি শব্দ সহ্য করতে পারেনা। আমরা তখন কান চাপা দিই বা কানে তুলো গুঁজি। এর থেকে আমরা এটাই দেখি যে আমাদের জীবন একটি লিমিটেড কোম্পানি।

আমাদের বাসনার একটা সীমা থাকা উচিত

একইভাবে আমাদের বাসনার একটা সীমা থাকা উচিত। মেয়েরা সাধারণতঃ দোকান থেকে বা এক্সিবিশন থেকে শাড়ি কিনে শাড়ির সম্ভার বাড়িয়েই চলে। তোমাদের একটি যুক্তিসঙ্গত সংখ্যায় শাড়ী থাকা উচিত। কেবলমাত্র আড়ম্বরের জন্য বা লোককে দেখানোর জন্য বিশাল শাড়ির সংগ্রহ থাকা ঠিক নয়। অর্থের অপচয় করা খুব খারাপ।পুরুষদের ক্ষেত্রেও যা চাইনা, বা যার প্রয়োজন নেই ,সেটা কিনে খরচ না করে ব্যয় সংকোচ করা প্রয়োজন।

অর্থ দিব্যস্বরূপ। সম্পদের ক্ষেত্রে বলতে হবে যে লোভ করে অর্থ জমানো বা বিলাসব্যাসনে অতিরিক্ত ব্যয় করা সতর্কভাবে এড়িয়ে চলতে হবে। রান্নার ক্ষেত্রেও খাবার যাতে নষ্ট না হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। প্রয়োজনের অতিরিক্ত খেলে দেহের প্রতি অন্যায় করা হয়।

তৃতীয়তঃ সময় সম্পর্কে তোমাদের সাবধান হতে হবে। সময় হলো জীবনের মাপকাঠি। সেকেন্ড থেকে ঘন্টা আসে, ঘন্টা থেকে বছর আসে, বছর থেকে যুগ আসে, ইত্যাদি। এই মহা মূল্যবান ‘সময় ‘ কখনো অপচয় করা উচিত নয়। অকাজে যে সময় নষ্ট হয়, কোনোভাবেই আর তাকে ফিরিয়ে আনা যায়না। আমাদের সমস্ত কাজ এমন পরিকল্পনা করে করতে হবে যাতে সময়ের পূর্ণ সদ্ব্যবহার হয়। সুতরাং আমাদের কখনোই অন্ন, অর্থ, সময় বা শক্তির অপচয় করা উচিত নয়।

[শ্রী সত্য সাই দিব্যবাণী, ভলিউম ১৬, অধ্যায় ৩, বাসনার সীমিতকরণ (১)]

বাসনার সীমিতকরণ প্রকল্পের লক্ষ্য

বাসনার সীমিতকরণ প্রকল্পের সঙ্গে জড়িত একটি প্রকল্প রয়েছে। এই প্রকল্পের লক্ষ্য, অর্থ, সময়, অন্ন বা অন্যান্য সম্পদগুলির অপব্যবহার বন্ধ করা এবং লোক কল্যাণের জন্য সেগুলি ব্যবহার করা। সময় নষ্ট কোরনা। সময়ের অপচয় মানে জীবনের অপচয়। কাল স্বয়ং ঈশ্বর। শুদ্ধ মনে, নিঃস্বার্থভাবে সেবা কাজ করে সময়ের ব্যবহারকে পবিত্র করে তোলো। এখন লোকে অযথা, অপ্রয়োজনীয় জিনিষে, কথা বলে, অর্থহীন কাজ করে সময় নষ্ট করে। এমন কাজ করে আমরা দেহকে সময়ের কাছে বলি দিচ্ছি। আমাদের বরঞ্চ উচিত সেই চেষ্টা করা যাতে ,কাল আমাদের কথা শুনে চলে। এর অর্থ, সৎ চিন্তা ও সৎ কাজে সময় কাটাতে হবে। তোমাদের দৈনন্দিন জীবনে ,প্রতি সেকেণ্ডে নিজেকে প্রশ্ন করতে হবে”, আমি কী ভাবে সময়কে ব্যবহার করছি ?ভালো উদ্দেশ্যে না খারাপ উদ্দেশ্যে?” ঠিক তেমনি খাদ্যের ক্ষেত্রে প্রশ্ন করতে হবে, “আমি কি আমার যতটা প্রয়োজন ততটা খাচ্ছি, না বেশি খাচ্ছি? আমি কী খাবার নষ্ট করছি?”একইভাবে অর্থ বিষয়ে প্রশ্ন হবে, “আমি কী কারণে এই অর্থ ব্যবহার করছি? নিজের স্বার্থের প্রয়োজনে, নিজের নাম ও যশ হবে বলে অথবা আমার অহংকার এবং দম্ভের তৃপ্তির জন্যে?” একবার যদি এই প্রশ্নগুলির উত্তর খুঁজতে শুরু কর, তবে তার চেয়ে উৎকৃষ্ট আধ্যাত্মিক অনুশীলন আর কিছু হতে পারেনা।

এগুলোই হলো ‘বাসনার সীমিতকরণ’ প্রকল্পের লক্ষ্য।

জীবনকে পবিত্র ও সার্থক কর

মানুষকে তিন ধরণের শক্তি দেওয়া হয়: দৈহিক শক্তি, মানসিক শক্তি এবং অর্থবল। বলা হয়েছে এই তিনটিকেই যজ্ঞে আহুতি দেবার মতন করে ব্যবহার করতে হবে। এই যজ্ঞ ঈশ্বরকে নিবেদন করার জন্য নয়। যে ঈশ্বর তোমাদের দেহ ও মন দিয়েছেন, তিনি নিজের জন্য সেগুলি চাননা। ঈশ্বর সকল সম্পদেরও উৎস। তোমাদের সম্পদে তাঁর কিসের প্রয়োজন? পবিত্র কাজে সেগুলি ব্যবহার করো। সেবা কাজের প্রকল্পগুলি এই জন্য শুরু করা হয়েছে যাতে তোমরা নিজেদের জীবনকে পবিত্র ও অর্থবহ করে তুলতে পার। ত্যাগের মনোভাব গড়ে তোলাই এর লক্ষ্য।

[শ্রী সত্য সাই দিব্যবাণী , ভলিউম ১৭, অধ্যায় ১৬: Ceiling on desires (২)]

সদা আনন্দে থাক

তোমাদের সামনে যে সমস্যাই আসুক, যে কোনো পরিস্থিতিতে তোমাদের খুশি থাকতে শিখতে হবে। তোমায় যদি বিছে কামড়ায়, তাহলে ভাবতে হবে যে, সাপে তো কামড়ায়নি; সাপে কামড়ালে নিজেকে এই স্বান্তনা দিতে হবে যে, জীবনহানি তো হয়নি। তোমাদের যদি গাড়ি না থাকে, এই ভেবে খুশি হও যে তোমার পা দুটি সক্ষম আছে এবং তুমি হাঁটতে পারছো। তোমরা যদি লাখপতি নাও হও, এটা চিন্তা করো যে নিজের ও পরিবারের অন্নসংস্থানের জন্য পর্যাপ্ত অর্থ তোমাদের কাছে আছে। এইভাবেই সব প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যেও আনন্দে থাকতে হয়।

অন্তরে যে সত্য নিহিত আছে তাকে উপলব্ধি করার জন্য মনকে সচেষ্ট ভাবে সেইদিকে নিয়ে যাও।

শান্তিপূর্ণ ও অর্থবহ জীবনযাপন করার জন্য ‘বাসনার সীমিতকরণ’ অত্যন্ত জরুরি। আরো, আরো সম্পদ লাভের বাসনাকে সংযত করতে হবে। বরঞ্চ অন্তরের সত্যকে উপলব্ধি করার জন্য সচেষ্ট হও। সেই প্রচেষ্টা করতে হলে অন্নের, অর্থের, কালের ও শক্তির এমনকি জ্ঞানেরও অপচয় করা চলবেনা। এই সবকটিই ঈশ্বরের এক একটি রূপ।

অযথা কথা না বলা উচিত কারণ তার ফলে শক্তির অপচয় হয় এবং স্মৃতিশক্তি কম হয়ে যায়।

[শ্রী সত্য সাই দিব্যবাণী, ভলিউম ২৭, অধ্যায় ২০: শিক্ষার প্রারম্ভিক আধ্যাত্মিক ভূমিকা]

একমাত্র ঈশ্বরের কৃপা থাকলে তবেই শান্তি পাওয়া যায়

আধুনিক জাগাতে প্রতিটি মানুষ শান্তি পাবার জন্য খুবচেষ্টা করছে। আধ্যাত্মিক নীতি শান্তি এনে দিতে পারেনা বা বাজার থেকেও অর্থের বিনিময়ে শান্তি পাওয়া যায়না। শাস্ত্র জ্ঞান অর্জন করে বা খুব উচ্চ পদ অধিকার করেও শান্তি পাওয়া যায়না। একমাত্র ঈশ্বরের কৃপার সাহায্যেই শান্তি পাওয়া সম্ভব।
যদিও মানুষ শান্তি পাবার জন্য খুবই আগ্রহী, কিন্তু সেই পথে তাকে বহুতর বাধার সম্মুখীন হতে হয়। যাঁরা ট্রেনে যাতায়াত করেন তাঁরা নিশ্চয়ই এই স্লোগানটির সঙ্গে খুবই পরিচিত: “সঙ্গের মালপত্র কম থাকলে আরো আরামে যাওয়া যায় ও ভ্রমণ আনন্দদায়ক হয়।” এখন মানুষ সীমাহীন বাসনার বোঝা বাড়িয়েই চলেছে। এই বাসনারূপ মালপত্র অত্যন্ত ভারী হওয়ায়, জীবনের যাত্রাপথে চলা তার পক্ষে খুবই কষ্টকর হয়ে উঠেছে। এই ভাবে দ্রুত বাসনার সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় তার ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যায়, সে নিজের লক্ষ্যের থেকে দূরে চলে যায় এমনকি পাগলও হয়ে যায়।
এই কারণেই আমি ‘বাসনার সীমিতকরণের’ প্রয়োজনের ওপর এতো গুরুত্ব দিই। বাসনাকে সীমিত করলে তোমরা কিছুটা শান্তি পেতে পারো। নিজেদের বাসনায় দাঁড়ি টানতে হবে এবং ঈশ্বরের কৃপালাভের জন্য সচেষ্ট হতে হবে।

[শ্রী সত্য সাই দিব্যবাণী, ভলিউম ৩১, অধ্যায় ১৯: Faith Love and Grace]

তোমাদের নিজেদের মন্দ চিন্তা থেকেই অসৎ গুণের জন্ম হয়

মনে করো তোমার রাগ হলো। এই রাগ কথা থেকে এলো? তোমার নিজের কাছ থেকেই এসেছে। তেমনি তোমার মনের মধ্যেই ঈর্ষা অভিব্যক্ত হয়েছে। সুতরাং প্রতিটি অসৎ গুণই তোমাদের নিজেদের চিন্তার ফসল। সুতরাং তোমরা যদি নিজেদের চিন্তাকে ঠিকমতন সামলাতে পারো, তাহলে তোমরা জীবনে সবকিছুই পেতে পারো। মন, বুদ্ধি এবং চৈতন্য আত্মার প্রতিবিম্ব। মনের কোনো স্থিরতা নেই। মন হলো চিন্তা ও বাসনার আধার। বলা হয়ে থাকে, মন একাই বন্ধন এবং মুক্তির জন্য দায়ী। সুতরাং বাসনায় কিছু সীমা রক্ষা করে মনকে সঠিক নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে।

[শ্রী সত্য সাই দিব্যবাণী ভলিউম ৪২, অধ্যায় ১: Know thyself, you will know everything]

প্রকৃতির নঞর্থক দিকটি জাগিয়ে তুলো না

মানুষকে বুঝতে হবে যে সে সমাজের একটি অঙ্গ এবং সমাজের কল্যাণ করা তার কর্তব্য। যেমন দেহের বিভিন্ন অঙ্গ প্রত্যঙ্গগুলি দেহের ভালো মন্দের খেয়াল রাখে, ঠিক তেমনি আবার সমাজ হলো প্রকৃতির অঙ্গ। এবং প্রকৃতি হলো ঈশ্বরের অঙ্গ। এইভাবে মানুষ ও ঈশ্বরের মধ্যে একটি ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বিদ্যমান। প্রকৃতি মানুষের চেয়ে অগ্রণী; প্রকৃতিকে রক্ষা করার জন্য মানুষের উচিত প্রকৃতির সম্পদগুলি ব্যবহার করার সময় সীমা রক্ষা করা। প্রকৃতির সঙ্গে হঠকারিতা করলে, প্রকৃতিতে বিরূপ প্রতিক্রিয়া হয়। তার থেকে দুর্বিপাক সৃষ্টি হয়। প্রকৃতিকে রক্ষা করার জন্য মানুষকে বাসনার সীমিতকরণ অভ্যাস করতে হবে। প্রকৃতির নঙর্থক দিকটিকে জাগিয়ে তোলা ঠিক নয়।

এই ব্যাপারে বৈজ্ঞানিকদের কোনো সচেতনতা নেই। তাদের আবিষ্কারের ফলে সমাজে যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া হতে পারে, সেটার কথা তারা চিন্তা করেনা। সমাজের কল্যাণের জন্য তাদের কোনো মাথাব্যথা নেই। ধ্বংসমূলক অস্ত্রের আবিষ্কারে তারা তাদের বুদ্ধি প্রয়োগ করে। মানুষের আরামের জন্য ব্যবস্থা করার ক্ষেত্রেও সচেতনতা থাকা প্রয়োজন; কারণ অতিরিক্ত আরাম মানুষের মনের ক্ষতি করে এবং সুখের পরিবর্তে দুঃখ নিয়ে আসে। সীমা না থাকলে কোনো ভালো জিনিষই পাওয়া যায়না। প্রযুক্তির অগ্রগতির ফলে জীবনে অতিরিক্ত আরাম এসেছে; ফলে জীবন যান্ত্রিক হয়ে পড়েছে। আধ্যাত্মিকতা নিম্নমুখী হয়েছে। বিজ্ঞান সবকিছুই টুকরো করে ফেলে; আধ্যাত্মিকতা কিন্তু বৈচিত্রের মধ্যে একতা নিয়ে আসে। বর্তমানে মানুষ কিন্তু মানবজাতির মধ্যে যাতে একতা আসে, তার জন্য চেষ্টা করছে না।

মানুষ, ঈশ্বর ও প্রকৃতির নিবিড় সম্পর্ক

সূর্যের ক্ষতিকর রশ্মির হাত থেকে ওজোনের স্তর মানুষকে রক্ষা করে। বিজ্ঞানের অগ্রগতির ফলে অনেক কল কারখানা গড়ে উঠেছে। সেখান থেকে নানারকম ক্ষতিকর গ্যাস বেরিয়ে বায়ুস্তরে গিয়ে মিশছে। এর ফলে ওজোনের স্তরটি অনেক পাতলা হয়ে গিয়েছে। এই ধারা যদি বজায় থাকে তাহলে তার পরিনাম মারাত্মক হতে পারে। যাতে ওজোন স্তরের বিভাজন রোধ করা যায়, তার জন্য বৈজ্ঞানিকেরা চেষ্টা করছেন। কিন্তু তাঁরা প্রতিষেধক খুঁজে পাচ্ছেন না।

এই অবস্থার প্রকৃত কারণ হলো যে পরিবেশে কার্বন ডাই অক্সাইড অধিক পরিমাণে ছাড়া হচ্ছে। সাধারণতঃ গাছপালা কার্বন ডাই অক্সাইড শুষে নেয় এবং আলোক সংশ্লেষের দ্বারা স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় অক্সিজেন সরবরাহ করে। বিপজ্জনক ভাবে গাছপালা কেটে ফেলার ফলে বায়ুস্তরে কার্বন ডাই অক্সাইড এর পরিমান ভালোরকম বেড়ে গিয়েছে। এর প্রতিষেধক হলো অধিক পরিমানে গাছ পোঁতা বা অরণ্যায়ন। সবজায়গায় আরো গাছের সংখ্যা বৃদ্ধি করতে হবে এবং যে গাছপালা রয়েছে অন্য কারণে সেগুলি ভূপাতিত যাতে না হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। সুতরাং মানুষ ঈশ্বর ও প্রকৃতির সম্পর্ক খুবই নিবিড়। এই কথাটি হয়তো বৈজ্ঞানিকেরা উপলব্ধি করতে পারছেন না।

[শ্রী সত্য সাই দিব্যবাণী, ভলিউম ২৬, অধ্যায় ৩: The predicament of man today]
[http://www.sathyasai.org/publications/TeachingsOfBSSSB-Vol01.html]

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।