সত্যোপলব্ধি
সত্যোপলব্ধি
ছান্দগ্য উপনিষদে উদ্দালক, আরুণি ও শ্বেতকেতুর কথা বলা হয়েছে। উদ্দালকের পুত্র শ্বেতকেতু। উদ্দালক একদিন ভাবলেন যে তার ছেলেকে তিনি আত্মবিদ্যা শেখাবেন। তিনি বললেন, “শ্বেতকেতু, তুমি ঐ যে অশ্বত্থ গাছটি দেখতে পাচ্ছ, ওর একটি বীজ নিজে এসো।” বীজটি আনার পর তিনি বললেন, “এটিকে খোলো, খুলে ভাগ করো।” বললেন, “কি দেখতে পাচ্ছ?” শ্বেতকেতু বললেন, “দেখতে পাচ্ছি বীজের ভেতর আরও অনেকগুলি বীজ রয়েছে।” উদ্দালক বললেন, “এই অনেকগুলি থেকে একটি বীজ নাও। তাকে আবার ভাঙ্গো।”
শ্বেতকেতু তাই করলেন। বললেন, “কী দেখতে পাচ্ছ।”
শ্বেতকেতু বললেন, “কিছুই দেখতে পাচ্ছি না।” বললেন, “তা কি করে হয় শ্বেতকেতু! ঐ রকম এক একটি বীজ থেকেই ঐ প্রকাণ্ড অশ্বত্থ গাছ হবে। বীজের মধ্যে কিছু দেখতে পাচ্ছনা তো কি করে এক একটি প্রকাণ্ড অশ্বত্থ গাছ হবে!”
শ্বেতকেতু বললেন, “হ্যাঁ, হবে, এটা বাস্তব। কিন্তু, আমি কিছু দেখতে পাচ্ছি না।” উদ্দালক বললেন, “শ্বেতকেতু, এটাই সত্য যে এক একটি বীজ থেকেই এক একটি অশ্বত্থ গাছ হবে। ঐ বীজটির মধ্যেই সেই সৃষ্টির রহস্য, পরম সত্যটি লুকিয়ে রয়েছে। তাকে তুমি দেখতে পাচ্ছনা কিন্তু তা সত্ত্বেও সে বর্তমান। তেমনি এই আত্মা, সেই সর্বব্যাপী আত্মা লুকিয়ে রয়েছেন, তাঁকে আমি দেখতে পাচ্ছিনা, কিন্তু দেখতে তাঁকে না পেলেও তিনি আছেন এটিই সত্য।” বলে তিনি সেই বিখ্যাত উক্তিটি করলেন, “তৎ ত্বম অসি” অর্থাৎ শ্বেতকেতু তুমি সেই-ই।”
শ্বেতকেতু বললেন, “আপনি যা বলছেন, সে কথাটা আমি বুঝতে পারলাম কিন্তু এর বেশী কিছু বুঝতে পারলাম না।”
উদ্দালক তখন বললেন, “তুমি এক কাজ করো”। এক গ্লাস জল আনতে বললেন এবং সেই জলে কয়েক টুকরো নুন দিতে বললেন। তারপর বললেন, “শ্বেতকেতু, তুমি যেখানে শোবে, সেখানে মাথার কাছে রেখে দাও। সকালবেলা এটি আমার কাছে নিয়ে আসবে।”
শ্বেতকেতু তাই করলেন। সকালবেলা নিয়ে আসার পর উদ্দালক বললেন, “শ্বেতকেতু, ঐ জল থেকে নুনগুলো আমায় তুলে দাও।”
শ্বেতকেতু বললেন, “তা কি সম্ভব! এই জলের ভেতর নুনগুলিকে তো আর দেখতেই পাওয়া যাচ্ছে না!”
উদ্দালক বললেন, “তুমি এক কাজ করো। ঐ জলের ওপর থেকে একটু জল নিয়ে খেয়ে দেখতো?”
শ্বেতকেতু খেয়ে দেখলেন ও বললেন, “এটা নোনতা খেতে।”
উদ্দালক বললেন, “মাঝখান থেকে একটু খেয়ে দেখতে সেটা কিরকম।” শ্বেতকেতু মাঝখানের একটু জল স্বাদ নিয়ে দেখলেন নোনা আবার গ্লাসের তলার জলও একটু স্বাদ নিয়ে দেখলেন নোনা। বললেন, “এর ওপর, মাঝ ও তলা—সবটাই নোনা।”
উদ্দালক বললেন, “যে আত্মার কথা তোমায় আমি বলেছিলাম শ্বেতকেতু, সেই আত্মাও সেরকম সমস্ত সৃষ্টির মধ্যে, ওপরে, নীচে এবং সবের মধ্যে ব্যাপ্ত হয়ে রয়েছেন। শ্বেতকেতু, তৎ-ত্বম্-অসি, তৎ-ত্বম্-অসি।” শ্বেতকেতু বললেন “এই যে আত্মা সর্বব্যাপী, এটাই যে সত্য, তা আমি কি করে বুঝব?”
উদ্দালক বললেন, “খুব সহজ। ধরো একটি লোককে চোখ বেঁধে একটা জায়গায় নিয়ে গিয়ে ছেড়ে দেওয়া হল। এই লোকটি কি করে নিজের বাড়ীতে ফিরতে পারবে? সে চোখের বাঁধন খুলে কাছাকাছি লোক আছে কিনা বা কোনো চেনা আছে কিনা তা দেখার চেষ্টা করবে, তারপরে যদি লোক দেখতে পায় তো তাকে জিজ্ঞাসা করবে যে আমি কোথায় আছি’ এবং সেখান থেকে নিজের বাড়ীতে ফেরার পথনির্দেশ জানতে চাইবে। হয়ত তিন/চারজন লোক তার বাড়ীর পথনির্দেশ দিতে পারবে না, আবার একজন হয়ত তাকে বাড়ীর সঠিক পথনির্দেশ দিতে পারবে। এই সঠিক পথনির্দেশ পাওয়ার পর সে যদি সঠিক পথনির্দেশ মত এগিয়ে চলে তবে সে তার বাড়ীতে পৌঁছতে পারবে। তেমনি, শ্বেতকেতু, যে জায়গা থেকে আমরা সকলে এসেছি, সেই আমাদের চিরকালীন যে বাড়ী, চিরকালীন যে আবাস, সেই বাড়ীর ঠিকানাও খুঁজে ফিরতে হয়। প্রকৃত গুরুর কাছ থেকে সেখানে ফেরার পথটি জেনে ফিরতে হয়। প্রকৃত গুরুর কাছ থেকে সেই পথ জেনে নিয়ে যদি ঠিকভাবে চলা যায় তবেই জানা যায়, তুমিই সেই, ‘তৎ ত্বম্ অসি’ শ্বেতকেতু।”
প্রশ্নঃ
- উদ্দালক শ্বেতকেতুকে কি শিক্ষা দিতে চাইলেন?
- তিনি তাকে কি আনতে বললেন?
- তিনি তাকে কি করতে বললেন?
- ।শ্বেতকেতু কিভাবে বুঝতে পারল যে ঈশ্বর সর্বব্যাপী?