শ্রী সত্য সাইবাবার জীবনী – তৃতীয় ভাগ
শ্রী সত্য সাইবাবার জীবনী – তৃতীয় ভাগ
সারা মাঘ মাস (তেলেগু ক্যালেন্ডারের এগারোতম মাস) ধরে সত্য ছোট ছেলেদের ভোর চারটের সময় আঞ্জনেয় মন্দিরে নিয়ে যেতো।
কিছু ছোট ছেলে এতই ছোট ছিলো যে তারা অতো ভোরে ঘুম থেকে উঠতে পারতো না। সেই জন্য সত্য তাদের কাছের পুকুরে বহন করে নিয়ে যেতেন ও তাদের পূন্যস্নান করাতেন যে স্নান প্রথাগত ভাবে মাঘ মাসের সঙ্গে সম্পর্ক যুক্ত এবং তারপর তাদের মন্দিরে নিয়ে যেতেন মন্দির প্রদক্ষিণ করানোর জন্য।
যখন ছোট ছেলেরা মন্দির প্রদক্ষিণ করতো, সত্য মন্দিরের মধ্যে বসে থাকতো। একদিন ছোটোরা সবাই বায়না করলো যে সত্যকেও তাদের সাথে মন্দির প্রদক্ষিণে যোগ দিতে হবে। তারা বললো, আমরা তোমাকে ছাড়া মন্দির প্রদক্ষিণ করবো না।” সত্য প্রথমে রাজি হলনা, সে বললো যে সে মন্দিরের ভিতর থেকেই তাদের লক্ষ্য করে। কিন্তু শেষে তিনি তাদের আবদারে রাজি হলেন এবং মন্দির প্রদক্ষিণ করতে শুরু করলেন।
পরবর্তী কালে এই ঘটনা উল্লেখ করার সময় স্বামী বলেন যে বিশ্বাস করো আর নাই করো, আঞ্জনেয় স্বয়ং এসেছিলেন এবং মন্দির প্রদক্ষিণ করা থেকে তাকে থামিয়েছিলেন। হনুমান বলেছিলেন, “হে প্রভু! শ্রী রাম! আমারই উচিত আপনাকে প্রদক্ষিণ করা, আপনি কখনও একাজ করবেন না।”
সব ছোট ছেলেরা সত্যকে ধরলো ও তাকে তাদের সাথে টেনে নিয়ে যাবার চেষ্টা করলো, কিন্তু তারা তাকে নড়াতে পর্যন্ত পারলোনা। তিনি তাদের বললেন, “আঞ্জনেয়কে কিন্তু ভুল বশত সাধারণ বানর ভেবোনা; সে আমাকে মন্দির প্রদক্ষিণ করার অনুমতি দেবে না।”
এই ঘটনার পরে শিশুদের মনে একটা বিরাট রূপান্তর ঘটলো। সেদিন আঞ্জনেয় মন্দিরে তারা যা প্রত্যক্ষ করেছিলো, সে অভিজ্ঞতার কথা তারা গ্রামে ঘুরে ঘুরে সব মানুষদের বলে বেড়াতে লাগলো।
সুব্বাম্মার কাছে এ খবর পৌঁছে গেলো। পরের দিন তিনি সত্যকে তার বাড়িতে ডেকে বললেন, “রাজু ,আমি কিছু দোসা বানিয়েছি, এসো এবং তা খাও।” তখনকার দিনে ইডলি ও দোসার মত খাবারকে বড়লোকদের খাবার বলে গন্য করা হত। সত্য কখনই একা খেতে রাজি হতেন না, এবং তাই তিনি সুব্বাম্মাকে বললেন যে তিনি আসবেন যদি সুব্বাম্মা সব শিশুদেরই খাওয়ান। সুব্বাম্মা তখন সব শিশুদের জন্যই দোসা বানালেন।
যখন সত্য থাকতো না, সুব্বাম্মা ছোটো ছেলেদের তার কাছে ডেকে বলতেন, “তোমরা কি জানো তোমরা কতটা ভাগ্যবান যে তোমরা রাজুকে বন্ধু হিসেবে পেয়েছো। সে কিন্তু সাধারণ ছেলে নয়। সবসময় তার নির্দেশ মেনে চলবে। কোনো পরিস্থিতিতেই কখনও তাকে অমান্য করোনা। ওকে সুখী করে তোমরাও সুখী হও। তোমরা যদি কোনো ভুল বা অন্যায় করো, সে কখনোই প্রকাশ করবে না যে সে অখুশি, কিন্তু তোমাদের কাজের পরিণতি বা ফলের মোকাবেলা তোমাদেরই করতে হবে। সুতরাং তোমরা এমন ভাবে আচরণ করবে যাতে সে কখনোই অখুশি না হয়।”
সুব্বাম্মা নিজের জীবন উৎসর্গ করেছিলেন স্বামীজীর প্রতি। তিনি সকল ভক্তদের বিনামূল্যে খাদ্য বিতরণ করতেন এবং তিনি তার জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত স্বামীজীর সেবা করে গেছেন। একদিন যখন স্বামী তার সঙ্গে গরুর গাড়ি করে ভ্রমণ করছিলেন, স্বামী তাকে জিজ্ঞেস করলেন,” সুব্বাম্মা, তুমি কি চাও?” তিনি খুব কোমল স্বরে উত্তর দিলেন, “স্বামী , আমি কিছুই চাই না, কিন্তু যখন আমি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করবো, আপনি নিজের হাতে আমার মুখে জল দিয়ে আমার জীবন পরিশুদ্ধ পবিত্র করবেন।” স্বামীজী প্রতিজ্ঞা করেছিলেন তিনি তার ইচ্ছে পূরণ করবেন।
পরবর্তী কালে, কয়েকজন ভক্তের অনুরোধে স্বামী দশদিনের জন্য চেন্নাই গিয়েছিলেন। সেই সময় বিশ্বযুদ্ধ চলছে। প্রতি ঘন্টায় বিমান আক্রমণের সাইরেন শোনা যেতো ও রাস্তাগুলি হয়ে যেতো জনমানব হীন। এই পরিস্থিতিতে স্বামীজী সময় মত পুট্টাপর্তীতে ফিরে আসতে পারলেন না। ঠিক সেই সময় সুব্বাম্মা সাংঘাতিক অসুস্থ হয়ে পরলেন। তাকে বুক্কাপট্টনম নিয়ে যাওয়া হল ও সেখানে তিনি প্রাণ ত্যাগ করলেন। তার আত্মীয়স্বজনেরা বিদ্রূপাত্মক মন্তব্য করলেন, “সাইবাবা তাকে কথা দিয়েছিলেন যে শেষ সময়ে তিনি তার মুখে জল দেবেন। তিনি কি এসেছেন? কোথায় তিনি?”
চেন্নাই থেকে ফেরার সময় স্বামীজী একটি শ্মশান ভূমির পাশ দিয়ে আসছিলেন। সেখানে একজায়গায় অনেক কাঠ স্তুপ করা ছিলো। বাবা সেখানে দাঁড়ালেন ও জিজ্ঞাসা করলেন যে কার অন্তেষ্টি ক্রিয়া সম্পন্ন হতে চলেছে। ধোপা সুবান্না বললো, “স্বামী, সুবাম্মা তিন দিন আগে মারা গেছেন। “স্বামী তার বাড়িতে যেখানে তার মৃতদেহ রাখা ছিলো সেখানে গেলেন। সুবাম্মার বোন স্বামীকে দেখা মাত্র উচ্চস্বরে কেঁদে উঠে বললো, “বাবা, তিনি আপনার প্রতীক্ষায় ছিলেন, তার প্রবল আশা ছিলো আপনি আসবেন। তিনি আকূল ভাবে চেয়েছিলেন যে শেষ সময়ে আপনি এসে তার মুখে জল দেবেন। তিনি অতৃপ্তি নিয়েই প্রাণ ত্যাগ করলেন। “স্বামীজী তখন তাকে বললেন যে এরকম ঘটনা কখনও ঘটতে পারে না। স্বামীজী একটু জল চাইলেন এবং সুব্বাম্মার মুখের ঢাকাটা খুললেন। যেহেতু তিন দিন অতিক্রান্ত হয়ে গেছে, তার সারা শরীরে পিঁপড়ে হেঁটে বেড়াচ্ছিলো। স্বামীজী স্নেহের স্বরে ডাকলেন, “সুব্বাম্মা।” তিনি চোখ মেলে তাকালেন, স্বামীজীর হাত ধরলেন এবং কাঁদলেন। তিনি তার চোখের জল মুছিয়ে দিলেন এবং বললেন,” এখন শান্তিতে তুমি চোখ বন্ধ করো।” স্বামীজী পবিত্র জল মুখে ঢাললেন এবং তার প্রতিজ্ঞা রক্ষা করলেন।
আমরা এতক্ষণ স্বামীজীর ছোট বেলার গল্প শুনছিলাম যাতে আমরা অনুভব করতে পারি যে ছাত্রাবস্থা থেকেই স্বামীজী এক আদর্শ অনুকরণীয় জীবন অতিবাহিত করেছেন। তিনি শৈশব কালে যে কষ্ট ও সমস্যার মধ্য দিয়ে গিয়েছেন, তার অন্য কোনো কারণ ছিলো না। প্রকৃত অর্থে, তিনি এসব কিছুই করেছেন এক আদর্শ উদাহরণ স্থাপন করার জন্য। সুতরাং তার শিষ্য বা অনুগামী হিসেবে, আমাদেরও ঠিক সেভাবেই জীবন অতিবাহিত করা ও আচরণ করা উচিত যাতে আমরা অর্থ ও সময় কোনোটারই অপচয় না করি এবং আমাদের মধ্যে ভালো চিন্তা ভালো অভ্যেস ও ভালো কাজের স্ফুরণ ঘটাতে পারি। স্বামীজী বলেন, “ঈশ্বরের ওপর তোমাদের জীবনের ভিত স্থাপন করো, ঈশ্বরকে সন্তুষ্ট করো ও জীবন্মুক্ত হও অর্থাৎ ঈশ্বরের মাঝে প্রকৃত মুক্তি খুঁজে পাও।”