ভীষ্মের প্রতিজ্ঞা
ভীষ্মের প্রতিজ্ঞা
বহুকাল আগের কথা। তখন আমাদের এই দেশের নাম ছিল “মহা-ভারত”, কারণ এদেশ তখন বহু বীরের জন্ম দিয়েছিল এবং তাদের বীর কীর্তি সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়েছিল। পাণ্ডব ও কৌরব বংশের ছেলেরা পরস্পর ছিল খুড়তুতো ভাই, পিতামহ ভীষ্ম ছিলেন এদের সকলের অভিভাবক। সকলেই তাকে ভালবাসত ও শ্রদ্ধা করত। তিনি নিজে রাজা ছিলেন না, কিন্তু তিনি রাজা তৈরী করতেন ও রাজাদের চালাতেন। তিনি রাজবংশে জন্মেও নিজের ইচ্ছাতে সিংহাসন ত্যাগ করেছিলেন। ঘটনাটা ছিল এই রকম। তিনি ছিলেন পিতা রাজা শান্তনুর একমাত্র পুত্র। সিংহাসনের উত্তরাধিকারী হিসেবে বীর যোদ্ধা হিসেবে তাকে গড়ে তোলা হয়েছিল। ভীষ্ম তখন যুবক। তার পিতা শান্তনু কিভাবে যেন জেলেদের রাজার মেয়ে সত্যবতীকে পছন্দ করলেন ও বিয়ে করতে চাইলেন।
জেলেদের রাজা খুবই ভাল হলেও নিজেদের জাতের বাইরের কারও সঙ্গে মেয়ের বিয়ে দিতে ইচ্ছুক ছিলেন না। কারণ এতে নিজের বংশের অমর্যাদা করা। হবে। তাছাড়া রাজা শান্তনুর সঙ্গে বিয়ে হলে তার মেয়ে রাজপ্রাসাদে থাকতে পারবে কিন্তু কেউই তাকে রাণী বলে শ্রদ্ধা করবে না, কারণ তার ছেলে রাজা হতে পারবে না। রাজা হবে বড় ছেলে সত্যব্রত অর্থাৎ ভীষ্ম। তিনি শান্তনুকে বললেন যে সত্যব্রতের জায়গায় সত্যবতীর ছেলেকে যুবরাজ করতে রাজী হলে তিনি মেয়ের বিয়ে দিতে পারেন।
জেলেদের রাজার এই প্রস্তাব শান্তনু মেনে নিতে পারলেন না। কিন্তু রাজপ্রাসাদে ফিরে এসে সত্যবতীকে ভুলতে পারলেন না। মনের দুঃখ চেপে রাখলেন। সত্যব্রতের চোখে তার বাবার মনের দুঃখ ধরা পড়ল। খোঁজ নিয়ে বাবার মনের দুঃখের কারণ জানতে পারলেন।
জেলেদের রাজার সঙ্গে দেখা করে তিনি প্রতিজ্ঞা করলেন যে যদি সত্যবর্তীকে তার বাবা শান্তনুর সঙ্গে বিয়ে দেওয়া হয় তাহলে তাদের ছেলেকেই রাজা করবেন, নিজে রাজত্ব ত্যাগ করবেন। কিন্তু জেলেদের রাজা বললন, আপনি রাজত্ব ছাড়তে রাজী হলেন এতে আমার পূর্ণ বিশ্বাস আছে। কিন্তু আপনি বিয়ে করবেন, আপনার ছেলে কি রাজত্ব ছাড়তে রাজী হবেন?” ভীষ্ম তার কথা যুক্তিযুক্ত বলে মনে করে বললেন, “আমি প্রতিজ্ঞা করছি, আমি এ জীবনে কখনই বিয়ে করব না। তাহলে ত আপনার নাতির রাজা হওয়া আটকাবে না? এবার দয়া করে রাজী হয়ে আপনার কন্যা সত্যবতীকে আমার সঙ্গে দিন। আমি তাকে নিয়ে বাবার সঙ্গে বিয়ে দেব। এই দুইটি কঠিন প্রতিজ্ঞার জন্যে সত্যব্রতের নাম ভীষ্ম হয়েছিল অর্থাৎ যিনি ভীষণ প্রতিজ্ঞা করেছেন।
সত্যবতীকে ভীষ্মের সামনে আনা হলে ভীষ্ম তাকে মা বলে ডেকে প্রণাম করলেন ও সম্মানের সঙ্গে রথে চড়িয়ে পিতার কাছে নিয়ে এলেন। শাস্তনু সব কথা শুনে ছেলে ভীষ্মকে আশীর্বাদ করলেন, “কেউই তোমায় যুদ্ধে হারাতে পারবে না। তোমার ইচ্ছামৃত্যু হবে অর্থাৎ নিজে না চাইলে তোমার মৃত্যু হবে না।” পিতামাতার আশীর্বাদ সবসময় সত্যি হয়, তাই ভীষ্মও ইচ্ছামৃত্যু লাভ করলেন।
সেদিন হতে ভীষ্ম সন্ন্যাসীর জীবন কাটাতে লাগলেন। কালক্রমে সত্যবতীর চিত্রাঙ্গদ ও বিচিত্রবীর্য নামে দুই ছেলের জন্ম হল এবং শান্তনুর মৃত্যু হল। এদিকে গন্ধর্বের সঙ্গে যুদ্ধে চিত্রাঙ্গদের মৃত্যু হল। তখন বিচিত্রবীর্যকে সিংহাসনে বসিয়ে ভীষ্ম রাজ্য শাসন করতে লাগলেন। ক্রমে বালক বিচিত্রবীর্য বড় হলে তার বিয়ে দিতে চাইলেন। তাই মাতা সত্যবতীর অনুমতি নিয়ে কাশী রাজার তিন মেয়ের স্বয়ংবর সভায় উপস্থিত হলেন। ভীষ্মকে স্বয়ংবর সভায় উপস্থিত দেখে সকলের মনে হল তিনি নিজের বিয়ের জন্যে এসেছেন। তাই সকলে তার বন্দনা ও গুণকীর্তন করতে লাগলেন। এই অবসরে তিনি তিন কন্যাকে জোর করে রথে তুলে নিয়ে এসে তার ভাই বিচিত্রবীর্যের সঙ্গে বিয়ে দিতে চাইলেন। উপস্থিত সকল রাজা ভীষ্মকে বাধা দিতে এলে সকলকে পরাজিত করলেন। পরাজিত রাজাদের ভিতর সৌভরাজ শাল্ব ছিলেন।
রাজপ্রাসাদে এলে কাশী রাজার তিন কন্যার ভিতর জ্যেষ্ঠা কন্যা বললেন যে তিনি আগেই মনে মনে শাল্ব রাজাকে পতিরূপে বরণ করেছেন। শাল্ব রাজাও তাকে পত্নী বলে গ্রহণ করেছেন। তাই তার পক্ষে বিচিত্রবীর্যকে বিয়ে করা সম্ভব। নয়। তখন ভীষ্ম জ্যেষ্ঠ কন্যা অম্বাকে ছেড়ে দিয়ে অন্য দুই কন্যা অম্বিকা ও অম্বালিকার সঙ্গে ছোট ভাই বিচিত্রবীর্যের বিয়ে দিলেন।
কিন্তু অতি অল্প বয়েসে বিচিত্রবীর্য যক্ষ্মা রোগে প্রাণত্যাগ করলেন। তখন সত্যবতী ভীষ্মকে রাজা হবার জন্যে ও বিয়ে করে বংশ রক্ষা করবার জন্যে অনুরোধ করলেন। পিতা জেলেদের রাজার কাছে দেওয়া প্রতিজ্ঞা হতেও সত্যবতী ভীষ্মকে মুক্ত করে দিলেন। কিন্তু ভীষ্ম কিছুতেই নিজের প্রতিজ্ঞা ভাঙতে রাজী হলেন না।
ভীষ্ম বহু বছর বেঁচে ছিলেন এবং কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের পর একটি শুভদিন বেছে নিয়ে ইচ্ছামৃত্যু বরণ করলেন।