জৈনধর্ম

Print Friendly, PDF & Email
জৈনধর্ম

জৈনধর্ম, যা হিন্দু ধর্মেরই একটি অনুসারী ধর্ম, ভগবান মহাবীরের দ্বারা প্রবর্তিত হয়েছিল ৮০০ খ্রিস্টপূর্বে। যদিও জৈনধর্ম হল আর্যধর্ম, এই ধর্ম বেদের কর্তৃত্ব ও প্রভুত্ব মেনে নেয়নি।

প্রায় খ্রিস্টপূর্ব অষ্টম শতাব্দীতে এক দল আর্য বেদ প্রবর্তিত কিছু শিক্ষা বিধির এবং হিন্দু ধর্মের কিছু আচার ও ক্রিয়া কান্ডের বিরোধীতা করেছিল। পার্থিব সমৃদ্ধি অর্জনের জন্য ও স্বর্গে প্রবেশের অনুমতি পাবার জন্য পশুবলীকে মেনে নিতে তারা রাজী হলনা। তারা এই ধারনা পোষণ করে যে প্রতিটি প্রাণীই পবিত্র এবং যজ্ঞের নামে নিরপরাধ পশুদের হত্যা করা পাপ। যে ধর্মীয় ঐতিহ্য তখন সর্বত্র প্রচলিত ছিল তারা তার বিরোধিতা করেছিলো।

কঠিন শৃঙ্খলাবদ্ধ ও সরল জীবনযাপনের ওপর‌ই তারা বেশী জোর দিয়েছে এবং তারা অনুভব করেছিলো মানুষকে তার পাশবিক প্রবণতাকে অবশ্যই দমন করা উচিত। কিছুদিনের মধ্যেই সেই সব মানুষেরা যারা এই মনোভাব পোষণ করতো তারা বর্ধমান মহাবীরের শিষ্যত্ব গ্রহণ করে একত্রিত হল এবং এভাবেই সৃষ্টি হল আর একটি ধর্মমত, যাকে বলা হয় জৈনধর্ম। এই মহান ধর্মের শিকড় খুঁজে পাওয়া যায় অনেক প্রাচীন কালে এবং এর উৎস যুক্ত রয়েছে ‘ঋষভদেব’ এই নামের সাথে যিনি একজন মহান রাজা ছিলেন এবং যিনি পরবর্তীতে একজন মহান ও সর্বশ্রেষ্ঠ তপস্বীতে রূপান্তরিত হয়েছিলেন।

জৈনধর্মে তীর্থঙ্কর শব্দটির মানে হল এমন একজন যে সংসার সমুদ্র পার হবার জন্য একটি ভেলা প্রদান করে (অর্থাৎ যারা মুক্তির পথ আবিষ্কার করেছেন ও এবং অন্যদের সেই মুক্তির পথের ঠিকানা বলে দেন।) এই ভেলাই হল ধর্ম। এরকম বিশ্বাস করা হয় যে ঋষভদেবই ছিলেন প্রথম তীর্থঙ্কর, ২৩ তম তীর্থঙ্কর হলেন পার্শ্বভনাথ। জৈন তীর্থঙ্করগণের মধ্যে বর্ধমান মহাবীর হলেন ২৪তম ও সর্বশেষ তীর্থঙ্কর।

মহাবীরকে জিন বলেও সম্বোধন করা হয়, জিন অর্থাৎ বিজয়ী, যিনি পার্থিব রাজ্য জয় করেননি কিন্তু আধ্যাত্মিক রাজ্য জয় করেছেন। তিনি নিজের আত্মাকে, ইন্দ্রিয়সমুহকে ও পার্থিব কামনাবাসনাকে জয় করেছেন। জৈনরা বিশ্বাস করে যে সর্বোচ্চ বা শ্রেষ্ঠ মানব হল একজন’ সিদ্ধ’– সে হল সেই আত্মা যে মুক্তি বা মোক্ষ লাভ করেছে।

বর্ধমান মহাবীরের জীবনী

বর্ধমান মহাবীর বৈশালী রাজ্যের রাজা সিদ্ধার্থ ও রাণী ত্রিশলা দেবীর পুত্র হিসাবে অর্থাৎ ক্ষত্রিয় রাজপুত্র হিসেবে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। শৈশবে বর্ধমান সাহসের সঙ্গে অনেক বীরত্বপূর্ণ কাজ করেছিলেন এবং সেই কারণে তাকে একজন সাহসী মানুষ বা মহাবীর নামে ডাকা হত। বিলাসবহুল জীবন যাপনে মহাবীরের কোনো উৎসাহ ছিলো না। তার মন সবসময় মানুষের দুঃখ কষ্ট ও কিভাবে তারা এই কষ্ট থেকে মুক্তি পাবে, এই নিয়েই ভাবিত ছিলো। তিরিশ বছর বয়সে তিনি সংসার ত্যাগ করেন। ১২ বছর কঠিন নিয়মানুবর্তিতা ও সাধনার পর অবশেষে তার মধ্যে জ্ঞানের বিকাশ ঘটলো। মানুষের দুঃখ কষ্টের কারণ ও তা থেকে মুক্তির উপায় তিনি জানতে পারলেন এবং জৈন দর্শনে তিনি তা প্রচার করলেন। তার শিক্ষার চূড়ান্ত উদ্দেশ্য হল জন্ম জীবন ও মৃত্যুর আবর্ত থেকে পুরোপুরি মুক্তি এবং একটি চিরন্তন শান্তিপূর্ণ অবস্থা অর্জন করা। এই অবস্থাটি মোক্ষ (নির্বাণ) নামেও পরিচিত। তার জীবনের বাকি তিরিশ বছর তিনি ধর্মপ্রচার করেছেন এবং অনেক মানুষকে তার শিষ্যত্বে বরণ করে নিয়েছেন। ৭২ বছর বয়সে বিহারের পাবাপুরিতে তিনি নির্বাণ বা মোক্ষ লাভ করেন। তিনি রেখে গেলেন সুদৃঢ় ভাবে সংগঠিত জৈন সম্প্রদায় যা সমগ্র ভারতে ক্রমশ প্রসারিত ও সমৃদ্ধ হয়ে ওঠে।

জৈন ধর্মের দর্শন

জৈনরা বিশ্বাস করে যে যখন মানুষ তার কর্ম থেকে মুক্ত হয়, সে তখন কেবল জ্ঞান বা চূড়ান্ত জ্ঞান অর্জন করে। জন্মমৃত্যুর আবর্ত থেকে নিজেকে মুক্ত করতে হলে মানুষকে অবশ্যই কিছু নিয়ম বা অনুশাসন মেনে চলতে হবে। সন্ন্যাসীদের জন্য যে নিয়ম তা খুবই কঠিন। কিন্তু গৃহী বা সাধারণ মানুষের জন্য তা অনেকটাই উদার।
সেগুলি হল:

  1. অহিংসা: প্রতিটি বস্তুতেই প্রাণ বা আত্মা রয়েছে এবং তাই একজন কখনোই কোনো প্রাণীকে আঘাত করবে না কিন্তু তাদের প্রতি সদর্থক দয়া প্রদর্শন করবে।
  2. সত্য: একজন অবশ্যই সত্যকথা বলবে।
  3. অস্তেয়: একজনের অবশ্যই চুরি করা উচিত নয়। এমনকি চুরি করার চিন্তাও পাপ।
  4. অপরিগ্রহ: একজন মানুষ অবশ্যই লোভী হবেনা এবং অর্থ সঞ্চয়ে মনোযোগী হবে না ও লোকচক্ষুর আড়ালে তা পুঞ্জীভূত করবেনা। একজনের ততটুকুই থাকা উচিত যতটুকু তার বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজন।
  5. ব্রহ্মচর্য: চিন্তা, বাক্য ও কর্মে অবশ্যই একজনকে শুদ্ধ ও পবিত্র হতে হবে।

জৈনধর্ম জীবনের তিনটি মূল্যবান রত্ন বা শিক্ষা প্রচার করে:

  1. সঠিক জ্ঞান (সম্যক জ্ঞান)
  2. সঠিক দৃষ্টি (সম্যক দর্শন)
  3. সঠিক আচরণ (সম্যক চরিত্র)

এই তিনটি নীতি বা ঈশ্বরের আদেশ অনুসরণ মানুষকে সমস্ত দুঃখ যন্ত্রণা থেকে মুক্তির পথে, মোক্ষের পথে পরিচালিত করে। জৈন ধর্ম এমন একটা ধর্ম যেখানে প্রতিটি প্রাণকে শ্রদ্ধার যোগ্য বলে বিবেচনা করা হয় এবং এই ধর্ম অনুবীক্ষণ যন্ত্রের সাহায্যে শুধু দেখা যায় এরকম ক্ষুদ্র জীবের রক্ষণাবেক্ষণকে প্রকাশ্যে সমর্থন করে ও তাদের জীবন যাপনেও এই অভ্যেস পালন করে। জৈন সন্ন্যাসীরা এই সব অতি ক্ষুদ্র প্রাণীদের নিঃশ্বাসের শরীরে গ্রহণ করা ও তাদের ক্ষতি সাধন করা থেকে নিজেদের বিরত করার জন্য প্রায়ই মুখে মাস্ক বা মুখবন্ধনী পরেন। তারা খালি পায়ে হাঁটেন কারণ পদদলিত হয়ে অতি ক্ষুদ্র প্রাণীরা আহত বা নিহত হতে পারে।

অনেক বছর বা সময় ধরে জৈন ধর্মগ্রন্থ লিপিবদ্ধ করা হয়েছে কিন্তু বহুল পরিচিত গ্রন্থ হল ১৮০০ বছর আগে পন্ডিত সন্ন্যাসী উমাসাথী বা উমাস্বামীর লেখা ‘তত্ত্ববার্তাসূত্র’ বা প্রকৃত সত্যের ব‌ই।

জৈন ধর্মের প্রতীক (নিচে দেখানো হয়েছে) হল যৌগিক বা মিশ্র, জৈন ধর্মের সাথে তাৎপর্যপূর্ণ এরকম অনেকগুলি প্রতীকের সমাহারে তা তৈরি হয়েছে। প্রতীকটি জৈন ধর্মের মূল বাণী বা শিক্ষাকে পরিবেষ্টন করে রয়েছে।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: