ইসলাম

Print Friendly, PDF & Email
ইসলাম

ইসলাম হল একটি ধর্মাচারণ বা ধর্ম ব‍্যবস্থা যার প্রবর্তক ছিলেন নবী মহম্মদ। আরবী ভাষায় ইসলাম মানে হল ‘সমর্পণ’ বা ‘আত্মনিবেদন’।

মহম্মদ ৫১০ খ্রিস্টাব্দে মক্কাতে জন্মগ্রহণ করেন। সেই সময়, আরব দেশের অবস্থা ছিলো বিশৃঙ্খলা ও বিভ্রান্তিতে পূর্ণ। দেশটি বেশ কিছু উপজাতি ও গোষ্ঠীতে বিভক্ত ছিলো এবং তাদের মধ্যে সবসময় যুদ্ধ বিগ্রহ লেগে থাকতো। মহম্মদের বাবা আবদুল্লাহ তার জন্মের দুই মাস আগেই মারা যান। তার বয়স যখন ছয় বছর তখন তিনি তার মা আমিনাকে হারান। তার ঠাকুরদা তাকে লালন পালন করেন এবং পরে তার কাকা তার দেখাশুনা করেন।

মহম্মদ কোনো প্রথাগত শিক্ষা গ্রহণ করেন নি। তার কাকার ভেড়ার পাল চরাবার জন্য তাকে মাঝে মাঝেই মরুভূমিতে যেতে হত। তিনি ছিলেন এতটাই সৎ, ন‍্যায়পরায়ণ ও সত‍্যনিষ্ঠ যে লোকেরা তাকে ‘অল-আমিন’ (নির্ভরযোগ্য) বলে সম্বোধন করতো।

মহম্মদের যখন ২৫ বছর বয়স, তিনি খাদিজা নামে একজন ধনী বিধবা মহিলাকে বিবাহ করেন। কিন্তু বিবাহের পর তিনি ব‍্যবসায় বেশি মনযোগ দিলেন না। তিনি হীরা পাহাড়ের নিভৃত গুহায় চলে যেতেন এবং তিনি প্রার্থনা ও ধ‍্যানে তার সময় অতিবাহিত করতেন। যখন তার চল্লিশ বছর বয়স তখন থেকেই তিনি দিব‍্য মহিমার প্রকাশ উপলব্ধি করতে শুরু করেছিলেন। দেবদূত গ‍্যাব্রিয়েল তাকে বলেছিলেন যে একতা ও ঈশ্বরের শ্রেষ্ঠত্ব ও প্রভুত্বের বার্তা প্রচার করার জন্য এবং নৈতিক অবক্ষয় থেকে মানুষকে উন্নিত করার জন্য ঈশ্বর তাকে নির্বাচন করেছেন।

যখন তিনি মূর্তি পূজা ও তার দেশবাসীর অন্ধবিশ্বাসে পূর্ণ রীতিনীতির বিরোধিতা করতে শুরু করলেন, মক্কা বাসীরা তার উপর ভীষণ অত‍্যাচার শুরু করে দিল এবং তাকে পাগল ও যাদুকর অপবাদ দিলো। মহম্মদকে অবর্ণনীয় কষ্ট সহ্য করতে হয়েছিলো। অত‍্যাচার যখন অসহনীয় হয়ে উঠলো, তিনি মদিনায় পালিয়ে গেলেন এবং সেখানে মানুষ তাকে উষ্ণ স্বাগত জানাল, বরণ করে নিল এবং অনেকে তার নতুন বিশ্বাস বা ধর্ম গ্রহণ করলো।

মহম্মদের জনপ্রিয়তা দিনে দিনে বাড়তে থাকে ও একসময় তিনি নগরের ও পরাক্রমশালী উপজাতিদের শাসকে পরিণত হন। তিনি মক্কাবাসীর বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়ে এবং কোনরকম রক্তপাত ছাড়াই মক্কা জয় করেন। মক্কায় তীর্থযাত্রা থেকে ফিরে এসে ৬৩২ খ্রীস্টাব্দে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত‍্যাগ করেন।

মহম্মদ যে আলো জ্বালিয়েছিলেন তা সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়লো এবং প্রায় ৭০০ লক্ষ অনুগামী সমেত ইসলাম ধর্ম পৃথিবীর মুখ্য ধর্মগুলির মধ্যে একটিতে পরিণত হল।

মহম্মদের পুরো জীবনটাই হল সহজ, সরল ও অনাড়ম্বর। তা মানবজাতির প্রতি সেবার প্রকৃষ্ট ও অনন্য উদাহরণ। ভদ্রতা, দয়া, করুণা, সরলতা, মানবিকতা, সহানুভূতি ও নিষ্ঠা ছিল তার চরিত্রের মূল সুর বা চাবিকাঠি। তার মনগ্রাহী ও সুন্দর আচরণের মধ্য দিয়ে তিনি তার অসংখ্য অনুগামীদের ভক্তি ও ভালোবাসা অর্জন করেছিলেন। তিনি যা উপদেশ দিতেন তা নিজের জীবনেও পালন করতেন।

পবিত্র কোরান এবং হাদিস

কোরান ইসলামদের পবিত্র ধর্ম গ্রন্থ। নবী মহম্মদের কাছে এর মহিমা প্রকাশিত হয়েছিলো দেবদূত গ‍্যাব্রিয়েলের দ্বারা। কাব‍্যের শুরুর কিছু বার্তা বা নিদর্শন ছাড়া এবং আরও কিছু অংশ ছাড়া যেখানে নবী বা দেবদূত উত্তম পুরুষ হয়ে কথা বলছে, এখানে গ্রন্থের পুরোটা জুড়েই বক্তা হলেন ঈশ্বর । আরবী ভাষায় কোরান অর্থ হল ‘আবৃত্তি বা বর্ণনা’। এই গ্রন্থ পথ প্রদর্শনকারী আলোর ন‍্যায় কাজ করে, ধর্মপ্রাণ মানুষদের অনুপ্রাণিত করে ও সঠিক পথে পরিচালিত করে। এটি মানুষকে বলে তার নিজের কি রকম আচরণ করা উচিত। ‘মুসলিম’ শব্দটির অর্থ হল ‘ধর্মপ্রাণ বা ধার্মিক’।

বেদের মত‌ই, প্রথমে কোরানের জন্ম হয় শ্রুতির মাধ্যমে অর্থাৎ পরম্পরা গত শ্রবণের মাধ্যমেই তা সংরক্ষিত ছিল কিন্তু মহম্মদের মৃত্যুর পর, তিরিশটি অধ‍্যায়ে এটি সংকলিত হয় ও লিপিবদ্ধ হয়।

শিক্ষাঃ

একজনই ঈশ্বর, তিনি আল্লাহ। একজন‌ই পরমেশ্বর, আল্লাহ, সকলের, সব প্রাণের সৃষ্টিকর্তা ও পালনকর্তা, তিনি অদ্বিতীয়, একা ও উপাসনার বা পূজিত হবার যোগ্য। তিনি যে শুধু সর্বত্র বিরাজমান তাই নয়, তিনি সর্বজ্ঞ, সর্বশক্তিমান, সদা ক্ষমাশীল, সবচেয়ে স্নেহপ্রবন, সবচেয়ে করুণাময়। আল্লাহকে পূজো করার অর্থ হল তাকে ভালোবাসা, তাকে জানা, জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে তার নিয়মনীতি অনুসারে কাজ করা, মানবজাতির সেবার মধ্য দিয়ে তার সেবা করা। কোরান বলে ধার্মিক হল সেই মানুষটি যে ঈশ্বরে বিশ্বাস করে, শেষের দিন সেই নবীরা ও দেবদূতেরা যারা তাদের ঐশ্বর্য গরীবদের বিলিয়ে দেয়, যারা ক্রীতদাসদের মুক্ত করে, যারা প্রার্থনায় একনিষ্ঠ এবং যাদের দানধ‍্যানের অভ‍্যেস রয়েছে, প্রতিকুলতার ও দুঃখ কষ্টে ও চরম ক্লান্তির মধ্যেও যারা স্থির, ধৈর্যশীল,- তারাই প্রকৃত অর্থে ধার্মিক। এরকম মানুষ হল তারা, যারা নিষ্ঠাবান ও যাদের ঈশ্বরভীতি রয়েছে। ইসলামের মূল নীতিগুলি (পাঁচটি স্তম্ভ) নিম্ন লিখিত:

  1. একজনই মাত্র ঈশ্বর রয়েছেন এবং মহম্মদ হলেন তার দূত বা বার্তাবাহক। প্রত‍্যেকে তার ভালো ও মন্দ কাজের জন্য দায়ী। ইসলাম বিশ্বাস করে শেষ বিচারে যখন প্রত‍্যেকে তাদের পার্থিব জীবনযাত্রা ও কাজকর্মের জন্য পুরস্কার বা শাস্তি পাবে।
  2. একজন মুসলিম অবশ‍্য‌ই দিনে পাঁচবার প্রার্থনা (নামাজ) করবে, ভোরে, দুপুরে, বিকেলে, সন্ধ্যায় ও রাতে। তারা একা বা দলবদ্ধ হয়ে প্রার্থনা করতে পারে। মহম্মদের জন্মস্থান মক্কা যেদিকে সেদিকে মুখ করে তারা প্রার্থনা করবে।
  3. রমজানের পবিত্র মাসে সে ভোর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত উপবাস পালন করবে। রামাদান অথবা চন্দ্র বছরের নবম মাস খুব পবিত্র কারণ মুসলিমগন বিশ্বাস করে যে এই পবিত্র মাস চলাকালীন ঈশ্বর নবীর কাছে কোরানের শ্লোক উন্মোচিত করেন বা প্রকাশিত করেন।
  4. তাকে অবশ্যই জাকাত (গরীব ও অভাবীদের প্রতি দয়া ও দান) দিতে হবে। জাকাত দেওয়াকে পূজো বলে গণ্য করা হয় কারণ যে মানুষটি ঈশ্বরের দয়ায় পার্থিব স্বাচ্ছন্দ অর্জন করেছে সে এই দানের মধ্য দিয়ে ঈশ্বরের প্রতি ধন্যবাদ নিবেদন বা কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করে।
  5. যদি সম্ভব হয় , জীবনে অন্তত একবার মক্কায় তীর্থযাত্রা (হজ) করতে যাওয়া উচিত।

এছাড়াও, কোরান সকল মুসলিম সম্প্রদায়কে অনুরোধ করেছে প্রতিবেশীদের ভালোবাসতে, সঠিক ও ভদ্র আচরণ করতে, সততার সাথে ব‍্যাবসা বাণিজ্য করতে এবং মাদকাসক্তদের উপেক্ষা করতে।

আল্লাহ ও শান্তির প্রতি সমর্পণ হল ইসলাম ধর্মের মূল সুর বা মূল কথা। একজন মুসলিমের অভিবাদন বা সম্ভাষণের প্রকাশ মাধ্যম হল ‘ অস- সালাম- আলায়িকুম’ (আপনার মধ্যে শান্তি বিরাজ করুক) এবং যাকে অভিবাদন করা হল তার প্রত‍্যুত্তর হল ‘অ- আলায়িকুম আস্‌সালাম’ (আপনার মধ‍্যেও শান্তি বিরাজ করুক)। কোরান মানুষকে অনুপ্রাণিত করেছে ঈশ্বরের প্রতি তার জীবনকে উৎসর্গ করতে ও উপলব্ধি করতে যে আমরা ঈশ্বরের সন্তান ও ঈশ্বরের কাছেই আমরা ফিরে যাবো।

মক্কার কাবা একটি ঘনক্ষেত্র আকারের পাথর যা সেই মহান মসজিদের আঙিনায় রয়েছে।এটি একটি কালো কাপড়ে ঢাকা যে কাপড়টি শুচিশিল্পের দ্বারা কোরানের শ্লোকে অলংকৃত।

অর্ধচন্দ্র ও তারা ইসলাম সংস্কৃতির প্রতীক হিসেবে গণ্য হয়। তারার পাঁচটি তীক্ষ্ণ কোণকে ইসলাম ধর্মের পাঁচটি স্তম্ভ হিসেবে গণ্য করা হয়। মুসলিম চন্দ্র মাসে অর্ধচন্দ্রের একটি মুখ্য ভূমিকা রয়েছে। রামাদানের উপবাস পর্বের শুরু ও শেষের ইঙ্গিত দেয় এই অর্ধচন্দ্র।

সুফিবাদ

সুফিবাদের উৎস‌ও ইসলাম ধর্ম। এটি ঈশ্বরকে ভালোবাসার ধর্ম। হিন্দু ধর্মের অনেক বৈশিষ্ট্য এখানে দেখতে পাওয়া যায়। তারা বিশ্বাস করে ঈশ্বর সর্বত্র বিরাজমান। একজন সুফি কাউকে প্রত‍্যাখ‍্যান বা ঘৃণা করেনা , এমনকি একজন নাস্তিককেও নয়। তার কাছে, সবাই ঈশ্বর। সুফি সাধকেরা ভারতবর্ষে হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে ঐক্য গড়ে তোলার চেষ্টা করেছে। সবচেয়ে জনপ্রিয় সুফি সন্তরা হলেন, ১) বাবা ফারিদ গুঞ্জ শাকার, ২)নিজামুদ্দিন আউয়ালিয়া, ৩)বাবা নুরুদ্দীন। সুফি সন্তরা সব ধর্মের মূল ও অন্তর্নিহিত একতা বা মিলকে ঘোষণা করেন।

উপসংহার

ঈশ্বরের সাম্রাজ্যে সকল ধর্মমতই মানব কল্যানে রত এক একটি শক্তি, তারা পরস্পরবিরোধী নয়, বরং একে অপরের পরিপূরক। ধর্মমত যাই হোক, এর লক্ষ্য হল একজন মানুষকে অধিকতর ভালো মানুষে পরিণত করা এবং তাকে সাহায্য করা যাতে সে জীবনের চরম লক্ষ্যকে খুঁজে পায়, পরম পূর্ণতায় মুক্তি বা মোক্ষ লাভ করে।

সব ধর্মের মূল শিক্ষা বা বাণী হল ‘মানবজাতির ভ্রাতৃত্ব ও ঈশ্বরের পিতৃত্ব।’

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: