তস্মাদসক্তঃ সততং

Print Friendly, PDF & Email
তস্মাদসক্তঃ সততং —বিশদ পাঠ

এই শ্লোকটিতে কৃষ্ণ বলছেন যে, “কোনরকম আসক্তি ছাড়া নিজেদের কর্তব্য পালন কর। অনাসক্ত হয়ে কর্তব্য করলে মানুষ পরমাত্মাকে লাভ করতে পারে।

আসক্তি ত্যাগ করার অর্থ বাসনা ত্যাগ করা। আসক্তি আমাদের বাসনার দিকে নিয়ে যায়। কিন্ত যদি সতর্ক ভাবে, সঠিক ভাবে, দক্ষতার সঙ্গে, ফলের আশা না করে কর্তব্য করতে পারি, তাহলে আমরা মানসিক শান্তি লাভ করব।

এক্ষেত্রে কর্মযোগী রাজা জনকের উদাহরণই শ্রেষ্ঠ। তিনি নিখুঁতভাবে রাজার কর্তব্য পালন করছিলেন। একই সঙ্গে তিনি ছিলেন একজন যোগী। কর্মফলের প্রতি তাঁর বিন্দুমাত্র আগ্রহ ছিল না।তাঁর মনে সাম্য ছিল। তিনি সর্বদা ঈশ্বরকে স্মরণ করে ধার্মিক জীবন যাপন করতেন।

যে কাজ নির্মল মানসিকতার সঙ্গে ভালবাসা নিয়ে, কর্তব্যবোধে করা হয়, তা আমাদের হৃদয়কে বিকশিত করে তোলে। আমাদের চৈতন্যের পরিসর বাড়ে ও গভীর হয়। আমাদের মধ্যে যে স্বার্থপরতা সুপ্ত থাকে, তার নাশ হয়। এমন ব্যক্তি তার ধনরাশি, দক্ষতা ও বুদ্ধি এবং পদমর্যাদা ও সামাজিক অবস্থান অন্যের জন্য বিলিয়ে দেয়। তিনি যথার্থ ভাবে একজন শান্ত মানুষ হন। তিনি যেখানেই থাকুন, তাঁর এই শান্তভাব তাঁর চারপাশের লোকজনের মধ্যেও ছড়িয়ে যায়।

মনে আসক্তি না থাকলে মন শুদ্ধ হয়।দেহের সকল কাজ প্রতিদিন আসক্তি রহিত ভাবে হয়ে থাকে। উদাহরণস্বরূপ, আমাদের হৃদয় দিনে রাত্রে বিরামহীন ভাবে স্পন্দিত হয়। কিন্ত সেকথা আমরা কখনও ভেবে দেখিনা।

উদর খাদ্য পরিপাক করে। সে সম্বন্ধে আমরা বিশেষ চিন্তা করিনা। ঠিক তেমনই আমাদেরও পার্থিব কর্তব্য আপনা হতে কিন্তু দক্ষ ভাবে করা উচিৎ। এইভাবে চললে মন শান্ত হয় ও আত্মজ্ঞান লাভের উপযুক্ত হয়। আমরা কখনও, কখনও দেখতে পাই, গ্রামের মহিলারা মাথায় করে জল নিয়ে যায়, হাতে করেও নিয়ে যায়। কলসিগুলি বড় হয় এবং তার যথেষ্ট ওজন থাকে। কিন্ত তারা হাসতে, হাসতে, কথা বলতে, বলতে পথ চলে। তবে সব কথা, গল্পের মাঝেও মনের একাংশ কলসিগুলির প্রতি নিবদ্ধ থাকে। বাকি মন বন্ধুদের সঙ্গে আনন্দে মেতে থাকে। আমাদেরও এইভাবে গৃহে, বিদ্যালয়ে ও সমাজে নিজেদের কর্তব্য করতে হবে। কিন্ত একই সঙ্গে মনকে ঈশ্বরের ওপর নিবদ্ধ রাখতে হবে।

যে ব্যক্তি একজন গৃহের সদস্য ও সমাজের সদস্য হিসেবে নিজের দায়িত্ব পালন করেনা, নিজের নিত্য কর্ম করে না বা সামাজিক কর্তব্য পালন করে না, সে কখনও ঈশ্বর উপলব্ধির পরমানন্দ লাভ করতে পারেনা। আমাদের অতীত জীবনের কর্ম, বা অতীত জীবনে কৃত কর্মের ফল আমাদের ভোগ করতেই হয়। এগুলি হল আমাদের প্রারব্ধ কর্ম যা এই জীবনে ভোগ করার জন্য আমাদের দেওয়া হয়েছে।

আমাদের প্রভু বলেন যে অতীত কর্মের ফল মুছে ফেলার এক সহজ উপায় আছে। তিনি বলেন, “বীজ যদি মাটির গভীরে প্রোথিত থাকে, তাহলে তার থেকে চারা গাছ হয়না। তেমনি ভ্রান্ত কর্ম থেকে উৎপন্ন দুঃখও আমাদের জীবনে আসবেনা যদি সেই বীজগুলি, সেইসব প্রাণীর প্রতি প্রেমপূর্ণ সেবার গভীরে প্রোথিত থাকে, যাদের সাহায্য, সহানুভূতি ও ভালবাসার প্রয়োজন।”

“একমাত্র পুণ্য কর্মের সদর্থক ফলই পাপকাজের নঞর্থক ফলকে নিবারণ করতে পারে।” সম্পূর্ণ, সজাগ বুদ্ধি দিয়ে কর্ম ফলের প্রতি আসক্তি ত্যাগ কর। কর্তব্য বোধে বা সেবা মনে করে নিজেদের কাজ করতে থাক। এইরকম মনোভাব গড়ে তুলে,তার সাহায্যে বন্ধন ও কর্মের হাত থেকে নিজেদের মুক্ত কর।

-গীতাবাহিনী

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: