উদ্ধারেদাত্মা – বিশদ পাঠ

Print Friendly, PDF & Email
উদ্ধারেদাত্মা—–বিশদ পাঠ

মানুষ একমাত্র নিজের আত্মার সাহায্যেই নিজের উত্তরণ ঘটাতে পারে। সে যেন কখনই নিজেকে নিম্ন স্তরে অবনমিত না করে। জানবে আত্মাই তোমাদের বন্ধু, আত্মাই তোমাদের শত্রু।

নিজের চেষ্টায় নিজেকে তুলতে হয়। নিজের অধঃপতন ঘটানো উচিৎ নয়। মানুষের নিজের আত্মাই তার বন্ধু আবার সেই তার শত্রু হতে পারে।যদি আমরা বুদ্ধির সহায়তায় নিজেদের ইন্দ্রিয় ও মনকে নিয়ন্ত্রিত করতে পারি, তাহলে সেই ইন্দ্রিয়গুলিই আমাদের সেরা বন্ধু হয়ে উঠবে। নিয়ন্ত্রিত করতে না পারলে তারাই হবে আমাদের পরমশত্রু।

উদাহরণ হিসেবে রসনার কথা ধরা যাক— যদি আমরা রসনাকে নিয়ন্ত্রিত করতে পারি অর্থাৎ কথা ও স্বাদগ্রহণকে নিয়ন্ত্রিত করতে পারি তাহলে আমরা অনেক কিছুই করতে পারব। জিহ্বাকে, ভাল কথা বলতে, ভালবেসে কথা বলতে, ঈশ্বরের নাম উচ্চারণ করতে শেখাতে হবে। তাহলে আমরা এই জগতে শান্তি ও মৃত্যুর পরে মোক্ষ লাভ করব। প্রহ্লাদের কথাই ধরা যাক। সে সর্বদা ঈশ্বরের (নারায়ণের)নাম করত।তার জন্যই সে সাহসের সঙ্গে সব বাধার সম্মুখীন হতে পেরেছিল এবং শেষে ঈশ্বরের আশীর্বাদ লাভ করেছিল।

আমরা যেমন বীজ বপন করি, তেমনই ফসল পাই। আমরা সৎ কর্মের জন্য ভাল এবং অসৎ কর্মের জন্য মন্দ ফল লাভ করি।আমরা নিজেদের এই যে সমস্যায় জর্জরিত করেছি, তার থেকে নিজেদের বের করে আনার দায়িত্ব কেবল আমাদেরই; এর জন্য অন্যকে দোষ দেওয়া মূর্খতার পরিচয় এবং অর্থহীন।

নিয়ম ও নিষেধের বেড়াই জীবনের খেলাকে আকর্ষণীয় করে তোলে। ফুটবল খেলায় যদি খেলোয়াড়দের বল নিয়ে যা খুশী করতে দেওয়া হয়, ফাউল না থাকে, অফ্ সাইড বা গোল না থাকে, হাত দিয়ে ছোঁড়া বারণ না হয়, শাস্তি না থাকে, তাহলে সে খেলার কোন মানেই হবেনা আর কেউ তার থেকে ‘আনন্দও’ পাবেনা।

– S.S.S. II.

সুখ ও দুঃখ আমাদের কৃতকর্মের ফল। একথা স্বীকার করি আর নাই করি, সকল কৃতকর্মের ফল ভোগ করতে আমরা বাধ্য। এটাই প্রকৃতির নিয়ম। সুতরাং সঠিক পথে কর্ম করাই বান্ঞ্ছনীয়।আমরা যা কিছুই করব, দেখব বা শুনব, তার শুদ্ধতা সম্পর্কে আমাদের সজাগ থাকতে হবে, তাতে লালসা বা ঘৃণা থাকবেনা। যে সুখভোগ করব, তা যেন কোন মন্দভাবের দ্বারা কলুষিত না হয়।

[বিদ্যা বাহিনী–পৃ,৮৮]

তোমাদের মানসিক দৃষ্টিভঙ্গিই ঠিক করে দেবে, তোমরা শান্তিতে থাকবে,নাকি থাকবেনা। মনে যদি এরকম শান্তি থাকে,তাহলে কেউ সেটা কেড়ে নিতে পারবেনা। তোমাদের সুখের ব্যঘাৎ তোমার নিজেরাই ঘটাও। তোমরা মনে ঈর্ষা,ক্রোধের মতন অনুভূতিকে প্রবেশের অধিকার দাও, তোমরা নিজেরাই নিজেদের বিনাশ কর। তোমারা যদি নেতিবাচক পরিবেশ তৈরী কর–‘তাহলে তোমারা,পরিবারের এবং দেশের সামঞ্জস্য নষ্ট করবে। পরিবর্তে নিজেদের হৃদয়ে ও মনে ভ্রাতৃত্বের সুন্দর অনুভব রাখতে হবে। তবেই আমরা নিজেদের সুস্থ রাখতে পারব, পরিবারে ও দেশে শান্তি বজায় রাখতে পারব। মনে রেখ প্রেম ও সহমর্মিতাই বিশ্বের ধর্ম।

ব্যাখ্যা:

আমাদের প্রতিটি চিন্তা, বাক্য ও ক্রিয়ার জন্য আমরা দায়ী। অন্যের ঘাড়ে দোষ চাপানোর চেষ্টা মূর্খতা ও অর্থহীন। নিজেকে সেবা করার ও সুস্থ করে তোলার ক্ষমতা আমাদের রয়েছে।আমরা আমাদের নিজেদের অন্তরের গভীরে গিয়ে সেখান থেকে অন্যায় চিন্তা,মন্দ প্রবৃত্তি,ক্ষোভ ও ভয়গুলিকে বার করে এনে, শক্ত হাতে তাদের মোকাবিলা করতে পারি। চেতন মন নিজে সেটা দেখে নিজেদের সারিয়ে তুলতে পারে।

যদি সত্যিই আমরা বন্ধুর মতন নিজেদের স্বাস্থ্যকর উন্নতি চাই, তাহলে আমাদের অবশ্যই মনন ও নিজেদের সুস্থ সমালোচনা করতে হবে। গুরুর কৃপায় এর থেকে আমরা মনের জোর পাব।

আমরা যদি নিজেদের ভ্রান্তির জন্য আড়াল খুঁজি, অজুহাত দিই, বা সমস্ত ভুলের জন্য অন্যের ওপর দোষ চাপাই তাহলে আমরা নিজেদের ক্ষতি করব ও নিজেরাই নিজেদের শত্রু হয়ে উঠব। এইভাবে আমরা নিজেদের চোখে নিজেরাই ছোট হয়ে যাব। আত্মসম্মান না থাকলে আত্মবিশ্বাস বা আত্মসন্তোষও থাকেনা। আদর্শ আমি এবং আমি প্রকৃতপক্ষে যা, তার মধ্যে বিশাল প্রভেদ রয়েছে। আমাদের মধ্যে বেশিরভাগই সাধারণত নিজেদের এই দ্বৈতসত্তা সম্পর্কে অবহিত নই। আমরা নিজেদের আদর্শ মনে করি এবং নিজেদের মধ্যে যে ত্রুটিগুলি আছে সে সম্বন্ধে অন্ধ হয়ে থাকি।নৈতিক শক্তি কি,স্বার্থহীন প্রেম কি,নিয়মানুবর্তী জীবন যাপন কাকে বলে, ‘আমাদের কেমন হওয়া উচিৎ’ এই সমস্ত কিছু সম্বন্ধে আমাদের ধারণা পরিস্কার। কিন্ত আমাদের মনে সেই জোর নেই যে আসক্তি, ভালবাসা, ঘৃণা, ক্ষুধা, ও প্রবৃত্তিকে প্রতিহত করি। আমাদের বাবা যেমন বলেন, সেই ভাবে, ABC অর্থাত সর্বদা সতর্ক থেকে এবং অসৎ সঙ্গ থেকে দূরে থেকে আমরা নিজেদের অন্তঃস্থিত উচ্চতর এবং মহত্তর আদর্শগুলির সঙ্গে যুক্ত হতে পারি। শেষ অবধি নিজেকে আশীর্বাদ লাভের যোগ্য করে তুলবে না অধঃপতিত করবে সেই দায়িত্ব সাধকের নিজস্ব।

গল্পসমূহ
১। প্রেম থেকে প্রেমের জন্ম হয়:

একদিন আকবর তাঁর মন্ত্রী বীরবলের সঙ্গে হাঁটছিলেন।তাঁরা দেখলেন দূর থেকে একজন চাষী তাঁদের দিকে আসছে। আকবর বীরবলকে বললেন যে তিনি ঐ ব্যক্তিকে গুলি করতে চান। তিনি বীরবলকে অনুরোধ করলেন, “চাষীর সঙ্গে দেখা হলে তাকে জিজ্ঞেস কোর সে কি ভাবছে।”

চাষী কাছে এলে বীরবল সম্রাট আকবরকে দেখিয়ে তাকে জিজ্ঞেস করলেন, যে সে, রাজার সম্পর্কে কি ভাবছে। তিনি তাকে একথাও বললেন যে “তুমি মিথ্যা বোলনা বা কোনরকম সংকোচ করোনা। তোমার যা মনে হচ্ছে তা সত্য করে বল।”

সেই চাষী বিদ্বেষপূর্ণ স্বরে বলল, “আমার ইচ্ছা হচ্ছে ওঁর দাড়ির প্রতিটি চুল উপড়ে ফেলি।”

বীরবল যখন রাজার কাছে গিয়ে সেই কথা জানালেন, রাজা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “ওহে বীরবল আমার সভায় যে বিদ্বানেরা আসেন, তাঁরা তো আমাদের বারবার এই কথাই বলে থাকেন। একমাত্র প্রেমই আমাদের সাধুর সন্ধান দিতে পারে এবং তিনিই আমাদের ঈশ্বরের দরবারে পৌঁছে দিতে পারেন। ঘৃণা কেবল ঘৃণারই জন্ম দেয় এবং এই পৃথিবীর সঙ্গে আরো শক্ত বন্ধনে বেঁধে ফেলে।”

২) এক দরিদ্র ব্যবসায়ী ও পরশমণি

একবার এক সাধু এক ব্যবসায়ীর বাড়ীতে এলেন। সেই ব্যবসায়ীর, ব্যবসা সফল না হওয়ায়, খুবই দারিদ্র্যের মধ্য দিয়ে তার দিন কাটছিল। সাধু এলে তিনি খুব কেঁদে তাঁর কাছে আরজি জানালেন, “হে মহান, ঈশ্বরের প্রতিনিধি, আপনি পরম কৃপা করে আমার এই চরম দারিদ্র্যের নাশ করুন!”

দয়াপরবশ হয়ে সেই সাধু,ব্যবসায়ীকে একটি পরশমণি দিলেন। তার স্পর্শে ধাতু সোনা হয়ে যেত। তিনি বললেন, “ভালোমানুষ, এই পাথরটা তুমি নাও।এটা দিয়ে তোমার যত ইচ্ছে সোনা করে নাও।এটি তিন মাস তোমার কাছে রাখ। তারপর আমি ফিরে এটি আবার নিয়ে যাব।”

প্রথম মাসে ব্যবসায়ী বাজারে গিয়ে লোহার ছাঁটের দাম জানতে চাইল। বিক্রেতা জানাল যে দাম বেড়ে পাঁচ টাকা থেকে সাত টাকা কিলো হয়েছে। ব্যবসায়ী নিজেকে বলল, “এই নতুন, চড়া দামে লোহা কেনা বোকামি হবে।আমি সামনের মাস অবধি অপেক্ষা করব।তখন হয়তো দাম কম হয়ে যাবে।”

বেচারা, বোকা লোকটি! সে বুঝতেই পারলনা যে এক কিলো লোহা যদি সোনা হয়ে যায়, সে অত্যন্ত বড়লোক হয়ে যাবে।

একমাস পরে, সে আবার বাজারে গেল। কিন্ত তখন লোহার দাম আরো বেড়ে গেছে।

সে ভাবল, “এত দাম দিয়ে কিনলে আমি কী বোকাটাই না বনে যাব। তার চেয়ে ভাল, আমি আরেক মাস অপেক্ষা করি।”

তৃতীয় মাসে সে দেখল লোহার দাম আরো বেড়ে গেছে। লোহার ছাঁটের দাম কিলো প্রতি ১৫ টাকা হয়ে গেছে। সে বলল, “এ সাংঘাতিক দাম বলছে।আমি আরো একটু অপেক্ষা করব। দাম কমতে বাধ্য।”

কিন্ত এর মধ্যে তিন মাস সময়কাল পেরিয়ে গেল। সাধু এসে পরশমণি ফেরৎ নিয়ে চলে গেলেন। ব্যবসায়ী যেমন গরীব ছিলেন, তেমনই রয়ে গেলেন।

সাধুজনের সঙ্গ করলে সত্যকার পরশমণি পাওয়া যায, যা লোহাকে সোনায় রূপান্তরিত করে।

প্রশ্ন:
  1. আমরা কিভাবে নিজেদের অন্তরের উচ্চতর আদর্শে নিজেদের উত্তরণ ঘটাতে পারি?
  2. ABC বলতে কি বোঝায়?
  3. How is one, one’s own friend? Or One’s own enemy?

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।