বাসনার সীমিতকরণ
বাসনার সংজ্ঞা হল “এমন কিছু চাওয়া বা পাওয়ার ইচ্ছা ,যা তৃপ্তি ও আনন্দ দেয়। ” বাসনা আমাদের মধ্যে যে মতিভ্রম নিয়ে আসে, তা হল :
ক) পাওয়া হয়ে গেলেই চাওয়া চলে যায়।
খ) বাসনা পূর্ণ হলে সন্তুষ্টি আসে।
স্বামী বারবার বলছেন যে এই দুটি বিশ্বাসই ভ্রান্ত।
“মানুষ বুঝতে পারেনা যে বাসনা যত বাড়ে সুখ ততই কমে যায়। বাসনার কোনো শেষ নেই। উইঢিপিতে উই বৃদ্ধি পাওয়ার মতন, বাসনা বেড়ে চলে। যতই থাক বা যতই ভোগ করা হোক সন্তুষ্টি কখনই আসেনা।”
“পৃথিবীর দরিদ্রতম ব্যক্তিটি কে? যার অনেক বাসনা সেই পৃথিবীর দরিদ্রতম মানুষ। সবচেয়ে ধনী কে? যার মনে অনেক সন্তোষ আছে, সেই পৃথিবীর সবচেয়ে ধনী ব্যক্তি। ” -বাবা
পৃথিবীতে সব জিনিষেরই একটা সীমা আছে। মানবদেহের তাপমাত্রার সীমা আছে, অর্থাৎ তাকে ৯৮.৪ ডিগ্রী হতে হবে; তাপমাত্রা এর থেকে বেশি হলে আমরা বলি তার জ্বর হয়েছে। রক্তচাপ বা রক্তে শর্করার পরিমান সীমা ছাড়ালে আমাদের স্বাস্থ্যের ক্ষতি হয়।
যদি চোখের সামনে কোনো আলোর ঝলকানি হয় বা ছবি তোলার সময় ফ্ল্যাশ লাইট জ্বলে ওঠে, চোখ আপনা থেকে বন্ধ হয়ে যায়। চোখ অত আলো সহ্য করতে পারেনা। কানও একটা সীমার পরে আওয়াজ সহ্য করতে পারেনা। আমরা সেরকম ক্ষেত্রে কান চাপা দিই, অথবা কানের ভিতর তুলো দিই। এইসব দেখে বুঝতে হবে যে আমাদের জীবন একটা লিমিটেড কোম্পানি!একইভাবে বাসনারও একটা সীমারেখা টানতে হবে।
দিব্যবাণী – ১৯৮৩
সুস্থ ও আনন্দময় জীবনের জন্য COD বা বাসনার সীমিতকরণ একান্ত জরুরী। সীমাহীন বাসনা দুঃখ নিয়ে আসে। এগুলি আধ্যাত্মিক অগ্রগতির পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। অনিয়ন্ত্রিত বাসনা মানুষের আনন্দ ও শান্তি নষ্ট করে দেয়। বাসনার সীমিতকরণ লাভ করার উপায় হল বাসনার সংখ্যা কম করা। বীজকে যদি ভাজা হয়, তাহলে তার থেকে আর গাছ হয় না।
মহাভারতে এবং পূরাণে বাসনার সীমিতকরণের ওপর খুবই গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। বাসনা এক থেকে অনেক হয়ে যায়। একটি বাসনা পূর্ণ হলে তার থেকে লোভ জন্মায়। বাসনা যদি পূর্ণ না হয় তাহলে তার থেকে রাগ ও ঈর্ষা এসে যায়। আর সবশেষে সেই কারণে মানবিক মূল্যবোধগুলির পতন ঘটে।
অশেষ এবং নীতিবহির্গত বাসনাগুলিকে কীকরে নির্মূল করা যায়? বাবা যেসব নির্দেশ দিয়েছেন সেগুলি হলো:
- সবসময় সতর্ক থাক, দুর্জনের সঙ্গ এড়িয়ে চলো
- খারাপ জিনিষ দেখোনা, যা ভালো তাই দেখ
খারাপ জিনিস শুনোনা, যা ভালো তাই শোনো
খারাপ কথা বলোনা, ভালো কথা বল
খারাপ চিন্তা ক’রো না,সৎ চিন্তা কর
খারাপ কাজ ক’রো না, সৎ কর্ম কর
জীবনের চারটি মূল উপকরণের ব্যবহারে সীমারেখা টেনে ,বাসনাকে কমিয়ে আনার এক উপায় হল বাসনার সীমিতকরণ।
- অর্থ
- খাদ্য
- সময়
- শক্তি
অর্থ, খাদ্য, সময় ও শক্তি এই চারটি জিনিস মানুষকে উপহার হিসাবে দেওয়া হয়েছে।এগুলি পবিত্র কারণ এরা ঈশ্বরের সাকার রূপ।
1. সময় বা কাল হলো ঈশ্বর। সময়ের অপচয় মানে জীবনের অপচয়।
ঈশ্বরকে এইভাবে মর্যাদা জানানো হয়- ‘কালায় নমঃ’, কালকালায় নমঃ কালাতীতায় নমঃ’, ‘কালস্বরূপায় নমঃ’I পবিত্র শব্দের ব্যবহারে সময় কাটাও। সময়ের অপচয় ক’রো না।
– ভগবান বাবা – গ্রীষ্মকালীন শিক্ষাশিবির ১৯৯৩।
2. শক্তি হলো ঈশ্বর
ক্রোধ, বাসনা এবং অসৎ চিন্তা, মানুষের শারীরিক, মানসিক, এবং আধ্যাত্মিক শক্তিকে নিঃশেষিত করে। “শক্তির অপচয় ক’রো না।”
মানুষ অসৎ চিন্তা, অসৎ দৃষ্টি, অসৎ শ্রবণ এবং অসৎ কর্মে লিপ্ত হয়ে শক্তির অপচয় করে।
– গ্রীষ্মকালীন শিক্ষাশিবির ১৯৯৩।
3. অর্থ হলো ঈশ্বর
“ঈশ্বর হলেন সম্পদ।” ঈশ্বর যদি সম্পদ হন তাহলে অর্থের অপব্যবহার মন্দ কাজ। বিলাসিতাকে প্রশ্রয় না দিয়ে, অর্থ, অন্ন, বস্ত্র, গৃহ ইত্যাদি দান করা অভ্যাস করো। অর্থের অপব্যবহার করা কেবল মন্দ কাজ নয়, পাপ কাজ।
– গ্রীষ্মকালীন শিক্ষাশিবির ১৯৯৩।
4. খাদ্য হলো ঈশ্বর
একজন যে খাদ্য অপচয় করে, তাতে আরেকটি অনাহারে থাকা শিশুর ক্ষুধার নিবৃত্তি হতে পারে।
“অন্নের অপচয় করোনা, অন্ন ব্রহ্ম।” তোমাদের দেহ অন্ন থেকে উৎপন্ন হয়েছে।তোমাদের পিতা ও মাতা যে খাদ্য গ্রহণ করেছেন, তোমরা তারই ফল।
‘অন্ন ব্রহ্ম’; ‘Mitha thindi athi hayi ‘ বাবা বলেন সংযত আহার প্রভূত আরাম দিয়ে থাকে। যতটুকু প্রয়োজন ততটুকু খাও। পাতে অনেক খাবার নিয়ে সেটা নষ্ট করোনা।
– গ্রীষ্মকালীন শিক্ষাশিবির ১৯৯৩।
স্বামী কাৰুণ্যানন্দ, “আপনি স্বয়ং ঈশ্বর, যিনি নরদেহ ধারণ করেছেন এবং এখন এখানে শারীরিক ভাবে উপস্থিত আছেন। এই দেয়ালের অপর প্রান্তে শিশুরা আস্তাকুঁড় থেকে সামান্য অন্নের কণার জন্যে রাস্তার কুকুরদের সঙ্গে মারামারি করছে। এমন কেন হচ্ছে স্বামী?
ভগবান, স্বামী কারুণ্যানন্দকে বললেন, “এরা পূর্বজন্মে আয়েশ ও বিলাসে দিন কাটিয়েছে। তারা দামী, দামী খাদ্যসম্ভারে সাজানো টেবিল থেকে অবহেলাভরে, এটা থেকে এক টুকরো, ওটা থেকে এক টুকরো তুলে খেয়েছে। যত না খেয়েছে নষ্ট করেছি তার থেকে অনেক বেশী। অবজ্ঞাভরে মহার্ঘ্য খাবার ফেলে দিয়েছে। পূর্বজন্মে হঠকারিতা করে যা তারা নষ্ট করেছে এবং আবর্জনার স্তুপে ফেলেছে, এ জন্মে সেটাই তুলছে।জীবনের উপকরণগুলির সংযত ব্যবহার, নিঃস্বার্থপরতা, অন্যের সঙ্গে ভাগ করে নেওয়ার অভ্যাস, অন্যের জন্য চিন্তা করা, অন্যের জন্য দায়িত্ব অনুভব করা, বাসনার সীমিতকরণের জন্য এই মূল্যবোধগুলি প্রয়োজন।
শিশুদের মনে বাসনার সীমিতকরণের কথাটি যাতে প্রবেশ করে তার জন্য বাবা -মা, শিক্ষক এবং গুরুদের উপযুক্ত নীতিকথা বা কাহিনী সংগ্রহ করতে হবে।