ত্রিত্ব হিসাবে গুরু
গুরুর্ব্রহ্মা গুরুর্বিষ্ণু
গুরুর্দেবো মহেশ্বরঃ
গুরুঃসাক্ষাৎ পরব্রহ্ম
তস্মৈ শ্রী গুরবে নমঃ
“গুরু ব্রহ্মা, গুরু বিষ্ণু, গুরু মহেশ্বর। গুরুকেই তোমার সর্বস্ব বলে জানবে।
—সকলেই দিব্যস্বরূপ। বস্তুতঃ যা কিছু দেখছ, সবই
সেই দিব্য মহাজাগতিক রূপ ছাড়া কিছু নয়। (বিশ্ব বিরাট স্বরূপ)”
“গুরু শব্দের দ্বারা তাকেই বোঝানো হয় যিনি অজ্ঞানতার অন্ধকার দূর করেন। ‘গু’ হলেন গুণাতীত ,’রু’ হলেন রূপাতীত। এগুলি একমাত্র ঈশ্বরের দিকেই নির্দেশ করে। সেই জন্যই গুরুকে ব্রহ্মা, বিষ্ণ, শিব (হিন্দু ধর্মের ত্রিদেব) বলে সম্মান জানানো হয়। একমাত্র ঈশ্বরই হলেন প্রকৃত গুরু। অন্যেরা সকলেই হলেন শিক্ষক,যেমন কলেজে বিভিন্ন বিষয়ের শিক্ষক থাকে তেমন। তিনিই গুরু যিনি শিষ্যের কাছে ‘গুরি’ (লক্ষ্য )প্রকাশ করেন।’গুরি’ বলতে এখানে আত্মতত্ত্বকে বোঝানো হয়েছে।” [-সত্য সাই বাবার প্রদত্ত দিব্য ভাষণ – ১৯৯৭,২০শে জুলাই]
গুরু ব্রহ্মা। গুরু স্রষ্টা; তিনি নিজেই সৃষ্টি এবং নিজেই সেই সৃষ্টিতে অন্তর্লীন। এই বিশ্বের সমগ্রতায় ব্রহ্ম। সুতরাং এটা পরিষ্কার যে যিনি নিজে বিশ্বরূপ তিনিই গুরু। গুরু বিষ্ণু। বিষ্ণু কে? তিনিই বিষ্ণু যাঁর মধ্যে ব্যাপ্তিরূপ গুণ বর্তমান। তিনিই কর্তা আবার তিনিই কার্য। বিশ্ব হলো কার্য, ঈশ্বর হলেন কর্তা। সকল কার্য – কারণের পিছনে ঈশ্বর চৈতন্য বর্তমান। সমগ্র বিশ্ব বিষ্ণুর আকার বা রূপ। এই বিষ্ণুই হলেন গুরু।
গুরু মহেশ্বর। মহেশ্বর কে? তিনি বিশ্বের সকল প্রাণীর নিয়ন্তা। তাঁর আদেশ এবং নির্দেশেই বিশ্ব সঠিক ভাবে পরিচালিত হয়। ঋতুচক্র, বৃষ্টি, দিবা, রাত্রি, সবই তাঁর আজ্ঞাধীন। ঈশ্বরের আদেশেই সকল বস্তু ব্যতিক্রমহীন ভাবে নিয়মানুবর্তী হয়। গুরু যে কেবল শিক্ষা দেন এমন নয়।
একজন গুরু সর্বশক্তিমান, সর্বজ্ঞ এবং সর্বব্যাপী,তিনি স্বয়ং ঈশ্বর। গুরুপূর্ণিমায় পূর্ণচন্দ্রে কোন কলঙ্ক থাকেনা। চন্দ্র, মন ছাড়া আর কিছুই নয়। মন যখন সম্পূর্ণরূপে নির্মল হয়, তখন তা আলোক বর্ষণ করে। গুরুকে প্রদক্ষিণ করলে বা নৈবেদ্য সাজিয়ে দিলে গুরুপূর্ণিমা পালন করা হয়না। প্রকৃত নৈবেদ্য কী ?তা হল নিজের প্রেমকে নিবেদন করা। ঈশ্বর সর্বত্র বিরাজমান,এটি উপলব্ধি করাই হল প্রদক্ষিণ। এই কথাগুলি উপলব্ধি করতে পারলে, প্রতিটি দিনই গুরুপূর্ণিমা। গুরু একজনই, তিনি ঈশ্বর,তিনি ছাড়া আর কোনো গুরু নেই। সেই গুরুর ওপর মনকে নিবিষ্ট করো। “[-দিব্য ভাষণ ১৪ই জুলাই ১৯৯২]
গুণসমূহ ও ত্রিদেব
ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বর কোনো সাকার সত্তা নয়। ত্রিদেব তিনটি গুণের দেবতা রূপে অভিব্যক্তি। পুরাণে যে ব্রহ্মাকে চতুর্মুখ ও মহাজাগতিক স্রষ্টা রূপে বর্ণনা করা হয়েছে তা যথার্থ নয়। বস্তুতঃ ত্রিদেব তিনটি গুনের প্রতিভূ।
প্রকৃতিতে পাঁচটি ভূত রূপ শক্তি বর্তমান। ভূমি, অপ, অগ্নি, বায়ু এবং আকাশ। তোমরা যদি সৃষ্টির ক্রম বুঝতে চাও তাহলে এই পাঁচটি ভূতের ক্রমটি শেষ থেকে শুরু করতে হবে। আকাশ থেকে শুরু করে পরপর বায়ু, অগ্নি, জল এবং ভূমি আসবে। দুই ভাবে প্রকৃতিকে বুঝতে হবে: এক,সৃষ্টির ক্রমে; দ্বিতীয় প্রাত্যহিক অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে। সৃষ্টির ক্রমে ব্রহ্মা, বিষ্ণু মহেশ্বরকে বুঝতে চাইলে শেষ থেকে শুরুতে যেতে হবে। তখন ক্রম হবে ঈশ্বর, বিষ্ণু এবং ব্রহ্মা।
এইভাবে শুরু করা যাক – ঈশ্বর রূপ তত্ত্বের তাৎপর্য কী?
গীতা ঘোষণা করে: “ঈশ্বর সর্ব ভূতানাম হৃদদেশে অর্জুনঃ তিষ্ঠতি।” (হে অর্জুন ঈশ্বর সকলের হৃদয়ে বিরাজ করেন)”: সুতরাং ঈশ্বর হলেন হৃদয়ের অধিপতি। তিনি সকল জীবের হৃদয় আলোকিত করেন। তার অর্থ দাঁড়ায় যে ইশ্বরের দিব্য শক্তি প্রতিটি হৃদয়ে বর্তমান। হৃদয়ের অধীশ্বর রূপে ঈশ্বরের ওপর নাম হল আত্মা। হৃদয় থেকেই মন এসেছে। মন বিষ্ণু তত্ত্বের প্রতীক। বিষ্ণু শব্দের অর্থ যিনি সর্বব্যাপী। মন সমান ভাবে সর্বব্যাপী। বলা হয়ে থাকে “মনোমুলম ইদম জগৎ”,(অর্থাৎ মন হলো জগতের ভিত্তিভূমি।)I মন সমগ্র বিশ্বকে ব্যাপৃত করে বিরাজ করে। সুতরাং এটি বিষ্ণু তত্ত্বকে বোঝায়।
পুরুষানুক্রমে এই কথাই বলা হয় যে বিষ্ণুর নাভি থেকে ব্রহ্মার উদ্ভব। মন থেকে বাকের উৎপত্তি। বাক হল ব্রহ্মার মূর্ত রূপ। এই কারণেই ব্রহ্মার অনেক নামের একটি হলো “শব্দ ব্রহ্মময়ী” (শব্দরূপ ব্রহ্ম)I এইভাবে ঈশ্বর, বিষ্ণু এবং ব্রহ্মা, হৃদয়, মন ও বাকের প্রতীক। এই তিনটির মিলিত রূপ আত্মার প্রতীক। সুতরাং এই তিনজনকেই তিনটি ভিন্নরূপে একই পরমাত্মার প্রতীক ভেবে সম্মান করতে হবে।.
পরম গুরু
গুরুর্ব্রহ্মা গুরুর্বিষ্ণু
গুরুর্দেবো মহেশ্বরঃ
গুরুঃসাক্ষাৎ পরব্রহ্ম
তস্মৈ শ্রী গুরবে নমঃ
এই শ্লোকটির একটি গভীর আন্তর তাৎপর্য বর্তমান। কিন্তু সেই অর্থকে বিকৃত করা হয়েছে। একজন সাধারণ শিক্ষককে মহান বলে প্রতিপন্ন করা হয়েছে। ঈশ্বরকে খণ্ডিত করা হয়েছে। শ্লোকটিতে যে মূল একতার কথা ব্যক্ত হয়েছে সেটাই অনুল্লেখিত রয়ে গেছে।
“গুরুর্ব্রহ্মা”: এখানে যে ব্রহ্মার কথা বলা হয়েছে ,তিনি স্রষ্টা নন। তিনি বাক। “গুরুর্বিষ্ণু”: এখানে সর্বব্যাপী মনের কথা বলা হয়েছে,যা সর্বজীবে বর্তমান। সেটাই হল বিষ্ণুতত্ত্ব। “গুরুর্দেবো মহেশ্বরঃ”: এখানে হৃদাসনের কথা বলা হয়েছে। “গুরুঃসাক্ষাৎ পরম ব্রহ্ম”: এর তাৎপর্য এই যে বাক, মন ও হৃদয়ের ঐক্য পরমাত্মার প্রতীক। তাঁকেই গুরু বলে সম্মান করা উচিৎ।
গুণসমূহ এবং মহাজগৎ
গুরুর ভূমিকা কী? অজ্ঞানের অন্ধকারকে সম্পূর্ণরূপে দূরীভূত করা। যতক্ষণ গুণত্রয় বর্তমান থাকবে ততক্ষণ অন্ধকার থেকে মুক্তি নেই। যখন কেউ ত্রিগুণাতীত অবস্থায় পৌঁছয় তখনই সে গুরুর মর্যাদা লাভ করে। অথবা বলা যায় যে যখন কেউ ত্রিগুণের একতা উপলব্ধি করে ,তখনই সে গুরুর উপদেশের মর্ম উপলব্ধি করতে পারে। গীতার ঘোষণায়সাধারণতঃ মনে এই তিনটি গুণের ঐক্যের নিহিতার্থ ঘোষণা করা হয়েছে : “মমাত্মা সর্ব ভূতাত্মা” (আমার আত্মা সকল জীবের অন্তরাত্মা )I সকল জীবের অন্তরে যিনি বাস করেন ,তিনি এক। “একো অসি সর্ব ভূতান্তরাত্মা” (সেই এক যিনি সকল জীবের অন্তরাত্মা)I একতার এই মৌলিক তত্ত্বটিকে বিস্মৃত হয়ে মানুষ বহুর অরণ্যে পথ হারিয়ে ফেলছে ,ফলে তাদের শান্তি থাকছে না।
এই তিনটি গুণের ত্রিবিধ ক্রিয়ার ফলেই সৃষ্টি ,বৃদ্ধি ও লয়ের ক্রম চলতে থাকে। ত্রিগুণ হল বিশ্বের মূল, উৎস, ভিত্তি এবং প্রাণবায়ু। প্রকৃতির অভিব্যক্তি ও রূপান্তরের জন্য তারাই দায়ী। মহাজগতে যে অনন্ত বৈচিত্র্য দৃষ্ট হয়, তার মূলে রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন পরিমাণে তিনটি গুণের বিন্যাস ও সম্মেলন।
ত্রিগুণ ও তাদের বর্ণ
তিনটি গুণের জন্য তিনটি বর্ণ নির্ধারিত হয়েছে।
সাধারণত মনে করা হয় যে বিষ্ণু হলেন সত্ত্ব গুণের প্রতীক। একথা ঠিক নয়।. সত্ত্বগুণ ঈশ্বরের জন্য নির্ধারিত। এটি মায়ার অধীন নয়। যোগনিদ্রাকালে সত্ত্বগুণ, চিৎশক্তি আহরণ করে (জ্ঞানশক্তি) শুদ্ধ আত্মারূপে প্রকাশিত হয়। (সম্পূর্ণ নির্মল পরমাত্মা) I সুতরাং সত্ত্ব ঈশ্বরতত্ত্বের প্রতীক। এর বর্ণ হল শ্বেত।
পছন্দ অপছন্দের মধ্য দিয়ে রজোগুণ ব্যক্ত হয়। এটিকে ব্রহ্মার সঙ্গে সম্পর্কিত বলে মনে করা হয়। কিন্তু তা ঠিক নয়। রজোগুণ বিষ্ণুর সঙ্গে অন্বিত। শঙ্খচক্রগদাপদ্মধারী দেবতা রূপে বিষ্ণুর রূপ বর্ণনা করা হয়েছে।’ অলঙ্কারস্বরূপ’ বলেও বিষ্ণুর রূপ বর্ণনা করা হয়েছে। বিষ্ণুর অপর নাম বিশ্বম্ভর – যিনি বিশ্বকে রক্ষা করেন ও শাসন করেন। যেহেতু তিনি রাজা, তাই তাঁর রজোগুণ। রজোগুণ রক্তবর্ণ।
এবার ব্রহ্মার কথায় আসা যাক। বলা হয় যে ব্রহ্মা রজোগুণের অধিকারী। এই ধারণা ভ্রান্ত। ব্রহ্মা তমোগুণের প্রতীক। তমোগুণ মূর্খত্ত্ব ও অজ্ঞানের অন্ধকারের সঙ্গে সম্পর্কিত। এটি মমাকার (আমার এই বোধ )এবং অভিমান (আসক্তি) দ্বারা পূর্ণ। এই দুটি প্রবৃত্তিই সৃষ্টির জন্য দায়ী। যদি ‘আমি’ এবং ‘আমার’বোধ না থাকত তাহলে সৃষ্টি চলত না। এদুটি তমোগুণের পরিচায়ক এবং এর বর্ণ কালো। শ্বেত, রক্ত ও কৃষ্ণ এই তিনটি বর্ণ অতি গুরুত্বপূর্ণ তিনটি রং। অন্য সকল বর্ণ এই তিনটিতে মিশে যায়।
ঠিক সেইভাবে পৃথিবীতে সত্ত্বগুণ, রজোগুণ ও তমোগুণ বিশিষ্ট মানুষ আছে এবং এই তিনটি রঙের কোনো একটি রং তাদের বিশিষ্ট করে তোলে।
[উৎস: গুরু পূর্ণিমা দিবসে পূর্ণচন্দ্র অডিটোরিয়ামে ডিসকোর্স, জুলাই 29, 1988]