ওম সর্বে বৈ শ্লোক – বিশদ পাঠ
প্রার্থনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কাহিনী
যুধিষ্ঠির ধর্মরাজ নামে পরিচিত ছিলেন; তিনি অত্যন্ত সজ্জন ও ধার্মিক ছিলেন। শুদ্ধ, পবিত্র ও দিব্য কর্ম তাঁর জীবনকে ভরে রেখেছিল। যুধিষ্ঠির জীবনে কোনো পাপ কাজ না করায় তাঁর অনেক পুন্য সঞ্চয় হয়েছিল। কিন্তু দুঃখের কথা, তাঁর এই পবিত্র, পুণ্য জীবনে একটি ক্ষুদ্র কালির দাগ পড়েছিল।
কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে পাণ্ডবেরা কৌরবদের সঙ্গে যুদ্ধ করেছিলেন। তাঁরা গুরু দ্রোণাচার্যের সঙ্গেও যুদ্ধ করেছিলেন। কৃষ্ণ জানতেন যে দ্রোণাচার্যকে পরাস্ত করা খুবই কঠিন। যদি তিনি নিজে অস্ত্র নামিয়ে রাখেন এবং যুদ্ধ করতে অস্বীকার করেন, একমাত্র তাহলেই তাঁকে পরাস্ত করা সম্ভব। কিন্তু কী পরিস্থিতিতে দ্রোণ অস্ত্র ত্যাগ করতে পারেন? দ্রোণ তাঁর একমাত্র পুত্র অশ্বত্থামাকে অত্যন্ত স্নেহ করতেন। তিনি যদি তাঁর পুত্রের মৃত্যু সংবাদ শোনেন, একমাত্র তাহলেই তিনি বিষাদগ্রস্ত হয়ে অস্ত্র ত্যাগ করবেন। কিন্তু কোনো গুজবে কান দেবার মানুষ দ্রোণ নন। তিনি এই কথার সত্যতা যাচাই করার জন্য যুধিষ্ঠিরকে প্রশ্ন করবেন, কারণ যুধিষ্ঠির সর্বদাই সত্যবাদী। কী করে যুধিষ্ঠিরকে মিথ্যা বলতে রাজী করানো যাবে?
শ্রী কৃষ্ণ একটি উপায় চিন্তা করলেন। অশ্বত্থামা নামে একটি হস্তীর মৃত্যু হয়েছিল। কৃষ্ণ যুধিষ্ঠিরকে বললেন, যদি দ্রোণ তাঁকে জিজ্ঞাসা করেন, “অশ্বত্থামা কী মৃত?” তখন তিনি যেন উচ্চকণ্ঠে বলেন, “হ্যাঁ”, তারপর গলা নামিয়ে বলেন, “কিন্তু জানিনা সে মানুষ না হস্তী।” সেই পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ হলো এবং যেমন কৃষ্ণ ভেবেছিলেন, দ্রোণ সংবাদের সত্যতা যাচাই করার জন্য যুধিষ্ঠিরের কাছে গেলেন।
যুধিষ্ঠির মুখস্ত করা কথাগুলি আউড়ে গেলেন। কথাগুলি মিথ্যা না হলেও, পুরোপুরি সত্যও ছিলোনা। যুধিষ্ঠির জানতেন যে এই অশ্বত্থামা মানুষ নোই হস্তী। এই ক্ষুদ্র কর্মটি তাঁর জীবনে এক ফোঁটা পাপ নিয়ে এসেছিল।
মৃত্যুর পর যুধিষ্ঠিরের ওপর এই কাজের দায় এসে পড়ল। তাঁকে জানানো হলো যে এই ছোট্ট কাজটির জন্য যুধিষ্ঠিরকে অল্প সময়ের জন্য নরকে থাকতে হবে। তারপর তিনি তাঁর অর্জিত পুণ্যের ফল ভোগ করার জন্য স্বর্গে যেতে পারেন। যুধিষ্ঠির তৎক্ষণাৎ এই কথায় রাজী হলেন। যখন তিনি নরকে প্রবেশ করলেন, তখন যাঁরা সেখানে নরকযন্ত্রণা ভোগ করছিলেন, তাঁরা হঠাৎ এক শান্তি, শীতলতা ও আনন্দ অনুভব করলেন। তাঁরা এমন আনন্দ পেলেন, যা তাঁরা আগে কখনও পাননি। ধর্মরাজ নরকের এই পরিবর্তন অনুভব করলেন। তিনি সকলকে এতো ভালোবাসতে পারতেন, তাঁর মনে লোকের জন্য এতো সমব্যাথা ছিল, দয়া ছিল যে তিনি সর্বদা অন্যের আনন্দকে নিজের আনন্দ বলে মনে করতেন।
তিনি যমের কাছে অনুনয় করে বললেন, “হে প্রভু, মানুষ যদি মানবজাতির ভ্রাতৃত্বের উপলব্ধি না করতে পারে তাহলে সেই মানবজীবনের সার্থকতা কোথায়? আমার মনে হয়, এইসব নরকবাসীদের জন্যএখানে আমার উপস্থিতি প্রয়োজন। তাই আমি আমার সমস্ত পুণ্যফল এঁদের উৎসর্গ করতে চাই। এনাদের সুখের জন্য আমি নরকবাস করতে প্রস্তুত আছি। সবাই সুখী হোক। কেউ যেন কষ্ট না পায়। সবাই যেন শান্তির অন্বেষণ করে।” কী মহান ত্যাগ! যুধিষ্ঠিরের কথা শুনে যমদেব অত্যন্ত প্রীত হলেন। তিনি তৎক্ষণাৎ সকল নরকবাসীকে নরক থেকে মুক্তি দিলেন। তোমরা কী জান যুধিষ্ঠির কী পুরস্কার পেলেন?অন্যকে নিজের পুণ্যফল প্রদান করার ফলে তিনি আগের থেকে সহস্রগুণ পুন্য লাভ করলেন।
সবারই উচিত যুধিষ্ঠিরের মতন সকল মানুষের সার্বিক কল্যাণ, সুখ ও আনন্দের জন্য প্রার্থনা করা। আমরা সবসময় নিজেদের জন্য প্রার্থনা করি। আমরা আমাদের আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব এবং প্রতিবেশীদের জন্য প্রার্থনা করে থাকি। কিন্তু যুধিষ্ঠির যাদের জন্য প্রার্থনা করেছিলেন, তাঁরা তাঁর পরিচিত, বন্ধু বা আত্মীয় কিছুই ছিলেন না।