সীতাহরণ
তৎক্ষণাৎ সুপর্ণখা লঙ্কায় গিয়ে রাবণের দ্বারস্থ হল। ভগিনীর দুর্দশা দেখে রাবণ ক্রোধে কম্পমান হলেন।সুর্পনখা জানালো যে রাম লক্ষ্মণ এবং সীতা রক্ষীবিহীন অবস্থায় পঞ্চবটীতে বসবাস করছেন এবং সীতা হলেন পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সুন্দরী। রাবণ সীতাকে হরণ করার পরিকল্পনা করতে লাগলেন। তিনি মারীচের কাছে গেলেন। মারীচ নিজের ইচ্ছামত যে কোন রূপ ধারণ করতে পারত। রাবণ তাকে সোনার হরিণের রূপ ধরে রামকে বনের মধ্যে সে সীতার থেকে দূরে নিয়ে যেতে বললেন। মারীচ রাবণকে অনেক বোঝাল, যাতে তিনি তাঁর এই দুরভিসন্ধি ত্যাগ করেন কিন্তু রাবণ তাঁর সংকল্পে অনড়। তিনি মারীচকে হত্যা করার ভয় দেখালেন। রাবণের হাতে মৃত্যু অপেক্ষা রামের বাণে মৃত্যু অনেক বেশি শ্রেয়। তাই মারীচ অবশেষে রাবণকে সীতা হরণে সহায়তা করতে রাজি হল। সোনার হরিণের বেশ ধরে মারীচ রামের পর্ণকুটিরের দিকে গেল। সোনার হরিণ দেখামাত্র সীতা রামকে অনুরোধ করলেন ওই হরিণটিকে ধরে এনে দেবার জন্য। রাম লক্ষ্মণকে সীতাকে পাহারা দেওয়ার জন্য রেখে নিজে সোনার হরিণ ধরে আনতে গেলেন।
গুরু শিশুদের বলবেন, সকল রকম নেতিবাচক গুণ আপাতদৃষ্টিতে খুবই আকর্ষণীয়। এদের প্রলোভন কাটিয়ে ওঠা খুবই কষ্টসাধ্য। সীতা সমস্ত রকম রাজকীয় সুখ-স্বাচ্ছন্দ ছেড়ে রামের সঙ্গে বনবাস গিয়েছিলেন কিন্তু দুর্ভাগ্য এই যে কোন এক দুর্বল মুহূর্তে তিনি সোনার হরিণের মোহ ত্যাগ করতে পারলেন না। ত্যাগ যখন মোহে রূপান্তরিত হল, তখনই সীতা রামের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে বাধ্য হলেন। স্বামি বলেন, আমরা যখনই চারিপাশে যা কিছু দেখি সবকিছু উপভোগ করতে চাই তখনই আমরা ঈশ্বরের কথা ভুলে যাই, তাঁর অস্তিত্বকে অস্বীকার করি, তখনই আমরা অসুখী হই।
শিক্ষনীয় মূল্যবোধঃ চক্চক্ করলেই সোনা হয় না। বাহ্যিক জাঁকজমক প্রতারণা করে মাত্র। যখনই কামনা-বাসনা আমাদের গ্রাস করতে চায়, তখনই আমাদের আত্মনিয়ন্ত্রণ করা উচিত। নচেৎ আমরা ধ্বংসের দিকে অগ্রসর হব। ভগবান সংক্ষেপ করে বলেছেন, “যখন কাম আসে রাম চলে যায়।’’
অনেক চেষ্টার পর ধরতে না পেরে রাম বাণ নিক্ষেপ করলেন। হরিণ তীরবিদ্ধ হল। কিন্তু সে মৃত্যুর আগে রামের কণ্ঠস্বর নকল করে উচ্চৈঃস্বরে বিলাপ করতে লাগলো, “ ও সীতা! ও লক্ষ্মণ! বাঁচাও।’’ এই বিলাপ ধ্বনি শুনে সীতাবললেন, “ শুনতে পাচ্ছ না তোমার দাদার কাতর স্বর?” লক্ষ্মণ বিলক্ষণ জানতেন রামের ক্ষতি কেউ করতে পারবে না। উপরন্তু তাঁর আদেশ অমান্য করে সীতাকে একা রেখে যেতে তিনি একেবারেই ইচ্ছুক ছিলেন না। অপরপক্ষে, সীতাকে তিনি মায়ের মতো শ্রদ্ধা করতেন। সীতা বারংবার তাঁকে অনুরোধ করায় তিনি কুটিরের চারিপাশে গণ্ডি কেটে দিলেন। সীতাকে বারবার অনুরোধ করলেন যেন তিনি ওই গণ্ডির বাইরে না আসেন। লক্ষ্মণ চলে যাওয়া মাত্র রাবণ সাধুর বেশ ধরে সীতার কাছে ভিক্ষা চাইতে এলেন। তিনি লক্ষ্মণের গণ্ডি অতিক্রম করতে পারলেন না। সীতাকে গণ্ডির বাইরে বেরিয়ে এসে ভিক্ষা দিতে বললেন। গণ্ডির বাইরে আসা মাত্র রাবণ সীতাকে জোর করে তাঁর রথে তুলে নিলেন।
গুরু শিশুদের বলবেন, যখন বাবা-মা শিক্ষক অথবা গুরুজনেরা কোন কিছু করতে নিষেধ করেন তখন তা না করাই ভালো। কারণ তারা যা বলেন সে সবই আমাদের ভালোর জন্য। যদি আমরা নীতি নিয়ম না মেনে চলি তাতে আমাদেরই ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
শিক্ষনীয় মূল্যবোধ- তিনটি ‘ডি’ হল, ডিউটি (কর্তব্য), ডিভোসান(ভক্তি), এবং শৃঙ্খলা পরায়ণতা (ডিসিপ্লিন)।
পক্ষীরাজ জটায়ু সীতাকে হরণ করতে দেখে রাবণকে বাধা দিলেন। রাবণ শেষ অবধি জটায়ুর ডানা কেটে দিলেন। সীতাকে রক্ষা করতে না পেরে জটায়ু আক্ষেপ করতে লাগলেন কিন্তু রামের সঙ্গে সাক্ষাৎ না হওয়া পর্যন্ত তিনি প্রাণ ত্যাগ করতে চাইলেন না।
রামকে মাতা সীতার সংবাদ দেওয়ার জন্য তিনি রামের সাক্ষাৎ প্রার্থনা করতে লাগলেন। রাম এবং লক্ষ্মণ কুটীরে ফিরে এসে সীতাকে না দেখতে পেয়ে তার খোঁজ করতে বের হলেন। জটায়ুর সঙ্গে তাদের দেখা হল। সব কথা তাঁদের জানালেন। রামের হাতে জল পান করে তিনি প্রাণ ত্যাগ করলেন।
জটায়ু ছিলেন ধার্মিক এবং কর্তব্যনিষ্ঠ। তিনি রাবণের অন্যায় কাজের প্রতিবাদ করেছিলেন। অধর্মের বিরুদ্ধে লড়াই করা আমাদের কর্তব্য। জটায়ু ধর্ম পথ থেকে বিচ্যুত হননি। অসীম শক্তিধর রাবণের সঙ্গে তিনি বৃদ্ধ বয়সেও একা যুদ্ধে প্রবৃত্ত হন। শিশুদের উচিত সাহসিকতা এবং নির্ভীকতার সঙ্গে নিম্নলিখিত বিষয়গুলির মোকাবিলা করা।
ক) জীবনের সকল প্রকার পরিস্থিতির সম্মুখীন হওয়া।
খ) দুর্বল এর সাহায্যে এগিয়ে আসা।
(অন্যকে অপমানিত হতে দেখে নির্বাক দর্শকের ভূমিকা পালন করা উচিত নয়।) গুরুরা শিশুদের বোঝাবেন, তারা যদি কোন অন্যায় দেখে, তাহলে নিজেরা মারামারি বা কথা কাটাকাটি করে তার প্রতিবাদ করতে যাবে না। বড়দের ব্যাপারটা জানাবে।
শিক্ষণীয় মূল্যবোধ- সদাচারি হও। নিজের লক্ষ্যে অবিচল থাক। জীবন একটি প্রতিযোগীতা, এতে অংশ নাও।