লঙ্কায় হনুমান
সমুদ্র পার হবার সময় হনুমানকে অনেক বাধা অতিক্রম করতে হয়েছিল। উপস্থিত বুদ্ধি ও সাহস তাকে লঙ্কার উপকূলে পৌঁছে দিল। পর্বতচূড়ায় উঠে তিনি নগরী পর্যবেক্ষণ করতে লাগলেন ; লঙ্কার ঐশ্বৰ্য্য ও সৌন্দর্য্যে তিনি মুগ্ধ। সুরক্ষিত নগরী—তাই তিনি ঠিক করলেন রাতে নগরে প্রবেশ করবেন।
রাত্রি এল। হনুমান ক্ষুদ্র এক বানরের রূপ ধরে দেওয়াল উল্লঙ্ঘন করতে চেষ্টা করলেন। হঠাৎ এক রমণী যিনি লঙ্কার রক্ষয়িত্রী তাঁকে ধরে ফেললেন। হনুমান তাকে এক প্রচণ্ড আঘাত দিলেন—তিনি নতমস্তকে পথ ছেড়ে দিলেন। এইভাবে হনুমান প্রথম বাধা অতিক্রম করলেন—এটি তাঁর শুভ সূচনা।
প্রাসাদের পর প্রাসাদ হনুমান সন্ধান করতে লাগলেন। পরিকল্পনা অনুযায়ী দেব বিশ্বকর্মা এই নগরী নির্মাণ করেছিলেন। এতে ছিল অসংখ্য সৌধ, মন্দির ও উদ্যান। কোথাও বৈদিক স্তোত্রপাঠ, কোথাও কাব্যচর্চা, কলাবিদ্যাচর্চা, সঙ্গীত বা নৃত্য পরিবেশিত হচ্ছিল। হনুমান মুগ্ধ বিস্ময়ে বাসগৃহ, রান্নাঘর ও পাকশালাগুলি দেখলেন। শেষে তিনি রাবণের শয্যাগৃহে প্রবেশ করলেন। প্রাসাদের আঁকজমক দেখে তিনি অভিভূত। সেখানে সুন্দরীকুল মুনির মন টলাতে পারতো কিন্তু জিতেন্দ্রিয় হনুমান এসব ভ্রুক্ষেপ করলেন না। সীতাদেবীকে খোঁজাই তাঁর একমাত্র কাজ। রাবণ স্বর্ণখচিত শয্যায় নিদ্রিত। হনুমান দেখলেন—কী সুন্দর বীরতনু। সীতাকে দেখে তিনি প্রাসাদের বাইরে এলেন এবং কিছু পরে অশোক বনে প্রবেশ করলেন এবং রামচন্দ্রের কাছে পথ দেখানোর জন্যে কাতর প্রার্থনা জানালেন।
অশোক বনে একস্থানে অনেকগুলি রাক্ষসরমণী রয়েছে—কিন্তু সীতা কোথায় ! এমন সময় হনুমানের দৃষ্টি পড়লো এক অপরূপ সুন্দরী, কৃষকায়া নারীর ওপর। তিনি শিমসুপা বৃক্ষতলে, খোলাচুলে, সাধারণ পোষাকে ছিলেন। মুখ তার বিবর্ণ, কান্নায় চোখদুটি ফুলে উঠেছে। নিঃশব্দে হনুমান সেই বৃক্ষে আরোহণ করে লক্ষ্য করতে লাগলেন। সেই রমণীর মুখ হতে ক্রমাগত রামনাম ধ্বনিত হচ্ছিল। সে নাম শুনে হনুমান উল্লসিত। এই রমণীকে দেখে তিনি যেন পবিত্র হলেন। শেষে বুঝতে পারলেন যে এই রমণীই সীতা। তার দর্শনে হনুমানের শক্তি সাহস বেড়ে গেল।
হঠাৎ অশোকবনে দেখা দিল চাঞ্চল্য – রাবণ আসছেন। একটু পরেই চেড়ীগণসহ রাবণ সেখানে এলেন এবং সীতাকে অজস্র অনুরোধ করলেন তাঁকে পতিরূপে গ্রহণ করার জন্য। সীতা কিন্তু নীরব। রাবণ ক্রুদ্ধ সীতাকে শাস্তির ভয় দেখালেন। ঘৃণার সঙ্গে সীতা বললেন, ‘আমি রামের পত্নী, রাম ভিন্ন অপর কোন পুরুষকে আমি চিন্তা করি না। রামের অস্ত্রাঘাতে সমস্ত লঙ্কাপুরী ধ্বংস হবে। সত্বর গিয়ে তার পায়ে ধর, তিনি মহৎ, তোমাকে ক্ষমা করবেন।’
কথা শুনে রাবণ উত্তেজিত, চীৎকার করে বললেন, আমি দুমাস সময় দিচ্ছি। এরপর তুমি যদি আমাকে না গ্রহণ কর, আমি অনুচরদের বলবো তোমাকে টুকরো টুকরো করে কেটে সেই মাংস আমার প্রাতঃভোজনে দিতে। ক্রুদ্ধ রাবণ প্রাসাদে ফিরে গেলেন। সীতার সহজাত ধর্ম-প্রবৃত্ত তাকে শক্তি দিয়েছিল যাতে তিনি রাবণপ্রদত্ত সব বিলাস ঐশ্বৰ্য্য ঘৃণায় প্রত্যাখ্যান করেছিলেন।
হনুমান বৃক্ষ হতে অবতরণ করলেন এবং ক্ষুদ্র বানররূপে সীতার সম্মুখীন হলেন। তিনি রামের জন্ম হতে কিষ্কিন্ধ্যা আগমন কাহিনী গাইতে লাগলেন। সীতা অবাক—বানর মানুষের মত কথা বলছে। হনুমান করজোড়ে রইলেন। সীতা প্রথমে বিশ্বাস করতে পারলেন না, বললেন, ‘বুঝেছি তুমি রাবণ, আমাকে প্রতারণার জন্য ভিন্ন ভিন্ন রূপ ধারণ করছে।’ হনুমান হতভম্ব। তিনি বিনীতভাবে জানালেন, আমি প্রকৃতই রামের সেবক।’ এই কথা বলে সীতাকে আংটি দিলেন। আংটি দেখেই সীতাদেবী কাঁদতে লাগলেন—মনে হলো যেন রাম সম্মুখে রয়েছেন। তখন হনুমান তাকে বনবাসকালে তাদের একটি গুহ্য ঘটনা বললেন। সেই কথা শুনে সীতা মুহ্যমান হলেন, তাঁর সকল সন্দেহ দূরীভূত হলো।
হনুমান তাকে কাঁধে চাপতে বললেন যাতে তিনি লঙ্কা হতে সীতাদেবীকে বহন করে আনতে পারেন। কিন্তু সীতাদেবী রাজী হলেন না, বললেন, ‘প্রিয় পুত্র, আমি চোরের মত পালাতে পারিনা। রামচন্দ্র রাবণের হটকারিতার জবাব দেবেন ; লঙ্কা আক্রমণ করে রাবণ বধ করে আমাকে মুক্ত করবেন। তবেই না তিনি প্রকৃত ক্ষত্রিয়’।
এ কথাগুলি শুনে সীতার প্রতি হনুমানের ভক্তি শ্রদ্ধা দশগুণ বৃদ্ধি পেল। তিনি বিদায় নিলেন। যাবার আগে সীতা হনুমানকে একটি রত্ন দিলেন রামকে দেবার জন্য।
হনুমান রাবণের ক্রোধভাজন
হনুমান বরাবর সমুদ্রতীরে না ফিরে একটি কুমতলব আঁটলেন। রাবণকে রাগিয়ে একটু শিক্ষা দেবার জন্যে তিনি অশোক বনটি ধ্বংস করতে লাগলেন। প্রহরীরা রাবণসভায় গিয়ে খবর দিল যে এক দৈত্যের ন্যায় বানর নগরীর উদ্যানগুলি নষ্ট করছে। সহজ ব্যাপার মনে করে রাবণ একদল সৈন্য পাঠালেন। হনুমান কিন্তু সবকটি রাক্ষসকে বধ করায় কয়েকজন সেনাপতি সহ রাবণের এক পুত্র এল। সবাই হনুমান কর্তৃক নিহত হলো।
রাবণ এবার একটু চিন্তিত হয়ে পুত্র ইন্দ্রজিৎকে পাঠালেন। ইন্দ্রজিতের সব অস্ত্রই হনুমান প্রতিরোধ করলেন। শেষে ইন্দ্রজিৎ ব্রহ্মাস্ত্র নিক্ষেপ করলে ব্ৰহ্মর প্রতি সম্মানবশতঃ হনুমান অস্ত্রের বাঁধনে ধরা দিলেন। রাবণের সভায় পবননন্দনকে আনা হলো। প্রশ্নের উত্তরে হনুমান বলেন যে তিনি রামের অনুচর। রাবণ হল করে সীতাকে হরণ করেছেন—তার ফল অতি সাংঘাতিক। রাবণ ক্রুদ্ধ হয়ে হনুমানের প্রাণদণ্ড দিলেন কিন্তু ধার্মিক বিভীষণের কথামত ঠিক হল, হনুমানের লেজে আগুন দিতে।
হনুমান এ অবস্থায় নগরীর সৌধ হতে সৌধে লাফাতে লাফাতে চললেন ফলে আগুন ছড়িয়ে পড়লো — চারদিকে হাহাকার। তিনি লেজের আগুন সমুদ্রজলে নিভিয়ে চিন্তা করতে লাগলেন। হঠাৎ তার খেয়াল হলো কি সাংঘাতিক ভুল করেছেন। মা সীতাদেবী রয়েছেন অশোক বনে – সম্ভবত তিনিও পুড়ে গেছেন। ভাবামাত্রই আগুণ নিভিয়ে তিনি উড়ে গেলেন অশোকবনে — দেখলেন সীতা শান্ত, সমাহিতা। বিদায় নিয়ে তিনি আবার প্রত্যাবর্তন করতে লাগলেন।
বানর শিবিরে ফিরে এলে অঙ্গদ, জাম্ববান ও অন্যান্য বীরগণ হনুমানকে অভ্যর্থনা জানালেন। সকলে সমবেত হলে হনুমান তাঁর লঙ্কার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করলেন। অঙ্গদ আদেশ দিলেন যে তখনি তারা কিষ্কিন্ধা ফিরে গিয়ে রাম ও সুগ্রীবকে এই শুভ সমাচার দেবেন।
বানরগণ কিষ্কিন্ধায় ফিরলে তাদের উৎফুল্ল মুখ দেখে রাম ও সুগ্রীব বুঝলেন যে তাদের অভিযান সফল হয়েছে। হনুমান রামকে প্রণাম করে লঙ্কার সব অভিজ্ঞতা বর্ণনা করলেন। শেষে সীতাদত্ত রত্নটি রামকে দিলেন। রামচন্দ্র মুগ্ধ ও আনন্দিত হলেন এবং পবন-নন্দন হনুমানকে সস্নেহে আলিঙ্গন করলেন।
প্রশ্নঃ
- হনুমান কিভাবে সীতাকে বোঝালেন যে তিনি রামের দূত?
- সীতা কেন প্রথমে সন্দেহ করলেন? পরে তিনি কিভাবে আশ্বস্ত হলেন?
- হনুমান রাবণকে কি শিক্ষা দিলেন?