দেশান্তরাগতাঃ
অডিও
অডিও
- দেশান্তরাগতাঃ বুধাস্তৰ দিব্যমূতিম
- সন্দর্শনাভিরতি সংযুতচিত্তবৃত্যা।
- বেদোক্ত মন্ত্র পঠনেন লসন্ত্যজস্রম্
- শ্ৰী সত্য সাই ভগবান তব সুপ্রভাতম্।।
অর্থ
অর্থ ( Meaning)
তোমারর দিব্যমূর্তির দর্শনাকাঙ্খী হয়ে বহু পন্ডিত দূরদূরান্তর থেকে এসেছেন। অবিরত বেদমন্ত্র পাঠে তারা পুলকিত, শিহরিত হচ্ছেন। হে ভগবান সত্য সাই, তব জাগরণের আশীষপূত একটি মহিমান্বিত সুন্দর প্রভাতের প্রার্থনা জানাই।
ব্যাখ্যা
দেশান্তরা | অন্য দেশ থেকে |
---|---|
আগত | এসেছে |
বুধা | জ্ঞানী ব্যক্তিরা |
তব | তোমার |
দিব্যমূর্তিম্ | দিব্যরূপ |
সন্দর্শনা | পবিত্র দৃষ্টি |
অভিরতি | ইচ্ছা |
সমযুতচিত্তা | প্রবল আগ্রহের সঙ্গে |
বৃত্তা | মনের |
বেদক্তমন্ত্র | বৈদিক মন্ত্র |
পঠনেন | পাঠের সহিত |
লসন্ত | আনন্দ করছে |
অজস্রম্ | সর্বদা |
অন্তর্নিহিত তাৎপর্য্য
প্রাচীন কালে শুদ্ধ চেতনা সম্পন্ন ঋষিরা ঈশ্বরের কন্ঠস্বর শুনতে পেতেন। সেই একই কন্ঠস্বর বিশ্বের সর্বত্র অনুরণিত হচ্ছে।এসো আমরা সেই কন্ঠস্বর শোনার চেষ্টা করি। সেই দিব্য আদেশ মনন করি এবং তা জীবনে অভ্যাস করি।
বিশদ পাঠ:
ষষ্ঠ স্তবকে স্বাধ্যায় অথবা শাস্ত্র পাঠের কথা বলা হয়েছে। সত্যকে জানবার ইচ্ছা যখন প্রবল হয় তখন বেদ, উপনিষদ, গীতা ইত্যাদি পাঠে জিজ্ঞাসু ব্যাক্তি পরিতৃপ্তি লাভ করেন। এই সকল শাস্ত্র কোন মানুষ লেখেননি। ধ্যানের মধ্যে ঋষিরা শাস্ত্রের বাণী শ্রবণ করেছিলেন। যোগীক চেতনার উচ্চতর অবস্থায় তারা জীবনের পরম সত্যকে উপলব্ধি করেছিলেন। এই অবস্থায় তারা মন্ত্র দর্শন করেছিলেন এবং এই দ্রষ্ট মন্ত্র গুলি চেতনার উচ্চ স্তরে উন্নীত হওয়ার সূত্র বলে পরিগণিত হয়েছিল। সুতরাং মানুষের দিব্য পথে যাত্রা রক্ষাকবচের মত এই মন্ত্র গুলি এবং মুনি-ঋষিদের অভিজ্ঞতার দ্বারা আরো প্রশস্ত হল। সূক্ষ্ম বুদ্ধির উন্মেষ ঘটল। গীতা, উপনিষদ এর কঠিন শ্লোক গুলির অর্থ অনেক স্বচ্ছ হল। সত্যান্বেষী ব্যক্তি শাস্ত্রে গভীরভাবে মনোনিবেশ করলেন। গুরু বাক্য মনন করতে লাগলেন। শীঘ্রই আত্ম উপলব্ধি ঘটল। তিনি চেতনার গভীরে বিজ্ঞানময় কোষে প্রবেশ করলেন। আমি কে? আমি কোথায় যাচ্ছি? ঈশ্বর কি? তিনি কোথায়? বাবা বলেন,” আমাদের ৩/৪ ভাগ সাধনা হওয়া উচিত এই প্রশ্নগুলির উত্তর খোঁজা। গুরুর শিক্ষা আমাদের সচেতন করে এবং আমরা এই প্রশ্নগুলির উত্তর খোঁজার চেষ্টা করি।
গল্প
1. শুধু শিখলেই হবে না
মহাভারতে অনেক রূপক ধর্মী উপাখ্যান আছে। এগুলি থেকে অনেক নীতি শিক্ষা পাওয়া যায়। বনবাসে থাকাকালীন পাণ্ডবেরা অনেক পবিত্র নদী এবং মুনি-ঋষিদের আশ্রমে গিয়েছিলেন। প্রতিটি স্থানের ঐতিহাসিক মহিমা ছিল। গঙ্গাতীরে এইরকম একটি আশ্রম ছিল ঋষি রৈভ্যর। তাঁর দুই পুত্র পরবসু আর অরবসু। তারা ছিল শাস্ত্রজ্ঞ। একবার রৈভ্য তাঁর দুই পুত্রকে রাজা বৃহদ্যুম্ন আয়োজিত যজ্ঞে অংশ নিতে পাঠালেন। তারা রাজার প্রাসাদ এর উদ্দেশ্যে রওনা হলো
একদিন রাত্রে পিতার আশ্রমে ফিরে এসে পরবসু একটি গাছের নিচে একটি বন্য জন্তু কে দেখতে পেল। সঙ্গে সঙ্গে তাকে হত্যা করল। কাছে এসে দেখল সেটি কোন জন্তু ছিল না, সে তার পিতাকে হত্যা করেছে। তাড়াতাড়ি পিতার শেষকৃত্য সম্পন্ন করে আবার সে যজ্ঞস্থলে ফিরে গেল। সেখানে গিয়ে সে ভ্রাতা অরবসুকে সমস্ত বৃত্তান্ত জানালো এবং তাকে নিজেদের আশ্রমের ফিরে গিয়ে পিতার অবশিষ্ট পারলৌকিক ক্রিয়া সম্পন্ন করতে বলল। সে আরও বললো,” এই ঘটনার কথা সর্বসমক্ষে নিয়ে আসা উচিত নয়। আমরা এই যজ্ঞ সম্পাদনার দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি নিতে পারিনা। তুমি একলা যজ্ঞ সম্পাদন করতে পারবে না। আমিও দুটো কাজ একসাথে করতে পারব না। অতএব তুমি ফিরে যাও। পিতার পারলৌকিক ক্রিয়া সম্পন্ন করে ফিরে এসো।অরবসু অক্ষরে অক্ষরে ভ্রাতার নির্দেশ পালন করলেন। কর্তব্য পালনে তিনি কখনো কোনো অবহেলা করতেন না। তার হৃদয় এবং চরিত্র ছিল পবিত্র। যার প্রতিফলন তার চেহারায় ছিল সুস্পষ্ট।
ফিরে আসার পর ভ্রাতার জ্যোতির্ময় মুখমণ্ডল দেখে পরবসুর মধ্যে হিংসার উদ্রেক হল। তার কূট বুদ্ধিসম্পন্ন মন তাকে হীন কাজে প্রবৃত্ত করল। “সভাস্থ সকলকে উদ্দেশ্য করে সে বলল,” এই ব্যক্তি এই পবিত্র যজ্ঞস্থলে উপস্থিত থাকতে পারে না, কারণ সে একজন ব্রাহ্মণ কে হত্যা করেছে।
এই কথা শুনে অরবসু হতভম্ব হয়ে গেল। ভ্রাতার আচরণ তাকে তাকে বিস্মিত করল। সকলে তার দিকে এমন দৃষ্টিতে তাকাতে লাগলো যেন সে একজন আসামী, কোন জঘন্য হিংস্র কাজ সে করেছে। নিজেকে কিভাবে নির্দোষ প্রমাণ করবে তা সে ভেবে পেল না। তবুও আত্মপক্ষ সমর্থন করার জন্য সে বলল, “সুধীবৃন্দ,আমার কথা শুনুন, আমি সত্যি কথা বলছি, ইনি আমার অগ্রজ। উনি নিজেই পিতাকে হত্যা করেছেন। নিজে যজ্ঞ করবেন বলে আমাকে পিতার পারলৌকিক ক্রিয়া কর্ম সম্পাদন করতে পাঠিয়েছিলেন।“ সকলে তার কথায় হাসতে লাগলো। পরিস্থিতি আরো জটিল হলো। পরিহাস করে তারা বলল, “পাপের বোঝা কি আর অন্যের উপর চাপানো যায়?”
অরবসুর মত একজন সৎ এবং শুদ্ধ চিত্ত মানুষের পক্ষে হত্যা এবং মিথ্যা বলার অপযশ অসহ্য হল।কঠোর তপস্যা করার জন্য সে গভীর অরণ্যের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলো। তার তপস্যায় সন্তুষ্ট হয়ে দেবতারা তাঁকে বর দিতে চাইলেন। কঠোর তপস্যা করার জন্য অরবসুর মন থেকে ততদিনে ক্রোধ এবং প্রতিহিংসা অপসারিত হয়েছে। সে তার পিতার জীবন এবং ভ্রাতার পরিবর্তন প্রার্থনা করল।এই পরিবর্তন শুধু তার নিজের জন্যে নয় পরবসুর সংস্পর্শে আসা সকলের জন্য প্রয়োজন ছিল কারণ পরবসুর সংস্পর্শ অরবসুর মতো তাদের জন্যও ক্ষতিকারক হওয়ার সম্ভাবনা ছিল।
দুজন ভ্রাতাই অগাধ পন্ডিত ছিল।পরবসুর মন ছিল হিংসায় পরিপূর্ন, আর আরবসু ছিল শুদ্ধচিত্ত, দয়ালু এবং সহানুভূতিসম্পন্ন। এর থেকে প্রমাণ হয় শুধু শিক্ষালাভ করলেই মহৎ হওয়া যায়না। সৎ চিন্তা,সৎ বাক্য এবং সৎকর্ম মানুষকে মহৎ করে।
গল্প ২
একজন পার্সি সাধক তাবরিজ তার বন্ধু, দর্শনের অধ্যাপক মৌলানা রুমের কাছে গেল। রোজকার মতো অধ্যাপক মহাশয় একটি সরোবরের ধারে বসে কিছু পুঁথিপত্র নিয়ে নাড়াচাড়া করছিলেন। তাবরিজ তাকে তিনি কি করছেন তা জিজ্ঞাসা করলেন। উত্তরে মৌলনা বললেন,” ও তুমি বুঝবে না। এ হল গভীর আধ্যাত্মিক রহস্য। এগুলো বোঝবার জন্য প্রখর বুদ্ধিমত্তা আবশ্যক যা তোমার নেই। তাবরিজ প্রথমে মুখে কিছু বললেন না। একটু হেসে মৌলানার হাত থেকে পুঁথিগুলো নিয়ে সরোবরের জলে ফেলে দিলেন এবং তারপর বললেন,”দিব্যজ্ঞান পুঁথির মধ্যে বসবাস করে না বন্ধু।“ মৌলানা তাবরীজের ব্যবহারে ক্ষুব্ধহলেন কিন্তু ক্রোধ প্রকাশ করলেন না। বিষন্ন মুখে বললেন,”এ তুমি কি করলে অমার্জিত ফকির? জানো এই মূল্যবান পুঁথি নষ্ট করে তুমি জগতের যে অপরিসীম ক্ষতি করলে তা কোনদিনও পূর্ণ হবে না।
মুচকি হেসে তাবরিজ জল থেকে অক্ষত পুঁথিগুলো তুলে আনলেন। বললেন,” কিছু মনে করো না বন্ধু, ভবিষ্যতে শিশুদের খেলার সমতুল্য এই পুঁথি গুলোর জন্য দুঃখ কোরো না।
মৌলনা রুম হতভম্ব হয়ে গেলেন। তিনি তাবরিজের মধ্যে ঐশ্বরিক ক্ষমতা লক্ষ্য করলেন। পুঁথিগুলো এতটুকু ভিজেও যায়নি। তিনি বুঝতে পারলেন ঈশ্বর তাকে অভিজ্ঞতার মাধ্যমে প্রকৃত জ্ঞান অর্জন করতে নির্দেশ দিচ্ছেন। তিনি তার জীবনধারা সম্পূর্ণ পরিবর্তন করে ফেললেন। তাবরিজের প্রদর্শিত পথে সাধনা করে মৌলানা রুম সিদ্ধিলাভ করলেন এবং পারস্যের একজন বিখ্যাত সন্ত রূপে পরিচিত হলেন।