দিব্য পথনির্দেশ
কোনো ধর্মের যদি বিশেষ কোনো দিক থাকে যা সেটিকে অন্য ধৰ্ম থেকে বিশিষ্ট করছে, তাহলে অন্য ধৰ্ম থেকে আগত শিশুদের জন্য সেটা নিয়ে আমরা ছোটদের বালবিকাশ ক্লাসেও আলোচনা করতে পারি। কিন্তু খেয়াল রাখতে হবে যে তার থেকে শিশুদের মনে যেন কোনো সংশয় না তৈরী হয়। যদিও সকল ধর্মের মূল ও প্রধান নীতিগুলি এক, বাহ্যিক আচার অনুষ্ঠান বা রীতিনীতির দিক থেকে তাদের মধ্যে বিরোধিতা আছে বলে মনে হতে পারে। ছোটদের মন হয়তো নিজেদের ধৰ্ম ও অন্য ধর্মগুলির মধ্যে যে পার্থক্য ও অমিল রয়েছে তাকে ঠিকমতন বুঝতে বা সুসমঞ্জস ভাবে গ্রহণ করতে পারবেনা। তাই খুব বিস্তারিত ভাবে ধর্মগুলির মধ্যে প্রবেশ করার প্রয়োজন নেই। ধর্মগুলির মূল ও প্রধান দিকটি খুবই হালকা ভাবে ব্যাখ্যা করতে হবে। সেই সব মূল নীতির কথা বলতে হবে যা সব ধর্মেই সমান। সব ধর্মেই যে জিনিষ গুলির কথা বলা হয়ে থাকে, সেগুলি হলো : প্রার্থনার গুরুত্ব, পূজা করার প্রয়োজনীয়তা, মানুষের ভ্রাতৃত্ব এবং ঈশ্বরের পিতৃত্বের নীতি, সর্বজীবে ভালোবাসা।
এই সার্বিক মূল্যবোধগুলি কে সব ধর্মেই তুলে ধরা হয়েছে, সব ধর্মই একই লক্ষ্যে বা গন্তব্যে পৌঁছনোর বিভিন্ন পথ। এই বিষয়টি বোঝার জন্য কয়েকটি উপমা নেওয়া যেতে পারে। গহনা নানারকম কিন্তু সোনা এক। গরুর গায়ের রং নানারকম কিন্তু দুধ এক। তেমনি মানুষের পোষাক নানারকমের বা বিভিন্ন নামের হতে পারে; কিন্তু ভিন্ন হলেও ওই সব পোষাক কাপড় থেকেই তৈরী। পোশাকগুলির আকার বা প্রকার হয়তো আলাদা, প্যান্ট বা শার্ট বা বুশ কোট, গাউন বা শাড়ি, ভিন্ন ভিন্ন লোক যেমন পরে; কিন্তু সবই কাপড় থেকে তৈরী।
হিন্দুদের পূজাপদ্ধতি বেদের ঐতিহ্য ও অনুশাসনের ভিত্তিতে গঠিত। মুসলমানেরা কোরানের অনুশাসন মেনে নিজেদের পদ্ধতিতে পূজা করেন এবং ক্রিস্টানেরা বাইবেলে এর অনুশাসন অনুযায়ী বিশেষ রীতিতে প্রার্থনা করেন। কিন্তু সকলেই যা করেন তা প্রার্থনা। আসলে শেষ অবধি সবাই যা চায়, তা হলো ঈশ্বরের কৃপা। কেবল পূজার বাহ্যিক পদ্ধতিগুলি ধর্মবিশেষে আলাদা হয়ে থাকে।
সব ধর্মই মূলতঃ যে শিক্ষা দিতে চায় তা এক —-যেমন প্রেম, দয়া, সমতা (মানুষের ভ্রাতৃত্ব ও ঈশ্বরের পিতৃত্ব )। তারা এই কথাই বলতে চায় যে সকলের প্রতি সমভাবাপন্ন হয়ে উচিত এবং সবাইকে ভালোবাসা উচিত। সকলেই সহনশীলতার ওপর জোর দিয়ে থাকে।এ শিক্ষা বেদ, কোরান, বাইবেল সব জায়গাতেই দেওয়া হয়েছে। জরথ্রুষ্টও বলেছিলেন যে প্রার্থনা মানুষের জীবনে খুবই প্রয়োজনীয়। তিনি বলেছিলেন যে প্রার্থনা আমাদের মনকে শুদ্ধ করে এবং মন থেকে অসৎ প্র্রবৃত্তি দূর করে। সকল অসৎ গুণকে অগ্নিতে বিসর্জন দিতে হবে। সেটাই হয় যজ্ঞের সঠিক আহুতি। তিনি জোর দিয়ে বলেন যে ধার্মিক জীবন যাপনের জন্য তিনটি প্রধান নীতি হলো সৎ চিন্তা, সৎ বাক্য এবং সৎ কর্ম। উপনিষদে যা বলা হয়েছে, বুদ্ধও যা বলেছেন, তা হলো “এই জগৎ ও জীবন দুঃখে পরিপূর্ণ। “সর্বম দুঃখম “এবং তিনি বলেন যে শান্তি পেতে হলে অষ্টাঙ্গ মার্গ অনুসরণ করতে হবে।
এইভাবে দেখা যায় সকল ধর্মই মূলতঃ একই শিক্ষা দিয়ে থাকে। যদিও এদের বাহ্যিক দিক, রীতিনীতি, আচারঅনুষ্ঠান ইত্যাদি আলাদা হতে পারে। এর মূলে আছে আমাদের মনোভাব যা একের অপরের থেকে অনেক আলাদা। তাই আমরা সবকিছুর মধ্যে পার্থক্য ও বৈচিত্র্য দেখি। শিশুদের সকল ধর্মের মূল সমতা ও ঐক্যের কথা বোঝাতে হবে। এইভাবে শিশুদের মনে নিজেকে ধর্মের প্রতি গভীর ভালোবাসা ও অন্যের ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধা জাগিয়ে তাদের হৃদয়কে সমৃদ্ধ করে তুলতে হবে।
ভেদাভেদের চিন্তা, অপ্রেম, অসহিষ্ণুতা ইত্যাদিকে কখনই শিশুদের মনে ঢুকতে দিলে চলবে না। যদি এমন কিছু তাদের মনে থাকে তাহলে সেগুলিকে সেখান থেকে নিষ্কাষিত করতে হবে। এইভাবে তাদের মনে উন্নতি আসবে। তাদের নৈতিক ও আধ্যাত্মিক সত্যগুলি শেখাতে হবে। অবতার ও মহাপুরুষেরা বারবার এই পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করেছেন। কালের প্রয়োজন অনুযায়ী, ভৌগোলিক অবস্থান অনুসারেসেই সময়ের লোকেদের পরিস্থিতি ও সম্ভাব্য বিপর্যয়ের কথা ভেবে তাঁরা হয়তো বিভিন্ন দিকের ওপর বিশেষ জোর দিয়েছেন। কিন্তু তাঁরা একই মূল নীতি প্রচার করেছেন। সকল ধর্মই একই সত্যের ভিন্ন ভিন্ন দিক।শিশুদের কোমল মনে যদি এই মূল সত্য প্রবিষ্ট করা যায় ও তা লালন করা যায় তাহলে এই শিশুরা সার্বজনীন বা উদার দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে বড় হবে। সকল ধর্মের একতার বিষয়ে তাদের মনে গভীর বিশ্বাস তৈরী হবে।
অবশ্যই সব জায়গায় বা সকল বালবিকাশ ক্লাসে ভিন্ন ভিন্ন ধর্মাবলম্বী শিশু থাকেনা। কিন্তু যেসব কেন্দ্রে তা আছে, সেখানে, সেই কেন্দ্রের দায়িত্বে যে গুরু থাকবেন, তাঁকে খুব ভালো করে সেই ধর্মের বিষয়ে পড়াশোনা করতে হবে, সঠিক ভাবে সেই ধর্মের কথা বুঝতে হবে। তারপর তাঁকে শিশুদের যথাযথ ভাবে শিক্ষা দেন করতে হবে।
উৎস : Divine guidelines to Balvikas [বালবিকাশ গুরু সম্মেলন –১৯৭৮]