আলোগী
ঢোল বংশের প্রথম রাজা ‘রাজা রাজা’। ইনি ৯৮৫ থেকে ১০১৪ খৃষ্টাব্দ পর্যন্ত রাজত্ব করেছিলেন। ইনি সমস্ত দক্ষিণ ভারত এমনকি শ্রীলঙ্কাকেও নিজ রাজ্য সীমানার মধ্যে এনেছিলেন। তার একটি বিরাট নৌবাহিনী ছিল এবং এই নৌবাহিনীর সাহায্যে তিনি মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, এমনকি বর্মার একাংশ পর্যন্ত শাসন করতেন। তিনি কিন্তু তার চরম সাফল্যের সময়েও নিজেকে একজন ঈশ্বরের সামান্য সেবক বলেই জ্ঞান করতেন। এ বিষয়ে একটি সুন্দর গল্প আছে।
তিনি একটি বিখ্যাত মন্দির তৈরী করতে শুরু করেন। এটি শুরু হয় ১০০০ খৃঃ এবং শেষ হয় ১০০৯ খৃষ্টাব্দে। এই মন্দির আজও দক্ষিণ ভারতে ঢোল রাজাদের সমৃদ্ধির ও স্থাপত্যের স্বাক্ষর হিসাবে বর্তমান রয়েছে এবং আজও পথিক এবং পর্যটকদের আকর্ষণ করছে।
আলোগী বলে এক বৃদ্ধা মন্দিরটি যে শহরে হয়েছিল সেই শহরের এক প্রান্তে থাকতেন। আলোগী কথার অর্থ এক সুন্দরী মেয়ে। আলোগী খুব ভক্তিমতি, শুদ্ধাচারী ও নম্রস্বভাবা ছিলেন। তিনি চিরকালই ভগবানকে সেবা করার চেষ্টা করতেন এবং তার জন্য তিনি কখনও কিছু চাইতেন না কারণ তিনি বিশ্বাস করতেন যে ভগবানের দান পাওয়ার কোনো যোগ্যতা তার নেই। তিনি ভগবানকে যথাসাধ্য আরাধনা করতেন এবং যাদেরই তার মনে হত ভক্ত তাদেরই তিনি সেবা করবার চেষ্টা করতেন। যার ফলে সমস্ত মানবজাতি তার কাছে দেবতাস্বরূপ ছিল। সবাইকেই তিনি সেবার দ্বারা পূজা করতে চাইতেন।
আলোগী জানতে পারলেন রাজা একটি মন্দির তৈরী করছেন। তিনি দারুণ ঔৎসুক্য নিয়ে এই মন্দিরের কাজ যতক্ষণ হত ততক্ষণ তিনি বসে বসে কাজ দেখতেন। তিনি দেখলেন যে শ্রমিকরা কাজ করছে তারা দুপুরের দিক হলেই ক্লান্ত হয়ে পড়ে। তিনি বুঝতে পারলেন যে নিশ্চয়ই এই শ্রমিকরা কাজ করতে করতে দুপুরের গরমে তাদের তেষ্টা পায় তাই তারা ক্লান্ত হয়ে পড়ে। তখন তিনি আদা, সরষে এবং কারিপাতা দিয়ে খুব সুন্দর ঘোলের সরবৎ করে নিয়ে এসে সবাইকে বললেন, “তোমরা একটু একটু করে সবাই ঘোল খাও বাবা, তোমাদের শরীর স্নিগ্ধ, শান্ত হয়ে যাবে। সত্যিই, তার হাতের তৈরী ওই সুন্দর ঘোল খেয়ে শ্রমিকরা যেন নতুন উদ্যম ফিরে পেতেন এবং তারা আরও দ্বিগুণ উৎসাহ নিয়ে কাজ করতেন, মন্দিরের কাজ হতে হতে শেষের দিকে পৌঁছল। বিমান বলে, যে অংশটি অর্থাৎ মন্দিরের কেন্দ্রস্থলে যে উঁচু স্তম্ভটি, যেটি ২১৬ ফুট উঁচু, সেটি প্রায় শেষ হয়ে এসেছিল। এটি শেষ হয়ে আসছে দেখে আলোগীর মনে একটি চিন্তা এল। তিনি শ্রমিকদের বললেন, “বাবা, তোমাদের একটা কথা বলব, তোমরা আমার কথা রাখবে?
শ্রমিকরা বলল,হ্যাঁ, ঠাকুমা, তুমি আমাদের যা উপকার করেছ, আনন্দ দিয়েছ, তুমি যা বলবে তাই করব।
আলোগী বললেন, দেখ বাবা, আমার বাড়ীতে একটা গ্রানাইট পাথর আছে। আমার মনে হচ্ছে এই গ্রানাইট পাথরটি বিমানের মাথায় বসালে ভারী সুন্দর দেখাবে। তোমরা ওটা নিয়ে আসবে, ওটাকে একটু ঠিকঠাক করে বসিয়ে দেবে?
শ্রমিকরা তক্ষুণি রাজী হয়ে গেল। তাঁর বাড়ীতে গেল এবং দেখল সত্যি গ্রানাইট পাথরটি যেন এর মাথায় বসাবার মতনই মাপে মাপে রয়েছে। তারা পাথরটিকে নিয়ে এসে অল্প একটু কেটেকুটে নিয়ে বিমানের মাথায় বসাল। সত্যিই পাথরটা ভারী সুন্দর দেখতে লাগল।
এই মন্দির তৈরী একদিন শেষ হল।
মন্দির উদ্বোধন করার দিন এসে গেল। পন্ডিতরা দিনক্ষণ দেখে একটি অভিষেকের দিন ঠিক করলেন। এই অভিষেক যেদিন হবে তার আগে রাত্রে রাজা নিজে এলেন এটি পরিদর্শন করতে। তিনি দেখে অত্যন্ত খুশী হলেন এবং নিজের মনে ভাবলেন, ভগবান তার মন্দির তৈরী করবার জন্য আমাকে নির্দিষ্ট করেছিলেন। যাইহোক আমি তাঁর এই মন্দিরটি তৈরী করতে পেরেছি। এটাই আমার তৃপ্তি।
বাড়ী ফিরে এসে রাজা খুব আনন্দিতচিত্তে ঘুমিয়ে পড়লেন। ঘুমের মধ্যে তিনি একটি স্বপ্ন দেখলেন। শিব তকে স্বপ্নে দেখা দিলেন, বললেন, “আলোগী আমার জন্য যে মন্দিরটি তৈরী করে দিয়েছে, সেই মন্দিরে থাকতে পেরে আমি কিন্তু পরম খুশী হয়েছি।” রাজা ধড়মড় করে উঠে পড়লেন। তিনি নিজের কানকে, নিজের স্বপ্নকে বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। আলোগী, বৃদ্ধ মহিলা। সেকি! তিনি এমন মন্দির তৈরী করলেন। না, শিব তো আর মিথ্যা কথা বলতে পারেন না। তিনি খোঁজ নিতে শুরু করলেন। সবাইকে বলে দিলেন, “আলোগী বলে কোন মহিলা মন্দিরের কাছাকাছি থাকেন কিনা খোঁজ নাও। তিনি মন্দির তৈরীর সময় কি কি কাজ করেছেন তাও খোঁজ কর।” খোঁজ নেবার পর রাজা জানতে পারলেন যে এই আলোগী, যখন মন্দির তৈরী হচ্ছিল, তখন রোজ এসে শ্রমিকদের ঘোলের সরবৎ খাইয়ে শ্রমিকদের আরও কাজে উৎসাহ জুগিয়েছে, বল দিয়েছে এবং আনন্দ দিয়েছে। সমস্ত ঘটনা শুনে রাজা বুঝতে পারলেন, কী করছি আসল নয়, কিভাবে করছি সেইটিই ভগবানের কাছে মূল্য পায়, মর্যাদা পায়।
তিনি জোড় হাত করে আলোগীর কাছে গেলেন। গিয়ে বললেন, “মা, আমাকে শিব কাল রাতে দর্শন দিয়ে বলেছেন, তোমার তৈরী মন্দিরে থাকতে পেরে তিনি খুব আনন্দিত। কালকে এই মন্দিরের অভিষেক হবে। তুমি এস। তুমি এর সঙ্গে থাকবে।
লোকের মুখে মুখে আলোগীর কথা ছড়িয়ে পড়ল। যেখানে আলোগী থাকতেন, ক্রমে ক্রমে সেই জায়গাটি “আলোগী বাগ” বলে পরিচিত হল। তার বাড়ীর কাছে যে পুকুরটি ছিল সেটি “আলোগী পুকুর” বলে বিখ্যাত হল এবং তিনি একাদশ শতাব্দীতে যে কুঁড়েঘরটিতে থাকতেন সেটি এই বিংশ শতাব্দীতে পুরসভার অফিস বলে পরিচিত হল।
প্রশ্নঃ
- আলোগী কে ছিল?
- তিনি মন্দির নির্মাণের কাজে কিভাবে সাহায্য করছিলেন?
- তাঁর একমাত্র ইচ্ছে কি ছিল?
- স্বপ্নে ঈশ্বর রাজাকে কি বললেন?
- রাজা আলোগীর কাছ থেকে কি শিক্ষা পেলেন?