লুই পাস্তুর
তোমরা সবাই দেখেছ, গয়লার কাছ থেকে দুধ আনার পর প্রথমে তাকে গরম করা হয়, ফোটানো হয় তারপর খেতে দেওয়া হয়। এমনকি যখন চারিদিকে অসুখ করে বা বাড়ীতে কারোর অসুখ করে তখন জলও ফুটিয়ে নিয়ে তবে খেতে দেওয়া হয়। এর কারণ জানো? বেশ তোমাদের কারণটা বলছি।
বলছি একটি অদ্ভুত ছেলের কথা। তোমরা জলাতঙ্ক রোগের কথা হয়ত শুনেছ। (পাগলা কুকুর, ক্ষ্যাপা কুকুরে কামড়ালে মানুষের একরকম অসুখ করে, যখন সে আর জল খেতে পারে না সেই জন্যই এই রোগটির নাম জলাতঙ্ক)
যখনকার কথা বলছি, সেটা আজ থেকে প্রায় দেড়শ বছর আগের কথা। তখন পাগলা কুকুরে কামড়ালে কি চিকিৎসা ছিল জানো? বড় বীভৎস ছিল সেই চিকিৎসা।
ঐ ছেলেটি দেখতে গ্রামে কামারশালায় মানুষদের নিয়ে আসা হচ্ছে। কেন? না তাকে ক্ষ্যাপা কুকুরে কামড়েছে এবং তার চিকিৎসা করত ঐ কামারটি। চিকিৎসটি কি জানো? ঐ কামার একটা লোহাকে টকটকে লাল করে গরম করতো। যে লোকটিকে কুকুরে কামড়েছে তাকে আরও চার পাঁচজনে শক্ত করে ধরে একট বেঞ্চে শুইয়ে দিত। তারপর যেখানে কুকুরে কামড়েছে সেখানে ঐ গনগনে গরম লোহাটা ঐ কামার ঢুকিয়ে দিত, ছ্যাকা দিত, পুড়িয়ে দিত, আর লোকটি অসহায়ভাবে শুধু চিৎকার করতো।
সবচেয়ে করুণ ব্যাপার হচ্ছে, এই চিকিৎসাতেও কিন্তু জলাতঙ্ক হত । যার জলাতঙ্ক হবার হত ; কিন্তু মানুষ একমাত্র আশ্রয় হিসাবে এই কাজ করতে তখন বাধ্য হত। ছেলেটি এইটা দেখার পর, মনে মনে সে ছোট বয়সেই স্থির করে নেয় যে সে এর কারণ খুঁজে বের করবে এবং এর প্রতিকার বের করার চেষ্টা করবে।
ছেলেটি পদার্থ বিদ্যা এবং রসায়ন বিদ্যা নিয়ে পড়াশোনা করলো।
এই ছেলেটি ফরাসীদেশের। এর নাম তোমাদের মধ্যে কেউ কেউ হয়তো আন্দাজ করতে পারছো। এর নাম লুই পাস্তুর।
জন্ম ১৮২২, ফরাসি দেশের একটি গ্রামে, যার নাম ‘দোলে’। এর বাবা ছিলেন জাঁ যোসেফ পাস্তুর। ইনি চামড়ার ব্যবসার সাথে যুক্ত ছিলেন।
লুই পাস্তুর পাশ করার পর একটি কলেজের রসায়ণ বিদ্যার অধ্যাপক হিসাবে নিযুক্ত হলেন, ফরাসী দেশেরই একটি জায়গা যে জায়গাটির নাম ‘লীল’। এই জায়গাটি এমনিতে খুবই নগন্য, কিন্তু বিখ্যাত ছিল মদ তৈরীর জন্য। লুই পাস্তুর একে বিখ্যাত করেন তার অধ্যাপনার প্রথম জায়গা হিসাবে।
যাই হোক, তোমাদের প্রথমে দুধ গরম দিয়ে শুরু করেছিলাম, সেইটাই বলি। লুই পাস্তুর, তার মনে একটা কৌতুহল ছিল, কেন এই দুধ নষ্ট হয়ে যায় ? ঐ যে মদ তৈরী হচ্ছে, ঐ মদ নষ্ট হয়ে যায়, একজন মানুষ থেকে আর একজন মানুষের মধ্যে রোগ সংক্রমিত হয়, কি করে? কলেরা কি করে হয়? তিনি এই পরীক্ষা নিরীক্ষা করতে করতে দেখলেন, যে জলের ভেতর, তরল পদার্থের ভেতর একরকম জীবাণু রয়েছে এবং প্রমাণ করলেন এই জীবাণু গুলোই রোগকে বহন করে। তিনি দেখিয়ে দিলেন, এই জীবাণু গুলি উত্তাপ সহ্য করতে পারে না অর্থাৎ যদি জলকে ফোটানো হয়, যদি দুধকে ফোটানো হয়, তাহলে জল জীবানু মুক্ত হয় এবং দু্ধটাও আর কেটে যায় না।
এই জন্য তোমরা দেখতে পাও জলকে ফোটানো হয় এবং দুধকে ফোটানো হয়। এই আবিষ্কারের পিছনেও কিন্তু লুই পাস্তুরের একটা মানবিক হৃদয় ছিল। ঐ সময় ঐখানেতে খুব সিল্ক হত, সিল্ক কিসের থেকে হয় নিশ্চয়ই জানো। এক সময়, যে গুটি পোকা থেকে সিল্ক হয় সেই গুটি পোকাদের একটা মড়ক দেখা দেয়। এই মড়কে বহু গুটি পোকা মারা যায় এবং চাষীদের খুব ক্ষতি হতে থাকে।
লুই পাস্তুর এই চাষীদের ক্ষতির হাত থেকে বাঁচাবার জন্য অনুসন্ধান শুরু করেন এবং প্রমাণ করে দেন যে একরকম জীবাণুর আক্রমণ থেকেই এই রোগ হচ্ছে আর এর প্রতিকারও তিনি বের করে দেন।
ফিরে আসি পাগলা কুকুরে কামড়ানোর গল্পে। লুই পাস্তুর কি করে এই পাগলা কুকুরে কাড়ানোর ওষুধ বের করা যায় তা নিয়ে চিন্তা করতেন, এই চিন্তা করতে গিয়ে প্রথমেই তার জানা দরকার হয়ে পড়ল, যে বিষটা কোথায় থাকে? তিনি পরীক্ষা করে দেখলেন যে, বিষটা কুকুরের দাঁতে থাকে, রক্তে থাকে না। রক্তে যদি বা থাকে সেটা কি করে ছড়ায়? তখন তিনি এই পাগলা কুকুরগুলোকে ধরতেন। তোমরা শুধু চিন্তা করে দেখ, তখনকার দিনে পাগলা কুকুরে কামড়ালে কোনো চিকিৎসা নেই, মৃত্যু অবধারিত। এই জেনেও লুই পাস্তুর পাগলা কুকুরদের নিয়ে কাজ করেছেন। কুকুরে কামড়ানোর ওষুধ বের করার চেষ্টা করেছেন ; চেষ্টা করছেন বিখ্যাত হওয়ার জন্য নয়, বেশী টাকা রোজগার করবেন বলে নয়, এই জলাতঙ্ক হলে মানুষের ভীষণ কষ্ট হয়, ভীষণ যন্ত্রণা পেয়ে মারা যায়, এই যন্ত্রণা যাতে মানুষের না হয় এরই জন্য তিনি এর ওষুধ বের করার চেষ্টা করেছেন এবং এই চেষ্টা করতে গিয়ে তিনি প্রতি মুহূর্তে মৃত্যুকে নিমন্ত্রণ জানিয়েছেন অর্থাৎ নিজের জীবনকে তিনি তুচ্ছ করে অন্যের জীবন বাঁচাবার চেষ্টা করেছেন। এটাই সবচেয়ে বড় শিক্ষণীয় বিষয় তার জীবন থেকে।
পাগলা কুকুরকে ধরে তার দাঁতের মধ্যে আর মুখের মধ্যে একটা টেষ্টটিউব ঢুকিয়ে দিয়ে তার মুখের লালাটা নিলেন এবং মাইক্রোসকোপে ধরে দেখলেন যে ঐ লালা থেকেই এই জলাতঙ্কের বিষ ছড়াচ্ছে। এটা প্রমাণও হলো, ঐ লালাটা নিয়ে আর একটা কুকুরের গায়ে ইনজেকসন করে দিলেন, কিন্তু এটা প্রমাণ করতে প্রথমে তাকে খুব অসুবিধা পেতে হয়েছিল, কেননা কুকুরে কামড়ালে সঙ্গে সঙ্গেই অসুখটা হত না বা অসুখটা হতে কয়েক সপ্তাহ, কয়েক মাস, কয়েক বছর দেরী হতো।
পাস্তুর তখন ঐ লালাটাকে নিয়ে সুস্থ ককুরের একেবারে মস্তিষ্কে ইনজেকসনটা দিয়ে দিতে লাগলেন। তার ফলে রোগটা সঙ্গে সঙ্গেই হতে লাগল, এইভাবে তিনি পরীক্ষার প্রাথমিক স্তরে জানতে পারলেন রোগটা কি করে ছড়ায়। এবারে রোগটাকে কি করে প্রতিকার করা যায়?
তোমাদের আগেই বলেছি যে তিনি কলেরার জীবাণু নিয়ে গবেষণা করেছেন। তখন তিনি কলেরার জীবাণু নিয়ে মুরগীর শরীরে ইনজেকসন দিয়ে কলেরা মুরগীর হয় তা প্রমাণ করেছিলেন এবং জলকে ফুটোলে কলেরার জীবাণু মারা যায় তাও প্রমাণ করেছিলেন।
এখন কুকুরে যদি কামড়ে দেয় তাহলে কি ফুটোনো হবে? তার কি প্রতিকার? তখন তার মনে হলো যদি রোগ প্রতিরোধ শক্তি বাড়িয়ে দেওয়া যায়।
তিনি করলেন কি, ঐ পাগলা কুকুরের লালা নিয়ে একটি টেস্টটিউবের মধ্যে রেখে দিলেন। চৌদ্দদিন রেখে দেওয়ার পর যখন সেই জীবানুগুলো কমজোর হয়ে গেল তখন তা একটি কুকুরের মস্তিষ্কে ইনজেকসন দিলেন, তারপরের দিন দিলেন তেরদিনের জীবাণু, বার দিনের জীবাণু, এগারো দিনের জীবাণু, এমনিভাবে চৌদ্দদিন ধরে ক্রমে ক্রমে একেবারে টাটকা জীবাণু শেষদিনে তিনি তার মস্তিস্কে ইনজেকসন দিলেন। এরপর এই কুকুরটিকে ছেড়ে দিলেন একটা ক্ষ্যাপা কুকুরের
সামনে, ক্ষ্যাপা কুকুরটা তাকে কামড়াল, কিন্তু এর কিছু হলো না অর্থাৎ লুই পাস্তুর এই রোগের প্রতিকার আবিষ্কার করে ফেললেন।
অনেকগুলি কুকুরের ওপর পরীক্ষা করার পর যখন লুই পাস্তুর নিশ্চিত হলেন, যে তিনি ক্ষ্যাপা কুকুর কামড়ানোর ওষুধ আবিষ্কার করতে পেরেছেন তখন তার আগ্রহ হ’ল যে মানুষের ওপর এটি প্রয়োগ করার।
এমন সময় একটি ছেলে এলো, যার নাম যোসেফ মেয়িস্টার। সে নিজেকে একজন বৈজ্ঞানিকের পরীক্ষার উপাদান হিসাবে ব্যবহার করতে দিয়েছিল। তাই সে আজ এত বিখ্যাত। সেই দেড়শ বছর আগেকার ঘটনার কথা আজকেও লোকে মনে রেখেছে, এই ছেলেটিকে আজকেও লোকে জানে।
পাস্তুর এই যোসেফ মেয়িস্টার-কে বেছে নিলেন। এর সারা শরীরে এত বেশী জায়গায় কুকুরে কামড়েছিল যে তাকে ঐ কামড়ের চিকিৎসা করা আর সম্ভব ছিল না, করতে হলে নিশ্চিত ছেলেটি তক্ষুণি মারা যেত।
লুই পাস্তুর বললেন, “দাঁড়াও, আমাকে একবার পরীক্ষা করতে দাও”, বলে, তিনি চোদ্দদিন ধরে ঐ ছেলেটিকে ঐ রকমভাবে ক্রমাগত স্তিমিত জীবাণু থেকে শুরু করে একেবারে সদ্য টাটকা জীবাণু তাকে ইনজেকশন দিলেন এবং তাকে দেখা গেল ছেলেটির রোগ হলো না, সে সুস্থ রয়ে গেল। অর্থাৎ ছেলেটি পাগলা কুকুরে কামড়ান জলাতঙ্ক রোগ থেকে বেঁচে গেল। জলাতঙ্ক রোগে নিশ্চিত মৃত্যু থেকে বেঁচে গেল। লুই পাস্তুরের দ্বিতীয় রোগীও একটি অদ্ভুত ছেলে, এর নাম ‘জুপিল’। একেও পাগলা কুকুরে কামড়েছিল। কি করে কামড়েছিল জানো? সে এই পাগলা কুকুরের কামড় থেকে তার সঙ্গীদের বাঁচাবার জন্য এগিয়ে গিয়েছিল। তাতে ওর সঙ্গীদের সে বাঁচাতে পেরেছিল কিন্তু তাকে পাগলা কুকুরে কামড় দিয়েছিল। লুই পাস্তুর তাকে বললেন যে “তুমি, যেমন তোমার কয়েকজন সঙ্গীকে বাঁচাবার জন্য নিজের জীবনকে বিপন্ন করেছিল, তেমনি এখন সমগ্র মানবজাতিকে বিপদ থেকে রক্ষা করবার জন্য আমার পরীক্ষায় সহায়ক হও। আমি যেটা আবিষ্কার করেছি আমি তোমার ওপর সেটা প্রয়োগ করতে চাই।” জুপিল রাজী হয়ে গেল পরীক্ষাও হলো এবং সাফল্য এলো।
লুই পাস্তুর রাতারাতি বিখ্যাত হয়ে গেলেন। মনে রেখো এটা ১৮৫০-৬০ সালের ঘটনা যখন টি ভি ছিলনা, রেডিও ছিলনা, এরোপ্লেনও এত ছিল না। ফরাসী দেশের ছোট্ট গ্রাম থেকে খবর সারা পৃথীবীতে ছড়িয়ে পড়লো। সেই সুন্দর আমেরিকা যেখান থেকে জাহাজে করে আসতেই বহুদিন লেগে যেত, সেই সুদূর আমেরিকা থেকেও তার কাছে মানুষ জীবন বাঁচাবার জন্য ছুটে আসতো। লুই পাস্তুর এই রকমভাবেই মানবজাতিকে শুধু জলাতঙ্ক রোগ থেকে নয়, কলেরার রোগ থেকেও তিনিই প্রথম এই জীবাণু ব্যাসিলাস মাইক্রোবস থেকে বাঁচবার পথ দেখিয়ে ছিলেন।
প্রশ্নঃ
- কোন ঘটনা পাস্তুরের মনে দয়ার উদ্রেক করলো?
- আগেকার দিনে কুকুরে কামড়ালে কি চিকিৎসা করা হতো?
- পাস্তুরের আবিষ্কার সম্বন্ধে কি কি জানো?
- লুই পাস্তুর কিভাবে মানবজাতির উপকারে এলেন?