সত্ত্ব রজঃ-‐-বিশদ পাঠ
“হে শক্তিশালী অস্ত্রধারী অর্জুন, প্রকৃতি থেকেই, সত্ত্ব (বিশুদ্ধতা), রজঃ (আসক্তি) ও তমঃ (নিঃষ্প্রভতা), এই তিন গুণের জন্ম। এরাই অব্যয় আত্মাকে দেহের সঙ্গে যুক্ত করে।
সত্ত্ব, রজঃ ও তমঃ তাদের ওপরেই প্রভাব বিস্তার করতে পারে যারা দেহকে তাদের আত্মা বলে মনে করে। অব্যয় এই শব্দটির ব্যবহার এই কথাই বোঝায় যে আসলে আত্মা অবিনশ্বর। তার কোন বন্ধন নেই। অজ্ঞানতার জন্যই সে নিজেকে বদ্ধ বলে মনে করে। মানুষের বন্ধনের কারণ হল ত্রিগুণের থেকে উৎপন্ন দেহকে নিজের আত্মা বলে মনে করা,তার প্রতি আসক্তি এবং এই দেহ আমার, এই অধিকার বোধ। যাঁরা আত্মজ্ঞানী, তাঁরা সত্যটা জানেন। শ্রীরামকৃষ্ণ দেব এর উদাহরণ। তিনি উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন যে আত্মা পরমাত্মারই অংশ এবং দেহ ও আত্মা ভিন্ন। তাঁর জীবনের শেষভাগে তাঁর গলায় কর্কট রোগ বা ক্যান্সার হয়েছিল। তিনি এক গ্লাস জলও খেতে পারতেন না। কিন্ত সে নিয়ে তিনি আদৌ চিন্তিত ছিলেন না। তিনি শান্তি উপভোগ করছিলেন। তাঁর শিষ্যরা তাঁকে প্রশ্ন করলে তিনি বলতেন, “দেহ আমি নয়। আমার কোন যন্ত্রণা নেই।” জ্ঞানীর অবস্থা এমনই হয়।.
গুণ শব্দটির অর্থ দড়ি। প্রকৃতি তিনটি গুণের দ্বারা গঠিত। প্রকৃতি ঈশ্বরের স্বভাব। এটি ঈশ্বরের ব্যক্তরূপ বা ছায়া বলা যেতে পারে। এটি হল সেই ক্ষেত্র, যেখানে ক্ষেত্রজ্ঞ বা যিনি ক্ষেত্রকে জানেন, তিনি বাস করেন। ত্রিগুণ, সত্ত্ব, রজঃ ও তমঃ রূপে বর্ণিত হয়।
সত্ত্ব:
এই গুণটি (আমাদের প্রবণতা) হল উজ্জ্বলতা বা দীপ্তি ও বিশুদ্ধতা। যাদের মধ্যে সত্ত্বগুণ প্রধান হয়, তাদের মন উৎকন্ঠা বা ক্ষোভ থেকে মুক্ত হয়। তাদের মন শান্ত, আনন্দময় হয় ও তাদের মধ্যে সূক্ষ্ম তত্ত্ব বুঝবার ক্ষমতা বেশী থাকে। সত্ত্ব গুণ প্রধান হওয়ায় এদের চিন্তার ধারা শুদ্ধ ও সরল হয়।
তাদের মনে মানসিক শান্তির এক রোমাঞ্চকর অনুভূতি থাকে। কর্মে ইচ্ছুক, সাত্ত্বিক মন, মানসিক শক্তিকে মহান লক্ষ্যের দিকে পরিচালিত করার ক্ষমতা রাখে। সর্বদাই এঁরা কিভাবে জ্ঞান লাভ করা যাবে তার সন্ধান করেন।
যে ব্যক্তির মধ্যে সত্ত্বগুণ থাকে, তার ভিতর কয়েকটি গুণ পরিলক্ষিত হয়।.
সত্ত্ব গুণ মানুষকে যথার্থ আনন্দ ও সুখের পথ অনুসরণ করতে উৎসাহিত করে।অন্যের সুখ বা দুঃখে বা ঈশ্বরের লীলার কথা শুনলে তারা মাখনের মত গলে যায়। মৌমাছির মত তারা কেবল সুগন্ধি ফুলের ওপরেই গিয়ে বসে।
সাত্ত্বিক ব্যক্তি সৎ কর্ম, ভজন, পবিত্র গ্রন্থ পাঠ এবং সাধুসঙ্গ পছন্দ করে। বিভীষণ হলেন সত্ত্ব গুণ প্রধান ব্যক্তির উদাহরণ।
রজোগুণ ( শক্তি)
রজোগুণ বাসনা নিয়ে আসে এবং পার্থিব জগতে ভোগ করার ইচ্ছা জাগায়। এটি মাছির মতন। নোংরাতেও বসে আবার ভাল জায়গাতেও বসে।গুণটি অহংকার, হিংসা, ঈর্ষা ও লোভের দিকে নিয়ে যায়,যার পরিণতি শান্তির অভাব। রাবণ হলেন রজোগুণ প্রধান ব্যক্তির উদাহরণ। তিনি বহির্জগতে সুখ খুঁজেছিলেন।
তমোগুণ (জড়তা)
তমোগুণের প্রভাবে মানুষ সত্যকে মিথ্যা ও মিথ্যাকে সত্য বলে মনে করে।এটি ব্যক্তিকে অবহেলা, ও ভ্রান্তি এবং দুঃখ ও শোকের দিকে ঠেলে দেয়। তমোগুণ মানুষকে অমানুষ করে তোলে। তামসিক ব্যক্তি আবর্জনায় ঘোরা কীটের মত হয়।
তমোগুণ প্রধান ব্যক্তি আহার, পানীয় ও নিদ্রায় সময় অতিবাহিত করে। তমোগুণ প্রধান ব্যক্তির উদাহরণ কুম্ভকর্ণ।
সব ধর্মেরই উদ্দেশ্য হল সত্ত্ব গুণের পোষণ করা এবং অন্য দুটি গুণের প্রভাব হ্রাস করা, যাতে করে মানুষ প্রকৃত আনন্দ ও সুখ লাভ করে।
সাত্ত্বিক গুণ আমাদের জ্ঞানের সন্ধানে এগিয়ে যেতে উৎসাহ দেয়। পরে দেখা যায় যে মোক্ষ লাভের ইচ্ছাও বন্ধন হয়ে দাঁড়ায়। মানুষ মৌলিক ভাবেই মুক্ত; বন্ধন মায়া বা ভ্রম। সুতরাং বন্ধন শিথিল করার বাসনা অজ্ঞানতার ফল।
তিনটি গুণ যখন সাম্য অবস্থায় থাকে, তখন মানুষের মনে সমতা থাকে ও সে উচ্চতর সত্যে পৌঁছতে পারে।
রজঃ:
এই গুণটি লাল রঙের সঙ্গে সম্পর্কিত। রজোগুণ প্রধান হলে শত, শত বেদনা ও বাসনায় মন খন্ড বিখন্ড হয়ে যায়। যে ব্যক্তির মনে এই গুণটি সমানে কাজ করে যায়, সে সহস্র বাসনা, কামনা ও আবেগে পূর্ণ হয়। মনের এই বিক্ষোভের কারণ হল বাসনা ও আসক্তি। রাজসিক ব্যক্তি বাসনার পূরণের জন্য আকুল হয়ে থাকে। সেই বাসনা পূর্ণ হলে, অভীষ্ট বস্তুর প্রতি তার আসক্তি জন্মায়।
আমরা দেখতে পাচ্ছি রজোগুণ কিভাবে আমাদের কর্ম তৎপরতা বাড়িয়ে দেয়। যদি আমরা এমন কিছুর কথা ভাবি বা দেখি যেটি আকর্ষণীয়, তখন আমরা সেটি পাবার জন্য ব্যাকুল হয়ে পড়ি। সেটি পাবার জন্য তখন আমাদের চিন্তা করতে হয়, পরিকল্পনা করতে হয়, আয় বাড়াতে হয়, অধিক পরিশ্রম করতে হয়, সন্চয় করতে হয় ইত্যাদি। বস্তুটি লাভ করার পর তার প্রতি আমরা এতটাই আসক্ত হয়ে পড়ি যে তার সুরক্ষার জন্য আমাদের মনে ভয় ও দুশ্চিন্তা শুরু হয়ে যায়। সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে রজোগুণ আমাদের অশান্ত, লোভী করে তোলে এবং আমরা তখন স্বার্থপর হয়ে যাই, অন্যের কথা চিন্তা করি না। আরো, আরো লাভ করার জন্য বিকারগ্রস্ত হয়ে পড়ি; ফলে নিজেদের বুদ্ধি ও সক্ষমতা কিছুটা হারিয়ে ফেলি।
তমোগুণ:
অন্ধকার, জড়তা, অনবধান ও বিভ্রম—তমোগুণের প্রাধান্য থাকলে এই গুণগুলি মাথা চাড়া দেয়।
যে ব্যক্তির মধ্যে এই গুণ কাজ করে তার ন্যায়,অন্যায় বিচার করার ক্ষমতা থাকেনা। এমন ব্যক্তি তার নিম্ন প্রকৃতিতে বদ্ধ হয়ে থাকে। নিম্ন প্রকৃতি অর্থাত একগুচ্ছ ভ্রান্ত ধারণা, ভ্রান্ত ভাবনা।এমন ব্যক্তি যে কাজই করে তাতে তার আলস্য আর অযত্ন প্রকাশ পায়। জীবনের উচ্চতর ও মহত্তর উদ্দেশ্য সম্পর্কে সে নিদ্রিত থাকে। ঈশ্বরমুখী জীবন নিয়ে তার কোন উচ্চাশাই থাকেনা। তমোগুণ প্রধান ব্যক্তির মধ্যে চিন্তার চমৎকারিত্ব বা মনের কোমলতা বা মহৎ কাজ করা, এইসব দেখা যায়না।
তমোগুণ প্রধান হলে বুদ্ধি নিষ্প্রভ হয়ে যায়।সেই ব্যক্তির তখন আর সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা থাকেনা। নিদ্রার আলস্য সত্যকে আচ্ছন্ন করে, যার ফলে ঐ ব্যক্তি ভুল সিদ্ধান্ত নেয়।তার মধ্যে দায়িত্ব এড়িয়ে যাওয়ার প্রবণতা দেখা যায়। কোন মহৎ কাজ করার মতন আত্মবিশ্বাস সে খুঁজে পায় না। তার মধ্যে জগতে কোন লক্ষ্যে পৌঁছনোর উৎসাহ থাকেনা। তমোগুণ উচ্চাশাকে নষ্ট করে দেয়। তার জীবনে প্রধান কাজ হয় খাওয়া আর ঘুমোনো। তমোগুণ আমাদের বিচার ক্ষমতাকে আচ্ছন্ন করে, নীচ পাশব প্রবৃত্তির দিকে টেনে নিয়ে যায়।
সংস্কৃত ভাষায় ‘গুণ’ শব্দটির অর্থ ‘দড়ি’। জীবনের আধ্যাত্মিক সৌন্দর্য যেন জাগতিক বস্তর বন্ধনে বাঁধা পড়ে যায়। এই তিনটি গুণের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে মন কাজ করে। এরাই হল সেই মানসিক বাতাবরণ, যার মধ্যে মনের গতিবিধি চলে। যখন সত্ত্ব গুণ প্রধান হয়, তখন মানুষ শান্তভাবে, সৎপথে চলে। রজোগুণের প্রভাবে সে কর্মতৎপর হয় এবং নিজের বাসনা পূরণ করার জন্য নানা পরিকল্পনা করে ও ফন্দী আঁটে। তমোগুণ যখন প্রধান হয় তখন কাজ সুন্দর হয়না, তাতে বিশুদ্ধতা থাকেনা ও সেই কাজ নিঁখুত হয়না।
এই গুণগুলি দড়ির মতন আত্মাকে জড়ের সঙ্গে বদ্ধ করে।তখন আমাদের মধ্যে যে অসীম পরমাত্মা আছেন,তাঁকে আমরা ভুলে যাই। আমরা নিজেদের পরিচ্ছিন্ন ও দুর্বল দেহকেই ‘আমি’ বলে মনে করি। যদিও আত্মা কোন অবস্থাতেই কর্তা, ভোক্তা বা ভুক্তভোগী হতে পারেনা,এই গুণগুলির প্রভাবে সে ‘আমি দেহ, আমি মন’ এই ধারণায় বাঁধা পড়ে যায়।
সত্ত্ব গুণ তখনই বদ্ধ করে যখন এই গুণ যার মধ্যে আছে সে তার নিজস্ব জীবনধারার প্রতি আসক্ত হয়ে পড়ে। উদাহরণ স্বরূপ, একজন বৈজ্ঞানিক, যিনি একান্ত নিবেদিত প্রাণ হয়ে নিজের গবেষণাগারে কাজ করছেন, একজন শিল্পী যিনি তাঁর মলিন স্টুডিওতে ক্যানভাসের ওপর কাজ করছেন, দরিদ্র ও ফ্যাকাসে এক কবি, একজন সাধু যিনি শহীদ ও নিপীড়িত, এঁরা সবাই জীবনের এই পরম আনন্দ উপভোগ করে থাকেন। কিন্ত তাঁরা এই আনন্দের প্রতি আসক্ত হয়ে পড়েন; জীবনের যেটা পরম লক্ষ্য, সেই ঈশ্বরের কাছে পৌঁছনোর জন্য তাঁদের মনে কোন উচ্চাশা থাকেনা।
রজোগুণের দ্বারা বদ্ধ হয়ে মানুষ নিজের বাসনা পূরণের জন্যই কাজ করে ও সক্রিয় হয়।
তমোগুণ মানুষকে বদ্ধ করে কারণ মানুষ তার প্রকৃত স্বরূপকে জানেনা। এমন এক সত্তার সঙ্গে সে মানুষকে বদ্ধ করে যা নিজে নিম্ন প্রকৃতির এবং মানুষকেও নীচে টেনে নামায়। এইভাবে শ্রী কৃষ্ণ আমাদের দেখিয়েছেন যে মানুষ বিভিন্ন সময়ে মনের তিনটি ভিন্ন, ভিন্ন মানসিক অবস্থা অনুযায়ী তদনুরূপ গুণের দ্বারা বদ্ধ হয়ে থাকে।
ভিন্ন, ভিন্ন রঙের বোতলে ঢেলে রাখা গঙ্গা জলকে দেখে মনে হয় একেক বোতলের জলের রঙ একেক রকম। আসলে জলের কোন পরিবর্তন হয়না, কেবল বোতলের আলাদা, আলাদা রঙের জন্য এমন মনে হয়। ঠিক তেমনি এই তিনটি গুণ ভিন্ন, ভিন্ন পরিমাণে উপস্থিত থেকে মানুষের মন ও বুদ্ধির ওপর ক্রিয়া করে তার ব্যক্তিত্বকে ভিন্ন, ভিন্ন ভাবে প্রভাবিত করে।
কীভাবে এই তিনটি গুণকে আমরা অতিক্রম করব?
আমাদের অন্তরে এমন এক ক্ষমতার বিকাশ করতে হবে, যার সাহায্যে, আমরা আমাদের মনে যে কোন বাসনার উদয় হলেই তার স্বরূপ চিনতে পারব। যখন আমাদের মধ্যে সেই সূক্ষ্ম অনুভব জাগ্রত হবে, যা বলে দেবে ঐ বাসনাটি আমার অন্তরকে কীভাবে প্রভাবিত করবে, তখন আমরা সেই শক্তিও লাভ করব যার সাহায্যে আমাদের সকল মন্দ আবেগ ও অনৈতিক প্রবৃত্তিকে আমরা সরিয়ে দিতে পারব।তখন আমরা সাম্য বজায় রেখে ধর্মের পথে চলতে পারব আমরা নিজেদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারব। উদাহরণ স্বরূপ, যদি গাড়িতে করে অনেক লম্বা পথ যেতে হয়,তাহলে আমাদের গাড়ি কীভাবে চলে জানতে হবে এবং তার যন্ত্রপাতি গুলিকে জানতে হবে।গাড়ির গন্ডগোল হলে, অভিজ্ঞ চালক বুঝতে পারে কী হয়েছে এবং সেই ত্রুটি সারিয়ে দিতে পারে।
তেমনি আমরা আমাদের মনের মন্দ প্রবৃত্তি ও মনের মন্দ ভাবকে সৎ চিন্তা,সৎ বাক্য ও সৎ আচরণে বদলে দিতে পারি। তাহলে আমাদের সাই খুশী হবেন।
উদাহরণ: (শিশুদের জন্য)
- সকাল, সকাল উঠে তোমাদের বালবিকাশ ক্লাসের জন্য তৈরী হতে হবে।কিন্ত তোমার ঘুম কাটছে না। তুমি ভাবছ, প্রতি রবিবার কেন আমায় যেতে হবে? আমি মাঝে মাঝে যাব। আজ আমি যাবনা। তাছাড়া গল্পগুলো তো আমি বাড়িতেও পড়ে নিতে পারি। তোমার মধ্যে তখন কোন গুণ কাজ করছে?
- বালবিকাশের প্রজেক্টের জন্য তুমি একটি চার্ট তৈরী করেছ।সময়ে গিয়ে বালবিকাশ গুরুকে সেটি দেখানোর জন্য তোমার খুবই উৎসাহ। তুমি যাতে ক্লাসে প্রথম পুরস্কারটি পাও তার জন্য তুমি খুব প্রার্থনা করছ। তুমি বারবার এটা সেটা করে সেটিকে আরো ভাল করতে চাইছ। তুমি গুরুর বাড়ি গিয়ে, অন্য কেউ দেখাবার আগে নিজের প্রজেক্টটি তাঁকে দেখাতে চাইছ। পুরস্কার পাবার জন্য তুমি ব্যস্ত ও উৎসাহিত। পুরস্কারটি নিয়ে তুমি কী করবে, কিরকম সব বন্ধুদের দেখাবে, সেটাও ভেবে ফেলেছ।তোমার মধ্যে কোন গুণ কাজ করছে?
- তুমি বালবিকাশ ক্লাসের প্রজেক্টের জন্য একটি চার্ট তৈরী করেছ। সেটি তিনদিন আগেই তৈরী হয়ে কাগজে মোড়া হয়ে গেছে। তুমি তোমার সেরাটা দিয়ে ছবি এঁকেছ এবং সেটা নিয়ে আর ভাবতে চাওনা। তুমি প্রার্থনা করছ যে সেটি যেন বিষয়টিকে ঠিক করে তুলে ধরতে পারে এবং স্বামী খুশী হন। তুমি শান্তভাবে, সোজা বালবিকাশ ক্লাসে গেলে। ক্লাসের সবার চার্টই তোমার সুন্দর মনে হল। তুমি আশা করলে যে তার মধ্যে একজন,প্রথম পুরস্কার পাবে। তোমার মধ্যে কোন গুণ কাজ করছে?
গল্প:
তিন ভাই, বিভীষণ, রাবণ ও কুম্ভকর্ণ।
রাবণ ছিলেন লঙ্কার রাক্ষসদের রাজা।তিনি চার বেদ এবং ছয় শাস্ত্রে পন্ডিত ছিলেন। তাঁর দশটি মাথা এর প্রতীক। কিন্ত তাঁর অন্তর, কাম ক্রোধ, লোভ, মোহ, মদ ও মাৎসর্যে পূর্ণ ছিল।
তিনি ভগবান রামের কাছ থেকে জননী সীতাকে কেড়ে নিয়ে গেছিলেন। এত শাস্ত্র পড়েও তিনি নিজের মনকে একটুও সামলাতে চেষ্টা করেননি। তাঁর মধ্যে রজোগুণ প্রবল। সুতরাং শ্রী রামকে অবশ্যই তাকে শিক্ষা দিতে হত।
বিভীষণ ছিলেন রাবণের ভাই। কিন্ত তাঁদের চরিত্রের কী আকাশ পাতাল তফাৎ! বিভীষণের প্রকৃতি ছিল সাত্ত্বিক। ছোটবেলা থেকেই তিনি তাঁর ঈশ্বর ভক্তি ও ধার্মিক স্বভাবের জন্য পরিচিত ছিলেন। তিনি অনেক চেষ্টা করেছিলেন সীতাকে অপহরণ করার মতন পাপকাজ থেকে রাবণকে নিবৃত্ত করতে।
বিভীষণ ভগবানের চরণে আশ্রয় নিয়েছিলেন। তিনি প্রভু রামের সৈন্য দলে যোগ দিয়েছিলেন। বিভীষণের বাড়ি থেকে বৈদিক মন্ত্র উচ্চারণের শব্দ শুনে হনুমান বুঝেছিলেন যে সেখানে একজন মহান পুরুষ বাস করেন।
কুম্ভকর্ণ ছিলেন তৃতীয় ভাই। তিনি স্বভাবতঃ নিদ্রাকাতর ও অলস ছিলেন। বছরের অধিকাংশ সময় তিনি খেয়ে,পান করে ও ঘুমিয়ে কাটাতেন। তিনি জানতেন যে সীতাকে হরণ করে রাবণ খুবই অন্যায় করেছেন, কিন্ত রাবণের সঙ্গ ত্যাগ করার মতন মনের জোর তাঁর ছিলনা। তাঁর মনে হয়েছিল যে রাবণের হয়ে যুদ্ধ করা তাঁর কর্তব্য। এক ভয়ানক যুদ্ধে প্রভু রাম তাঁকে বধ করেন।
গল্প:
এক পথিক গভীর জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছিল। হঠাৎ তিনটি চোর তাকে আক্রমণ করল ও পরাস্ত করল। তারা পথিকের সর্বস্ব নিয়ে নিল। প্রথম চোরটি পথিককে মারবে বলে ছুরি বার করল। দ্বিতীয় চোর তাকে এত বাড়াবাড়ি করতে বারণ করল। সে বলল যে পথিককে হাত পা বেঁধে সেখানে ফেলে রাখা হোক। তার ভাগ্যে যা আছে তাই হবে। সেই কথাই রইল। চোরেরা সেখান থেকে চলে গেল। কিন্ত কিছুক্ষণ পরেই তৃতীয় চোর ফিরে এল। সে ছিল নরম মনের মানুষ। সে পথিকের বাঁধন খুলে দিয়ে তাকে তার বাড়ি ফেরার পথ দেখিয়ে দিল।
এইভাবে অপ্রত্যাশিত ভাবে যে তার প্রাণ রক্ষা করল, তার প্রতি পথিক অত্যন্ত কৃতজ্ঞ বোধ করল। চোরকে সে তার সঙ্গে তার বাড়ি গিয়ে তার আতিথেয়তা গ্রহণ করে তাকে কৃতজ্ঞতা জানাবার সুযোগ দেবার জন্য অনুরোধ করল।কিন্ত ঐ অপরিচিত লোকটি জানালো যে সে তার সীমার বাইরে যেতে অপারগ এবং বনের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে গেল।
এই পৃথিবী হল জঙ্গল।
তিনটি গুণ হল তিন চোর।
পথিক হল জীবাত্মা।
তার দিব্য গুণ তার সম্পদ।
তিন গুণের মধ্যে তমোগুণ তাকে বিনাশ করতে চায়।
রজোগুণ, কাম, ক্রোধ ও লোভের বাঁধনে তাকে বাঁধতে চায়।
সত্ত্ব গুণ তাকে এই বন্ধন ও শৃঙ্খল থেকে মুক্ত করে ও ঈশ্বরের পথ দেখায়। কিন্ত সত্ত্বগুণ শুধু পথ দেখাতেই পারে। ঈশ্বরকে সে চেনেনা।
২) সীতাকে ঠকানো হয়েছিল।
রাবণ ছিলেন প্রতারক। তাঁর হৃদয় ছিল কলুষিত। অনেক বোঝানো, ভয় দেখানোর পরেও তার মনের পরিবর্তন হয়নি। যে গাছটি বক্র, প্রাচীন ও অ-সরল,তাকে কি সোজা করা যায়? যা কালো তাকে কি করে সাদা করবে? রাবণের ব্যাপারটা ছিল এইরকম। নিজে মন্দ মতি বলে সে রামকেও সেই দৃষ্টিতেই বিচার করেছিল। সে ভেবেছিল যে অন্তিম পর্বেও যদি সে সীতাকে বুঝিয়ে তার বশ্যতা স্বীকার করাতে পারে তাহলে, রাম বিষণ্ণ হবেন, তাঁর বুক ভেঙে যাবে। তাহলে রাম আর যুদ্ধ না করেই লঙ্কা থেকে চলে যাবেন। সে একটি নিষ্ঠুর মতলব আঁটলো। সে বিদ্যুৎজিহ্বা নামে এক দক্ষ যাদুকরকে হুবহু রামের মতন একটি নকল মস্তক তৈরী করতে বলল। তারপর সে অশোকবনে গিয়ে সীতাকে বলল, “জেদী মহিলা! দেখ আমি কি করেছি। আমি রাম ও তার বানরসেনাদের সবাইকে মেরে ফেলেছি। এখন আমিই সব। এস আমার রাণী হও। রাম আর জীবিত নেই। এই দেখ তার মস্তক। আর ওর জন্য কেঁদোনা। এখন লঙ্কার রাণী হয়ে আনন্দ কর।
সীতা তাঁর সামনে রাখা সেই মস্তকটি দেখে হতভম্ব ও নির্বাক হয়ে গেলেন। যাদুকরের মায়া তাঁকে বিভ্রান্ত করল। স্বামীর জন্য সীতা অত্যন্ত দুঃখভরে কাঁদতে লাগলেন। বিলাপ করে তিনি বললেন, “হে প্রভু, হে রাম, তুমি কেন আমায় ত্যাগ করলে?” ঠিক সেই সময় রাবণের প্রহরীরা রাবণকে বলল যে, দরবার কক্ষে তাঁর উপস্থিতি প্রয়োজন। রাবণ তখনই প্রস্থান করলেন। রামের সেই যাদু মস্তকও ধোঁয়া হয়ে মিলিয়ে গেল। তার অস্তিত্ব থাকার জন্য রাবণের উপস্থিতি প্রয়োজন ছিল। সীতা অবাক হয়ে গেলেন। তখন সরমা নামে এক রাক্ষসী তাঁকে জানালেন যে ওটি ছিল তাঁকে বিভ্রান্ত করার জন্য রাবণের নীচ ছলনা। সরমা বললেন, “সীতা আপনি বিশ্বস্ত ও পবিত্র। আপনার রামের কোন ক্ষতি করার সাধ্য কারো নেই। রাবণ তাঁর মন্দমতির শীর্ষে পৌঁছে গেছেন, তাঁর মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী।”
একথা শুনে সীতার হৃদয়ের ভার লাঘব হল। তিনি তাঁর স্বামীর নিরাপত্তার জন্য প্রার্থনা করলেন।