অহিংসা
অহিংসা, আত্মার পূর্ণ প্রকাশের ফল। সেটি এমন এক মানসিক অবস্থা, যখন অদ্বৈত তত্ত্বের উপলব্ধি হয়েছে, সমগ্র সৃষ্টির একাত্মতা ও ঐক্য বোধের জাগরণ হয়েছে। এই অবস্থায় সকল প্রাণ ও সমগ্র সৃষ্টির সঙ্গে মিলনের সম্পূর্ণতা অনুভূত হয়। এটি আধ্যাত্মিক চৈতন্যের ফল; এ হল জাগ্রত চৈতন্যের গুণ ও বিশেষণ। সেই ব্যক্তি তখন একই ঈশ্বরকে সর্বত্র, সকল প্রাণীর মধ্যে ও সৃষ্টির প্রতিটি কণায় প্রত্যক্ষ করেন। ইনি যে কোন লোকের সুখ ও দুঃখকে নিজের বলে অনুভব করেন। তিনি তখন কারোর থেকে নিজেকে আর আলাদা ভাবেন না। এমন নির্মল ও নৈর্ব্যক্তিক প্রেম আত্মা থেকেই প্রবাহিত হয়।
অন্য চারটি মূল্যবোধের অর্থাত সত্য, ধর্ম, শান্তি ও প্রেমের কিন্ত মূলতঃ ব্যক্তিকেন্দ্রিক তাৎপর্য্য থাকে। অন্য কোনও ব্যক্তির বা বড়জোর কিছু ব্যক্তির সঙ্গে স্বীয় ব্যক্তিত্বের বিভিন্ন স্তরে তার নিজস্ব আদানপ্রদানই সেখানে প্রাধান্য পায়। অহিংসার প্রাসঙ্গিকতা নিজের সামাজিক দায়বদ্ধতা এবং সমগ্র পৃথিবী ও সকল প্রাণীর প্রতি সাধারণ ভাবে তার মানসিকতার মধ্যে থাকে। এমন প্রেম সর্বব্যাপী ও সর্ব পরিবেষ্টক,‐‐‐‐ বিন্দুমাত্র পার্থক্য না রেখে সকল প্রাণী তাতে অন্তর্ভুক্ত হয়।
ভারতীয় সংস্কৃতি ও আধ্যাত্মিকতার ওপর ১৯৭৮ সালে যে গ্রীষ্মকালীন শিক্ষাশিবির অনুষ্ঠিত হয়েছিল, সেখানে বাবা বলেছিলেন, “আমরা সাধারণতঃ মনে করে থাকি যে অহিংসা বলতে,কোনও প্রাণীকে আঘাত না করা বোঝায়। কিন্ত ‘হিংসা’ কেবল শারীরিক আঘাত করাকে বলেনা, নিম্ন রুচির জিনিষ দেখা, খারাপ বা অন্যায় কথা শোনা, রূঢ ভাবে কথা বলাও হিংসা।”
সকল ধর্মে বলা হয়েছে যে অহিংসা মানুষের সর্বোচ্চ কর্তব্য‐‐–অহিংসা পরমো ধর্মঃ। হিংসা কেবল শরীরগত হয়না। চিন্তা, বাক্য, ক্রিয়া,সর্বত্র অহিংসা থাকতে হবে। সেটাই হল যথার্থ অহিংসা। এই কারণেই আমাদের স্বামী,” সর্বদা সাহায্য কর,কখনও আঘাত করোনা” এই শিক্ষাটির ওপর এত জোর দিয়ে থাকেন।
আসুন আমরা এই পঞ্মূল্যবোধকে নিজেদের জীবনে গ্রহণ করি এবং সেই আলোকে নিজেদের দৈনন্দিন যাপনকে নিয়ন্ত্রিত করি।
এই পাঁচটি মূল্যবোধের ভিতর জীবনের অপর সকল গুণ ও মূল্যবোধ ধরা আছে। আমরা যদি এই মূল্যবোধগুলিকে আদর্শ বলে মানি,নিজেদের মন ও হৃদয়ে এগুলি গ্রহণ করে তাকে সংস্কৃত করি, নিজেদের বুদ্ধি ও ইচ্ছাশক্তিকে শাসন করি এবং নিজেদের আচরণকে সেইমতন নিয়ন্ত্রণ করি যাতে তা এই আদর্শের অনুগামী হয় ও সেই মূল্যবোধগুলির বাহক হয়, তাহলে আমরা জানব যে আমরা সঠিক পথে চলছি। তার ফলে আমাদের নিজেদের ও অপরের মঙ্গল বৃদ্ধি পাবে এবং আমরা ঈশ্বরের ইচ্ছা, তাঁর পরিকল্পনা ও সৃষ্টির নিয়ম অনুযায়ী চলতে সক্ষম হব।
এই পঞ্চমূল্যবোধকে পঞ্চপ্রাণ বলে মনে করতে হবে প্রাণ, অপান, উদান, সমান, ব্যান— শ্বাস গ্রহণ, শ্বাস ত্যাগ, বায়ুর ঊর্দ্ধগমন, (সমান্তরাল বিচরণ ও পরিক্রমণ)। যেহেতু এই মূল্যবোধগুলি প্রাণের সমার্থক, যে ব্যক্তির আচরণে এই মূল্যবোধের বিকিরণ হয়না সে প্রাণহীন বলে পরিগণিত হয়!
এ অবশ্যই সাই এর উপদেশ। এ হল সেই দিব্য উপদেশ যা সাই তাঁর ব্যক্তিগত জীবনের উদাহরণ দিয়ে, শুরু থেকে শেষ অবধি, প্রতিদিন আমাদের শেখাচ্ছেন। আমাদের স্বামী বলেন, “সত্য আমার প্রচার, ধর্ম আমার আচার, শান্তি আমার স্বভাব, প্রেম আমার স্বরূপ।”
আসুন আমরা সাই এর দেখানো এই পথে চলে, তাঁর পদচিহ্ন অনুসরণ করে, নিজেদের উদ্ধার করি, এবং সামান্য ভাবে হলেও,ক্ষুদ্র পরিমাণে হলেও সমাজের কল্যাণের জন্য, পৃথিবীর মঙ্গলের জন্য কিছু করি।