উৎসব
ধর্মীয় উৎসবের জন্য ভারতবর্ষ’ বিদিত। সম্ভবত ভারবর্ষের মতো এত ধর্মীয় উৎসব পৃথিবীর আর কোনো দেশে নাই। সমস্ত ভারতীয় সম্প্রদায়ই ধর্মানুষ্ঠান উদ্যাপন করে এবং সেগুলির মধ্যে অনেক সাদৃশ্য আছে।
হিন্দুদের শিবরাত্রি উপবাস ও রাত্রি জাগরণের মাধ্যমে প্রার্থনা ও নিবেদনের অনুষ্ঠান। উপবাস করা হয় চিত্ত-শুদ্ধি ও আত্মসংযমের জন্য। গোঁড়া হিন্দুরা প্রতিমাসের কৃষ্ণা একাদশীতে উপবাস করেন। ঐ দিনটি একাদশী নামে পরিচিত। মুসলমানেরাও রমজানের সপ্তবিংশ দিনে এরূপ উপবাস করেন। এটি কৃষ্ণপক্ষে হয়। এবং সবে কদর নামে পরিচিত। ভক্তরা জাগরিত থেকে আল্লাহর আশীর্বাদ প্রার্থনা করেন। আবার ৮ম চান্দ্রমাসের ১৪ই তারিখের রাত্রিতে ভক্ত মুসলমান জেগে থাকেন এবং উন্নতি ও সম্পদ প্রার্থনা করেন। চান্দ্রবর্ষে’র সপ্তম মাসে আর-একটি দিনকে (রজব মাসের ২৭ তারিখে) বলা হয় শবে মে’রাজ এবং এই দিনে গোঁড়া মুসলমানরা সারা রাত্রি জাগরিত থাকেন। এটিকে ‘আরোহণ রাত্রি’ বলা হয়- কারণ এই রাত্রিতে মহাপুরুষ মুহম্মদ ভগবানের সঙ্গে মিলিত হয়েছিলেন।
খ্রীস্টানদের কাছে গুডফ্রাইডে উপবাস ও প্রার্থনার দিন। তাঁরা গীর্জায় তিনঘণ্টা অতিবাহিত করেন, বাইবেল পাঠ, প্রার্থ’না ও যাজকের বাণী শুনে (যে তিনঘণ্টা যীশু খ্রীস্ট ক্রুশবিদ্ধ অবস্থায় ছিলেন তারই প্রতীক হিসাবে)। এটি যীশু খ্রীস্টের ক্রুশবিদ্ধ হওয়ার দিন। লেন্ট হল খ্রীস্টানদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ সময়; রবিবার বাদে ৪০ দিন ঐ সময় গণনা করা হয়। খ্রীস্টানদের কাছে এই ৪০ দিন বিশেষ তাৎপর্য’পূর্ণ’ কারণ যীশু খ্রীস্ট ঐ ৪০ দিন যাবৎ একাকী নির্জনে বাস এবং উপবাস করেছিলেন- পৃথিবীতে তাঁর মাধ্যমে শাসন প্রবর্তনের পর্বে। এই ৪০ দিন খ্রীস্টানরা ধ্যান, আত্মপরীক্ষা, চিত্ত- শুদ্ধি প্রভৃতির দ্বারা ঈশ্বরের সন্নিকটস্থ হতে চায়। ‘এটি অ্যাশ-ওয়েনস ডে’তে আরম্ভ হয়। এই অংশ অনুতাপ, নম্রতা, এবং সরলতার প্রতীক। হিন্দুদের কাছে বিভূতির তাৎপর্য’ যা- খ্রীস্টানদের কাছে ‘ভস্ম’ তাই। উপবাস ও রাত্রি জাগরণের তাৎপর্য’ সব ধর্মেই সমান। গান্ধীজী যখনই চিত্তশুদ্ধির প্রয়োজন বোধ করতেন- তখনই উপবাস করতেন। পৃথিবীর সব ধর্ম’ই প্রেম, ত্যাগ ও অহংকার বর্জনের নীতিকেই সমর্থন করে থাকে- তরুণ ছাত্ররা যেন এ কথা অবশ্যই উপলব্ধি করে।
প্রধান প্রধান ধর্মগুলিতে যে উৎসব সমূহ পরিপালিত হয়, সেগুলি তাদের মহাপুরুষদের জীবনভিত্তিক, কিংবা ঈশ্বরের মানবদেহ ধারণ বা অবতার সম্পর্কি’ত হয়ে থাকে। অধিকাংশ হিন্দু উৎসবগুলির বিশেষত্ব হল, ঈশ্বরের নানাবিধ মহিমা প্রকাশকে স্মরণীয় করে রাখা। গোকুলাষ্টমী, মহাশিবরাত্রি, দশেরা এবং আরো অনেক হিন্দু, উৎসব ভগবানকে অথবা তাঁর ভিন্ন ভিন্ন প্রকাশকে কেন্দ্রীভূত করে অনুষ্ঠিত হয়। মুসলমানদের রমজান, বকরী ঈদ প্রভৃতিও এই ধরনের উৎসব। ক্রিসমাস যীশুখ্রীস্টের জন্মোৎসব হিসাবে পালিত হয়।
ভারতবর্ষে’র গ্রামে অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্র আকারে হলেও শহরের মতো সব উৎসবই উদযাপিত হয়। গ্রামবাসী হিন্দু ও মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ই গ্রাম্য দেবদেবীকে বিশ্বাস করে। গ্রাম্য-উৎসবের একটি বড়ো বৈশিষ্ট্য হল যে হিন্দু, মুসলমান, খ্রীস্টান প্রভৃতি সব সম্প্রদায়ই মিলিত হয়ে বহু উৎসবকে সাম্প্রদায়িক ঐক্যের সঙ্গে উদযাপন করে। বাবা যেমন বলেছেন, একটি মাত্র জাতি আছে- সে জাতি মানবজাতি। একটি মাত্র ধর্ম’ আছে- তা হল প্রেমের ধর্ম’।
ভারতীয়দের ধর্ম’প্রাণতা খুবই গভীর। ধর্ম’ বিহীন জীবনকে চিন্তা করা ভারতীয়দের পক্ষে অসম্ভব। ভাবপ্রবণতা ও কুসংস্কার কখনো কখনো তাদের মধ্যে দেখা যায়। ভারতীয় জীবনধারায় পরিবারের প্রভাব খুব বেশি। একটি পাশ্চাত্য পরিবার অপেক্ষা একটি ভারতীয় পরিবারের মধ্যে সৌহার্দ্য বন্ধন অনেক বেশি। ভারতীয় সব ধর্মে’ই বয়োকনিষ্ঠদের বয়স্কদের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শ’ন অবশ্যকর্তব্য কর্ম’ বলে বিবেচিত হয়। পিতামাতার বৃদ্ধাবস্থায় রক্ষণাবেক্ষণ করা পবিত্র কর্তব্য। ভারতীয়রা নিজেদের প্রাচীন প্রথায় বিশ্বাসী, তবুও তারা অন্যের প্রথ্য ও আচার অনুষ্ঠান সম্বন্ধে খুবই সহনশীল। চরিত্র গঠনের দিকে তারা বিশেষ লক্ষ্য রাখে এবং তরুণদের মধ্যে যাতে নৈতিকতার বিকাশ ঘটে সে বিষয়ে খুবই সচেতন থাকে।
ভারতীয়দের জাতীয় ঐতিহ্যে পৌরাণিক কাহিনী, পুজার্চ’নাদি, সাহিত্য, ধর্মীয় প্রথা এবং চারুকলার প্রতি শ্রদ্ধার মনোভাবই তাদের দৃষ্টিভঙ্গিকে প্রসারিত করেছে যার ফলে পরমত-সহিষ্ণুতা, ক্ষমা ও বীরত্বপূর্ণ’ সহিষ্ণুতা প্রভৃতি বৃত্তিগুলি তাদের মধ্যে দেখা যায়। আমাদেরও তাই চেষ্টা করতে হবে যাতে আমরা আমাদের অতীতকে অর্থবহ করে বর্ত’মানে মূর্ত করে তুলতে পারি।
আমাদের উচিত নিজেদের মহান ঐতিহ্যের উপযোগী করে তোলা। আমাদের উচিত সত্যকে উপজীব্য করে পাঁচটি মৌল নীতি, আমাদের সনাতন ধর্মে’র পঞ্চশীল যথা- সত্য, ধর্ম’, শান্তি, প্রেম ও অহিংসাকে অনুসরণ করে জীবন ধারণ করা। আমাদের একান্ত কর্তব্য প্রেম ও পবিত্র জীবন যাপন সম্বন্ধে সাই উপদেশকে দিকে দিকে প্রচার করা- যাতে সকলের কাছে সমস্ত জগৎ এক অপূর্ব’ শান্তির নিলয় হয়ে ওঠে। বন্দে মাতরম্।