অদ্বেষ্টা – বিশদ পাঠ
অদ্বেষ্টা–বিশদ পাঠ
- অদ্বেষ্টা সর্বভূতানাম,মৈত্রঃ করুণ এব চ
- নির্মমো নিরহংকারঃ সমদুঃখসুখঃ ক্ষমী।।
যিনি কারুকে ঘৃণা করেন না, যিনি সকলের প্রতি বন্ধুভাবাপন্ন ও সহানুভূতিশীল, যিনি আসক্তিহীন ও অহংকারশূন্য, সুখ ও দুঃখকে সমান ভাবে গ্রহণ করতে পারেন এবং ক্ষমাশীল।
কারুর প্রতি ঘৃণার ভাব থাকা উচিত নয়। তাকে বিদ্বেষমুক্ত হতে হবে।সকলের প্রতি তাঁর মনোভাব হবে বন্ধুত্বপূর্ণ ও সহানুভূতিশীল। তাঁকে আসক্তি ও অহংকার থেকে মুক্ত হতে হবে। সুখ ও দুঃখকে সমান ভাবে গ্রহণ করতে হবে। তাঁর প্রকৃতি হবে ক্ষমাশীল। যদি কোন ভক্তের যথার্থ ভক্তি লাভ হয়ে থাকে, তাহলে তিনি সবার মধ্যে এবং সবকিছুর মধ্যে ঈশ্বরকে দেখতে শুরু করেন।
“ঈশ্বর সকলের হৃদয়ে বাস করেন” গীতায় এই কথাই বলা হয়েছে। যাঁর এমন মনোভাব হবে, তাঁর মনে কারুর প্রতি ঘৃণা থাকবেনা।
তিনি নিরাসক্ত হয়েও সকলের বন্ধু হবেন। দয়া তাঁর স্বভাবের অঙ্গ হবে। যে ভক্তের জ্ঞান লাভ হয়েছে, তাঁর দেহাত্মবোধ থাকেনা। সুতরাং কোন অবস্থাতেই তিনি সুখ বা দুঃখ অনুভব করেন না। তাঁর কোন পছন্দ বা অপছন্দ থাকেনা। সকলের প্রতি তাঁর নিঃস্বার্থ প্রেম থাকে। স্বভাবতঃই তিনি ক্ষমাশীল।
গুরুভায়ুরাপ্পার একজন খুব বড় ভক্ত ছিলেন, যাঁর মধ্যে, “অদ্বেষ্টা সর্বভূতানাম” এই শ্লোকে যে গুণগুলির কথা বলা হয়েছে,তার সবগুলিই ছিল। একবার তিনি তাঁর ছেলের জন্মদিন পালন করার জন্য গুরুভায়ুর মন্দিরে এলেন।মন্দিরের উৎসব এবং অনুষ্ঠান সংক্রান্ত অন্যান্য উৎসব নিয়ে সকলেই খুব ব্যস্ত ছিলেন। খাদ্য প্রস্তুত ছিল। হঠাৎ তাদের খেয়াল হল যে শিশুটিকে পাওয়া যাচ্ছেনা। এদিকে শিশুটি ধীর পায়ে রান্নাঘরে চলে গিয়েছিল। কেউ খেয়াল করেনি। দুর্ভাগ্যবশতঃ শিশুটি গরম ও ফুটন্ত ‘কান্জির ঝোলের’ মধ্যে পড়ে গিয়ে মারা যায়। পুন্তনম নামে সেই ভক্ত খবরটি শুনলেন। আকস্মিক ভাবে এই দুঃসংবাদ শুনে তিনি বিচলিত হলেন। কিন্ত যেহেতু তিনি পরম জ্ঞানী ছিলেন, তিনি নিজেকে সংযত করলেন এবং মনের শান্তভাব বজায় রাখলেন। কিছুমাস পরে ঈশ্বর তাঁকে আশীর্বাদ করে আরেকটি পুত্র দিতে চাইলেন। পুন্তনম তখন ঈশ্বরকে বললেন, “তোমার মতন চিরস্থায়ী সন্তান যার আছে, এমন সন্তান যার কখনও বিনাশ হবেনা, তার সেই সন্তানে কি প্রয়োজন যে চিরকাল থাকবেনা বা যে যেকোন সময় আমাকে ছেড়ে চলে যেতে পারে?”
নির্মমো:
মন থেকে যখন, ‘আমি ও আমার’ এই বোধ চলে যায়, তখন মানুষের একমাত্র চিন্তা হয়, ‘তুমি ও তোমার’। সে তখন সর্বত্র ‘তুমি’ কেই দেখে; এইভাবে তার একত্বের দর্শন হয়।
S S S X.
নিরহংকারঃ:
অহংকার হল ‘আমিত্ব’ বোধের স্বীকৃতি। এই ‘আমি’ এমন যার শক্তি, ক্ষমতা, বল ও ঐশ্বর্য আছে।’ আমি ব্রহ্ম’ এই জ্ঞান নয়। ‘আমি দেহ’ এই ভ্রান্ত ধারণা। নিরন্তর সাধনার দ্বারা এই বোধকে অতিক্রম করতে হবে।
ভক্তের মনকে ঘৃণা শূন্য ও প্রেমে পূর্ণ হতে হবে। আর্ত ও শোকাহতের সেবার মধ্য দিয়ে সেই প্রেমের প্রকাশ ঘটাতে হবে।
সমদুঃখসুখঃ:
যখন কোন ব্যক্তি সর্বত্র এবং সবকিছুর মধ্যে ব্রহ্মের পরম কৃপাময় রূপ দর্শন করেতখন তার গরম, ঠান্ডা, খরা, বন্যা, ঘুর্ণিঝড়, ব্যধি সবেতেই সমত্বের বোধ হয়। তাকে বলা হয় প্রাকৃতিক সমত্ব। প্রশংসা, নিন্দা, প্রেম, ঘৃণা, ফুলের তোড়া ও ছুঁড়ে মারা পাথর, ধনী ও দরিদ্র সব তখন এক হয়ে যায়। একে বলা হয় সামাজিক সমত্ব। পন্ডিত, মূর্খ, আস্তিক, নাস্তিক, কর্মফলের ভাল, মন্দ, সবই তার কাছে সমান বোধ হয়।একে বলা হয় কর্ম সমত্ব।
১৩ নং শ্লোকে শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে বলছেন যে, কোন, কোন লক্ষণ থাকলে বোঝা যাবে যে ঐ ব্যক্তি ঈশ্বরের প্রিয়।
এখানে কৃষ্ণ, শব্দের সাহায্যে একজন যথার্থ ভক্ত ও একজন ত্রুটিহীন ব্যক্তির ছবি এঁকেছেন।
অদ্বেষ্টা সর্বভূতানাম:
যখন কোন ব্যক্তি উপলব্ধি করেন যে একই আত্মা সর্বত্র বিরাজমান, তখন আর তাঁর মনে কারুর প্রতি ঘৃণা থাকেনা। তিনি তখন বুঝতে পারেন যে, এমন কেউ নেই যে ‘তাঁর’ থেকে আলাদা।
নিজের হাতকে কেউ ঘৃণা করেনা, কারণ সে নিজেও ঐ হাতে আছে। নিজেকে কেউ ঘৃণা করেনা
ঐরকম ব্যক্তি সকলের প্রতি বন্ধুভাবাপন্ন হন। তাঁর মনে সকলের জন্য সহানুভূতি থাকে। অভাবী মানুষকে তিনি তাঁর সবকিছু দিতে প্রস্তুত থাকেন। কোন কিছুকেই তিনি নিজের বলে মনে করেন না। কিছু মানুষের মনে অন্যকে কিছু দিলে যে অহংকার জন্মায় তিনি সম্পূর্ণরূপে সেরকম অহংকার শূন্য হন। তাঁর শান্ত ও মরমী স্বভাবের জন্য যদি তাঁর সম্পদ চলে যায় এবং তাঁকে দুঃখে পড়তে হয়, তাতেও তিনি কষ্ট অনুভব করেন না। জগৎ যদি তাঁর প্রশংসা করে, তাতেও তাঁর সুখ অনুভব হয়না। সুখ অথবা দুঃখ উভয় ক্ষেত্রেই তাঁর মন সাম্যাবস্থায় থাকে।
এমন ঈশ্বরমুখী, নিঃস্বার্থ মানুষের সঙ্গে অনেক সময় বিনা কারণে নির্দয় আচরণ করা হয়। কিন্ত তিনি সর্বদাই সহনশীল হন ও সবাইকে ক্ষমা করে দেন। যেমন আমরা সবাই জানি যে কোন কারণ ছাড়াই যীশুকে ক্রুশবিদ্ধ করা হয়। কিন্ত যীশু সেই মানুষগুলিকে ক্ষমা করেন এবং সমস্ত যন্ত্রণা ও অত্যাচার শান্তভাবে সহ্য করেন।
১৩নং শ্লোকে শ্রীকৃষ্ণ, কীভাবে যথার্থ ভক্ত হওয়া যায় তার পথ দেখিয়েছেন। কখনও, কখনও আমাদের মনে হয় যে, কোন ব্যক্তির আচরণ নির্দয়, অপ্রিয় বা রূঢ় হলে, তাকে ভালবাসা সহজ হয়না। কিন্ত আমাদের উচিত, তার আচরণের মনুষ্যকৃত দিকটিকে না দেখে, সবার মধ্যেই যে দিব্য স্ফুলিঙ্গ আছে তার সন্ধান করা।
সকল প্রাণীর, সকল বস্তর সত্য হলেন ঈশ্বর। সেই সত্য সম্পর্কে সচেতনতা সকল সৎগুণ ও ভালত্বের বীজতলা। এই সত্য আমাদের মধ্যে যত গভীর ভাবে উপলব্ধ হবে, ততই ‘ওরা’ এই বোধ বিবর্ণ হতে থাকবে। ভয়, ঈর্ষা, ঘৃণা এগুলিও চলে যাবে। সবই যখন সেই এক ‘পরমাত্মা’ তখন কে কাকে ঘৃণা করবে? আমাদের বাবা বলেন, আমাদের উচিত, ‘সবের মধ্যে সবকে দেখা।’ শ্লোকটি বলে যে মানুষ মাত্রেই একে অপরের ভাই এবং ঈশ্বর তাদের সকলের পিতা।
অহংকার হল দেহ চৈতন্য রূপ আবরণ, যা দিব্য চৈতন্যকে লুকিয়ে রেখেছে। যখন এই ক্ষুদ্র ‘আমি’ অদৃশ্য হয়ে যায়, তখনই সার্বিক ‘আমিকে’ দেখা যায়।ঘৃণাকে এড়িয়ে চলাটাকে সদর্থক গুণ বলা যায়না।এমন লোক আছে যারা অন্যকে ঘৃণা করেনা, কিন্ত তাদের হৃদয় পাথরের মতন। যিনি যথার্থ ভক্ত, তাঁর হৃদয় প্রেমে এবং অন্যের সেবা করার জন্য দ্রবীভূত হয়; অন্যের আনন্দকে তিনি নিজের আনন্দ বলে মনে করেন। আমাদের আধুনিক জগতে এমন অনেক মানুষের উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে যাঁরা দরিদ্র, ভেঙে পড়া, অসহায় এবং অত্যাচারিতদের জন্য নিঃস্বার্থ ভাবে কাজ করেন। মাদার টেরেসা এর উজ্জ্বল উদাহরণ। এমনই আরেক উদাহরণ হলেন বাবা আমতে। এঁরা দুজনেই মানুষের সেবায় নিজেদের উৎসর্গ করেছেন। তাঁদের স্বভাব প্রেমপূর্ণ এবং তাঁরা তাঁদের সহমানবদের যন্ত্রণা অনুভব করেন।
গল্প:
সন্ত একনাথ
একনাথ নামে একজন মহান সন্ত ছিলেন। তিনি ক্রোধ জয় করেছিলেন। এক বিত্তবান ব্যক্তি, একনাথের নামযশ হওয়ায়, তাঁর প্রতি খুব ঈর্ষান্বিত ছিলেন। তিনি জানালেন যে একনাথকে কেউ যদি রাগাতে পারে, তাহলে তিনি তাকে ৫০০ টাকা দেবেন। একটি দুষ্টু লোক তার কথায় রাজী হল। একনাথ যখন গোদাবরী নদী থেকে চান করে ফিরছেন, সে তখন সেখানে গিয়ে একনাথের মুখে থুতু ছুঁড়ে দিল। সন্ত একনাথ ফিরে গিয়ে আবার নদীতে চান করে এলেন। এইভাবে সেই দুষ্ট লোকটি, একনাথের ওপর ১০৮ বার থুতু ফেলল এবং একনাথ প্রত্যেকবার খুশীমনে নদীতে গিয়ে চান করে এলেন। এর ফলে সেই দুষ্ট লোকটির মনে এক বিশাল পরিবর্তন এল। সে সন্ত একনাথকে প্রণাম করে তাঁর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করল। সন্ত একনাথ সবার মধ্যে ঈশ্বরকে দেখতেন। তিনি হাত জোড় করে সেই লোকটিকে বললেন, “হে ভগবান পান্ডুরঙ্গ তোমার কী অসীম কৃপা! আমার একবারও ঐ পবিত্র নদীতে চান করতে আলস্য হতো, কিন্ত তুমি আজ আমায় দিয়ে ১০৮ বার চান করিয়ে নিলে। হে আমার মাতা, পিতা, আমার ঈশ্বর, এই বেশ ধারণ করে ভক্তকে পরীক্ষা করতে আসার জন্য আমার ধন্যবাদ গ্রহণ করো।”
এই কথা শুনে সেই দুষ্ট লোকটির বিবেক জাগ্রত হল। সে সন্তের কোলে পড়ে শিশুর মতন কাঁদতে লাগল। সে বললে, “আমি পাপী, আপনি আমার অপরাধ ক্ষমা করুন। ঐ ধনী লোকটি টাকা দেবে বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, তাই জন্য আমি আপনাকে রাগিয়ে দিতে চেষ্টা করেছিলাম। কিন্ত আপনি যথার্থই সন্ত।”
একনাথ হেসে বললেন, “বাছা, তুমি আমায় বললেনা কেন যে আমি রাগ করলে তুমি টাকা পাবে। তাহলে আমি অন্ততঃ রাগের ভান করতে পারতাম। তাহলে তোমারও কিছু অর্থ লাভ হতো।” কিন্ত পরবর্তী কালে তিনি তাঁর এই নতুন ভক্তকে বলেছিলেন, ঈশ্বরের নাম এবং সাধুসঙ্গই সত্যকার ঐশ্বর্য্য।
প্রশ্ন:
- কৃষ্ণের মতে ঈশ্বরের প্রকৃত ভক্ত কে?
- সত্যকার বন্ধুত্ব কাকে বলে? ত্যাগ বলতে কি বোঝায়?
- গর্ব ও অহংকার মানুষকে টেনে নীচে নামায়, কেন?
- মানসিক সাম্যের অর্থ কি?
- যাদের মনের জোর থাকে তারাই ক্ষমা করতে পারে—আলোচনা কর।
- একজন ত্রুটিহীন মানুষের কিছু গুণের কথা বল।
- ‘দুঃখ’ ও ‘সুখ’ কিসের ফল?
- একজন যথার্থ ঈশ্বরভক্তের কী, কী গুণ থাকা প্রয়োজন?
- সহানুভূতি ও প্রেম কী? যে কোন সন্তের করুণার একটি নিদর্শন দাও। হৃদয়ে গর্ব ও অহংকার প্রবেশ করলে ঈশ্বর সেখান থেকে চলে যান–আলোচনা করো।
- সকলকে ভালবাসো, সকলের সেবা করো, এই হল আমাদের ‘সাই’ এর বার্তা—আলোচনা করো।