অনন্যাশ্চিন্তা‐–বিশদ পাঠ

Print Friendly, PDF & Email
অনন্যাশ্চিন্তা‐–বিশদ পাঠ

এই শ্লোকে ভগবান বলছেন, “যারা সর্বদা একাগ্র ভক্তির সঙ্গে আমার চিন্তা করে, যারা আমায় পূজার অর্ঘ্য নিবেদন করে, যারা তাদের ভাবনায় সর্বদা আমার সঙ্গে যুক্ত থাকে,আমি তাদের রক্ষা করব, তাদের সকল প্রয়োজন পূর্ণ করব, সর্বদা তাদের মঙ্গলের দিকে লক্ষ্য রাখব,কথা দিলাম।”

ভগবান ঘোষণা করেছেন, “যারা কেবল আমাকেই ভালবাসে,আর কারুকে নয়, যারা সদাই আমার চিন্তা করে, যারা নিঃস্বার্থ ভাবে আমার পূজা করে,যাদের চিন্তা সর্বদা আমাতেই নিবদ্ধ থাকে,আমি তাদের পূর্ণ সুরক্ষা দিই,এবং নিজে তাদের সকল প্রয়োজন পূর্ণ করি।”জাগতিক ভোগানন্দের প্রতি এমন ভক্তদের কোনো আকর্ষণ থাকেনা। যারা সত্য কার ভক্ত, প্রভুর সঙ্গে এক সেকেন্ডের বিচ্ছেদও তাদের কাছে অসহনীয় বোধ হয়। গোপীরা এমন সত্যকার ভক্ত ছিল।

এমনকি গোপীরা ব্রহ্মার কাছে নালিশ জানালেন যে কেন তিনি চোখের পাতা সৃষ্টি করলেন, কারণ চোখের পাতা খোলা বন্ধ হওয়ার জন্য তাঁরা প্রভুকে দেখতে পাচ্ছেন না। একবার নারদ হনুমানকে জিজ্ঞেস করলেন যে তিনি কি করে সময় কাটাচ্ছেন। হনুমান উত্তর দিলেন যে রাম নাম জপের জন্য তাঁর কাছে পর্যাপ্ত সময় বাঁচেনা। বালক ভক্ত প্রহ্লাদের ওপর নানান ভাবে অত্যাচার করা হতো। কিন্ত প্রত্যেকবার ঈশ্বর তাকে রক্ষা করতেন। যে সত্যকার ভক্ত, ঈশ্বর তার বন্ধু, পথপ্রদর্শক ও তত্ত্বোপদেষ্টা। ঈশ্বর তাঁর ভক্তকে সর্বতোভাবে রক্ষা করেন।

যদি সবাই সত্য, ধর্ম, শান্তি ও প্রেমের পথে চলে এবং একই সঙ্গে নিয়মিত ভাবে ঈশ্বরের নাম জপ করে ,ঈশ্বর তাদের সকলকে সেই সবকিছু দেবেন যা তাদের প্রয়োজন, যা তাদের প্রাপ্য এবং যা তাদের মানসিক শান্তি দেবে। এর জন্য যে শর্ত পূরণ করতে হবে, তা হল অনন্য বা একাগ্র স্মরণ ও উপাসনা। উপাসনা অর্থাৎ এমন ঈশ্বরের ধ্যান যাতে অন্য কোন চিন্তা ব্যাঘাত ঘটাবে না। তছাড়া প্রয়োজন নিয়মিত আরাধনা। “যোগ” এই শব্দটির অর্থ, কাম্য বস্তর প্রাপ্তি। “ক্ষেম” শব্দটির অর্থ, যা প্রাপ্ত হল, তার সুরক্ষা। যে শৃঙ্খলার পথ ধরে চললে প্রাপ্তকে সুরক্ষিত রাখা যায়, তা হল, অনন্য চিন্তন–সব কিছু সরিয়ে রেখে ঈশ্বরের ধ্যান।

মনে করা হয় যে এই শ্লোকটি ঈশ্বরের এক পরম ঘোষনা। এটিতে আধ্যাত্মিক স্তরে জীবন যাপনের মহান নিয়মের কথা বলা হয়েছে। শ্রীকৃষ্ণ এখানে প্রতিজ্ঞা করছেন যে যারা কেবল তাঁরই পূজা করবে, একাগ্র মনে তাঁর ধ্যান করবে এবং এই পরিবর্তনশীল জগতে তাঁকেই একমাত্র সত্য বলে জানবে, তিনি তাদের যোগ ও ক্ষেম দেবেন। জাগতিক দৃষ্টিতে একথার অর্থ, যদি কেউ নিরন্তর ঈশ্বরের চিন্তা করে এবং সম্পূর্ণ ভাবে ঈশ্বরের সঙ্গে একই তারে বাঁধা থাকে,তাহলে ঈশ্বর তার জীবনের সকল প্রয়োজন—-খাদ্য, পরিধেয়,আশ্রয় সবের ভার গ্রহণ করেন। ভগবান এটি সেই ভক্তের জন্য করে থাকেন যে মন থেকে, একনিষ্ঠ ভাবে ঈশ্বরকে চায় এবং যে ঈশ্বর উপলব্ধির পথে বহুদূর এগিয়ে গিয়েছে। ঈশ্বরের জন্য তার ব্যাকুলতা ও চাওয়া এতটাই তীব্র যে তার মন সর্বদাই ঊর্দ্ধমুখী থাকে এবং খুব কমই জাগতিক স্তরে নেমে আসে। তখন সেই ভক্তের ভার ভগবান বহন করেন যাতে তাকে অন্নের জন্য পরিশ্রম করতে না হয় এবং সে ঈশ্বর মাদকতার উচ্চ থেকে উচ্চ স্তরে আরোহণে উৎসাহ লাভ করে। মহাপুরুষদের জীবনীতে আমরা দেখেছি যে ঈশ্বর সেক্ষেত্রে চমৎকার ঘটিয়ে থাকেন। স্বামী রামদাস গৃহত্যাগ করেন এবং ঈশ্বরের কৃপানির্ভর হয়ে জীবন যাপন করতেন। রামের যেমন ইচ্ছা তাঁকে আহার দিতেন, তাঁর আশ্রয়ের ব্যাবস্থা করতেন।

সকল সাধকের জন্যই এই শ্লোকের দ্বিতীয় অর্থটি খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। সেটি হল এই যে ঈশ্বর সাধককে উৎসাহ দেবার জন্য শুধু যে তার জীবনের ন্যুনতম চাহিদা পূরণ করেন তাই নয়, তিনি তার আধ্যাত্মিক উন্নতি ও সাধনার জন্য আরো,আরো সুযোগ করে দেন। তারপর ঈশ্বর সেই সাধককে পরম জ্ঞানের ও আনন্দের(ক্ষেমের) স্বর্গীয় চরম ক্ষণটিতে পৌঁছে দেন।
সুতরাং এই প্রসঙ্গে “যোগ” শব্দটির অর্থ হল “ভক্তদের যা প্রয়োজন তার ব্যবস্থা” অর্থাৎ দেহের সুরক্ষা; “ক্ষেম” শব্দটির অর্থ হল, তাকে যা দেওয়া হয়েছে, তার সুরক্ষা। সুতরাং সেই সব ভক্তদের কোন ক্ষতি হতে পারেনা। ঈশ্বর স্বয়ং তার খেয়াল রাখবেন যাতে তাঁর ভক্তের কোনও কষ্ট না হয়। সেই ভক্তের তো তার হৃদয়বাসী ইষ্ট দেবতা ছাড়া আর কোন কিছুতে আগ্রহই নেই। তিনিই তার জীবনের একমাত্র লক্ষ্য। ঈশ্বর স্বয়ং তাঁর ভক্তের সাহায্যের জন্য আবির্ভূত হচ্ছেন, এমন বহু উদাহরণ, নারসি মেহতা,নামদেব,সাকুবাঈ, জনাবাঈ,গুরু নানক ইত্যাদি সন্তদের জীবনে দেখা যায়।

কার মধ্যে অনন্যা ভক্তি আছে,তা এইসব লক্ষণ দেখে বোঝা যায়। তিনি কেবল ঈশ্বরের কথাই বলেন, তাঁর নামগান করেন, কেবল তাঁকেই দর্শন করেন, তিনি ঈশ্বরের জন্য কাজ করেন এবং ঈশ্বরের সঙ্গেই তাঁর অবসর যাপন করেন। — গীতাবাহিনী।

কাহিনী: এই শ্লোকটির অর্থ বোঝার জন্য স্বামী বিবেকানন্দের জীবন থেকে একটি ঘটনা।

উত্তরপ্রদেশের গ্রীষ্মের একটি, মধ্যাহ্ন।চারিদিক জ্বলে যাচ্ছে। স্বামীজী তরী ঘাটে ট্রেন থেকে নামলেন। তাঁর সঙ্গে ছিল কেবল সন্ন্যাসীর পোষাক, আর ট্রেনের তৃতীয় শ্রেণীর একটি টিকিট। টিকিটটি ছিল কিছুদূরের এক স্টেশনের। সেটি কেউ তাঁকে দিয়েছিল। তাঁর সঙ্গে কমন্ডলুও (জলের পাত্র) ছিল না। কুলিরা তাঁকে স্টেশনের শেডের মধ্যেও থাকতে দিচ্ছিল না। তিনি তখন তৃতীয় শ্রেণীর যাত্রীদের অপেক্ষা করার শেডের খুঁটিতে ঠেসান দিয়ে মাটিতে বসে পড়লেন। নানান লোকের সেই ভীড়ের মধ্যে ছিল উত্তর ভারতের এক মধ্যবয়স্ক ব্যবসায়ী। সে একটু দূরেই একটি শতরঞ্জি পেতে বসে ছিল। সেই শেডের ঢাকার মধ্যে, স্বামীজীর প্রায় বিপরীতে লোকটি বসেছিল। সে বুঝতে পেরেছিল যে স্বামীজী বহুক্ষণ কিছু খাননি। আগের দিন রাত্রে তাঁরা একই কামরার যাত্রী ছিলেন। তিনি স্বামীজীকে নিয়ে ঠাট্টা তামাসা করছিলেন। বিভিন্ন স্টেশনে ট্রেন থামছিল। স্বামীজীর প্রচন্ড জল পিপাসা পেয়েছিল। কিন্ত তাঁর কাছে পয়সা না থাকায় তিনি জলবাহকদের কাছ থেকে জল কিনতে পারছিলেন না। ব্যবসায়ীটি নিজের তৃষ্ণা মেটাতে জল কিনেছিলেন। সেই জল পান করার সময় তিনি স্বামীজীকে বিদ্রূপ করছিলেন। তিনি বলেন, “দেখ,ভাল মানুষ কি ভাল জল! তুমি যেহেতু সন্ন্যাসী,পয়সা কড়ি ত্যাগ করেছ, তাই তুমি জল কিনতে পারছ না। এবার জল না খেয়ে থাকার আনন্দ উপভোগ করো। তার থেকে আমার মতন অর্থ উপার্জন করো না কেন?জীবন উপভোগ করো!”

সে সন্ন্যাস নেওয়াকে সমর্থন করতো না বা পার্থিব ভোগের বাসনা ত্যাগ করতে হবে, একথাতেও বিশ্বাস করতো না। তার মত ছিল এই যে সন্ন্যাসীদের অভুক্ত থাকাই উচিত। তাই তাঁরা দুজনেই যখন তরীঘাটে নামলেন, তখন সে তর্ক করে,উদাহরণ দিয়ে,মজা করে,নানাভাবে স্বামীজীকে বোঝাতে চেষ্টা করল যে,তাঁর যা প্রাপ্য ছিল, তিনি তাই পাচ্ছেন। বিদ্রূপ ভরা ,ব্যাঁকা হাসি হেসে সে বলল,” দেখ,আমি কি ভাল পুরী আর লাড্ডু খাচ্ছি! তুমি তো অর্থ উপার্জন করতে চাও না,তাহলে তোমাকে, তৃষ্ণায় শুকনো গলা আর অভুক্ত পেট নিয়ে খালি মাটিতে বসে থাকতে হবে!”

স্বামীজী চুপ করে চেয়ে রইলেন। তাঁর মুখের একটি পেশীও নড়ল না।

সেই সময় সেখানে স্থানীয় এক ব্যক্তি এল।তার ডান হাতে একটি পুঁটলি ও একটি গ্লাস। বাঁ হাতের তলায় একটি শতরঞ্জি ও মাটির পাত্রে জল। সে তাড়াতাড়ি একটি পরিষ্কার জায়গা দেখে শতরন্জিটি বিছিয়ে দিয়ে, তার ওপর তার হাতের জিনিষগুলি রাখল এবং স্বামীজীকে আহ্বান করে বলল,”আসুন বাবাজী,আমি আপনার জন্য যে খাবার এনেছি,তা গ্রহণ করুন!” তার কথা শুনে স্বামীজী বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেলেন। এর অর্থ কি? এই নবাগত ব্যক্তিটি কে? আর সেই ব্যঙ্গ করা ব্যবসায়ীর দৃষ্টি পালটে গেল নির্বাক বিস্ময়ে।

নবাগত ব্যক্তিটি সমানে জোর করতে লাগল, “আসুন বাবাজী,আপনাকে এখানে এসে এইসব খাবার খেতেই হবে।!”

স্বামী বিবেকানন্দ বললেন, “বন্ধু আমার আশংকা,আপনার কোথাও ভুল হচ্ছে। আপনি বোধহয় অন্য কারো সঙ্গে আমাকে গুলিয়ে ফেলছেন। আমার তো আগে আপনার সঙ্গে কোথাও দেখা হয়েছে বলে মনেই পড়ছে না।” সেই কথা শুনে অপর ব্যক্তিটি চেঁচিয়ে উঠল,”না না, আপনিই সেই বাবাজী যাকে আমি দেখেছি।!”

স্বামীজী জিজ্ঞেস করলেন, “তার মানে,আপনি আমাকে কোথায় দেখেছেন?” তাঁর কৌতূহল খুব বেড়ে গেল। এদিকে তাঁর রসিক বন্ধুটি হাঁ করে সবকিছু দেখছিল।

লোকটি বলল,”আমি একজন মিঠাইওয়ালা। দুপুরে খেয়ে দেয়ে অভ্যাস মতন ঘুমোচ্ছিলাম। আমি স্বপ্ন দেখলাম যে শ্রী রাম আপনার দিকে আঙুল দেখিয়ে আমাকে বলছেন,যে গতকাল থেকে আপনি অভুক্ত আছেন দেখে তাঁর খুব কষ্ট হচ্ছে। তিনি বললেন, আমি যেন তখুনি উঠে কিছু পুরী তরকারি তৈরী করে রেলওয়ে স্টেশনে আপনার কাছে নিয়ে আসি।সঙ্গে যেন কিছু মিষ্টি থাকে,ভাল শীতল জল থাকে আর আপনার বসার জন্য শতরঞ্জি থাকে। আমি ঘুম ভেঙে উঠে ভাবলাম এটি স্বপ্ন। আমি আবার পাশ ফিরে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম। কিন্ত শ্রী রাম কৃপা করে আবার আমায় দর্শন দিলেন। বস্তুতঃ তিনি আমাকে ঠেলে ঘুম থেকে তুলে দিলেন এবং তাঁর কথা শুনতে বললেন। আমি তাড়াতাড়ি কিছু পুরী তরকারি করে,সকালে তৈরী করা কয়েকটা মিষ্টি নিয়ে, শীতল জল, আর আমার দোকান থেকে শতরন্জি নিয়ে, ছুটে সোজা এখানে চলে এসেছি। আমি তখনি দূর থেকে দেখেই আপনাকে চিনতে পেরেছি। এবার আসুন টাটকা থাকতে, থাকতে খাবারগুলো খান। আপনার নিশ্চয়ই খুব খিদে পেয়েছে।” তখন স্বামীজীর মনের কি অবস্থা হয়েছিল তা সহজেই কল্পনা করা যায়। তিনি তাঁর সমস্ত অন্তর দিয়ে তাঁর এই সরল,খাদ্যদাতাটিকে ধন্যবাদ জানালেন। তাঁর চোখ থেকে প্রেমের অশ্রু ঝরে পড়তে লাগল। কিন্ত সেই দয়ালু লোকটি প্রতিবাদ করে বলল,”না না বাবাজী,আমাকে ধন্যবাদ দেবেন না। এ সবই শ্রী রামের ইচ্ছা!” এই ঘটনায় সেই উপহাস করা ব্যবসায়ীটি থমকে গেল। সে স্বামীজীকে বলা তার সকল কটু কথার জন্য স্বামীজীর কাছে ক্ষমা চাইল এবং তাঁর চরণধূলি গ্রহণ করল।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।