অনুদ্বেগকরম্ – বিশদ পাঠ
অনুদ্বেগকরম্—বিশদ পাঠ
- অনুদ্বেগকরম বাক্যম সত্যম প্রিয়হিতম চ যৎ
- স্বাধ্যায়ভাষনং চৈব বাঙ্ময়ং তপ উচ্যতে।।
যে বাক্য উত্তেজক নয়, যে বাক্য সত্য, মধুর ও হিতকারী, তেমন বাক্য ও পবিত্র শাস্ত্র গ্রন্থের পাঠকেই ‘বাচিক তপস্যা’ বলা হয়।
যে বাক্য কারুকে আঘাত করেনা, সত্য বচন, প্রিয় ও হিতকারী বচন এবং বেদাদি শাস্ত্র গ্রন্থের পাঠকেই বাচিক তপস্যা বলা হয়।
আমাদের ভগবান বলেন, “সবসময় সন্তুষ্ট করা হয়ত সম্ভব হয়না কিন্ত মিষ্ট কথা সবসময়ই বলা যায়।” উদাহরণ স্বরূপ, ধরা যাক কোন ব্যক্তি অন্ধ। সেটাই সত্য। কিন্ত আমরা যদি তাকে, ওহে অন্ধ! বলে সম্বোধন করি, তাহলে তার মনে কষ্ট হবে। সত্য হলেও ঐ শব্দ উচ্চারণ মধুর নয়।এইজন্য শ্রীকৃষ্ণ বলছেন, সত্য, প্রিয়হিত—বাচিক সংযম খুবই জরুরী। নীরবতার মধ্যেই ঈশ্বরের কন্ঠ শোনা যায়।
বাবা বলেন, প্রথমে আমাদের জিহ্বাকে নামস্মরণের দড়ি দিয়ে বাঁধতে হবে। এই প্রসঙ্গে অম্বরীশের কাহিনী খুব ভাল উদাহরণ। যেহেতু অম্বরীশ সর্বদাই মিষ্টভাষী ছিলেন, অন্যকে কথার দ্বারা আঘাত করা তাঁর স্বভাব বিরুদ্ধ ছিল, ঈশ্বর তাঁকে প্রকৃত ভক্ত বলে স্বীকার করে নিয়েছিলেন। তিনি সর্বদা তাঁর জন্য সদাপ্রস্তুত ছিলেন।.
অম্বরীশ একাদশী ব্রত পালন করতেন। দ্বাদশীর দিন, তিনি একজন ব্রাহ্মণ অতিথিকে ভোজন করিয়ে তবে নিজে অন্ন গ্রহণ করতেন। এইরকম এক দ্বাদশীর দিনে সৌভাগ্য ক্রমে তিনি ঋষি দুর্বাসাকে অতিথি রূপে পেলেন। রাজা ঋষিকে তাঁর সঙ্গে আহার গ্রহণ করতে অনুরোধ করলেন। ঋষি স্নান করতে গিয়ে অনেক দেরীতে ফিরলেন। অম্বরীশ যখন উপবাস ভঙ্গ করে জল খেতে যাচ্ছেন, তখন ঋষি সেখানে উপস্থিত হলেন। তিনি প্রচন্ড রেগে গেলেন এবং অম্বরীশকে বিপন্ন করতে চাইলেন। ঋষি এক অদ্ভুত জীব সৃষ্টি করলেন। ঐ রাক্ষস অম্বরীশকে বধ করতে গেল। এইসময় বিষ্ণুর সুদর্শন চক্র তাকে নিধন করল। চক্র এরপর দুর্বাসাকে তাড়া করল। দুর্বাসা তখন সত্যলোকে, কৈলাসে এবং পরিশেষে বিষ্ণুর কাছে গেলেন। বিষ্ণু তাকে বললেন যে রাজা অম্বরীশ তাঁর প্রকৃত ভক্ত, তাঁকে উত্যক্ত করা ঋষির উচিত হয়নি। বিষ্ণু বললেন জ্ঞান ও তপস্যাকে তখনই শ্রদ্ধার্হ বলা যায়, যখন তার সঙ্গে নম্রতা ও বিনয় যুক্ত থাকে। রাজা অম্বরীশ এতটাই নম্র ও বিনয়ী যে তাঁর রক্ষার জন্য স্বয়ং ঈশ্বরকে ছুটে যেতে হয়েছিল। তিনি দুর্বাসাকে অম্বরীশের কাছে ফিরে গিয়ে তাঁর কাছে ক্ষমা চাইতে বললেন।
ব্যাখ্যা:
পাঁচটি জ্ঞানেন্দ্রিয়কে তাদের সীমা ও ক্ষমতা ভাল করে বুঝে সাবধানে ব্যবহার করতে হবে। তোমাদের প্রাত্যহিক জীবনে যদি কতিপয় দুরন্ত শক্তির ও তাদের প্রয়োগের সম্মুখীন হতে হয় সেই ক্ষেত্রে তোমরা তাদের ওপর যেমন নিয়ন্ত্রণ রাখবে, এদের ওপরেও সেই একই রকম নিয়ন্ত্রণ রাখতে হবে।
উদাহরণ হিসেবে আগুন আর বিদ্যুতের কথা ধরা যেতে পারে। সঠিক ভাবে প্রয়োগ করলে তাদের দ্বারা অনেক উপকার পাওয়া যায়। তা নাহলে এগুলি বিপদ ডেকে আনতে পারে। জিহ্বার দুটি ক্ষমতা রয়েছে। বাকশক্তি ও রসাস্বাদনের ক্ষমতা।
উপবাসের ফলে স্বাস্থ্যের উন্নতি হয়। মনেও আনন্দ ও শান্তি পাওয়া যায়। উপবাস বাককে সংযত করে। জিহ্বাকে ঠিক মতন সংযত করতে পারলে অন্য জ্ঞান ইন্দ্রিয়গুলি আপনার থেকে সঠিক পথে চলে আসে। বাসনা ত্যাগ করতে পারলে তোমরা মনের সমতা লাভ করতে সক্ষম হবে।
মানসিক তপস্যার জন্য কঠোর সতর্কতা প্রয়োজন। মন থেকে সব নঞর্থক চিন্তা যা মনকে দুর্বল করে দেয় সেগুলিকে উৎপাটিত করতে হবে। বাচিক তপস্যার ফলে অসীম ক্ষমতা লাভ হয়। কথা বলতে দাম লাগেনা কিন্ত শব্দ অমূল্য। খুব সাবধানতার সঙ্গে তার ব্যবহার করা উচিত। মধুর ও সত্য কথা বলার জন্য জিহ্বাকে ব্যবহার করা উচিত। কথার দ্বারা অন্যের মনে আঘাত করা পাপ।প্রত্যেকের মধ্যে ঈশ্বর বাস করেন। যে ব্যক্তি অন্যকে অপমান করে, আসলে সে স্বয়ং ঈশ্বরকেই অপমান করছে।
স্বাধ্যায় অভ্যাসনম—গুরুর শিক্ষা, যেখানে বেদের প্রজ্ঞা বিবৃত হয়েছে, সেগুলি পাঠ করার গুরুত্ব অপরিসীম। বাক সংক্ষিপ্ত হলেও এবং তা শব্দমাত্র মনে হলেও তার মধ্যে পারমাণবিক বিষ্ফোরকের শক্তি থাকে। কোন হতাশায় ডুবে থাকা ব্যক্তিকে যখন আনন্দদায়ক কথা বলা হয়,তখন তার মধ্যে হস্তীর মতন বল সন্চারিত হয়ে পরিবর্তন নিয়ে আসে।
আর যখন কোন শক্তিমান ও আনন্দময় ব্যক্তিকে কেউ হতাশাজনক কথা বলে,তখন সে দুঃখের ভারে ভারাক্রান্ত হয়ে মাটিতে বসে পড়ে। শব্দ মানুষকে তুলে ধরতে পারে অথবা নীচে নামাতে পারে। বেশী কথা বললে শক্তির অপচয় হয় এবং স্মৃতিশক্তি কমে গিয়ে অকাল বার্ধক্য চলে আসে। রেডিও খুব আস্তে করে চালালেও, ব্যাটারি ক্ষয় হয়। ঠিক একই ভাবে মনের ভিতর কথোপকথন চলতেই থাকে; সেটা জোরে বলা না হলেও, তার ফলে আমাদের শক্তি ক্ষয় হয়ে থাকে। আমরা নীরব উপবেশন ও ধ্যানের সাহায্যে শক্তি লাভ করে তাকে উচ্চ আদর্শের দিকে চালিত করতে পারি।
বাক ভাবপ্রকাশের অতি শক্তিমান মাধ্যম। তাকে বক্তার চিন্তা শক্তির যানবাহন বলা যায়। বাক্যকে যদি তেজস্বী ও বিশ্বাসযোগ্য হতে হয় তাহলে সেই উচ্চারিত শব্দসমূহের সঙ্গে চিন্তার সামঞ্জস্য ও সমন্বয় থাকা আবশ্যক। মানুষের কথা থেকে তার বুদ্ধি, সংস্কৃতি এবং মানসিক গঠন বোঝা সহজ। এরকম দেখা যায় যে খুব সামান্য কথা মনের ওপর গভীর রেখাপাত করে। আবার কখনও খুব উচ্চ শক্তি সম্পন্ন, বুদ্ধিযুক্ত, ভেবে চিন্তে বলা ভাষণও আমাদের মনে দাগ কাটতে পারেনা। তার কারণ বক্তার ব্যক্তিত্ব বোঝা যায়। হয়তো বক্তা আত্মসংযমী বা তার নিজের ওপর কোন নিয়ন্ত্রণ নেই। যতক্ষণ না কোন ব্যক্তি অন্যের
সঙ্গে সোজা সরল ব্যবহার করছে,ততক্ষণ তার মধ্যে দ্বৈত সত্তা কাজ করবে। সে এক কথা বলবে, আর তার আচরণ হবে বিপরীত।
কথা এমন হওয়া উচিত যা উত্তেজক হবেনা বা কারুকে আঘাত করবেনা।
কথা এমন হওয়া উচিত যা অন্যকে আঘাত করবেনা। বাক্য যেন কাউকে আঘাত না করে, কারুর বিরক্তি উৎপাদন না করে,বা অশ্লীল না হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। আমরা যদি সংবেদনশীল হই ও চোখ খোলা রাখি, তাহলে শ্রোতার মুখ দেখেই বুঝতে পারব যে আমার কথায় তার মনে কি প্রতিক্রিয়া হয়েছে। রূঢ় ভাষণ বা অবিবেচকের মতন কথা বলার জন্য অনেকেই ভাল বন্ধু হারান। যে বাক্য উচ্চারিত হল, তা যদি সত্য হয়, প্রিয় হয়, হিতকারী হয় এবং সত্য প্রকাশের উদ্দেশ্য নিয়ে অন্যের হিতার্থে উচ্চারিত হয়, অমায়িক হয়,তাহলে বক্তাও আশীর্বাদ লাভ করেন। কথায় আছে, “সততাই সর্বোৎকৃষ্ট পন্থা।” একটি মিথ্যা বলে, তাকে ঢাকার জন্য আরও দশটা মিথ্যা বলতে হয়।
যখন কারো কথার মধ্যে আড়ষ্টতা থাকেনা, এবং তা নম্র হয়, আর সেই কথায় বক্তার মনোভাব সঠিক ভাবে প্রকাশিত হয়, তখন বোঝা যায় যে তার চিন্তা, বাক্য ও ক্রিয়ার মধ্যে সামঞ্জস্য রয়েছে। গীতাচার্য্য শ্রী কৃষ্ণ বলেছেন যে বচন কেবল সত্য হলে হবেনা, তাকে মধুরও হতে হবে। কখনও, কখনও সত্য বচন নিষ্ঠুর হয়। সেক্ষেত্রে কথা বলার চেয়ে চুপ করে থাকা ভাল।
পরের লাইনে বলা হয়েছে, শ্রী কৃষ্ণ বলেছেন স্বাধ্যায় বা নিয়মিত পবিত্র গ্রন্থের পাঠও’ বাচিক তপস্যার’ অন্তর্ভুক্ত। কিছু লোক মনে করেন যে কথা না বলে তাঁরা বাচিক তপস্যা করছেন। আমাদের বাবা বলেন, যে মনের ভিতরে সর্বক্ষণ যে বাক্যালাপ চলেছে, তাকে নিরুদ্ধ করতে হবে। মনকে নীরব করার জন্য কিছু সাধনার প্রয়োজন আছে। প্রাথমিক ভাবে সাধনা হবে সঠিক চিন্তা ও তদনুযায়ী সঠিক কাজ করা। এইভাবে যখন মন শুদ্ধ হবে,তখন স্ব-পাঠ বা স্বাধ্যায় শুরু করা যেতে পারে। স্বাধ্যায়ের অর্থ যত্ন সহকারে প্রাচীন শাস্ত্রের অধ্যয়ন।
এরপর, যা পড়লাম তার ওপর মনন করতে হবে। ঋষিরা যে মন্ত্র দিয়ে গিয়েছেন সেগুলি হল সত্য। তার ওপর মনোনিবেশ সহকারে মনন করতে হবে। এইভাবে, বৃথা বাক্যালাপে সময় নষ্ট না করে আমরা যদি এমন কথা বলি যা সত্য ও যা শ্রোতার মনকে উর্দ্ধমুখী করে,তাহলে আমাদের প্রাণশক্তি সঠিক পথে প্রবাহিত হয়। এই শক্তি তখন স্বাভাবিক ভাবেই ধ্যান ও সেবাকাজের দিকে ধাবিত হবে এবং তার ফলে আসবে সবার প্রতি প্রেম।
আমরা বাচিক তপস্যা করলে অগাধ শান্তি লাভ করব। আমাদের প্রাত্যহিক জীবনে আমরা এমন মানুষের সাক্ষাৎ পাই যাঁরা প্রভূত শান্তি ও নিস্তরঙ্গ মন লাভ করেছেন। আমরা তাঁদের চরিত্রে, আচরণে সেটি লক্ষ্য করি। তাঁরা নম্র ভাবে কথা বলেন ও স্বল্পভাষী হন। প্রয়োজন ছাড়া কথা বলেন না। কিন্ত যদি তাঁদের কিছু বুঝিয়ে বলতে বলা হয় বা সকলের সামনে ভাষণ দিতে বলা হয়, তাঁরা আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে নির্ভুল ভাবে তাঁদের বক্তব্য রাখেন।
আমাদের প্রভু সাই তো অবতার। তবুও তিনি খুব কম কথা বলেন। আর যখন বলেন নীচু গলায় বলেন। তাঁর কথায় গভীর তাৎপর্য থাকে। তাঁর বচন অতি কোমল। সেই কথায় শ্রোতার মন প্রেম ও শান্তির আবরণে আবৃত হয়। আমাদের এই মহান দেশে সব মহাপুরুষেরাই স্বল্পভাষী ছিলেন। মহর্ষি রমণ নীরবতার মধ্য দিয়ে ও আন্তর ভাব বিনিময়ের সাহায্যে শিক্ষা দিতেন।
গল্প: (চিন্ন কথা)
শব্দই বক্তার শিক্ষাদীক্ষার পরিচয় দেয়।
“এই যে! তুমি কী সৈন্যদের এই দিক দিয়ে কুচকাওয়াজ করে যেতে দেখেছ?” এক ব্যক্তি এক অন্ধ চাষীকে জিজ্ঞাসা করল।
কয়েক মুহূর্ত পরেই, আরেকজন তাকে জিজ্ঞেস করল, “এই অন্ধ! মুখ খোল দেখি। আমাকে বলো তুমি এই পথ দিয়ে সৈন্যদের কুচকাওয়াজ করে যাওয়ার আওয়াজ শুনেছ কিনা।”
পরে এক তৃতীয় ব্যক্তি তার কাছে এসে বলল, “বাবু আপনি কি এই পথ দিয়ে কিছু সৈন্যদের কুচকাওয়াজ করে যেতে শুনেছেন?
শেষে আর এক ব্যক্তি সেই অন্ধের কাছে এসে তার কাঁধে হাত দিয়ে জিজ্ঞেস করল, “আমার প্রিয় ভাই, দয়া করে আমায় বলো তুমি এই পথ দিয়ে কিছু মানুষ যাওয়ার আওয়াজ শুনেছ কিনা।” অন্ধ লোকটি ঠিক বুঝতে পারল কে, কে তাকে প্রশ্ন করেছে।
প্রথমে যে রুক্ষ ভাবে কথা বলল, সে ছিল একজন সৈন্য। দ্বিতীয়জন যে ‘অন্ধ’ বলে সম্বোধন করল, সে হল কাপ্তান। তাদের কথায় অন্যের মনে কি হল, শ্রোতার মনে কতটা আঘাত লাগল তাতে এই দুই প্রকৃতির লোকের কিছু যায় আসেনা। তৃতীয় ব্যক্তি ছিল মন্ত্রী। সে শৃঙ্খলাপরায়ণ এবং তার ব্যবহারও সুন্দর। সে অবশ্যই সুশিক্ষা লাভ করেছিল এবং একজন অন্ধ মানুষের সঙ্গে কথা বলার সঠিক ধারা তার জানা ছিল। কিন্ত শেষে যে ব্যক্তি সেই অন্ধর সঙ্গে স্নেহ ভরে কথা বলেছিলেন, তার কাঁধে হাত রেখে কথা বলেছিলেন, তিনি ছিলেন স্বয়ং রাজা। তাঁর নম্র ও বন্ধুত্বপূর্ণ কথাই তাঁর রাজ পরিচয় ব্যক্ত করেছিল। মানুষের কথা বলার ধরণ, তাতে ভনিতা বা লোক দেখানোর উদ্দেশ্য আছে কিনা, বস্ততঃএসবের ওপরেই তার মহত্ব নির্ভর করে।
জিহ্বা হল হৃদয়ের বর্ম। সেই মানুষের প্রাণ রক্ষা করে। জোরে কথা বলা, দীর্ঘক্ষণ কথা বলা, এলোমেলো কথা বলা, রাগ ও ঘৃণা ভরে কথা বলা, এইসমস্তগুলিই মানুষের স্বাস্থ্যের ক্ষতি করে। এইধরণের কথা অন্যের মনে ক্রোধ ও ঘৃণার জন্ম দেয়। অন্যের মনে ক্ষতের সৃষ্টি করে, অন্যকে উত্তেজিত করে, তাকে রাগিয়ে দেয়, এবং বিভেদ সৃষ্টি করে।-
নীরবতাকে কেন সোনার সঙ্গে তুলনা করা হয়?
যে মানুষ নীরব থাকে, তার কোন শত্রু থাকেনা অবশ্য বন্ধুও না থাকতে পারে। নিজের অন্তরে ডুব দিয়ে নিজের দোষ ও মনোভাব বিশ্লেষণের জন্য তার কাছে সময় থাকে।
অন্যের দোষ খোঁজার তার আর আগ্রহ থাকেনা। পা পিছলে গেলে হাড় ভেঙে যায়। কিন্ত তোমার জিহ্বা পিছলে গেলে তুমি অন্য কারো বিশ্বাস ও আনন্দ ভাঙ। সেই ক্ষত চিরকাল থেকে যায়। সুতরাং জিহ্বার ব্যবহারে খুব সতর্ক থেকো।
যত নম্র ভাবে কথা বলবে, যত কম কথা বলবে, যত মিষ্টি করে কথা বলবে, ততই তোমার পক্ষেএবং জগতের পক্ষেও ভাল।
গল্প:
আগুনের স্বভাব:
সূত্র নামে একজন জ্ঞানী ফকির বা সাধু ছিলেন। তিনি ছিলেন ভীষণ দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ও সাহসী। একদিন তার এক বন্ধু তাকে এসে বলল, “একজন বিখ্যাত সাধু এসেছেন। এই এলাকায় সবাই তাকে ভীষণ শ্রদ্ধা করে। চলো আমরা তাঁকে দর্শন করে আসি।” সূত্র তার কথায় রাজী হল এবং তারা সেই সাধুর কুটিরে গেল। সেখানে গিয়ে, হেঁট হয়ে তাকে প্রণাম করে, তারা বললে, “করুণাময় ঈশ্বরের জয় হোক।”
সাধুও তাদের সম্ভাষণ জানালেন এবং তাদের তাঁর কাছে এসে বসতে বললেন। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে সূত্র সেই সাধুকে জিজ্ঞেস করল, “আপনার কাছে কি আগুন আছে? আমার একটু প্রয়োজন ছিল। “সাধু উত্তর দিলেন, “না আমার কাছে এখন কোন আগুন নেই।”
আবার কিছুক্ষণ নীরবতার পর সূত্র পুণরায় জিজ্ঞেস করল, “সাধুবাবা, আপনার কাছে কি আগুন আছে?”
একটু বিরক্ত হয়ে সাধু বললেন, “আমি তো আগেই তোমাকে বলেছি যে আমার কাছে তা নেই।” কিন্ত এই উত্তরে সূত্র একেবারেই খুশী হলনা। সে সঙ্গে সঙ্গে তৃতীয়বার জিজ্ঞেস করল,” সাধুবাবা আমার আগুনের খুব প্রয়োজন। সুতরাং দয়া করে আমায় কিছু আগুন দিন। এতে সেই সাধু সত্যিই বিরক্ত হয়ে, রেগে জবাব দিলেন, “মূর্খ! দয়া করে আমার কাছে আগুন চাওয়া বন্ধ করো। আমার কথা কি তুমি বুঝতে পারছ না? আমি তোমায় তিনবার বলেছি যে আমার কাছে কোন আগুন নেই। তাতেও কি তোমার হচ্ছে না? নাকি তুমি ঐ বোকার মতন প্রশ্ন বারবার করে যাবে?”
সূত্র চুপ করে রইল এবং তার মধ্যে কোন বিকার দেখা গেল না। কিন্ত যেই সেই সাধু চুপ করলেন, সে বলল: ভাই,আমার সত্যিই আগুনের প্রয়োজন, তুমি কি নিশ্চিত যে তোমার কাছে কোন আগুন নেই?
এইবার প্রচন্ড রেগে সেই সাধু হাতে একটা লাঠি তুলে নিলেন। সূত্র’র দিকে এগিয়ে গিয়ে যতক্ষণ না লাঠিটা ভেঙে গেল, ততক্ষণ তাকে মারতে লাগলেন। তখন সূত্র হেসে বলল, “শান্ত হও ভাই। আমি এখন আমার প্রশ্নের জবাব পেয়ে গেছি। আমি যখন প্রথম এলাম, এসেই ধোঁয়া দেখতে পেয়েছি এবং ধোঁয়ার গন্ধ পেয়েছিলাম। সুতরাং আমি জানতাম যে এখানে আগুন আছে। এখন তো সবাই দেখতে পাচ্ছে যে ক্রোধাগ্নি দাউদা করে জ্বলছে। sকিন্ত অবাক কান্ড, তুমি এখনও বলে যাচ্ছ যে এখানে আগুন নেই।” এতক্ষণে সেই সাধু বুঝতে পারলেন যে সূত্রের মনে কি ছিল। সাধুর রাগ এবার চলে গেল। লজ্জায় মাথা নীচু করে সে নম্র কন্ঠে বলল, “ভাই, তুমি আমায় যে শিক্ষা দিলে, তার জন্য তোমায় ধন্যবাদ। আমি এই শিক্ষা হৃদয় দিয়ে গ্রহণ করলাম। আমি নিজেকে বদলাতে চেষ্টা করব।”