যেমন খাদ্য, তেমন স্বভাব
যেমন খাদ্য, তেমন স্বভাব
কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের দশদিনের দিন ভীষ্ম পড়ে গেলেন। সেদিন হতে যুদ্ধের আঠার দিন পর্যন্ত কৃষ্ণ যুদ্ধক্ষেত্রে নানা ঘটনার নায়ক ছিলেন আর ভীষ্ম অর্জুনের তৈরী শরশয্যায় শায়িত ছিলেন। ভীষ্মের ইচ্ছামৃত্যু ছিল। তিনি মকরসংক্রান্তির শুভ দিনের জন্যে অপেক্ষা করতে লাগলেন; সেদিন তিনি দেহ ত্যাগ করবেন। যুদ্ধের শেষ দিনে বিজয়ী পাণ্ডবগণ দ্রৌপদীকে নিয়ে ভীষ্মের কাছে এলেন শ্রদ্ধা নিবেদন করবার জন্যে। শরশয্যায় শুয়ে ভীষ্ম পাণ্ডবদের খুব আদর করে যে উপদেশ দিয়েছিলেন তা শান্তিপর্ব নামে বিখ্যাত।
ভীষ্ম যখন শান্তিপর্বে আচরণবিধি কি হওয়া উচিত বলে উপদেশ দিচ্ছিলেন তখন দ্রৌপদী আপন মনে জোরে হেসে উঠলেন। বয়োজ্যষ্ঠদের সামনে এভাবে জোরে হেসে উঠবার জন্যে পাণ্ডবরা দ্রৌপদীর উপর বিরক্ত হলেন। কিন্তু ভীষ্ম দ্রৌপদীকে কাছে ডেকে আশীর্বাদ করে বললেন যে, দ্রৌপদী হলেন বুদ্ধিমতী নারী। বিনা কারণে তিনি কখনই হাসতে পারেন না। তিনি দ্রৌপদীকে হেসে উঠবার কারণ জিজ্ঞেস করলেন।
দ্রৌপদী খুব বিনয়ের সঙ্গে উত্তর দিলেন, “প্রভু! আজ আপনি আচরণ বিধি সম্পর্কে বলছেন। কিন্তু রাজসভায় যখন দুর্যোধনরা আমায় চরম অপমান করেছিল তখন ত’ আপনি আচরণ বিধির কথা একবারও বলেন নি। পাণ্ডবরা হলেন ধর্মের মূর্ত বিগ্রহ। তাদের ত আচরণ বিধি বলবার কোনও প্রয়োজন নেই। এসব ত দুর্যোধনদের বলা উচিত ছিল। কিন্তু আপনি তাদের বলেন নি। তাছাড়া ঐদিন ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির নিজে হেরে গিয়ে আমায় বাজী রেখেছিলেন। তাই আমি আপনার কাছে প্রশ্ন রেখেছিলাম। কিন্তু আপনি কোনও উত্তর দেন নি। সেদিন আপনার ধর্মভাব কোথায় ছিল? সেদিন আপনি আচরণ বিধি বলেন নি কেন? একথা মনে আসাতে আমি হেসে উঠেছিলাম।”
ভীষ্ম হাসিমুখে দ্রৌপদীর এই প্রশ্নের জন্যে প্রশংসা করে বললেন যে, আসন্ন কলিযুগে এই প্রশ্ন খুবই কাজে আসবে। তিনি বললেন, “বহু বছর আমি দুষ্ট দুর্যোধনদের সেবা করেছি। তারা যে খাদ্য দিয়েছে তাই খেয়েছি। তাই দুষ্ট লোকের। দেওয়া অপবিত্র খাবার খেয়ে আমার সকল ধর্মবোধ ঢাকা হয়ে পড়েছিল। লোকে যেমন খাদ্য গ্রহণ করবে তেমনি হবে। কিন্তু তোমার স্বামী অর্জুন আমার শরীরে তীর মেরে এবং আমায় শরশয্যায় শুইয়ে দিয়ে গা থেকে অনেকটা রক্ত বের করে দিলেন। ঐ দুষ্ট রক্ত বের হয়ে যাওয়াতে আমার ধর্মবোধ আবার জেগে উঠেছে।”
এই কথা বলে ভীষ্ম সকলকে বুঝিয়ে দিলেন যে আমরা যে খাবার খাই তা অপবিত্র হতে পারে। যে খাবার খাব তার উপর স্বভাব নির্ভর করবে। যে রান্না করবে তার স্বভাব, যে পাত্রে রান্না হচ্ছে তার পরিচ্ছন্নতা, যে জিনিস রান্না হচ্ছে তার পবিত্রতা এসব কিছুর উপর খাদ্যের পবিত্রতা নির্ভর করে, আর খাদ্যের উপর আমাদের স্বভাব নির্ভর করে। খাদ্য হতে চিন্তা, চিন্তা হতে কর্ম, কর্ম হতে স্বভাব ও আমাদের ভালমন্দ নির্ভর করে। তাই খাদ্যের পবিত্রতার উপর নজর রাখতে হবে।