শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংস
শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংস
জন্ম ও বাল্যকাল
কলিকাতায়
দক্ষিণেশ্বরে
মায়ের দর্শন লাভ
হঠযোগ অভ্যাস
শ্রীরামের দর্শন লাভ
সারদা দেবীর সহিত রামকৃষ্ণের বিবাহ
ভৈরবী ব্রাহ্মণী ও রামকৃষ্ণের তান্ত্রিক সাধনা
রামকৃষ্ণের বিচার
রামলালার (বালদেবতা রাম) রামকৃষ্ণকে অনুসন্ধান
কৃষ্ণদর্শন
অব্যক্ত ঐশ্বর দর্শন (বৈদান্তিক উপলব্ধি)
অন্য ধর্ম সাধনা- মুহম্মদ, যীশুখ্রীস্টের দর্শন
মাতা সারদা দেবী
শিষ্যদের প্রতি রামকৃষ্ণের বাণী
অন্তিম পর্ব
ভূমিকা
‘রামকৃষ্ণ পরমহংসের জীবন একটি ‘বাস্তবায়িত ধর্ম-কাহিনী-যাতে আমরা “ঈশ্বরকে সামনা-সামনি দেখি”। তিনি ছিলেন একধারে দেবতা ও পবিত্রতার মূর্ত প্রতীক।’-মহাত্মা গান্ধী
শ্রীরামকৃষ্ণ তাঁর জীবনে ধর্মে’র সত্যতা ও ভগবানের বাস্তবতা প্রমাণ করেছেন। যখন প্রায়-নাস্তিক, কিন্তু অকপট যুবক নরেন্দ্রনাথ দত্ত রামকৃষ্ণকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ‘মহাশয়। আপনি কি ঈশ্বরকে দেখেছেন?’ রামকৃষ্ণে সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিলেন- ‘হ্যাঁ, আমি তাঁকে দেখেছি, ঠিক যেমন তোমার এখানে দেখছি- বরং তাঁকে আরো ঘনিষ্ঠ ভাবে দেখেছি।’ তারপরে তিনি তাঁর ঈশ্বর-দর্শন ও অভিজ্ঞতার কথা নরেন্দ্রনাথকে, যিনি পরে সারা বিশ্বে স্বামী বিবেকানন্দ নামে ধর্মে’র পুরোধা রূপে স্বীকৃত হয়েছিলেন, তাঁর কাছে বলেছিলেন।
রামকৃষ্ণ প্রমাণ করেছেন যে সর্ব’ ধর্ম’ই সত্য; এগুলি শুধু ভগবানের কাছে যাবার বিভিন্ন পথ। ধর্ম’ শুধু বিশ্বাসেই আবদ্ধ নয়, ধর্ম’ রয়েছে উপলব্ধিতে- ভগবদ-উপলব্ধিতে।
বস্তুতান্ত্রিকতায় আচ্ছন্ন জগতে রামকৃষ্ণ আধ্যাত্মিকশক্তির এক মহান প্রচারক। তিনি ভারতীয় সংস্কৃতি ও আধ্যাত্মিকতার মূর্ত প্রতীক। যে সময়ে পাশ্চাত্য ভাবধারা ও সভ্যতার অন্তঃপ্রবাহে দেশ নৈতিক ও আধ্যাত্মিক অধঃপতনের জলাভূমিতে পরিণত হয়েছিল এবং যার ফলে হিন্দুদের বিশ্বাসের ভিত নড়ে উঠেছিল, সেই সময়ে তিনি হিন্দুধর্মে’র অন্তর্নি’হিত সৌন্দর্য’, ঐশ্বর্য’ ও শক্তির দিকে হিন্দুদের দৃষ্টি আকর্ষ’ণ করেছিলেন।
বিজ্ঞানের অগ্রগতিতে বন্ধুবাদের প্রসারণশীলতা যখন সমগ্র জগৎকে পরিব্যাপ্ত করছিল, তখন রামকৃষ্ণ হিন্দুধর্ম’কে তার গভীর সঙ্কট থেকেই শুধু উদ্ধার করেন নি, তার সকল ধর্ম’-বিশ্বাসের পুনরুজ্জীবন করে ক্রমবর্ধমান নাস্তিকতাকে নির্মূল করেছিলেন।
রামকৃষ্ণ সংগত কারণেই পরমহংস– নামে পুজিত হতেন। হংস যেমন জল থেকে দুধকে পৃথক করে পান করে এবং দুধের রসাস্বাদনে আনন্দ পায়, রামকৃষ্ণও তেমনি গভীর অন্তর্দৃষ্টি ও উপলব্ধির দ্বারা দেহস্থ আত্মাকে, বস্তুর আভ্যন্তরীণ শক্তিকে (সত্তাকে), পরিদৃশ্যমান জগতের অন্তরালস্থিত বিধাতাকে পৃথক ভাবে অনুভব করে ঐশ্বরিক মাধুর্য’ আস্বাদন করতেন।
যদিও রামকৃষ্ণ কোনো শাস্ত্র পাঠ করেন নি, তবুও সব ধর্মশাস্ত্র তাঁর দ্বারা সমর্থিত ও পূর্ণতা প্রাপ্ত হয়েছিল; সকল শাস্ত্র-পারঙ্গম মূর্তি’মান প্রজ্ঞা ছিলেন তিনি; বৈরাগ্য, ভক্তি ও জ্ঞান-এই তিনটি ধারার মিলনে তাঁর জীবন হয়ে উঠেছিল পবিত্র ত্রিবেণী-সঙ্গম।
জন্ম ও বাল্যকাল
বঙ্গদেশের হুগলী জেলার অন্তর্গত দেরেপুর গ্রামের অধিবাসী ধর্মপ্রাণ ব্রাহ্মণ দম্পতি ক্ষুদিরাম চট্টোপাধ্যায় এবং তাঁর স্ত্রী চন্দ্রমণি ছিলেন রামকৃষ্ণের জনক-জননী। তাঁদের প্রায় পঞ্চাশ একরের মতো জমিজমা ছিল। ভক্তিভরে গৃহদেবতা শ্রীরামচন্দ্রের পুজার্চনা ও সাংসারিক সকল কর্তব্য সম্পাদন করে তাঁরা এক সুখী দম্পতি ছিলেন। ১৮১৪ সালে ক্ষুদিরামের জীবনের একটি ঘটনায় সমগ্র পরিবারের ভাগ্য পরিবর্তিত হয়। একবার গ্রামের জমিদার ক্ষুদিরামকে তাঁর একজন প্রজার বিরুদ্ধে মামলায় মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়ার জন্য অনুরোধ করেন। ক্ষুদিরাম এই মিথ্যা সাক্ষ্য দিতে অস্বীকার করার জমিদার ক্রুদ্ধ হন এবং তাঁর কাছে বহু টাকার ঋণের জন্য ক্ষুদিরামের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনেন। জমিদার এই মিথ্যা অভিযোগকে মিথ্যা সাক্ষীর সাহায্যে প্রমাণিত করে ক্ষুদিরামের সমস্ত জমি দখল করে নেন। পূর্বপুরুষের আবাস ছেড়ে হৃতসম্পদ ক্ষুদিরাম নিকটবর্তী’ গ্রাম কামারপুকুরে নতুন গৃহ নির্মাণ করে বসবাস করতে লাগলেন।
এক বন্ধুর সদাশয়তায় তিনি অর্ধ’ একর জমি চাষের জন্য পান। একদা- সমৃদ্ধিশালী পরিবারকে ক্ষুদ্র জমিটুকুর সামান্য আয়ের উপর নির্ভ’র করতে হলেও, গৃহদেবতা শ্রীরামের উপর অবিচলিত নিষ্ঠা নিয়ে সন্তুষ্ট চিত্তেই তাঁরা দিন কাটাতে লাগলেন। জগন্নাথদেবের অধিষ্ঠানস্থল পুরীধামে যাওয়ার পথের ধারে কামারপুকুর গ্রাম অবস্থিত হওয়ায় সাধু-সন্ন্যাসী ও বৈষ্ণব তীর্থযাত্রী যাঁরা পুরীধামের পথে কামারপুকুরের ধর্ম’শালায় বিশ্রাম নিতেন, ক্ষুদিরামের পক্ষে তাঁদের সৎসঙ্গ সকল সময়ে পাওয়ার সুযোগ হত; এর ফলে তাঁর আধ্যাত্মিকতার প্রভূত উন্নতি হয়।
একদা পাশের গ্রাম থেকে ফেরার পথে ক্ষুদিরাম তাঁর আরাধ্যদেবতা রঘুবীরের মুর্তি একটি ধানক্ষেতের মধ্যে পান। এতে তিনি খুব আনন্দিত হলেন এই ভেবে যে ভগবান নিজেই তাঁর কাছে খুঁজে খুঁজে এসেছেন। পবিত্র মুর্তি’কে মন্দিরে প্রতিষ্ঠিত করে তাঁরা স্বামী-স্ত্রী উভয়েই একান্ত ভক্তিসহকারে পুজা করতে লাগলেন।
সে সময়ে ক্ষুদিরামের রামকুমার নামে একটি পুত্র এবং একটি কন্যাও ছিল। কালক্রমে রামকুমার হিন্দুশাস্ত্রে পাণ্ডিত্য অর্জ’ন করেন এবং অর্থ উপার্জন দ্বারা পিতার দায়িত্বভারের কিছু লাঘব করতে আরম্ভ করেন। এতদিনে ক্ষুদিরাম সময় ও সুবিধা পেয়ে রামেশ্বর-তীর্থ’ যাত্রা করলেন। পরে দ্বিতীয় পুত্রের জন্ম হলে ক্ষুদিরাম তার নামকরণ করেছিলেন ‘রামেশ্বর’, কারণ তিনি ভেবেছিলেন যে ঐ পুত্র রামেশ্বরের দেবতা শিবের আশীর্বাদ স্বরূপ।
প্রায় এগারো বছর পরে, ১৮৩৫ সালে ক্ষুদিরাম গয়াতীর্থের উদ্দেশে যাত্রা করেন। এখানে পিতৃপুরুষের উদ্দেশে শ্রদ্ধাঞ্জলি দেওয়ার পর তিনি রাত্রে এক অদ্ভুত স্বপ্ন দেখেন। তিনি স্বপ্নে দেখলেন যে তিনি গদাধর- বিষ্ণুর মন্দিরে রয়েছেন এবং তিনি যে সব জিনিস তাঁদের উদ্দেশ্যে অর্পণ করেছিলেন তাঁর পূর্বপুরুষেরা তাই দিয়ে ভোজোৎসব করছেন। এই সময়ে হঠাৎ মন্দিরটি এক দিব্যজ্যোতির বন্যায় প্লাবিত হয়ে গেল, এবং স্বৰ্গত আত্মাগুলি হাঁটু মুড়ে বসে সিংহাসনস্থিত দেবতাকে শ্রদ্ধাঞ্জলি দিতে আরম্ভ করলেন।
সিংহাসনস্থিত জ্যোতির্ময় মূর্তি’র ইঙ্গিতে ক্ষুদিরাম তাঁর নিকটস্থ হয়ে সাষ্টাঙ্গ প্রণিপাত করলেন এবং জ্যোতির্ম’য় পুরুষের বাণী শুনতে পেলেন- ‘ক্ষুদিরাম। আমি তোমার ঐকান্তিক ভক্তিতে সন্তুষ্ট হয়েছি। তোমাকে আমার পিতারূপে গ্রহণ করে আমি তোমার কুটিরে জন্মগ্রহণ করব।’ ক্ষুদিরাম আনন্দাপ্লুত হৃদয়ে জেগে উঠলেন। তিনি বুঝতে পারলেন যে তাঁর গৃহ কোনো না কোনো ভাবে আশীর্বাদ-ধন্য হবে। একই সময়ে চন্দ্রমণি দেবীও কামারপুকুরে অদ্ভুত স্বপ্ন দেখেছিলেন; ঐ স্বপ্নগুলির একটিতে দেখলেন তিনি যেন গ্রামের ধনি কামারনীর সঙ্গে একটি শিবমন্দিরের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন এবং শিবলিঙ্গ থেকে একটি জ্যোতি বিচ্ছুরিত হয়ে তাঁর মধ্যে প্রবেশ করল।
১৮৩৬ সালের ১৮ই ফেব্রুয়ারি সকালে চন্দ্রমণি দেবী একটি পুত্র সন্তানের জন্ম দিলেন, যিনি উত্তরকালে হিন্দুধর্মের পুনরভ্যুদয়ের অগ্রদূত রূপী শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংস নামে পরিচিত হন। গ্রামের অভিজ্ঞ জ্যোতিষীরা গণনা দ্বারা শিশুর উজ্জল ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে ঘোষণা করলেন। শিশুটি সত্যই খুবেই নয়ন-মনোহর ছিল এবং তার সমস্ত দেহটি স্বর্ণাভা মণ্ডিত ছিল। গয়াধামের দেবতার নামানুসারে শিশুর নামকরণ হল গদাধর; কারণ শিশুটি ছিল তাঁরই আশীর্বাদ।
সুমিষ্ট চেহারার অধিকারী এই বালককে গ্রামের সবাই ভালোবাসত এবং আদর করে ‘গদাই’ বলে ডাকত। শৈশবকাল থেকে তাঁর মানসিক বিকাশ বয়স অপেক্ষা অধিক পরিণতি লাভ করেছিল; তিনি অত্যস্তুত বুদ্ধির পরিচয় দিতেন। তিনি অল্পসময়ের মধ্যে সব জিনিস শিখতে পারতেন এবং হিন্দু দেব-দেবীর স্তোত্রগুলি খুব শীঘ্রই মুখস্ত করে নিতেন। গ্রামের বিদ্যালয়ে অধ্যয়ন কালে তিনি বেশ উন্নতি করেন। কিন্তু গণিতে ছিল তাঁর অনীহা; মনে হয় যে- যিনি অনন্ত অসীমের অবধায়ক তাঁর সীমিত সংখ্যার প্রতি অনীহা থাকা একান্তই সহজাত। বেশির ভাগ সময়েই তিনি ভারতীয় মহাকাব্য, পুরাণ, অধ্যাত্ম-গুরুদের উপদেশাবলী পড়তেন। ঐ পুস্তকগুলি তাঁকে খুবই প্রভাবান্বিত করেছিল, এবং দিনের পর দিন তাঁর ধর্ম’ভাবের বৃদ্ধি হওয়ায় ধ্যানের মধ্যে তিনি নিজেকে হারিয়ে ফেলতেন ও এক মোহাচ্ছন্ন অবস্থা (আবেশ) লাভ করতেন। ক্রমশ দেখা গেল যে শুধু ধর্মীয় ব্যাপারই নয়, কোনো সুন্দর দৃশ্য কিংবা কোনো মর্মস্পর্শী’ ঘটনা তাঁকে আবিস্ট করার পক্ষে যথেষ্ট ছিল। পরবর্তী’ জীবনে শিষ্যদের কাছে রামকৃষ্ণে তাঁর শৈশবের ঐ ধরনের একটি ঘটনা বিবৃত করেন:
‘আমার বয়স তখন ছয়-সাত বছর হবে। আষাঢ় মাসের কোনো এক দিন আমার সঙ্গে ধামায় যে মুড়ি ছিল তাই খেতে খেতে ধান ক্ষেতের সর, আলের উপর দিয়ে যাচ্ছিলাম। আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখি সুন্দর বজ্র-বিদ্যুৎ ভরা মেঘ। অল্পক্ষণের মধ্যেই সেই কালো মেঘ সারা আকাশে ছড়িয়ে পড়ল, আর সাদা এক ঝাঁক বক মাথার উপরে ঐ মেঘের সামনে দিয়ে উড়ে যেতে লাগল। এই রমণীয় বৈসাদৃশ্যে দেখে আমার মন অন্যজগতে এমনি চলে গেল যে, আমি বাহ্যজ্ঞানরহিত হয়ে পড়ে গেলাম। আর সব মুড়ি ‘চারদিকে ছড়িয়ে গেল। কয়েকজন লোক আমায় সেই অবস্থার দেখে, আমার হাত ধরে বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে গেল। সেই প্রথম ভাবের আনন্দে আমি আমার চৈতন্য হারিয়ে ফেলেছিলাম।’
আর-একটি ঘটনা- যখন একবার শিবরাত্রির দিন গ্রামের যাত্রা-অভিনয়ে তিনি শিব সেজেছিলেন। শিবের বেশে নিজেকে দেখে সঙ্গে সঙ্গে তাঁর এমন ভাবাবেশ হয় যে বহুকষ্টে তাঁর স্বাভাবিক চৈতন্য ফিরিয়ে আনা হয়। ঈশ্বর- চিন্তা বা কোনো সুন্দর প্রাকৃতিক দৃশ্য- যাতে ভগবানের অদৃশ্য হস্তের পরিচয় পাওয়া যায়- এ সবই তাঁর ভাবাবেশ সৃষ্টির পক্ষে যথেষ্ট ছিল।
১৮৪৩ সালে ক্ষুদিরামের মৃত্যু হলে জ্যেষ্ঠপুত্র রামকুমারের উপর সংসারের ভার এসে পড়ে। ক্ষুদিরামের মৃত্যুতে গদাধরের মনে এক বিরাট পরিবর্তন আসে। একদিকে স্নেহময় পিতার অভাব এবং সেই সঙ্গে জীবনের অনিত্যতা তাঁকে ভাবিয়ে তোলে। তারপর থেকে প্রায়ই তিনি প্রতিবেশীদের আমবাগান অথবা শ্মশানে গিয়ে অনেকক্ষণ ধরে চিন্তামগ্ন হয়ে বসে থাকতেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও তিনি স্নেহময়ী জননীর কথা ভোলেন নি। তিনি কোনো বিষয়ে আর বিশেষ জেদ ধরতেন না এবং মাতার বিষন্নতা কাটাবার জন্য যতটুকু পারেন আনন্দ ও সান্তনা দেওয়ার চেষ্টা করতেন।
গদাধর এক নতুন আনন্দের সন্ধান পেয়েছিলেন, তা ছিল গ্রামের ধর্মশালার পুরীযাত্রী যে সব সন্ন্যাসীরা বিশ্রাম করতেন তাঁদের সঙ্গলাভ করা। তিনি বেশির ভাগ সময়েই ঐ সব সাধুসঙ্গে কাটাতেন এবং আধ্যাত্মিক বিষয়ে তাঁদের আলোচনা শুনতেন। একদিন চন্দ্রমণি দেবী বিস্মিত হয়ে দেখলেন যে প্রিয় পুত্রের সারা দেহ ভম্মাচ্ছাদিত এবং পরনে গৈরিক বসন, এক হস্তে যষ্টি অপর হস্তে কমণ্ডলু- ঠিক যেন একটি বালক সন্ন্যাসী। চন্দ্রমণি দেবী এই দেখে আনন্দ পাওয়ার পরিবর্তে ভয় ও উদ্বেগে কেঁদে উঠে বললেন, ‘বাছা! কে তোমায় সন্ন্যাস দিল। তুমি কোথায় যাচ্ছ? তোমায় ছেড়ে আমি কি করে বেঁচে থাকব?’ এই বলে গদাধরকে দৃঢ় আলিঙ্গনে আবদ্ধ করে কাঁদতে লাগলেন। গদাধর তখন মাতাকে এই বলে সাস্তানা দিলেন যে, ‘মা! আমি সন্ন্যাসী হই নি। শুধু তোমায় একটু আনন্দ দেবার জন্য, আর আমাকে সন্ন্যাসীর সাজে কেমন মানায়, তা দেখার জন্য আমি এই ভাবে সেজেছি।’ যা হোক, তাঁর মা তাঁকে প্রতিজ্ঞাবন্ধ করালেন যে তাঁর (মাতার) বিনা অনুমতিতে গদাধর জীবনে সন্ন্যাস নেবেন না বা বাড়ি ছেড়ে যাবেন না। এতেই বোধগম্য হয় যে রামকৃষ্ণ কেন বিবাহ করেছিলেন, আর তাঁর শিষ্যরা অনেকেই কেন সন্ন্যাসী হয়েছিলেন। (অবশ্য রামকৃষ্ণের বিবাহ ছিল আধ্যাত্মিক মিলন, সাধারণ বাস্তব জগতের নরনারীর মিলন নয়। রামকৃষ্ণ তাঁর স্ত্রী সারদাদেবীকে পূজা করতেন শক্তিরূপে অর্থাৎ মা কালী রূপে; সারদাদেবীও তাঁর সঙ্গে মাতৃবৎ ব্যবহার করতেন)।
নয় বৎসর বয়সে গদাধর উপবীত ধারণ ও গায়ত্রী উপদেশ গ্রহণ করেন। এর দ্বারা মানুষের আধ্যাত্মিক জগতে দ্বিতীয় বার জন্ম হয় এবং সে ব্রাহ্মণে পরিণত হয়; এর অর্থ’ এই যে ব্রহ্মকে উপলব্ধির পথে অগ্রসর হয়। উপনয়নের সময় এক অদ্ভুত ঘটনা ঘটে। প্রথা অনুযায়ী মাতার কাছ থেকে প্রথম ভিক্ষা গ্রহণ না করে, গদাধর শুদ্রবংশীয়া ধনি কামারণী- যে তাঁকে পরমস্নেহভরে শৈশবে তত্ত্বাবধান করত, তার কাছ থেকে ভিক্ষা গ্রহণ করেছিলেন। নিজের সস্তান না থাকায় ধনি গদাধরকে সন্তানস্নেহে ভালোবাসত গদাধরও তার প্রতি খুব ভালোবাসা দেখাতেন যাতে সে আনন্দ লাভ করে। অবশ্য তার কাছ থেকে ভিক্ষা গ্রহণ করার অর্থ’ ব্রাহ্মণ-পরিবারের প্রচলিত প্রথা লঙ্ঘন করা; কিন্তু সাধারণ সামাজিক প্রথার অনুসরণ অপেক্ষা প্রকৃত ভালোবাসার মূল্য ছিল গদাধরের কাছে অনেক বেশি, কারণ ‘জাতি নির্ধারিত হয় হৃদয়ের বৈশিষ্ট্যে, জন্ম দ্বারা নয়।’
সেই সময়ে আধ্যাত্মিক আবেশ ছাড়াও গদাধরের পৌরাণিক কাহিনীর অভিনয়ের দিকে ঝোঁক এসেছিল। গ্রামের বাইরে কাছাকাছি আমবাগানে সঙ্গীদের নিয়ে তিনি অভিনয় করতেন। কৃষ্ণলীলাই ছিল তাঁর প্রিয় বিষয় বস্তু। তাঁর গৌরবর্ণ দেহ, কুঞ্চিত কেশ, গলায় ফুলের মালা- এভাবে বংশীধারীর সাজে তিনি শ্রীকৃষ্ণের অভিনয় প্রায়ই করতেন। সময়ে সময়ে গ্রামের বালকদের সম্মিলিত কণ্ঠের সংকীর্তনে আমবাগান মুখরিত হয়ে উঠত। অনেক সময় আখ্যানবস্তুতে অভিভূত হয়ে তিনি আবেগের প্রাবল্যে আবেশাবিষ্ট হয়ে পড়তেন। রামকৃষ্ণ তাঁর বন্ধুদের কাছে এই অবস্থার কথা উল্লেখ করে বলতেন, ‘কি হয় তোমরা কি জান? আমি যখনই ঈশ্বরের কথা হৃদয়ে গভীরভাবে ভাবি, তখনই আমি সেখানে তাঁর উপস্থিতি টের পাই। তখন মনে হয় তিনি যেন আমায় ভালোবেসে অন্তরে আকর্ষণ করছেন। তখন আমি বাহ্য- চৈতন্য হারিয়ে ফেলতে শুরু করি এবং অন্তরে গভীর শান্তি আর আনন্দ ভোগ করি।’ কিন্তু বালকের এই অলৌকিক মনোভাব মা এবং জ্যেষ্ঠ ভ্রাতাদের চিন্তার কারণে পরিণত হল। লোকের মনে ধারণা ছিল যে রামকৃষ্ণ মৃগীরোগে আক্রান্ত হয়েছেন।
পরিবারে শীঘ্রই দুর্যোগ ঘনিয়ে এল। রামকুমারের স্ত্রী একটি শিশুপুত্র রেখে মারা যান। বর্ষীয়সী পিতামহী তখন শিশুকে লালন-পালন করতে লাগলেন। রামকুমারের স্বল্প আয়ে সংসারযাত্রা নির্বাহ খুবই কষ্টসাধ্য হওয়ার ফলে অনেক ঋণ হয়ে পড়ল। রামকুমার তখন সাংসারিক অর্থকষ্ট দূর করার জন্য কলিকাতায় অর্থ’ উপার্জনের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলেন এবং সহরের কেন্দ্রস্থলে একটি টোল খুললেন। রামেশ্বর পরিবারের দেখা- শোনা করতেন। গদাধর ক্রমে আরো গভীর ভাবে আধ্যাত্মিক সাধনায় মগ্ন হতে লাগলেন। বিদ্যালয় প্রদত্ত শিক্ষার প্রতি তিনি বিরূপ ছিলেন। তাঁর মনে হত যে জীবনে আরো মহৎ উদ্দেশ্য তাঁকে পালন করতে হবে কিন্তু সেই মহোত্তর উদ্দেশ্য যে কী হতে পারে, তা তিনি ঠিক বুঝতে পারতেন না। যাই হোক, ঈশ্বর-উপলব্ধি করাই তাঁর কাছে তখন অনুসরণযোগ্য লক্ষ্য হয়ে উঠেছিল, কিন্তু ঈশ্বরানুসন্ধানে গৃহত্যাগের পথে বাধা ছিল বৃদ্ধা মাতার প্রতি তাঁর ভালোবাসা।
কলিকাতায়
ক্রমে রামকুমারের টোলের কিছু উন্নতি হল। টোলের কাজ বেড়ে খাওয়াতে তাঁর একজন সাহায্যকারীর প্রয়োজন হল। বিদ্যালয়ের শিক্ষার প্রতি গদাধরের বিরূপতা লক্ষ্য করে তিনি গদাধরকে কলিকাতায় এনেছিলেন এই আশায় যে গদাধর টোলের কাজের সাহায্য করবেন এবং তিনি গদাধরকে পড়াশোনায় প্রবৃত্ত করিয়ে সঠিক পথে পরিচালনা করতে পারবেন।
কলিকাতাতেও গদাধর স্কুলের বিদ্যাশিক্ষার দিকে বিশেষ আগ্রহী হলেন না। কিন্তু তিনি লোকের বাড়িতে পূজার্চনা করতেই অধিক আগ্রহী ছিলেন, যে কাজের দায়িত্ব জ্যেষ্ঠ ভ্রাতাই তাঁকে নিতে বলেছিলেন। গদাধরের সরলতা, আন্তরিকতা, মনোজয়ী ব্যবহার ও ভক্তিভাব সকলকে মুগ্ধ ও আকর্ষণ করেছিল। অল্পসময়ের মধ্যেই তাঁর চারধারে এক বন্ধু ও গুণমুগ্ধের পরিমণ্ডলী গড়ে উঠেছিল এবং তাঁরা সবাই সম্ভ্রান্ত পরিবারের লোক ছিলেন।
একদিন রামকুমার গদাধরকে বিদ্যার প্রতি অবহেলা করার জন্য তিরস্কার করায় গদাধর তেজস্বীতার সঙ্গে উত্তর দেন, ‘দাদা, শুধুমাত্র অন্নসংস্থানের জন্য জ্ঞান নিয়ে আমি কি করব, বরং যে জ্ঞানে আমার হৃদয় আলোকিত হবে এবং চিরদিনের মত আমায় শান্তি দেবে, সেই জ্ঞান আমি অর্জন করব।’ রামকুমার এই ধরনের সরল অথচ দৃঢ় উত্তরে হতবুদ্ধি হয়ে গেলেন। গদাধরকে বিদ্যার্জনে প্রবৃত্ত করতে না পারায় তিনি গৃহদেবতা রঘুবীরের ইচ্ছার উপর সব ছেড়ে দিলেন।
দক্ষিণেশ্বরে
সেই সময় কলিকাতায় রানী রাসমণি নামে এক পরম ধার্মিক ধনী বিধবা থাকতেন। ১৮৪৭ সালে কলিকাতার চার মাইল উত্তরে, দক্ষিণেশ্বরে গঙ্গার পূর্ব’ তীরে প্রচুর অর্থব্যয়ে তিনি এক বিরাট কালীমন্দির স্থাপন করেন। পাথরে বাঁধান চতুষ্কোণ প্রাঙ্গণের মাঝে বিরাট মন্দির- প্রধান অধিষ্ঠাত্রী দেবী মা কালী। এখানে আর-একটি মন্দির আছে, যেটি হল রাধাকৃষ্ণের; এই দুটি মন্দির ছাড়া দুই সারিতে দ্বাদশ শিব গঙ্গার ধার থেকে কিছু উচ্চ- জানে মন্দিরে প্রতিষ্ঠিত। এ ছাড়া কীর্তন, গীত-বাদ্যাদির জন্য একটি প্রশস্ত ঘর, মন্দিরের কর্মচারীদের বসবাসের স্থান ও রানীর পরিজনদের জন্য বাসগৃহ প্রভৃতি আছে। দুটি পুষ্করিণী সহ সুন্দর একটি উদ্যান আছে এবং সে উদ্যানে যে বটবৃক্ষটি আছে সেটি রামকৃষ্ণের জীবনের সঙ্গে জড়িত।
১৮৫৫ খ্রীস্টাব্দের ৩১মে মন্দিরটি দেবী ভবতারিণীর (কালী) উদ্দেশে উৎসগীকৃত হয়েছিল; সেদিন থেকেই রামকুমার পৌরহিত্য গ্রহণ করেন। কিছুদিন পর গদাধর জ্যেষ্ঠ ভ্রাতার সঙ্গে উদ্যান সমন্বিত ঐ পবিত্র মন্দিরে আসেন; সেখানের শান্তিপূর্ণ আবহাওয়া গদাধরের আধ্যাত্মিক সাধনার পক্ষে খুবই অনুকুল হয়। এই স্থানেই রামকৃষ্ণের জীবনের বহু, চমকপ্রদ অধ্যায় যেমন সূচিত হয়, সেই সঙ্গে ভারতীয় ধর্ম জীবনের পুনরুজ্জীবনও হয়।
হৃদয় নামে যে যুবকটি প্রায় পচিশ বছর রামকৃষ্ণের অন্তরঙ্গ সঙ্গী হিসাবে থেকে, তাঁকে তাঁর সাধনার ঝড় ঝঞ্ঝার দিনগুলিতে বিশেষ বিশ্বস্ততার সঙ্গে ও পরিশ্রম সহকারে পরিচর্যা করেন, এই সময় সেই যুবক দক্ষিণেশ্বরে আসেন। হৃদয় ছিলেন গদাধরের ভাগিনেয়। তাঁর আগমনে গদাধর খুব আনন্দিত হঙঝকিছুদিনের মধ্যেই মথুরানাথ বিশ্বাস (মথুর বাবু), যিনি রানী রাসমণির জামাতা ছিলেন, তাঁর নজর গদাধরের উপর পড়ে। কালী প্রতিমাকে সকালে পত্র পুষ্প ও চন্দনে এবং বিকালে মহার্ঘ’ বস্ত্র-অলংকারে সজ্জিত করার দায়িত্ব তিনি গদাধরকে দেন। মনোমত কার্যে’ নিযুক্ত হয়ে আন্তরিকতার সঙ্গে গদাধর কার্য সম্পাদন করতেন এবং অন্য সময়ে আত্মহারা হয়ে মা কালীকে ভক্তিগীতি শোনাতেন।
কালী মন্দিরে নিযুক্তির অল্পদিন পরেই এমন এক ঘটনা ঘটল যার ফলে রানী রাসমণি ও মথুর বাবুর কাছে রামকৃষ্ণের মর্যাদা অনেক বৃদ্ধি পেল। একদিন রাধাকৃষ্ণ মন্দিরের পুরোহিত কৃষ্ণমূর্তি’কে শয়ন গৃহে নিয়ে যাওয়ার সময় পা পিছলে পড়ে যান এবং মূর্তি’র একটি পা ভেঙে যায়। পণ্ডিতেরা উপদেশ দেন মূর্তিটিকে গঙ্গায় বিসর্জন দিয়ে নতুন মূর্তি প্রতিষ্ঠা করতে, কারণ শাস্ত্রবিধান অনুযায়ী অঙ্গহীন দেবতার পূজা হয় না। কিন্তু রামকৃষ্ণ এ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করেন এবং বলেন যে এ উপদেশ হাস্যকর। তিনি আরো বলেন, ‘যদি রানীর জামাতার পা ভেঙে যায় তবে তিনি কি ঐ জামাতার বদলে অন্য জামাতা আনবেন? নাকি তিনি চিকিৎসার বন্দোবস্ত করাবেন। এখানেও তাই হোক না কেন? কাজেই মূর্তি’র পা-টিকে জুড়ে নিয়ে আবার পূজা হোক আগের মতোই।’ রামকৃষ্ণ নিজেই মূর্তিটির মেরামতির ভার নিলেন এবং এত নিখুঁত ভাবে জুড়লেন যে সতর্ক’ পর্যবেক্ষণেও বোঝা যাচ্ছিল না কোথায় ভেঙেছিল। রাণী ও মথুর বাবু উভয়েই খুব খুশি ও উদ্বেগমুক্ত হলেন। এর পরে রামকৃষ্ণকেই রাধাকৃষ্ণের মন্দিরের পূজারী নিযুক্ত করা হল।
‘কেনারাম ভট্টাচার্য’ নামে এক ব্যক্তি মন্দিরে কালী পুজাপদ্ধতিতে খুবই অভিজ্ঞ ছিলেন। রামকুমার তাঁর কাছে রামকৃষ্ণকে দীক্ষা নেওয়ালেন। এর উদ্দেশ্য ছিল যাতে রামকৃষ্ণ পূজার সম্পূর্ণ ভার গ্রহণ করে তাঁকে কিছু বিশ্রামের সুযোগ দিতে পারেন; কারণ তিনি ক্রমশই ভগ্নস্বাস্থ্য হয়ে পড়ছিলেন। কিছুদিন পর রামকুমার পরলোকগমন করেন। রামকৃষ্ণ এতে খুবই আঘাত পান এবং জীবনের অনিত্যতা সম্বন্ধে উপলব্ধি করেন। অক্ষয় অব্যয় সেই শাশ্বতকে প্রত্যক্ষ করার গভীর ইচ্ছা তখন তাঁকে পরিব্যাপ্ত করে।
রামকৃষ্ণের কাছে কালী প্রতিমা কেবলমাত্র প্রস্তর মূর্তি’ই ছিলেন না- ছিলেন জীবন্ত মাতার মতো। যদিও সাধারণ্যে প্রচলিত বিশ্বাস আছে যে, কালী যেমনি ভয়ঙ্করী, তেমনি মঙ্গলদায়িনী। তিনি একাধারে প্রকৃতির ধ্বংসকারিণী এবং সৃষ্টিকারিণী শক্তি, কিন্তু রামকৃষ্ণের কাছে তিনি ছিলেন শুধুই স্নেহময়ী মাতা, শক্তি ও মঙ্গলের আধাররূপিনী মধুর, কোমল এবং মাতৃবৎ উদ্বেগময়ী, যিনি তাঁর ভক্তকে সযত্নে সর্বদা বিপদ হতে রক্ষা করেন।. রামকৃষ্ণ সমস্ত মনপ্রাণ দিয়ে তাঁকে ভক্তি করতেন এবং বিভ্রান্তি ও অজ্ঞতার বিরুদ্ধে একমাত্র সহায় বলে জানতেন। এ ছিল দেবী আরাধনায় দেহ মন প্রাণের সম্পূর্ণ’ উৎসর্গীকরণ।
মায়ের দর্শন লাভ
রামকৃষ্ণ এখন নিজেকে সম্পূর্ণ ভাবে সাধনায় মগ্ন করে দিলেন। রাত্রিতে যখন সকলে ঘুমিয়ে পড়ত সেই সময় তিনি পাশের গভীর জঙ্গলে চলে যেতেন এবং প্রত্যুষে যখন ফিরে আসতেন তখন দেখা যেত তাঁর দুটি চোখ ফুলে উঠেছে, মনে হত যেন বহুক্ষণ ধরে কেঁদেছেন কিংবা ধ্যান করেছেন। তিনি কেঁদে কেঁদে ডাকতেন, ‘মা! তুমি কোথায়? আমায় দেখা দাও।’ যখন মন্দিরের সান্ধ্য ঘণ্টাধ্বনি দিনাবসানের কথা জানিয়ে দিত, তখন তিনি অধৈর্য্য হয়ে কেঁদে উঠতেন- ‘আরো একটা দিন বৃথাই চলে গেল মাগো। কারণ আমি তোমার দেখা পেলাম না। এই ক্ষণস্থায়ী জীবনের আরো একটা দিন কেটে গেল- আমি সত্যকে উপলব্ধি করতে পারলাম না।’ এই যন্ত্রনাময় অবস্থায় যখন রামকৃষ্ণ ধৈর্যে’র শেষ সীমায় এসেছেন, তখন আবরণ উন্মোচিত হল- মা প্রত্যক্ষ দর্শন দানে রামকৃষ্ণকে ধন্য করলেন। রামকৃষ্ণ অনেক পরে তাঁর শিষ্যদের কাছে এই দর্শনের অভিজ্ঞতার কথা বলেছিলেন:
‘তখন আমি মায়ের দর্শ’ন-সৌভাগ্য বঞ্চিত হয়ে অশেষ যন্ত্রণা ভোগ করছি। মনে হচ্ছিল আমার হৃদয়টাকে যেন ভিজে গাছার মতো নিংড়ে ফেলছে। আমি তখন এই ভেবে ভয়ে আর অশান্তিতে ছটফট করছি যে, এ জীবনে মাকে দর্শন করা হয়ত আমার ভাগ্যে নেই। এই বিচ্ছেদ আমি আর সহ্য করতে পারছিলাম না, বেচে থাকা নিরর্থক মনে হচ্ছিল। হঠাৎ আমার চোখ পড়ল মায়ের মন্দিরে রাখা খাঁড়ার উপর। আমি পাগলের মতো লাফিয়ে উঠে সেটা নিলাম জীবনটাকে শেষ করার জন্য, তখন হঠাৎ মা আমায় দেখা দিলেন আর আমি অজ্ঞান হয়ে মেঝের উপর পড়ে গেলাম। তারপর ঠিক কি হয়েছিল বা সেই দিন বা তারপর দিন কি ভাবে কেটেছে আমি কিছুই জানি না; কিন্তু আমার মধ্যে এক সম্পূর্ণ’ নতুন অবিমিশ্রত শান্তির ধারা বয়ে যাচ্ছিল আর আমি ‘মা’র উপস্থিত বুঝতে পারছিলাম।’
এর পর থেকে অবিরত এভাবে মাকে দর্শনের জন্য রামকৃষ্ণের আকুলতা বেড়ে গেল। কিন্তু যেহেতু তিনি আর এই ভাবে দর্শন পান নি, তিনি মাঝে মাঝেই গভীর নৈরাশ্যে ডুবে যেতেন। তিনি মায়ের এই লুকোচুরি খেলা সহ্য করতে পারছিলেন না; ফলে তাঁর ধ্যান-জপ ও প্রার্থনার মাত্রা দ্বিগুণ বাড়িয়ে দিলেন। দর্শন ঘন ঘন হতে আরম্ভ হল এবং তিনি দেখতে পেতেন যে বরাভয়দায়িনী জ্যোতির্ময়ী মূর্তি’তে মা সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছেন। তিনি দেখতে পেতেন মা হাসছেন, কথা বলছেন, সান্তনা দিচ্ছেন ও নানাভাবে তাঁকে শিক্ষা দিচ্ছেন। এমন-কি, যখন রামকৃষ্ণ মাকে নৈবেদ্য বা ভোগ নিবেদন করতেন তখন তিনি তাঁর হাতে মায়ের নিশ্বাসের স্পর্শ পেতেন। নিজের ঘর থেকে তিনি শুনতে পেতেন যে ‘মা’ পায়ের মল বাজিয়ে আনন্দে ছোটো মেয়ের মতো মন্দিরের সিঁড়ির উপর উঠছেন। রামকৃষ্ণ তাঁকে অনুসরণ করে দেখতেন এলোকেশী মা বারান্দায় দাঁড়িয়ে হয় কলিকাতা কিংবা গঙ্গার দিকে তাকিয়ে আছেন। এইভাবে মা রামকৃষ্ণকে সর্বদা না হলেও ঘন ঘন প্রত্যক্ষ দর্শন দিতেন। যতই তাঁর উপলব্ধি গভীর হতে লাগল ‘মা’ তাঁর কাছে তত বেশি জ্যোতির্ময়ীরূপে প্রকট হতে লাগলেন। মা কালীর প্রস্তরমূর্তি’কে জাগ্রত বলেই রামকৃষ্ণ মানতেন, কিন্তু এখন প্রতিমার পরিবর্তে’ তিনি সাক্ষাৎ ‘মা’কে দেখতে পেতেন। লোকেরা কিন্তু তাঁর মস্তিষ্কের সুস্থতা সম্বন্ধে সন্দিহান হয়ে তাঁকে সম্পূর্ণ মানসিক বিকারগ্রস্ত ভাবত।
একদিন পূজার সময় রানী রাসমণি মন্দিরে উপস্থিত ছিলেন। তিনি রামকৃষ্ণকে ‘মা’র কাছে প্রার্থনাসংগীত গাইতে অনুরোধ করলেন। সে সংগীত ধীরে ধীরে হৃদয়ের গভীর কন্দর থেকে উৎসারিত হয়ে দিব্য আনন্দ- যারা রূপে রামকৃষ্ণের সারা দেহমন প্লাবিত করল। আদালতের একটি মোকদ্দমা সম্বন্ধে চিন্তা করে কিছুক্ষণ বাদে রানী অন্যমনষ্ক হয়ে পড়লেন। রামকৃষ্ণ হঠাৎ গান বন্ধ করে দেন এবং রানীকে জাগতিক চিন্তা ও বাসনা দ্বারা মন্দিরের পবিত্রতাকে কলুষিত করার জন্য তীব্র ভৎর্সনা করেন। রানী তখনই বুঝতে পারলেন যে, রামকৃষ্ণও কেমন ‘মা’ (কালী)র মতো সর্ব’জ্ঞ হয়ে উঠেছেন।
হঠযোগ অভ্যাস
এরপরে রামকৃষ্ণে হঠযোগ অভ্যাস করতে লাগলেন। তিনি শ্মশানে গিয়ে অনাবৃত দেহে বহুক্ষণ ধরে ধ্যানমগ্ন হয়ে থাকতেন। একদিন সন্ধ্যায় তিনি টাকরাতে এক ধরনের অস্বস্তিকর অনুভূতি বোধ করলেন এবং মুহূর্ত মধ্যে রক্তপাত হতে আরম্ভ হল। তিনি খুব হতচকিত হয়ে গেলেন, কারণ রক্তের রঙ ছিল কালো। সৌভাগ্যক্রমে সেখানে একজন বর্ষীয়ান এবং অভিজ্ঞ আধ্যাত্মিক জ্ঞানসম্পন্ন যোগী উপস্থিত ছিলেন। তিনি বললেন, ‘ভগবানকে ধন্যবাদ! ভয়ের কোনো কারণ নেই; রক্তপাতে তোমার অনেক উপকার হয়েছে। তোমার যোগসাধনায় সুষুম্না-নাড়ী খুলে গেছে এবং তার ফলে মস্তিষ্কে যে রক্ত ধেয়ে যাচ্ছিল তা সৌভাগ্যক্রমে মুখের তালু দিয়ে পথ করে নেমে এসেছে; নচেৎ এর ফলে তোমার যে ‘জড়-সমাধি’ হত, তা থেকে তুমি সাধারণ চৈতন্যভূমিতে নেমে আসতে পারতে না। জগন্মাতা তোমাকে দিয়ে কোনো মহৎ কাজ করাবেন বলে তোমার দেহকে এইভাবে রক্ষা করলেন। কারণ জগন্মাতা তোমায় দিয়ে কোনো দিব্য-উদ্দেশ্য সম্পাদনের জন্যই তোমায় জাগতিক চৈতন্যের মাঝে রাখতে চান।’
শ্রীরামের দর্শন লাভ
গোড়া থেকেই শ্রীরামকষ্ণের ধর্ম’মত ছিল ক্যাথলিকদের মতো। তিনি ভগবানের সকল নাম ও রূপকে ভক্তি করতেন। তিনি ভগবানের এক রূপ থেকে অন্য রূপকে ভিন্ন দেখতেন না। ঈশ্বরের এক রূপের উপলব্ধি তাঁকে অপর রূপের উপলব্ধির উৎসাহ দিত এবং যতদিন অবধি সেই রূপ প্রত্যক্ষ না দেখছেন, ততদিন ভক্তিভরে তিনি চেষ্টা করে যেতেন। এইভাবে তিনি শ্রীরামচন্দ্রের উপলব্ধির অভিলাষী হয়েছিলেন। তিনি সেজন্য বিশ্বাস ও ভক্তি সহকারে রামের প্রতি হনুমানের ভাব পরিস্ফুট করার চেষ্টা করেছিলেন; অর্থাৎ প্রভুর প্রতি দাসের মনোভাব (দাস্যভাব)। এই সময়ে তিনি নিজেকে সম্পূর্ণ হনুমানের মতো ভাবতেন; এমন-কি মানুষের অভ্যাস ত্যাগ করে বানরের মতো সব অভ্যাস করেছিলেন। তিনি বাদাম, ফল ইত্যাদি খাদ্য হিসাবে গ্রহণ করতেন, গাছে উঠে ডালে ডালে লাফিয়েও যেতেন। এই সাধনার ফলে তিনি জননী সীতাকে দর্শন করেন, যিনি তাঁর দিকে করুণাপূর্ণ ভাবে চেয়ে ছিলেন। সেই জ্যোতির্ময়ী মূর্তি’ ক্রমে তাঁর দেহের মধ্যে প্রবিষ্ট হল। এরপর তিনি স্বয়ং শ্রীরামচন্দ্রের দর্শন লাভ করেন।
সারদা দেবীর সহিত রামকৃষ্ণের বিবাহ
রামকৃষ্ণ সম্বন্ধে নানা গুজব ও তাঁর অসুস্থতার কথা শুনে উদ্বিগ্ন হয়ে কামারপুকুরে ফিরে আসার জন্য মা (চন্দ্রমণি দেবী) অনেকবার চিঠি দিয়েছিলেন; রামকৃষ্ণ সেই আদেশ শিরোধার্য’ করে আবার জন্মস্থানের শান্তিপূর্ণ নিস্তব্ধ স্বাস্থ্যকর আবহাওয়ায় ফিরে গেলেন। কিন্তু এখানেও তিনি যোগ অভ্যাস পরিত্যাগ করেন নি। মায়ের যত্নে তিনি পুনরায় শারীরিক সুস্থতা ফিরে পেলেন।
রামকৃষ্ণের বয়স তখন ২৫ বৎসর। তাঁর মা ও রামেশ্বর তাঁর বিবাহের কথা চিন্তা করেছিলেন; তাঁরা ভেবেছিলেন, রামকৃষ্ণকে সাংসারিক জগতে ফিরিয়ে আনার একমাত্র পন্থা হল এই। তাঁরা নানাস্থানে পাত্রীর জন্য খোঁজ করতে আরম্ভ করলেন, কিন্তু কে এই পাগলকে কন্যাদান করবে। তাঁরা নিরুৎসাহ ও বিষণ্ণ হয়ে পড়েছিলেন। তাঁদের চিন্তা ও উদ্বেগ দেখে রামকৃষ্ণ একদিন বললেন, ‘কেন তোমরা এখানে ওখানে খোঁজ করছ? জয়রামবাটীতে যাও, সেখানে রামচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের কন্যাকে বিধাতা আমার জন্য নির্দিষ্ট করে রেখেছেন।’ কামারপুকুর থেকে তিন মাইল দুরে জয়রামবাটী গ্রামে খোঁজ করে ঐ উক্তির সত্যতা প্রমাণিত হল। ছয় বৎসর বয়স্কা পাত্রী, কিন্তু তাঁর পিতামাতা তখনি রামকৃষ্ণের সঙ্গে তাঁর বিবাহ দিতে ইচ্ছুক হলে বিবাহ যথারীতি সম্পন্ন হল। বিবাহের পরে বন্ধু তাঁর পিত্রালয়ে চলে গেলেন। রামকৃষ্ণ দেড় বৎসর গ্রামে বাস করে দক্ষিণেশ্বরে ফিরে আসলেন। তারপর তিনি ছয় বৎসর ধরে সাধনা করেন। এই সময়ে অর্থ’ ও জাতিভেদ প্রথার প্রতি তাঁর প্রচণ্ড বিরূপতা জন্মাল। বৈরাগ্যের ইচ্ছা তাঁকে সম্পূর্ণরূপে আচ্ছন্ন করল।
ভৈরবী ব্রাহ্মণী ও রামকৃষ্ণের তান্ত্রিক সাধনা
১৮৬১ সালে স্ত্রীলোকের রূপে রামকৃষ্ণের একজন গুরু অযাচিত ভাবে এসে উপস্থিত হলেন। তিনি ছিলেন একজন যোগিনী। তিনি ছিলেন মধ্যবয়স্কা এবং তাঁর নাম ছিল ভৈরবী ব্রাহ্মণী। রামকৃষ্ণকে দেখেই ভৈরবী আনন্দাশ্রু দ্বারা পরিপূরিত লোচনে অবাক বিস্ময়ে বললেন- ‘বাছা আমার, তুমি এখানে! আমি এতদিন ধরে তোমায় খুঁজছি। আজ তোমায় দেখতে পেলাম…’ এমন আবেগ নিয়ে ভৈরবী বলেছিলেন যে মনে হচ্ছিল অবশেষে যেন তাঁর হারানো সন্তান তিনি খুঁজে পেয়েছেন। রামকৃষ্ণও খুব বিচলিত হলেন।
বৈষ্ণব ও তন্ত্রশাস্ত্র এবং তদসম্পর্কি’ত আধ্যাত্মিক সাধনা সম্বন্ধে ভৈরবী খুবই অভিজ্ঞা ছিলেন। ঐকান্তিক সাধনার দ্বারা ভৈরবীর বিস্ময়কর উপলব্ধি হয়েছিল এবং তিনি খুঁজে বেড়াচ্ছিলেন এমন একজন উপযুক্ত পাত্র, যাঁকে তিনি তাঁর সাধনালব্ধ সব ঐশ্বর্য’ দান করতে পারেন। রামকৃষ্ণ ব্রাহ্মণীকে মাতার মতো শ্রদ্ধা করতে লাগলেন এবং অধ্যাত্ম-গুরু হিসাবে তাঁকে গ্রহণ করলেন। ভৈরবীও সুদক্ষ পরিচালনার রামকৃষ্ণকে কঠিন তান্ত্রিক সাধনায় সিদ্ধ করে তুললেন।
রামকৃষ্ণের বিচার
এই সময়ে রামকৃষ্ণের মানসিক বিকারের কথা আবার প্রচারিত হওয়ায় ব্রাহ্মণী ভৈরবী সকলকে আশ্বাস দিলেন যে, রামকৃষ্ণ এখন শাস্ত্রের বর্ণনা অনুযায়ী মহাভাব (অদ্ভুতপূর্ব’ আধ্যাত্মিক আনন্দ) অবস্থায় উপনীত হয়েছেন: যে অবস্থা কেবলমাত্র একান্ত ভক্তের ভগবানের সঙ্গো মিশে একাকার হওয়ার তীব্র ইচ্ছার রূপ, যেমন রাধা ও গৌরাশ্য মহাপ্রভুর হয়েছিল। যা হোক মথুরবাবু এ বিষয়ে বিখ্যাত ধামি’ক ও পণ্ডিতদের সুচিন্তিত মতামত চাইলেন। তিনি তদানীন্তন স্বনামধন্য পণ্ডিতদের এক সভা ডাকলেন। বৈষ্ণব ধর্মশাস্ত্রবিদ ও বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের নেতৃস্থানীর বৈষ্ণবচরণ এবং তান্ত্রিক সম্প্রদায়ের স্বনামধন্য তান্ত্রিক গৌরীকান্ত তক’ভুষণকে বিচারক হিসাবে আমন্ত্রণ জানানো হল। এই বিচারের ফলাফলে স্থির হল যে, রামকৃষ্ণ সাধারণ যোগী নন; তাঁরা সবাই রামকৃষ্ণের পদতলে লুটিয়ে পড়লেন এবং বললেন, ‘তুমি সেই আধ্যাত্মিক শক্তির খনি, যার সামান্যতম ভগ্নাংশ সময়ে সময়ে অবতাররূপ গ্রহণ করে পৃথিবীতে আসে।’ এইভাবে, যে-সব বিখ্যাত পণ্ডিত ও শিক্ষিত ব্যক্তিরা তাঁর (রামকৃষ্ণের) বিচারের জন্য আহত হয়েছিলেন, তাঁরাই রামকৃষ্ণের পদতলে আনত হলেন।
রামলালার (বালদেবতা রাম) রামকৃষ্ণকে অনুসন্ধান
১৮৬৪ সালে জটাধারী নামে এক মহৎ বৈষ্ণব সাধক দক্ষিণেশ্বরে আসলেন। তিনি পরিব্রাজক-সন্ন্যাসী ছিলেন এবং বালদেবতা রামের (রামলালা) ভক্ত ছিলেন। দীর্ঘকাল ব্যাপী ধ্যান জপ ও পুঞ্জার ফলে তাঁর খুবই আধ্যাত্মিক উন্নতি হয়েছিল এবং তিনি রামচন্দ্রকে শিশুরুরূপে দর্শন করেন অল্পবয়স্ক শ্রীরামচন্দ্রের জ্যোতির্ময় মূর্তির জীবন্ত উপস্থিতি তাঁর কাছে প্রত্যক্ষ- বস্তু ছিল। তিনি যেখানেই যেতেন, রামলালাকে সঙ্গে নিয়ে যেতেন। রামলালাকে যে ভোজ্যবস্তু নিবেদন করা হত তা তিনি সত্যই গ্রহণ করতেন। জটাধারী সর্বক্ষণই মূর্তি’র পরিচর্যা করতেন এবং সর্বদাই এক অবিচলিত শাস্তির মধ্যে বাস করতেন। রামকৃষ্ণ, যিনি রামলালার সব কাজ প্রত্যক্ষ করতেন, সারাদিনই জটাধারীর সঙ্গে থাকতেন ও রামলালাকে লক্ষ্য করতেন। রামলালা ক্রমশ রামকৃষ্ণের এত অন্তরঙ্গ হলেন যে তিনি রামকৃষ্ণের সঙ্গে তাঁর ঘরে যেতেন। রামলালা সুন্দর ভাবে রামকৃষ্ণের সামনে নাচতেন, লাফ দিয়ে তাঁর পিঠে উঠতেন, বা কোলে ওঠবার জন্য আবদার করতেন। এইভাবে রামলালা শিশুর মতোই সব খেলা খেলতেন এবং এইভাবে রামলালা ও রামকঞ্চে দুজনেই দুজনের প্রিয় হয়ে উঠেছিলেন।
একদিন জটাধারী রামকৃষ্ণের কাছে কাঁদতে কাঁদতে এসে বললেন- ‘এখান থেকে আমার যাওয়ার সময় হয়েছে, কিন্তু রামলালা বলছেন তিনি আমার সঙ্গে যাবেন না, এখানেই তোমার কাছে থাকবেন। আমি তাঁকে তোমার কাছে রেখে যাচ্ছি- যদিও তাঁকে ছেড়ে থাকা আমার পক্ষে খুবই কষ্টদায়ক, কারণ তিনি আমার জীবন; তবুও আমি এই ভেবে সুখী হব যে, তিনি তোমার কাছে থাকবেন।’ এই বলে জটাধারী শুধু তাঁর দেহকে বহন করে নিয়ে যান, প্রিয় রামলালা ও তাঁর নিজের মনকে রেখে যান রামকৃষ্ণের কাছে।
কৃষ্ণদর্শন
রামকৃষ্ণ দাস্য ভাবেতে শ্রীরামচন্দ্র ও জননী সাঁতার দর্শন পান; বাৎসল্য- ভাবে বালক রামের দর্শনও পেয়েছিলেন। এরপর তিনি সখ্যভাবে সাধনায় শ্রীকৃষ্ণের দর্শন পান। এসবের পর তিনি সর্বোচ্চ স্তরের বৈষ্ণব সাধনায় রত হলেন, যেখানে পূজক (সাধক) রাধার সঙ্গে একাত্মতা লাভ করে চিরপ্রেমিক কৃষ্ণপ্রেমের দিব্য আনন্দে নিজেকে হারিয়ে ফেলেন। নিজের ব্যক্তিত্বকে লুপ্ত করার জন্য রামকৃষ্ণ রাধার সাজে সজ্জিত হয়ে স্ত্রীলোকদের সঙ্গে তাদেরই একজন হয়ে থাকতেন। এই পূর্ণ’-একাত্মতা শীঘ্রই পুরস্কৃত হল এবং তিনি শ্রীকৃষ্ণের অনুপম সৌন্দর্যে’র দর্শন লাভ করলেন। সুঠাম মনোহারী শ্রীকৃষ্ণে রামকৃষ্ণের মনের তৃষ্ণা মিটাবার জন্য তাঁর সামনে উপস্থিত) হলেন। তারপর তিনি শ্রীরামকৃষ্ণের মধ্যে লীন হয়ে গেলেন এবং এর ফলে। রামকৃষ্ণ প্রায় ২।৩ মাস দিব্যানন্দে মগ্ন রইলেন।
অব্যক্ত ঐশ্বর দর্শন (বৈদান্তিক উপলব্ধি)
ভক্তি শাস্ত্রের অন্তর্গত সকল প্রকার ভক্তির সাধনা রামকৃষ্ণে করেছিলেন, যথা- শান্ত, দাস্য, সখ্য, বাৎসল্য ও মাধুর্য, প্রত্যেকটিকে তিনি সম্যক উপলব্ধি করেছিলেন। তাঁর এ পর্যন্ত যত কিছুর দর্শ’ন হয়েছিল সবই ছিল ব্যক্তিস্বরূপ দর্শনের মধ্যে আবদ্ধ (ইন্টদেবতার মূর্তি’), কিন্তু আধ্যাত্মিক অভিজ্ঞতা পেতে হলে এইটাই শেষ কথা নয়। সাধককে আরো উচ্চস্তরে উঠতে হবে, যেখানে জ্ঞান, জ্ঞাতা ও জ্ঞেয় তিনটিতে মিলে একটি অখণ্ড সত্তায় (চৈতন্যে) পরিণীত হবে, য়ে অবস্থায় সীমা (স্থান) মিশে যায় অসীমে (শূন্যে), কাল বিলীন হয় অনন্তে এবং কার্য’কারণ পরিণত হয় অতীত স্বপ্নে। এই অবস্থার যে উপনীত হয় একমাএ সেই উপলব্ধি করতে পারে- কারণ এ অভিজ্ঞতা বর্ণনাতীত।
আত্মা যখন বহু চেষ্টার পর পার্থিব সীমারেখা অতিক্রম করে বস্তুজগতের শৃঙ্খল মোচন করে অনন্ত ব্রহ্মে লীন হয়, তখনই হয় ‘নির্বি’কল্প সমাধি’- অদ্বৈত দর্শনের চরমাবস্থা। রামকৃষ্ণই যে এই অভিজ্ঞতা লাভের সর্বশ্রেষ্ঠ অধিকারী ছিলেন, সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই, এবং তার উপযুক্ত সময়ও হয়ে এসেছিল। ‘তোতাপুরী’ নামে একজন পরিব্রাজক সন্ন্যাসী দক্ষিণেশ্বরে এসেছিলেন। তিনি ছিলেন জ্ঞানযোগী। তিনি শুধু অদ্বৈত তত্ত্যেই সুদক্ষ ছিলেন না, পরন্তু তার বাস্তব উপলব্ধিও করেছিলেন। তিনি রামকৃষ্ণকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তুমি কি বেদান্ত অধ্যয়ন করতে চাও?’ রামকৃষ্ণ উত্তর দিলেন ‘আমি জানি না। মার উপরে সব নির্ভর করছে। যদি তিনি রাজী হন তবে আমি পড়ব।’ তোতাপুরী তখন বললেন, ‘বেশ তো, যাও, তাঁকে জিজ্ঞাসা কর।’ রামকৃষ্ণ মন্দিরে প্রবেশ করে দেবী- যিনি তাঁর কাছে মায়ের মতো ছিলেন- তাঁকে এবিষয়ে জানালেন। মা (কালী) তাকে বললেন, ‘হ্যাঁ বাছা, তুমি শিখতে পার; সেই উদ্দেশ্যেই আমি ওকে (তোতাপুরীকে) তোমার কাছে এনেছি।’ রামকৃষ্ণ উদ্ভাসিত আননে তোতাপুরীর কাছে গিয়ে মায়ের অনুমতির কথা জানালেন। তোতাপুরী তখন উপযুক্ত অনুষ্ঠান সহ বেদান্তের সকল সূত্র ও গভীর তথ্যাদি অধ্যয়নে রামকৃষ্ণকে দীক্ষিত করেন। নাম ও রূপের জটিলতা থেকে মনকে মুক্ত করে অবিমিশ্র সত্তায় নিবদ্ধ করে আত্মার গভীরে (সত্তার গভীরে) প্রবেশ করার জন্য তিনি রামকৃষ্ণকে নির্দেশ দিলেন। কেবলমাত্র মমতাময়ী ‘মা’র অতি পরিচিত মূর্তি’ ছাড়া অন্য সব বন্ধু বা বিষয় থেকে মনকে উঠিয়ে নিতে রামকৃষ্ণের অবশ্য কোনো অসুবিধা দেখা দেয় নি। তোতাপুরী তখন রামকৃষ্ণের দুই ভ্রুর মধ্যবর্তী স্থানে একটি কাঁচের টুকরা দিয়ে চাপ দিলেন। রামকৃষ্ণ পরে এ বিষয়ে বলেছিলেন- ‘আমি আবার ধ্যানে বসলাম, এবং যখনই মা কালীর মহিমময়ী মূর্তি’ আমার সামনে এসে উপস্থিত হল, আমি তথনই আমার বিচারশক্তির খড়া দিয়ে ঐ মূর্তি’কে দুখণ্ড করলাম, তারপর থেকে আর আমার মনে কোনো বাধা আসে নি; আমার মন তখনই ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য স্তর অতিক্রম করল, আর আমার সমাধি হল।’
যখন প্রথমদিনের সাধনাতেই রামকৃষ্ণে নির্বিকল্প সমাধিতে উপনীত হলেন এবং সেই অবস্থাতেই মৃতকল্প অবস্থায় তিন দিন রইলেন, তোতাপুরী খুবই বিস্মিত হলেন। তোতাপুরী চমৎকত হয়ে বললেন, ‘এটা কি বাস্তব সত্য? এও কি সম্ভব যে এই লোকটির মাত্র একদিনের চেষ্টায় যা সফল হল সেই অবস্থার জন্য আমাকে চল্লিশ বছর ধরে কঠিন সাধনা করতে হয়েছে। হে ভগবান! এ তো দৈবঘটনা ছাড়া কিছু নয়।’ তারপর এই অসাধারণ শিষ্যকে অদ্বৈত সাধনায় পারদর্শী করার জন্য তোতাপুরী আরো এগারো মাস দক্ষিণেশ্বরে ছিলেন।
তোতাপুরী ভাবলেন যে, রামকৃষ্ণ ‘মায়ের কাছে যে প্রার্থনা জানাল তা অন্ধ-সংস্কার ছাড়া আর কিছুই নয়।’ কিন্তু ঘটনাচক্র ও প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা পরে তোতাপুরীকে দিব্য জননীর অস্তিত্বে বিশ্বাসী হতে বাধ্য করেছিল। তিনি উপলব্ধি করলেন যে ‘ব্রহ্ম’ এবং ‘শক্তি’ অভিন্ন- একই সত্তার দুই ভিন্ন অবস্থান (রূপ)।
তোতাপুরীর প্রস্থানের পর রামকৃষ্ণে ছয়মাস পার্থিব ও মানসিক সকল উপলব্ধির স্তর অতিক্রম করে ব্রহ্মে অবস্তান করেন। হৃদয় জোর করে কিছু খাদ্য ও জল রামকৃষ্ণের মুখে মাঝে মাঝে দিতেন, এর দ্বারাই তাঁর পার্থিব দেহ জীবিত ছিল। অবশেষে মা কালী আদেশ করলেন ‘মানবকুলের হিতের জন্যই জাগতিক চৈতন্যের সংস্পর্শে থাক।’ এরপর তাঁর মন ক্রমশ নিম্নস্তরে নেমে আসে এবং তিনি দেহগত চৈতন্য লাভ করেন। /p>
অন্য ধর্ম সাধনা- মুহম্মদ, যীশুখ্রীস্টের দর্শন
অদ্বৈত তত্ত্ব , উপলব্ধির পর রামকৃষ্ণের দৃষ্টিভঙ্গি এতই প্রসারতা লাভ। করেছিল যে, সমস্ত ধর্ম’কেই ব্রহ্মোপলব্ধির বিভিন্ন পথ বলে তিনি মনে করতেন এবং তিনি তা স্বীয় অভিজ্ঞতার কষ্টিপাথরে যাচাই করতে মনস্থ করলেন।। এজন্য তিনি গোবিন্দ রায় নামে একজন সুফী সম্প্রদায়ভুক্ত ব্যক্তি, বিবি তখন দক্ষিণেশ্বরে বাস করতেন, তাঁর কাছে ‘ইসলাম’ ধর্মে’ দীক্ষিত হলেন; ঐ ব্যক্তি জন্মসূত্রে হিন্দু ছিলেন, পরে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। রামকৃষ্ণে ঐকান্তিকতা সহকারে ইসলাম ধর্মে’র সাধনায় ব্রতী হলেন। পরবর্তী’ কালে তিনি এবিষয়ের উল্লেখ করে বলেছেন- ‘সেই সময়ে আমি “আল্লাহর” নাম অবিরত স্মরণ করতাম, মুসলমানদের মতোই পোশাক পরতাম, নিয়মিত ‘নামাজ’ পড়তাম এবং মন থেকে হিন্দুধর্মে’র সব ধারণা সরিয়ে দিয়েছিলাম। আমি যে শুধু হিন্দু দেবদেবীকে প্রণাম করাই বন্ধ করেছিলাম তা নয়, তাঁদের কথাও ভাবতাম না। তিনদিন বাদে আমি ঐ সাধনার লক্ষ্যে পৌঁছেছিলাম।’ প্রথমে তাঁর পয়গম্বর মুহম্মদের দর্শন লাভ হয়, পরে আল্লাহর উপলব্ধি হয়।
কয়েক বছর বাদে খ্রীস্টানধর্ম’ সম্পর্কে’ তাঁর একই অনুভুতি হয়েছিল। একদিন তিনি মনোযোগ সহকারে যখন দিব্য-শিশু, সহ ‘ম্যাডোনা’র চিত্রটি দেখতে দেখতে খ্রীস্টের কথা ভাবছিলেন তখন তিনি অনুভব করলেন যে, চিত্রটি যেন জীবন্ত হয়ে উঠেছে এবং মেরী ও খ্রীস্টের মূর্তি’ থেকে আলোক- রশ্মি বিচ্ছুরিত হয়ে তাঁর (রামকৃষ্ণের) হৃদয়ে প্রবিষ্ট হয়েছে। তিনদিন যাবৎ গীর্জা, খ্রীস্টান ভক্তবৃন্দ, প্রার্থনা ইত্যাদির দর্শন তাঁর হতে লাগল। চতুর্থ দিনে পঞ্চবটীতে তিনি যখন বেড়াচ্ছিলেন, তিনি খৃষ্টকে তাঁর কাছে এসে তাঁকে আলিঙ্গন করে তাঁর মধ্যে প্রবেশ করতে দেখলেন। রামকষ্ণ বলে উঠলেন- ‘ইনিই যীশুখ্রীস্ট- শ্রেষ্ঠ যোগী, প্রেম-স্বরূপ, যিনি নিজের বুকের রক্ত ঢেলে দিয়েছেন মানুষের মুক্তির জন্য, এবং তাদের জন্য নানাবিধ যন্ত্রণাও ভোগ করেছেন তিনি।’
রামকৃষ্ণ বুদ্ধের পুজাও করতেন, কারণ হিন্দুরা তাঁকে ‘ভগবানের অবতার’ বলে ভাবে। বুদ্ধ সম্বন্ধে তিনি বলেছেন- ‘প্রভু বুদ্ধ যে বিষ্ণুর অবতার সে বিষয়ে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। তাঁর (বুদ্ধর) উপদেশ ও শিক্ষার সঙ্গে বৈদিক জ্ঞানকাণ্ডের (উপনিষদের শিক্ষা) কোনো তফাত নেই।’
তাঁর ঘরে তিনি তীর্থঙ্কর মহাবীরের ছোটো মূর্তি’ রেখেছিলেন এবং সেখানে সকাল ও সন্ধ্যায় ধূপ জ্বালাতেন। রামকৃষ্ণ শিখ গুরুদের সম্বন্ধে বলতেন যে, তাঁরা সবাই রাজর্ষি জনকের অবতার।
ভারতীয় বেদান্তের তিনটি শাখা- দ্বৈত, বিশিষ্টাদ্বৈত ও অদ্বৈত সম্বন্ধে তিনি বলতেন যে, মানুষের পরমলক্ষ্যের অগ্রগতির পথে ঐগুলি বিভিন্ন সোপান- এরা পরস্পরবিরোধী নয়, বরং পরস্পরের পরিপূরক, কারণ বিভিন্ন মানুষের মনস্তাত্তিক বিকাশে বিভিন্ন স্তর ও দৃষ্টিভঙ্গির উপযোগী এইগুলি।
শিষ্যদের প্রতি রামকৃষ্ণের বাণী
‘পুষ্করিণীর অনেক ঘাট আছে, হিন্দুরা তারই একটি থেকে ঘট ভরে নেয় এবং বলে ‘জল’; মুসলমানেরা আর-একটি থেকে চামড়ার ভিস্তিতে জল ভরে এবং বলে ‘পানি’ এবং তৃতীয়টি থেকে খ্রীস্টানরা জল নেয়, বলে ‘ওয়াটার’। আমরা কি কল্পনাতেও আনতে পারি যে এই বস্তু জল নয়, শুধু পানি আর ওয়াটার? একথা হাস্যকর নয় কি? আসলে বস্তু একই, কেবল নাম বিভিন্ন এবং প্রত্যেকেই সেই একই বস্তুকে খুঁজছে।
‘পৃথিবীর প্রতিটি ধর্ম’ই এরূপ এক-একটি ঘাট। ঐকান্তিকতা ও বিশ্বস্ততার ভাব মনে নিয়ে এর যে কোনো ঘাটে গেলেই চিরন্তন শাস্তির জল তুমি স্পর্শ করতে পারবে। কিন্তু কখনো বলো না যে, তোমার ধর্ম’ অন্যের চেয়ে ভালো।
‘বিভিন্ন ধর্ম’মত, বিভিন্ন পথ খুঁজছে ‘একই ঈশ্বরে’ গিয়ে পৌঁছাতে। কলিকাতার কালীঘাটের কালীমন্দিরে যাওয়ার বিভিন্ন পথ আছে। অনুরূপ ভাবে বিভিন্ন পথ মানুষকে ঈশ্বরের গৃহে নিয়ে যায়। তাই প্রত্যেক ধর্ম’ই এক-একটি পথ।
‘বিশিষ্টাদ্বৈত অবধি মন ও বুদ্ধি তার ধারণাকে প্রকাশ করতে পারে- তার বেশি নয়। পূর্ণত্ব বোধ হলে পরমাত্মা ও তাঁর প্রকাশ সমান সত্য বলেই মনে হয়। ঈশ্বরের নাম, তাঁর আবাস, এবং তিনি নিজে- একই আধ্যাত্মিক বস্তুতে গঠিত বলে বোধ হয়। সবই ঐশ্বরিক- কেবল বিভিন্নতা তাদের রূপে (আকারে)। ‘আধ্যাত্মিক উপলব্ধির শেষ কথা ‘অদ্বৈত’। এইটি এমন একটি জিনিস যা সমাধিতেই অনুভব করা যায়, কারণ এ হল বাক্যমনাতীত।’ রামকৃষ্ণের তখন দৃঢ় প্রত্যয় হয়েছিল যে, তাঁর এই অভাবনীয় আধ্যাত্মিক প্রচেষ্টা এবং উপলব্ধিসমূহ তাঁর নিজের জন্য নয়, পরন্তু আধ্যাত্মিক বিকাশের এক নবযুগের পথ প্রদর্শক হিসাবে এর প্রয়োজন ছিল। এবং মানুষকে দেখাবার জন্য যে, সেই মহোত্তম স্রষ্টা ও তাঁর সৃষ্টিকে, তাঁর দৈবত্বের সত্যতার উপলব্ধি করার পথের বাঁধাকে কি করে অতিক্রম করতে হয়।
মাতা সারদা দেবী
রামকৃষ্ণ ও সারদাদেবী স্বামী-স্ত্রী ছিলেন শুধু নামেই। এক ঐশ্বরিক পরিকল্পনায় তাঁরা দুজনে মিলিত হয়েছিলেন; এটি ছিল বিশুদ্ধ, পবিত্র ও আধ্যাত্মিক সখ্যতা। রামকৃষ্ণ সারদা দেবীকে মা কালীর মতোই ভাবতেন এবং তাঁকে পূজাও করতেন। সারদা দেবী যদিও রামকৃষ্ণকে ‘অবতার’ বলে ভাবতেন তবুও তিনি মা যেমন ছেলেকে লালন-পালন করেন তেমনি করতেন। তাঁদের মধ্যে এই স্নেহ ভালোবাসা ছিল পবিত্র, নিঃস্বার্থ ও আধ্যাত্মিকতা পূর্ণ। ১৮৭২ সালে ১৮ বছর বয়সে সারদা দেবী দক্ষিণেশ্বরে পতিগৃহে আসেন। তিনি রামকৃষ্ণের মায়ের সঙ্গে পাশেই আর-একটি ঘরে থাকতেন।
সারদা দেবীর আসার দুই মাস পরে রামকৃষ্ণ মা কালীর জন্য ষোড়শী পূজার আয়োজন করেন। সকলকে বিস্মিত করে তিনি দেবীর জন্য পুষ্পশোভিত বেদিতে সারদা দেবীকে বসতে বললেন এবং মা কালী জ্ঞানে সারদা দেবীকে সন্টাঙ্গে প্রণিপাত করে, ফুল ও পুজার সকল উপচারে পুজা করেন। মা (সারদা দেবী) ও রামকৃষ্ণ উভয়েই সমাধিমগ্ন হলেন। সমাধি ভঙ্গের পর, আবার রামকৃষ্ণ সারদা দেবীকে প্রণাম করেন এবং উদাত্ত কণ্ঠে বলে ওঠেন- ‘হে জগন্মাতা! হে জগৎ-জননী! আজ আমি তোমার পদতলে এতদিনের সব সাধনা নিবেদন করছি। সেদিন খুব দূরে নয় যেদিন তোমার শত সহস্র সন্তানেরা তোমার কাছে আসবে, তাদের তুমি এ বস্তু বিলিয়ে দেবে। দু হাতে তাদের তুমি এ বস্তু বিলিয়ে দিও। রামকৃষ্ণ ও সারদা দেবী এইভাবে অবতার পুরুষ ও অবতার শক্তি রূপে পৃথিবীতে তাঁদের পবিত্র উদ্দেশ্য সাধনের জন্য পূর্ণ মহিমায় পূর্ণ বিকশিত হয়ে উঠেছিলেন। তাঁদের অসংখ্য সন্তান, যাঁরা এসে সমবেত হয়েছিলেন, যেমন বিবেকানন্দ, ব্রহ্মানন্দ, নিরঞ্জনানন্দ, প্রেমানন্দ প্রভৃতি- তাঁদের দেখাশোনার জন্য রামকৃষ্ণ হয়েছিলেন ‘জগৎপিতা’ এবং সারদা দেবী ‘জগন্মাতা’।রামকৃষ্ণ সহ অন্যান্য সকলের কাছে সারদা দেবী ছিলেন, কল্যাণময়ী মা কালীর সাক্ষাৎ প্রতিমূর্তি।
রামকৃষ্ণের তীর্থযাত্রা- রানী রাসমণি ও মথুরবাবুর আশীর্বাদপূত চিরযাত্রা
রানী রাসমণির জামাতা মথুরবাবু প্রথম থেকেই অনুভব করেছিলেন যে রামকৃষ্ণ সাধারণ লোক নন এবং তাঁর অসীম সৌভাগ্য যে রামকৃষ্ণের সংস্পর্শে এসেছেন। রামকৃষ্ণের এই খামখেয়ালী ভাব অনেক সময় মথুর- বাবুকে বিব্রত করত এবং অনেক সময় রামকৃষ্ণের এই নিষ্পাপ সরলতাকে বাদ দিলে সত্যই তিনি সুস্থ মস্তিষ্কের কিনা সে বিষয়েও মথুরবাবুর সন্দেহ জাগত। কিন্তু কয়েকটি অলৌকিক ঘটনা রামকৃষ্ণের প্রতি তাঁর বিশ্বাস ও ভক্তি দৃঢ় করে তুলেছিল। রামকৃষ্ণ রানী রাসমণিকে মন্দিরের মধ্যে ভৎর্সনা- করায় মথুরবাবু ক্ষুব্ধ হন। কিন্তু রানী রাসমণি স্বীকার করেন যে- ‘এতে রামকৃষ্ণের দোষ ছিল না, আমারই অন্যায় হয়েছিল মন্দিরের পবিত্র চত্বরের মধ্যে ব্যক্তিগত ও তুচ্ছ সম্পত্তির কথা ভাবা। তাঁর ভৎর্সনায় আমার চৈতন্য হয়েছিল। রামকৃষ্ণ সব সময়ই আমাদের ভক্তি ও শ্রদ্ধার পাত্র।’ কিন্তু মথুরবাবুর মন তাতেও সম্পূর্ণ শান্ত হল না। এর কিছুদিন বাদে এমন এক ঘটনা ঘটল যাতে সব সন্দেহ মুছে গিয়ে এমন এক বিশ্বাসের সৃষ্টি হল, যা কোনোদিন নষ্ট হয় নি। একদিন মথুরবাবু, মন্দিরের অফিসঘরে বসে ছিলেন। সেই সময় বারান্দায় রামকৃষ্ণ পায়চারী করছিলেন, আর মুখে পাগলের মতো আস্তে আস্তে কি বলছিলেন। মথুরবাবু চেয়ে দেখছিলেন, হঠাৎ মথুরবাবু, বিস্মিত হয়ে বলে উঠলেন, ‘আমি কি স্বপ্ন দেখছি? না।। এ তা হলে সত্যই!’ তিনি যা দেখেছিলেন তা হল কখনো মা-কালী, কখনো জটাধারী শিব, কখনো বা রামকৃষ্ণকে। তিনি যুগপৎ চমৎকৃত ও আনন্দিত হলেন এই অপার্থিব দৃশ্য দেখে, এবং তাঁর দৃড় ধারণা হল রামকৃষ্ণ ‘শিবশক্তির’ একত্র সমাবেশ। মথুরবাব, দৌড়ে এসে রামকৃষ্ণকে প্রণাম করে বললেন, ‘আমায় ক্ষমা করুন। আমি ঐশ্বর্য’, অহঙ্কার ও অজ্ঞানতায় অন্ধ হয়ে ছিলাম-মা আজ আমার চোখ খুলে দিয়েছেন।’ তারপর তিনি তাঁর দর্শনের কথা রামকৃষ্ণকে বলেন। রামকৃষ্ণ তখন তাঁর স্বভাবসিদ্ধ শিশুসুলভ ভঙ্গিতে বললেন, ‘এ সবই মায়ের কাজ, আমি শুধু “জয় ভৈরবী! জয় মহাদেব!” বলে ঘুরে বেড়াচ্ছিলাম।’ ময়ূরবাবু একথা শুনে বুঝতে পারলেন যে, রামকৃষ্ণ শুধু যে জপ করেছিলেন তা নয়, তাঁর গভীর প্রেম ভক্তিতে তিনি যা উচ্চারণ করছিলেন, সেই স্মৃতি’র সঙ্গে তিনি এক হয়ে যাচ্ছিলেন।
কয়েক মাস পরে রানী রাসমণির মৃত্যু হয়। রাত্রিতে তাঁর যখন চিরনিদ্রা নেমে আসে তখন ঘরে একটি বড়ো প্রদীপ জ্বলছিল। রানী রাসমণি হঠাৎ বলে উঠলেন, ‘আলো নেভাও, আলো নেভাও। দেখছ না, মা ভবতারিণী তাঁর জ্যোতিতে আমাদের বাড়ি আলো করে তুলেছেন। ভিতরে এসো মা! ভিতরে এসো মা। ভিতরে এসো মা!…’ এই বলে রানী রাসমণি দিব্য জননীর কাছে চলে গেলেন। যে প্রশান্ত হাসিতে তাঁর মুখে উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছিল তাতে মনে হয়েছিল যে রানী রাসমণি সত্যই মৃত নন- বরং তিনি ‘জননীর’ শান্তিপূর্ণ’ অনন্ত অস্তিত্বে জেগে উঠেছেন। রানীর মৃত্যুর পর মথুরবাবুই মন্দির ও সম্পত্তির সব দায়িত্ব নিলেন। এই সঙ্গে তিনি রামকৃষ্ণের দেখাশোনার দায়িত্বভারও নিলেন। সারদা দেবীর দক্ষিণেশ্বরে আগমনের চার বৎসর পূর্বে’ মথুরবাবু তীর্থ’- যাত্রা করেন এবং রামকৃষ্ণকেও সঙ্গে যেতে রাজী করান।
পথে যেতে যেতে রামকৃষ্ণ লোকেদের দুঃখ দুর্দশা দেখে খুবই ব্যথিত হলেন। দেওঘরে গিয়ে তিনি মথুরবাবুকে বললেন গ্রামের লোককে অন্ন ও বস্ত্র বিতরণ করতে। কিন্তু এটি অনেক ব্যয়সাধ্য বিষয় ছিল। সেজন্য হবে- বাবু, প্রথমে অনিচ্ছুক ছিলেন। কিন্তু রামকৃষ্ণ এ ব্যাপারে দৃড়প্রতিজ্ঞ হওয়াতে তিনি সম্মত হন। রামকৃষ্ণ বলেন যে এইসব লোকই ‘দরিদ্র- নারায়ণ’- এদের ভালোবাসার সঙ্গে দেখাশোনা করতে হয় এবং তাতেই ভগবানের প্রকৃত পূজা করা হয়। তিনি বললেন যে যদি ঐ লোকেদের অন্ন ও বস্ত্র না দেওয়া হয়, তবে তিনি সেইখানেই (দেওঘরে) থাকবেন, আর অগ্রসর হবেন না।
যখন নৌকাযোগে গঙ্গা অতিক্রম করে তাঁরা বারাণসীতে যাচ্ছিলেন, তখন শিবধাম তাঁর কাছে স্বর্ণ’মণ্ডিত ও ‘ঘনীভূত আধ্যাত্মিক স্তুপ’ বলে বোধ হল। নৌকায় মণিকর্ণিকার ঘাট পার হওয়ার সময় রামকৃষ্ণের দর্শন হল যে একটি জ্বলন্ত শবদেহের কর্ণে দেবাদিদেব মহাদেব ‘পবিত্র মন্ত্র’ উচ্চারণ করছেন এবং তারপর চিতা থেকে একটি সুক্ষ্ম দেহ উঠে এলে দেবী পার্ব’তী তাকে স্বর্গগমনে সাহায্য করলেন। রামকৃষ্ণের এই দর্শন সম্বন্ধে পুরাণের উক্তির সঙ্গে মিলে যায়, যাতে লিখিত আছে যে, যদি কোনো ব্যক্তির কাশীতে ‘মৃত্যু হয় তবে তার আত্মার সদগতি হয় বাসে মুক্তি পায়।
এই তীর্থযাত্রীরা শ্রীকৃষ্ণের মধুর লীলাস্থল মথুরা ও বৃন্দাবনে গেলেন। একপক্ষ কাল সবাই সেখানে ছিলেন। রামকৃষ্ণ ঐ সময়ে সর্বদাই এক অনির্বচনীয় আনন্দ ও ঐশ্বরিক ভাবে মগ্ন থাকতেন।
তাঁরা গয়াতীর্থ ভ্রমণে যাওয়াও স্থির করেছিলেন, কিন্তু রামকৃষ্ণ নিজেই মথুরবাবুকে ঐ যাত্রা থেকে বিরত থাকতে বলেন। রামকৃষ্ণ চিন্তা করলেন যে যদি তিনি ঐ পবিত্র স্থানে গমন করেন তবে তাঁর মন পার্থিব জগৎ থেকে চিরদিনের মতো বিলীন হয়ে যাবে। কারণ তিনি গয়াতীর্থে’ তাঁর পিতার দর্শনের কথা পিতার কাছেই শুনেছিলেন, এবং অনুভব করলেন যে যদি তিনি গয়াতীর্থে’ যান তবে তাঁর মন সেখানে দেবতায় লীন হয়ে যাবে। ইতিপূর্বে’ই তার দৃঢ় প্রত্যয় হয়েছিল যে ‘মা’ তাঁর মাধ্যমে মানুষের মুক্তির উদ্দেশ্য পূর্ণ করবেন। কাজেই গয়া ভ্রমণ পরিত্যাগ করে তীর্থযাত্রীরা সকলেই কলিকাতায় ফিরে এলেন।
মথুরবাবু, ১৬ বৎসর পূর্বে রামকৃষ্ণের দেখা পেয়েছিলেন; রামকৃষ্ণই তাঁর মধ্যে আধ্যাত্মিকতার বীজ বপন করেন।
১৮৭১ সালের জুলাই মাসে মথুরবাবু গুরুতর অসুস্থ হওয়ায় তাঁকে কালীঘাটে নিয়ে যাওয়া হয়। ঐ দিন রামকৃষ্ণের গভীর ভাব-সমাধি হয় এবং প্রায় ২/৩ ঘণ্টা থাকে। যখন বিকাল ৫ টায় তাঁর ভাব-সমাধি ভঙ্গ হয়, তিনি হৃদয়কে ডেকে বলেন, মথুরবাবুর আত্মা মা কালীর মধ্যে বিলীন হয়ে গেছে। পরে রাত্রিতে দক্ষিণেশ্বরে সংবাদ এলো ঠিক বিকাল ৫টায় মথুরবাবুর মৃত্যু হয়েছে। মথুরবাবু, খুবই ভাগ্যবান ছিলেন যে রামকৃষ্ণের জীবনের ঘটনা-বহুল যুগেই তাঁর সঙ্গে রামকৃষ্ণের সাক্ষাৎ হয়েছিল। শ্বশ্রু মাতার মতো। তিনিও রামকৃষ্ণের প্রতি ভক্তিভারাবনত ছিলেন।
তাঁর শিষ্যবৃন্দ- বিবেকানন্দ এবং অন্যান্যরা
১৮৭৯ সাল থেকে রামকৃষ্ণের চারিপাশে শিষ্যরা সমবেত হতে আরম্ভ করেন। তিনি যে শুধু সাধারণ মানুষের উপরই তাঁর প্রভাব বিস্তার করতেন। তা নয়, তদানীন্তন শিক্ষিত বুদ্ধিমান যুবকদের উপরও তাঁর প্রভাব ছিল। বহু অজ্ঞেয়বাদী শুধুমাত্র কৌতূহলী হয়ে আসতেন, কিন্তু তাঁর সান্নিধ্যে আসার পর তাঁরা অজ্ঞেয়বাদকে পরিত্যাগ করতেন। কারণ রামকৃষ্ণের মধ্যে তাঁরা ঈশ্বরের অস্তিত্ব সুস্পষ্ট অনুভব করতেন। তাঁর মৃত্যুর পূর্বে পর্যন্ত সাত বৎসর ধরে তিনি তাঁর কাছে যে এসেছে তাকেই ঈশ্বরের বাণী শোনাতেন। তিনি বিবেকানন্দের মতো অতি তেজস্বী ও প্রগতিশীল শিষ্যদলের এক পরিমণ্ডলী গঠন করেন, যাঁরা পরে ভারতীয় অধ্যাত্মবাদের উদ্দীপ্ত শিখাকে শুধু ভারতবর্ষে’ই নয়, সারা বিশ্বের সুন্দরতম প্রান্তেও পূর্ণ’ প্রজ্বলিত করেছিলেন। রামকৃষ্ণ বহু প্রাচীন আধ্যাত্মিক সত্যকে প্রকাশিত করে তাদের চিরন্তনী অভ্রান্ততা প্রমাণিত করেন।
অন্তিম পর্ব
রামকৃষ্ণের জীবনের অস্তিম পর্বে’র দিনগুলি যদিও করুণ, তবুও সেগুলি সূর্যাস্তের স্নিগ্ধ সৌন্দর্যে’র মতোই মনোহর ও গাম্ভীর্যপূর্ণ’ ছিল। তাঁর কাছে সমাগত সকলেরই আধ্যাত্মিক নবজাগরণের প্রচেষ্টায় নিজের শক্তিকে এমন ভাবে নিয়োজিত করেছিলেন যা পার্থিব দেহের সহ্যসীমার বাইরে চলে। গিয়েছিল। ১৮৮৫ সালে তিনি গলায় ব্যথা অনুভব করেন; প্রারব্ধ কর্ম’ তাঁর তখন সম্পূর্ণ’ হয়েছিল। ঐ ব্যথা ক্রমশ গুরুতর হয়ে ওঠায় কলিকাতায় কাশীপুরে একটি উদ্যানবাটিতে তাঁকে স্থানান্তরিত করা হয়। তাঁর পরিচর্যার জন্য তাঁর অন্যান্য শিষ্যবৃন্দ ও নরেন্দ্রনাথ এবং সারদা মা সর্বদা থাকতেন। রামকৃষ্ণজানতেন যে মরজগতে তাঁর সমাপ্তি বেশি দূরে নয়। তিনি নরেন্দ্রনাথকে তাঁর অধ্যাত্ম-উত্তরাধিকারী হিসাবে নির্বাচন করেন এবং অন্যান্য শিষ্যদের রক্ষণাবেক্ষণের ভার তাঁর হাতে দেন। রামকৃষ্ণ শিষ্যদের প্রত্যেককে আশীর্বাদ করেন। তিনি নরেন্দ্রনাথকে রামনাম মন্ত্রে দীক্ষিত করেন। নরেন্দ্রনাথের উপর এর দৈবী প্রভাব বিস্তার হয় এবং মুহূর্ত’ মধ্যে তিনি দিব্য আনন্দে মাতোয়ারা হয়ে ওঠেন।
‘সমাধির কয়েকদিন আগে রামকৃষ্ণ নরেন্দ্রনাথকে কাছে ডাকেন। ঘরে তখন কেউ ছিল না। নরেন্দ্রনাথকে সামনে বসিয়ে তাঁর দিকে তাকিয়ে রামকৃষ্ণ সমাধিস্থ হয়ে গেলেন। নরেন্দ্রনাথ অনুভব করলেন যেন সূক্ষ্ম ইন্দ্রিয়াতীত শক্তি বিদ্যুতের মতো তাঁর মধ্যে প্রবিষ্ট হল; তিনিও ক্রমশ বাহ্যচেতনা হারিয়ে ফেললেন। নরেন্দ্রনাথ চেতনা ফিরে পেয়ে দেখলেন রামকৃষ্ণের চোখে জল। তিনি নরেন্দ্রনাথকে বললেন- ‘আমার সব শক্তি আজ তোমায় দিয়ে আমি ফকির হলাম! ঐ শক্তির মাধ্যমে তুমি জগতের অশেষ হিতসাধন করবে।’ এইভাবে রামকৃষ্ণ তাঁর সকল ঐশ্বরিক শক্তি নরেন্দ্রনাথকে অর্পণ করলেন- মানবহিতের প্রদীপ জ্বালিয়ে রাখার জন্য। দিন দুই বাদে রামকৃষ্ণকে এইভাবে কষ্ট পেতে দেখে নরেন্দ্রনাথের মনে তাঁর দৈবত্ব সম্বন্ধে সংশয় জাগল। আশ্চর্যের বিষয় যে-মুহুহূর্তে নরেন্দ্রনাথের মনে এ কথার উদয় হল সেই মুহূর্তে রামকৃষ্ণে ধীর স্বরে বললেন- ‘যিনি রাম এবং যিনি কৃষ্ণ ছিলেন, এ শরীরে তিনিই এখন রামকৃষ্ণ- শুধুমাত্র বেদান্তের মতানুসারে নয়; প্রত্যক্ষ ভাবেই।’ রামকৃষ্ণের এত মহিমা দেখার পরেও এইভাবে সন্দেহ করার জন্য নরেন্দ্রনাথ খুবই দুঃখ বোধ করলেন।
১৮৮৬ খ্রীস্টাব্দের ১৫ই আগস্ট, রবিবার সন্ধ্যায় রামকৃষ্ণ সমাধিমগ্ন হলেন; মধ্যরাত্রিতে চৈতন্যলাভ করে সুস্পষ্ট ভাবে তিনি তিনবার মা কালীর নাম করেন। রাত্রি ১টা বেজে ২মিনিট সময়ে হঠাৎ নাসিকাগ্রে তাঁর দৃষ্টি নিবন্ধ হয়ে গেল এবং তাঁর সারা মুখ হাস্যোদ্ভাসিত হয়ে উঠল, তিনি মহা-সমাধিতে প্রবেশ করলেন।
এইভাবে, ভারতের আধ্যাত্মিক জীবনে এক গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়ের পরিসমাপ্তি ঘটল। বিবেকানন্দ বলেছেন, ‘গ্রন্থগুলি শুধু তত্ত্বমাত্র, কিন্তু তিনি ছিলেন উপলব্ধি; তাঁর একান্ন বছরের জীবনে তিনি জাতিকে পাঁচহাজার বছরের আধ্যাত্মিক জীবনে এগিয়ে নিয়ে গেছেন এবং ভবিষ্যৎ বংশধরদের কাছে এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত রূপে পরিগণিত হবেন।’
রামকৃষ্ণের জীবন হিন্দুধর্মে’র এক সম্পূর্ণ’ পরিমণ্ডল- আস্তিকবাদ বা বেদান্তের মতো খণ্ডাংশ নয়। তিনি ছিলেন একধারে জ্ঞানী ও ভক্ত। ঈশ্বর তাঁর কাছে ছিলেন সাকার ও নিরাকার। তিনি গৃহীর জীবন এবং বৈরাগ্য ও যোগযুক্ত সন্ন্যাসীর জীবন- উভয়কেই সমান মূল্য দিয়েছেন। তাঁর মতে সর্বধর্ম’ই একই বৃক্ষের শাখা-প্রশাখা। তিনি প্রমাণ করেছেন যে ধর্ম’ যথাযথ ভাবে পরিচালিত হলে মোক্ষপ্রদায়ী হয়।
রামকৃষ্ণের আধ্যাত্মিক দীপ্তি- যা আজও আলোক বিতরণ করছে, তা চিরদিন ধরেই দীপ্যমান থাকবে। আমাদের উচিত তাঁর শিক্ষাকে মনোমধ্যে পোষণ করা এবং তার যোগ্য হওয়ার জন্য ঐকান্তিক চেষ্টা করা।’কর্তব্য কর, কিন্তু মন রেখো ভগবানের উপর। যদি ভগবানকে ভালো না বেসে পার্থিব ব্যাপারে মেতে ওঠ, তবে তুমি আরো জড়িয়ে পড়বে। কাঁঠাল-ভাঙার আগে লোক হাতে তেল মেখে নেয় যাতে কাঁঠালের আঠাতে হাতের আঙুল না জড়িয়ে যায়।
‘রাতের আকাশে অনেক নক্ষত্র তোমরা দেখতে পাও, কিন্তু সূর্য’ উঠলে আর দেখতে পাও না; তবে কি বলবে যে দিনের বেলায় নক্ষত্র থাকে না? সুতরাং হে মানুষ! তোমরা যদি অজ্ঞানতার অন্ধকার দিনগুলিতে ভগবানের দেখা না পাও, বলো না যে ভগবান নেই।
”যে ভাবেই ইচ্ছা, তুমি ভগবানের কাছে প্রার্থনা কর। তিনি নিশ্চয়ই তোমার কথা শুনবেন, কারণ তিনি পিপড়ের পদধ্বনিও শুনতে পান।’-শ্রীরামকৃষ্ণ
Reference: Gurus Guide – Path Divine Group III Balvikas