ঐশ্বরিক বক্তৃতা
ঐশ্বরিক বক্তৃতা
দিব্য বাণী—-সাই শ্রুতি, কোদাইকানাল, ২৯শে এপ্রিল ২০০৯
সৃষ্টি সত্য হতে উদিত হয়ে, সত্যেই লয় পায় পৃথিবীতে এমন কি কোনো স্থান আছে, যেখানে সত্য নেই ? এই বিশুদ্ধ ও নির্মল সত্যটি দেখবার চেষ্টা কর।
বিশ্বাস হারালে ঈশ্বরও হারিয়ে যান
প্রত্যেকেই শান্তি ও সুখ পেতে চায়। কেউ দুঃখ পেতে চায় না ,কেউ কঠিন সময়ের মুখোমুখি হতে চায়না। পোপাট তার ভাষণে বলেছেন যে সকালেই দিব্যাত্মাস্বরূপ। ঈশ্বর এক। দ্বিতীয় কেউ নেই। যদি তুমি ভাব যে দ্বিতীয় কেউ আছে, তবে তা অসত্য হবে। সুতরাং দ্বিতীয় সত্ত্বার কোনো অস্তিত্ব নেই।
সবই এক।
ছোট্ট একটি পিঁপড়ে বা মশা এবং পাখি থেকে বিশালাকায় হস্তী ,সবাই সেই ঈশ্বরের প্রকাশ। এমনকি গাছপালা, পাহাড়, পর্বত, তাও ঈশ্বরের প্রকাশ। তাই যদি হয় তাহলে দ্বিতীয় সত্ত্বা কী করে থাকতে পারে? দ্বিতীয় সত্ত্বা তোমাদের কল্পনা, তোমাদের ভ্রান্তি। তোমরাই সেটা তৈরী করেছ। একবার ভেবে দেখো যে তোমাদের দেহ কথা থেকে এসেছে। তোমরা বলবে যে তোমাদের পিতামাতার থেকে দেহ এসেছে। তোমরা তোমাদের পিতামাতার কাছ থেকে আসনি। তোমরা নিজেদের কাছ থেকেই এসেছ। সত্ত্বা একটাই। দ্বিতীয়ের অস্তিত্ব কোথায়? কিন্তু এখন মানুষ বৈচিত্র্যে বিশ্বাস করে, একত্বে নয়। এই একত্ব বলতে কি বোঝায়? একত্ব বহুর সমাহার নয় ; এ হলো একত্বের উপলব্ধি। তোমাদের চারিদিকে যদি আয়না থাকে, তাহলে তোমরা নিজেদের অনেক রূপ দেখতে পাও। এগুলি সবই তোমারই রূপ। কিন্তু সত্য এটা নয়। যে প্রশ্ন করে এবং যে উত্তর দেয় দুজনেই এক। সবাই এক। ‘দৈবম মানুষ রূপেন’ (ঈশ্বরই মানুষের রূপ পরিগ্রহণ করেছেন। একই লোক নানান রূপ পরিগ্রহ করে। এদের একটিকে অন্যটি থেকে পৃথক মনে করা ভুল। আমি যখন মাইক্রোফোনে কথা বলছি তখন তোমরা আমার গলা শুনতে পাচ্ছ। বক্তা এক, কিন্তু বহু কারন সেই একই আওয়াজ শুনছে। ‘একোহম সর্বভূতানাম ‘(সবার মাঝে যে এক সত্য আছে তা আমি )। ‘একম্ সদ্ বিপ্রাঃ বহুধা বদন্তি ‘—-(সত্য এক, কিন্তু বিজ্ঞেরা তাকে বিভিন্ন নামে অভিহিত করে থাকেন।) আকাশে একটিই সূর্য আছে। কিন্তু বহু নদী, পুকুর ও কলসে আমরা তার প্রতিবিম্ব দেখি। সূর্য এক কিন্তু জল থাকলেই সেখানে সূর্যের প্রতিবিম্ব দেখা যায়। একটা থালায় জল ঢাললে, সেখানেও সূর্যের প্রতিবিম্ব দেখা যায়। এর থেকে এমন কথা কি বলা যায় যে ওই জলের মধ্যে সূর্য আছে? না, না। এটি সূর্যের প্রতিবিম্ব মাত্র। ঠিক তেমনই আত্মা এক। মন, বুদ্ধি, অচেতন মন, অহংকার, এগুলি হলো ভিন্ন ভিন্ন পাত্রের মতন। সুতরাং যেন যে ঈশ্বর এক।
শুদ্ধ হৃদয়ে ঈশ্বরকে দেখা যায়
সবই ঈশ্বর। তোমার যদি অন্যরকম চিন্তা থাকে, তাহলে তা তোমার ভ্রম বা মায়া। সূর্য যখন মাথার ওপর ঝলমল করে তখন সকল জলাশয়ে তার প্রতিবিম্ব দেখা যায়। যেখানে জল অপরিষ্কার সেখানেও প্রতিবিম্ব দেখা যায়। কিন্তু জল যদি সম্পূর্ণরূপে অপরিষ্কার হয় তাহলে অবশ্যই প্রতিবিম্ব দেখা যাবেনা। ঠিক তেমনই তোমার হৃদয় শুদ্ধ ও নির্মল হলে তোমার ঈশ্বর দর্শন হবে। কিন্তু তোমার হৃদয় কলুষিত। যখন তুমি হৃদয়কে নির্মল করে তুলবে তখন তুমিও খুব ভালো করে ঈশ্বরকে দেখতে পাবে। ঈশ্বর প্রত্যেকের মধ্যে বিরাজ করছেন। সদ্যোজাত শিশু থেকে শুরু করে একজন প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তি এবং একজন বৃদ্ধ, সবার মধ্যে ঈশ্বর উপস্থিত আছেন। একটি ছোট্ট শিশু ধীরে, ধীরে বড় হয় এবং বার্ধক্যে পোঁছায়। ওই শিশু,ওই মহিলা এবং ওই বৃদ্ধা একই লোক। মানুষের ভাবনা তাকে ভিন্ন, ভিন্ন রূপ দর্শন করায়। ঈশ্বরের বিভিন্ন রূপ নেই। বস্তুতঃ তাঁর কোনো রূপই নেই। কিন্তু তাঁর অনেক নাম আছে। যদিও তাঁর অনেক নাম আছে, সেই সব নাম একই ঈশ্বরের বিভিন্ন প্রতিবিম্বকে সূচিত করে। প্রবহমান অথবা বদ্ধ যে কোনো জলেই তুমি সূর্যের প্রতিবিম্ব দেখতে পাবে। বহমান জলে ছায়াটি কাঁপে স্থির জলে সে নিষ্কম্প। মায়ার প্রভাবে তোমরা জগতের প্রতি আসক্ত হও। এই পৃথিবীর সবকিছুই মায়ার বিক্ষেপ। হিরণ্যকশিপু তার ছেলে প্রহ্লাদকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, “কোথায় ঈশ্বর? তুমি সবসময় নারায়ণ, নারায়ণ করছো। কে এই নারায়ণ? “প্রহ্লাদ উত্তর দিয়েছিলেন, “মানুষ নিজেই তো নারায়ণ। তুমি যাই দেখবে সেখানে কেবল নারায়ণই রয়েছেন। তিনি আমার মধ্যে, তোমার মধ্যে এবং অন্য সকলের মধ্যে বিরাজ করছেন। “হিরণ্যকশিপু বললেন, “এই স্তম্ভের মধ্যেও তিনি আছেন ? “প্রহ্লাদ উত্তর করলেন, “অবশ্যই এই স্থানেও তিনি আছেন। “হিরণ্যকশিপু একটি গদা নিয়ে সেই স্তম্ভে আঘাত করলেন। সঙ্গে সঙ্গে তিনি বিষ্ণুকে আবির্ভূত হতে দেখলেন। সুতরাং যা কিছু দেখবে, জানবে সেখানেই ঈশ্বর আছেন। কিন্তু হিরণ্যকশিপুর মতন লোকেদের ঈশ্বরে বিশ্বাস থাকেনা।
একতা দর্শনের জন্য দৃষ্টিকে প্রস্তুত করতে হবে
যদিও সৃষ্টিতে সম্পূর্ণ ঐক্য বিরাজ করছে, কিন্তু আমরা যে দৃষ্টিকোণ থেকে দেখি তা বৈচিত্র্যকে তুলে ধরে। আমরা বলি, “উনি আমার পিতা, উনি আমার মাতা। এ আমার বড় বোন, ও আমার ছোট বোন।” আমরা রূপভেদে ভিন্ন, ভিন্ন সম্পর্ক গড়ে তুলি। এই সম্পর্কগুলি কথা থেকে এল? একতার নীতি না থাকলে কোনো কিছুরই অস্তিত্ব থাকতে পারেনা। একটি উদাহরণ দেওয়া যাক। একটি কুকুর এমন একটি ঘরে প্রবেশ করল যেখানে অনেকগুলি আয়না লাগানো আছে। সে আয়নার ভিতর বহু কুকুর দেখতে পেল এবং ঘরের ভিতর অতগুলি কুকুর দেখে ভয় পেয়ে গেলো। কুকুরটি ভাবলো তার জীবন সংশয় হতে পারে। এই পরিস্থিতি থেকে বেরোতে সে একটি আয়নায় নিজের প্রতিবিম্ব দেখে, সেটিকে আরেকটি কুকুর ভেবে, আয়নাটির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লো। সে যখন ঝাঁপিয়ে পড়লো তখন দেখলো যে অন্য কুকুরটিও ঝাঁপিয়ে পড়লো। এর ফলে আয়নাটি ভেঙে গেলো। তখন কুকুরটি বুঝতে পারলো যে ওই জায়গায় আর কোনো কুকুর নেই। সে তখন ঘর থেকে বেরিয়ে এলো। অতগুলো কুকুরের হাত থেকে নিজেকে বাঁচাতে পেরে সে খুব আত্মপ্রসাদ লাভ করলো। কিন্তু অতগুলি কুকুরছিল কোথায়? সে কেবল বহু আয়নায় নিজের প্রতিচ্ছবি দেখেছিলো। মানুষের সঙ্গেও আজ এমনটাই হচ্ছে। মানুষ যদি ওই ভিন্ন, ভিন্ন রূপগুলিকে জগৎরূপ দর্পনে নিজের প্রতিবিম্ব বলে বোঝে তাহলে সে একত্বকেও বুঝতে পারবে। সুতরাং পিতা, মাতা, ভাই, বোন বলে আলাদা কোনো সত্ত্বা নেই। কিন্তু মোহ ও ভ্রান্তির ফলে লোকে নানান সম্পর্ক গড়ে তোলে এবং বলে, “এ আমার বোন, এ আমার ভাই, যিনি আমার পিতা ,যিনি আমার মাতা।” এগুলি একেবারেই দৈহিক সম্পর্ক। তোমার দিব্য স্বরূপের ভিত্তিতে গঠিত কোনো সম্পর্ক নয়। একই আত্মা সবার মধ্যে বিরাজ করছেন। এই কথাটি বোঝার চেষ্টা করতে হবে। কিন্তু, আত্ম তত্ত্বকে ভুলে গিয়ে তোমরা জাগতিক সম্পর্ক গড়ে তোলো।
কামনা বা চাহিদার বোঝা কমাতে হবে
জগতে সুখ ও দুঃখ দুটোই আছে। কঠিন সময়ে তোমরা বোলো, “হায়! ঈশ্বর আমায় কেন এতো দুঃখ দিলেন? আমি কি পাপ করেছি?” অপরদিকে যখন ধনলাভ হয় এবং তোমরা খুশি হও, তখন বলো, “আমার কি সৌভাগ্য।” একটা তোমার সৌভাগ্য বা অন্যটা তোমার দুর্ভাগ্য, কোনোটাই নয়। সৎ চিন্তা থাকলে ফলও ভালো হবে। মন্দ চিন্তা থাকলে আবার ফলও মন্দ হবে। ভালো বা মন্দ বাইরে থেকে আসেনা।
সবই ঈশ্বর। বিছে দেখলে লোকে ভয় পেয়ে, ভাবে যে সেটা তাকে কামড়ে দেবে। কিন্তু ওই বিছের মধ্যেও ভগবান আছেন। এমন কোনো প্রাণী নেই, যার মধ্যে ঈশ্বর নেই। আসলে তোমাদের নিজেদের ভ্রম থেকে বেরিয়ে আস্তে হবে। মানুষের বড় বেশি চাহিদা। এই অত্যধিক চাহিদাই ভ্রান্তির কারণ। অতএব বাসনা কমাতে হবে। কি করে সেটা করা যায়? সব বাসনাই মনের সৃষ্টি। আর মন ইচ্ছেমতন আচরণ করে। “মনঃ এব মনুষ্যনাম কারণম বন্ধমোক্ষয়ো (মনই মানুষের বন্ধন ও মুক্তির কারণ।)
মোক্ষের পথ অনুসরণ করতে চেষ্টা করা উচিত। তাহলে আর ভ্রান্তির সুযোগ থাকবেনা। কিন্তু মানুষ বাসনায় পূর্ণ; আর সেই বাসনার মুলে আছে মন। সুতরাং প্রথম ও প্রধান কর্তব্য হলো মনকে নিয়ন্ত্রণ করা। সেটা করতে পারলে আর একটিও বাসনা থাকবেনা। এইজন্যই বলা হয় যে মালপত্র কম থাকলে আরাম বেশি থাকে ও যাত্রা সুখকর হয়। বাসনার মালপত্র কম করলে, তবেই ঈশ্বর প্রীত হবেন। জোতবাসনা বাড়াবে জীবনের বোঝা ততই দুঃসহ হয়ে উঠবে। যত কম মালপত্র থাকবে তোমরা ততবেশী সুখী হতে পারবে। যতদিন বিয়ে না হয়, ততদিন মানুষ ভাবে “আমার যা আছে তাতে আমার ঠিক চলে যাবে। দু একদিন উপোস দিতে হলেও আমার কিছু এসে যাবেনা।” কিন্তু বিয়ের পর এবং সন্তান থাকলে কত দুশ্চিন্তার বোঝাই না তাকে বইতে হয়। এই স্ত্রী এবং সন্তান কথা থেকে এলো? তুমি যেখান থেকে এসেছো এরাও সেই একই উৎস থেকে এসেছে। তুমি একজনকে স্ত্রী বলে মনে করছো কারণ তুমি তার প্রতি আসক্ত। সব মহিলাকেই কি তুমি স্ত্রী বলতে পারো? না, না। ওরকম কথা বললে তোমায় মার খেতে হবে। এইভাবে তোমরা কথা বলতে পারোনা। স্বামী -স্ত্রী এর সম্পর্ক কেবল একটি দেহের সঙ্গে আরেকটি দেহের সম্পর্ক। এই শারীরিক সম্পর্ক অনেক সমস্যা তৈরী করে।
যার অর্থ আছে লোকে তাকে ধনী কিন্তু সেই একই ব্যক্তির যদি অর্থ না থাকে, তাকে লোকে ভিখারি বলবে। তোমার অনেক পয়সা থাকলে লোকে তোমায় বড় বলবে (bigger) বলবে। পয়সা না থাকলে তোমায় তারাই ভিখারী (beggar) বলবে। সুতরাং একই লোকের প্রতি এই দুটি বিশেষণই প্রযোজ্য (bigger or beggar) I সমদৃষ্টি গড়ে তুলতে চেষ্টা করো, দেখবে তোমার সবকিছু ভালো হবে। এমনকি যদি কেউ তোমায় মারে তাহলেও ভাববে, “যে আমায় আঘাত করছে ,সেও ঈশ্বর ছাড়া আর কেউ নয়। আমার নিশ্চয় কোনো ত্রুটি আছে তাই ঈশ্বর আমায় মেরেছেন। এই দেহের দ্বারা কোনো ভুল কাজ হয়েছে, সুতরাং তাকে শাস্তি পেতে হবে।”
আমরা যাই করবো, প্রতিক্রিয়া, প্রতিফলন এবং প্রতিধ্বনি হয়ে সেটা আমাদের কাছে ফিরে আসবে। আমাদের যে অভিজ্ঞতাই হয় সেটা আমাদেরই কর্মের ফল। ঈশ্বর কোনোটাই দেননি। ঈশ্বর মানুষকে আনন্দ ছাড়া আর কিছুই দেননা। সেই আনন্দ উপভোগ করার পর, যিনি সেই আনন্দ দিয়েছেন তাঁর সমালোচনা করা ঠিক নয়। দুঃখ ও সুখ উভয়েই তোমাদেরই কর্মের প্রতিফল। ঈশ্বর তোমাদের ভালোবাসেন মানে তিনি নিজেকেই ভালোবাসেন।
আমরা যাই করবো, প্রতিক্রিয়া, প্রতিফলন এবং প্রতিধ্বনি হয়ে সেটা আমাদের কাছে ফিরে আসবে। আমাদের যে অভিজ্ঞতাই হয় সেটা আমাদেরই কর্মের ফল। ঈশ্বর কোনোটাই দেননি। ঈশ্বর মানুষকে আনন্দ ছাড়া আর কিছুই দেননা। সেই আনন্দ উপভোগ করার পর, যিনি সেই আনন্দ দিয়েছেন তাঁর সমালোচনা করা ঠিক নয়। দুঃখ ও সুখ উভয়েই তোমাদেরই কর্মের প্রতিফল। ঈশ্বর তোমাদের ভালোবাসেন মানে তিনি নিজেকেই ভালোবাসেন।
আত্মতত্ত্বকে জানতে হবে
তুমি যদি সত্যি ভগবানকে ভালোবাস ,তাহলে সর্বদা তাঁর কথা চিন্তা কর। তোমার যদি রামকে ভালো লাগে, তাহলে রামের কথা চিন্তা কর। তেমনি তুমি যদি কৃষ্ণকে পছন্দ করো, তাহলে তাঁর ওপর মনকে নিবিষ্ট করো। কিন্তু সবসময় মনে রাখতে হবে যে রাম বা কৃষ্ণ কেউ বাইরে নেই; তাঁরা তোমার হৃদয়েই আছেন। রামের যে রূপ পছন্দ, চোখ বন্ধ করে সেই রূপের ধ্যান কর। তুমি অবশ্যই মানস চক্ষে তাঁকে দেখতে পাবে। শেষে তোমার উপলব্ধি হবে যে আমি নিজের ভ্রমবশতঃ মনে করছি যে রাম ও কৃষ্ণ আমার থেকে আলাদা। বস্তুতঃ আমিই রাম আমিই কৃষ্ণ। তুমি যখন রামের ধ্যান করো, তখন তাঁর যে বিরূপ দেহটা পাও তা তোমারই চিন্তার প্রতিফলন। তেমনি কৃষ্ণের কথা ভাবলে তুমি কৃষ্ণের রূপ দেখতে পাবে। তোমার মোহ বা ভ্রমের জন্য মনে হয় যে তাঁরা তোমার থেকে ভিন্ন। রামকে কি কেউ দেখেছে? কৃষ্ণকে কি কেউ দেখেছে? শিল্পী রবি বর্মা শাস্ত্রের বর্ণনা অনুযায়ী রাম ও কৃষ্ণের ছবি এঁকেছেন। এগুলো কেবলই ছবি; তারা সত্যকে প্রকাশ করেনা।
সবাই তার পছন্দমতন নামে ঈশ্বরকে ডাকতে পারে —রাম, কৃষ্ণ, গোবিন্দ যে নাম হোক। সেই নাম ও রূপে তুমি তাঁর ধ্যান করতে পারো। তাতে কোনো দোষ নেই। তোমাকে আমি এই অভ্যাস ত্যাগ করতে বলছিনা। কিন্তু মনে দৃঢ় বিশ্বাস থাকতে হবে যে “আমিই ঈশ্বর, আমার আত্মা ঈশ্বর।” আত্মার কোনো রূপ নেই। তার শুধু নাম আছে। সূর্যের মতন আত্মা সবার মধ্যে ঝলমল করে। কেবল শুদ্ধ হৃদয়ে তাঁকে দেখা যায়। যে হৃদয় শুদ্ধ নয় সেখানে তাঁকে দেখা যায়না। এই সত্য প্রতিষ্ঠা করতে বারবার অবতার এসেছেন। অবতারের নিজেদের স্বার্থের জন্য জন্মগ্রহণ করেননা। তাঁরা সবার মাঝে সত্যকে প্রতিষ্ঠা করবেন বলে আসেন। তাঁদের শিক্ষা অনুযায়ী চলো এবং আত্মতত্ত্বকে উপলব্ধি কর। বেদান্ত দাবী করে যে আত্মাই একমাত্র সত্য।
জল থেকেই ঢেউ হয়। জল না থাকলে ঢেউও থাকতে পারেনা। তেমনি আত্মা ছাড়া কোনো রূপ সম্ভব নয়; আত্মার ওপর মনকে নিবিষ্ট করে, “ওম নমো নারায়ণায়”, “ওম নমো নারায়ণায়” জপ করো। পুরোটা বলতে যদি অসুবিধা হয় তাহলে শুধু ‘ওম’কার জপ করলেই হবে। তার কারণ সবকিছুই’ ‘ওম’ এর মধ্যে নিহিত আছে। ‘ওম’প্রণব বা আদি শব্দকে বোঝায়। উপনিষদে একেই ‘আত্মা’ বলা হয়েছে। তৈত্তিরীয় উপনিষদে আত্মা সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। রাময়ন, ভাগবত এবং মহাভারতে অবতারের কাহিনীর মধ্য দিয়ে এই সত্যি প্রকাশিত হয়েছে। সবকিছুই তোমার মধ্যেই আছে। বাইরে কিছুই নেই। সমগ্র সৃষ্টি এক। নিজেদের ভ্রান্তি দূর কর। নাম ও রূপের পিছনে যে সত্য রয়েছে, তাকে উপলব্ধি করতে সচেষ্ট হও।
নাম ও রূপকে একে অপরের থেকে আলাদা করা যায়না। তোমরা ‘সাইরাম, সাইরাম, সাইরাম’ এই নাম জপ করো। এই ‘সাইরাম’ নামটি আমাকে দেওয়া হয়েছে। আমি এই নামটি নিয়ে জন্মাইনি। তেমনি রাম ও কৃষ্ণ এই নামগুলি ও তাদের পিতা, মাতা তাদের দিয়েছিলেন। তার এই নামগুলি নিয়ে জন্মাননি। র্যাম কি এসে বলেছিলেন যে, “আমি হলাম রাম”? না, না। তিনি ছিলেন দশরথের পুত্র এবং তাঁকে এই নামটি দেওয়া হয়েছিল।
শান্তি থেকে প্রেম আসবে। যার শান্তি নেই তার প্রেমও থাকতে পারেনা। আমাদের মধ্যে যখন প্রেমের বিকাশ হয়, তখন সবাইকে আপন মনে হয়। মনে হয় সবাই আমারি বিভিন্ন রূপ। সবাই এক। সবার প্রতি তোমাদের ব্যবহার সমান হয়ে উচিত। এই সত্য উপলব্ধি করার চেষ্টা করো। হাওয়া উঠলে সেই হাওয়ায় শুকনো পাতা উড়ে যায়। কিন্তু কচি পাতাগুলি উড়ে যায়না। তারা দলের সঙ্গেই থাকে। তোমাদের মানবিকতা কখনোই ওই ঝরে উড়ে যাওয়া শুকনো পাতার মতন হওয়া উচিত নয়। জেনো সবই এক দিব্য রহস্য।
- শ্রী রামের কাহিনী বিস্ময়কর,
- তা ত্রিভুবনের মানুষের জীবনকে শুদ্ধ করে
- এটা সেই কাস্তের মতন যা পার্থিব বন্ধনের লতাগুল্মকে ছেদন করে
- সে কাহিনী একজন ভালো বন্ধুর মতন যে বিপদের দিনে তোমার পাশে দাঁড়ায়
- সে কাহিনী যেন বনে তপস্যারত মুনি ঋষিদের আশ্রয়।I(তেলেগু কবিতা)
অচলাভক্তি গড়ে তোল
মনকে সেই কুকুরের মতন হতে দিওনা যে নিজের প্রতিবিম্ব দেখে নিজেই ভ্রান্ত হয়। বহু আয়নায় নিজের প্রতিচ্ছবি দেখে কুকুরটির ভ্রমহয় যে কুকুর আছে। কিন্তু অনেক কুকুর নেই। তোমরা কুকুরকে কুকুর মনে করতে পার, কিন্তু তার মধ্যেও ভগবান আছেন। স্পন্দন ছাড়া কুকুরও বাঁচতে পারেনা। এই স্পন্দন কি? এটি প্রাণের স্পন্দন। এই প্রাণতত্ত্ব তার মধ্যে আছে বলেই কুকুরটি খাওয়াদাওয়া করে ঘুরে বেড়ায়। “ও বাইরের লোক, এ বড়লোক, ও ভিখারী “এইরকম ভেদাভেদ করোনা।
সবাই এক। সবার মধ্যে এককে দেখো। তবেই তোমার ভক্তি অচলা ও যথার্থ ভক্তি হয়ে উঠবে। তা না হলেই ওঠা পড়া থাকবে। প্রতি মুহূর্তে তোমারভক্তি দোলাচলে থাকবে। অনেকেই নিজেদের ভক্ত বলে মনে করে। ঈশ্বরে বিশ্বাস যতদিন থাকে, ততদিন ভক্তিও ঠিক থাকে। যেই ভক্তি বিচলিত হয় তখন মনও বিচলিত হয়। যথার্থ বিশ্বাস কোনো অবস্থাতেই বিচলিত হয়্না। যাই ঘটুক না কেন, তোমায় যদি টুকরো, টুকরো করে কেটেও ফেলা হয় তাহলেও তোমার ভক্তি যেন বিচলিত না হয়। তাকেই বলে স্থির অচল এবং শুদ্ধ ভক্তি। এইরকম অচল ও স্বার্থহীন ভক্তি গড়ে তোলো। যীশুও ঠিক এইরকমই শিক্ষা দিয়েছিলেন। ঈশ্বর এক.তাঁকে পেতে হলে নিজের অহংকারকে কেটে ফেলতে হবে। ক্রস তারই প্রতীক। কখনো বিশ্বাস হারিওনা। সমস্ত শক্তি দিয়ে তাকে ধরে রাখো। তাহলে তুমিও অবশ্যই তোমার যথার্থ পরিচয় উপলব্ধি করতে পারবে। মানবিকতার প্রতিষ্ঠা করার জন্য মানুষের জন্ম হয়েছে, ধ্বংস করার জন্য নয়। সত্য, ধৰ্ম, শান্তি, প্রেম ও অহিংসার মতন মানবিক গুণগুলি বিকশিত করো। সত্য ধর্মের সঙ্গে মিলিত হলে সেখানে শান্তি ও প্রেমের জন্ম হয়। প্রেমই সবাইকে ঐক্যের বন্ধনে বাঁধতে পারে। রাগ হলে কি নিজের সন্তানকে মেরে ফেলবে? না, না। তুমি তাকে বকবে, কিন্তু তার ক্ষতি করবেনা। তেমনি হৃদয়ে প্রেম থাকলে সবাইকে আপন মনে হবে। সকল মহিলাকে মা ও বোনের মতন সম্মান করো।
এই ভারতের পুণ্যভূমিতে সহনশীলতাই সত্য সৌন্দর্য,
সকল তপস্যার মধ্যে সত্যের প্রতি আনুগত্যই শ্রেষ্ঠ তপস্যা
এই দেশে অমৃতসমান অনুভূতি হলো নিজের মায়ের প্রতি ভালোবাসা।(তেলেগু কবিতা)
সমস্ত নারীর প্রতি এমন পবিত্র মনোভাব গড়ে তোলো। বিয়ের পরই একজন মহিলাকে তুমি তোমার স্ত্রী বলতে পার। তিনি ছাড়া সব মহিলাই মা বা বোনের মতন হওয়া উচিত। তেমনি সব পুরুষকেই নিজের ভাই বলে মনে করা উচিত। ঈশ্বর এক। তিনিই একমাত্র পুরুষ। একবার গোপিকারা কৃষ্ণের সঙ্গে দেখা করতে তাঁর বাড়িতে গেলেন। তাঁরা সেখানে ঢুকতে গেলে পাহারাদার বললো, “এ বাড়িতে মহিলাদের প্রবেশ নিষেধ। “গোপিকারা তাকে প্রশ্ন করলো, “তাহলে তুমি এখানে কি করছো? “সে বললো, “আমি তো পুরুষমানুষ। “গোপিকারা বললো, “কেবলমাত্র পুরুষের পোশাক পরে আছো বলে তুমি নিজেকে পুরুষ বলতে পারোনা। তোমার ও আমাদের মধ্যে একই পঞ্চভূত ও পঞ্চপ্রাণ আছে। তুমি পুরুষের পোশাক পরেছো এবং আমরা নারীর পোষাক পৱেছি,শুধু এই কারণে আমরা পৃথক হতে পারিনা। একই দিব্যতত্ত্ব তোমার মধ্যেও আছে আমাদের মধ্যেও আছে। বস্তুতঃ একমাত্র কৃষ্ণই পুরুষ, আর সবাই মহিলা।”
ঈশ্বরকে ভালোবাসাই জীবনের মূল লক্ষ্য।
বর্তমানে এই সমতা ও ঐক্য পৃথিবী থেকে হারিয়ে গেছে। ঐক্যের বোধ না থাকায় আমরা দিব্যত্বকেও দেখতে পাচ্ছিনা। ফলে ঘৃণা বেড়ে চলেছে।আজকের পৃথিবী ভেদের মুঠোয় বন্ধ। প্রেমের অভাবে, পরস্পরে লড়াই চলছে। আজ মানুষ তার মানাবিকতাকেও ভুলে গেছে। সর্বপ্রথমে বুঝতে হবে যে তোমরা দিব্য আত্মাস্বরূপ। যেই বলবে যে আমি মানুষ এবং তিনি ঈশ্বর তখনি দুই এর ভাব বা দ্বিত্ব এসে যাবে। দুই থাকলে, তিনও জায়গা করে নেবে আর সে হলো মন। এটাই তোমার ধ্বংসের জন্য সম্পূর্ণ দায়ী হবে। স্বামীর সঙ্গে স্বামীর মতন এবং স্ত্রীর সঙ্গে স্ত্রীর মতন আচরণ করতে হবে। প্রত্যেককেই তার নিজের কর্তব্য করতে হবে। ইংরেজিতে ডিউটি বলতে একটি বিশেষ কাজকে বোঝায়। কিন্তু কেবল কিছু কাজ করাই মানুষের কর্তব্য নয়। নিষ্কাম কর্মকেই কর্তব্য বা ডিউটি বলে। একজন স্বার্থপর মানুষ মাছেরও প্রধম। মাছ স্বার্থপর হয়না। অতএব মনে কখনোই স্বার্থপরতাকে স্থান দিওনা। স্বার্থপরতা ত্যাগ করলে তবেই আত্মোপলব্ধি হবে। ইন্দ্রিয়ের দাস হলে সর্বদাই তুমি স্বার্থপর হবে। অতএব স্বার্থপরতা ত্যাগ করো। সবাইকে সাহায্য করো। রামনবমীর দিন আমি বলেছিলাম যে ঈশ্বর এক। পৃথিবীতে যে ভিন্নতা দেখা যায় তা কেবল বাহ্যিক। বস্তুতঃ মানুষ তো নিজেই ঈশ্বর। এই সত্যে আস্থা গড়ে তোলো। তোমার বিশ্বাসকে একটুও বিচলিত হতে দিওনা /বিশ্বাস হারালে ঈশ্বরকেও হারিয়ে ফেলবে। তোমার সঙ্গে যাই ঘটুক না কেন কখনো স্বার্থপর হয়োনা। এইভাবে চললে তুমি তোমার দিব্যত্ব উপলব্ধি করতে পারবে। তখন তোমার মধ্যে আর এই ভ্রম থাকবেনা যে রাম, কৃষ্ণ, ঈশ্বর এবং বিষ্ণু পরস্পরের থেকে ভিন্ন। রাম, কৃষ্ণ এইসব নামগুলি আমাদের দেওয়া। সবাই ঈশ্বরের থেকে সৃষ্টি হয়েছে। ঈশ্বর এক দুই নয়। আজ থেকেই সমস্ত ভেদভাব দূর করতে সচেষ্ট হও। ঈশ্বরকে যখন ভালোবাসবে তখন তাঁর আরাধনা কর এবং তাঁর কথা অনুযায়ী চলো। এটাই তোমার জীবনের প্রধান এবং যথার্থ লক্ষ্য।
[ভগবানের দিব্যবাণী থেকে সংগৃহীত –সাই শ্রুতি, কোদাইকানাল ২৯শে এপ্রিল ২০০৯]