বক্রতুণ্ড মহাকায় শ্লোক – অধিকতর পাঠ
কাহিনী
সত্যযুগে (সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মা কর্তৃক সৃষ্ট প্রথম যুগ) সিন্দুরাসুর নামে প্রচণ্ড শক্তিশালী এক দানব বাস করত। সে সর্বদা কঠোর সাধনা করত, কিন্তু সাধনায় অর্জিত শক্তি সে ধ্বংসাত্মক কাজে ব্যবহার করত। কালক্রমে সে এতটাই শক্তিমান হয়ে উঠলো যে দেবতাদের পক্ষেও তাকে হারানো অসম্ভব হয়ে উঠলো। সিন্দুরাসুর সাধু- সন্ন্যাসীদের বন্দী ক’রে অত্যাচার চালাতো ও ভাবতো যে জগতে তার সমকক্ষ কেউ নেই।
এই অবস্থায় সাধু সন্ন্যাসীরা শ্রী নারায়ণের কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করলেন ও সিন্দুরাসুরের কবল থেকে মুক্ত করবার প্রার্থনা জানালেন। সাধু সন্ন্যাসীরা শ্রী নারায়ণের আশীর্বাদ লাভ করলেন কারণ ভগবান স্বয়ং বলেছিলেন – “পরিত্রাণায় সাধুনাং বিনাশায় চ দুষ্কৃতাং” অর্থাৎ “সাধু ব্যক্তিদের রক্ষা ও দুর্বৃত্ত দের বিনাশের কারণে যুগে যুগে আমি আবির্ভূত হই”। শ্রী নারায়ণ সাধু সন্ন্যাসীদের আশ্বস্ত করলেন এই ব’লে যে তাদের দুশ্চিন্তার কিছু নেই ও তিনি স্বয়ং ভগবান শিব ও দেবী পার্বতীর পুত্র হিসেবে জ্ন্মগ্রহণ ক’রে সিন্দুরাসুরের বিনাশ করবেন।
কিছুকাল করে দেবী পার্বতীর সন্তানসম্ভবা হন। ইতিমধ্যে সিন্দুরাসুর জানতে পারে যে ভগবান শিবের পুত্র হিসেবে শুভশক্তির প্রতীকস্বরূপ যে জন্মগ্রহণ করতে চলেছে তার হাতেই সে ধ্বংস হবে। সিন্ধুরাসুর সূক্ষ্মরূপ ধারণ ক’রে দেবী পার্বতীর গর্ভে প্রবেশ ক’রে গর্ভস্থ শিশুর শিরোচ্ছেদ করে ও অদৃশ্য হয়।
নয় মাস পর দেবী পার্বতী এক পুত্রসন্তানের জন্ম দেন। যদিও সেই শিশু মাথা ছাড়া জন্মগ্রহণ করেছিল, সে ছিল স্বয়ং শ্রী নারায়ণের এক প্রকাশ, তার মধ্যে প্রাণ ছিল। কিন্তু দেবী পার্বতী তখন তার শিশুপুত্রকে দেখলেন, তখন – “কী হয়েছে দেখুন, মাথা ছাড়া পুত্র দিয়ে কী হবে?” বলে শোকে – দুঃখে কাঁদতে লাগলেন। ভগবান শিব দেবী পার্বতীকে সান্ত্বনা দিতে লাগলেন ও তাঁর এক অনুচর বীরভদ্রকে বললেন সারা জগত ঘুরে এমন কোন প্রাণী খুঁজে বের করতে যে দক্ষিণ দিকে পা রেখে ঘুমোচ্ছে এবং সেই প্রাণীর মাথা কেটে আনতে বললেন। সেই মত বীরভদ্র সারা জগত ঘুরলো, কিন্তু কোথাও দক্ষিণ দিকে পা রেখে ঘুমানো কোন প্রাণী খুঁজে পেল না কারণ শাস্ত্রমতে মৃত্যুর দেবতা যমরাজ দক্ষিণ দিকে অবস্থান করেন। যেহেতু যমরাজ দক্ষিণ দিকে অবস্থান করেন, সেহেতু দক্ষিণ দিকে পা রেখে ঘুমানোর অর্থ সেই ব্যক্তি যমরাজ্যে প্রবেশ করছে। তখনকার দিনে লোকে শাস্ত্রের বিধানগুলো গভীর ভাবে বিশ্বাস করতো ও প্রতিদিনের জীবনে সেগুলো মেনে চলতো। বীরভদ্র কেবলমাত্র একটি হাতি ছাড়া আর অন্য কোন প্রাণীকে ঐভাবে ঘুমানো অবস্থায় দেখতে পেল না। সে ভগবান শিবের কাছে ফিরে গিয়ে বললো, “হে প্রভু, বারবার খোঁজার পরেও এমন কোন মানুষ আমি পাইনি যে দক্ষিণ দিকে পা রেখে ঘুমোচ্ছে। আমি একটি হাতিকে ঐ অবস্থায় ঘুমোতে দেখেছি। আপনি যদি আজ্ঞা করেন, আমি তাহলে সেই হাতির মাথাটি এখানে নিয়ে আসতে পারি।” ভগবান শিব সম্মত হলেন, বীরবল সেই হাতির মাথাটি সেখানে নিয়ে এল এবং ভগবান শিব সেই হাতির মাথাটি সেই শিশুর দেহে স্থাপন ক’রে তাকে জীবনদান করলেন।
কিন্তু দেবী পার্বতী তখনো এই ভেবে দুঃখিত ও হতাশ হয়ে রইলেন যে সমগ্র জগৎ তাঁর পুত্রের মানবদেহে হাতির মাথার বিষয়টি নিয়ে উপহাস করবে। কিন্তু ভগবান শিব বললেন যে তাঁর দুশ্চিন্তার কোনো কারণ নেই ও ঘোষণা করলেন “আমি আশীর্বাদ করছি যে এই শিশু বিদ্যাপতি অর্থাৎ জ্ঞানদাতা রূপে পরিচিত হবে, বিদ্বানগণ ও পণ্ডিতগণ তাঁকে শ্রদ্ধা জানাবে ও পুজো করবে। সে বিঘ্নহর্তা অর্থাৎ সকল বাধা বিপত্তি নাশক হিসেবে পরিচিত হবে ও সকল অনুষ্ঠানের আগে মানুষ তাঁর পুজো করবে। সর্বদা প্রথমে তাঁর পুজো হবে ও সে প্রচুর খ্যাতি লাভ করবে।” এই কথায় দেবী পার্বতী অত্যন্ত খুশি হলেন।
প্রভু গণেশ বড়ো হতে লাগলেন ও যৌবনে পা দেওয়ার কিছুকাল পর সেই উদ্দেশ্য পূরণের সময় উপস্থিত হ’ল যে উদ্দেশ্যে তাঁর আগমন। সেই উদ্দেশ্যে তিনি সিন্দুরাসুরের সাথে যুদ্ধ করবার জন্য নর্মদা নদীর তীরে যাত্রা করলেন। এটি ছিল এক দীর্ঘ ও ভয়ঙ্কর যুদ্ধ তার শেষে প্রভু গণেশ পরশু অর্থাৎ কুঠার দিয়ে সিন্দুরাসুর হত্যা ক’রে জয়লাভ করেন। তার মাথা কাটার সময় তার দেহের সমস্ত রক্ত ছিটকে এসে প্রভু গণেশের সারা দেহে পড়ে। এই কারণে প্রভু গণেশের গায়ের রং লাল যা শুভশক্তির কাছে অশুভশক্তির অসারতা প্রমাণ করে। এই কারণে নর্মদার তীরে লাল রঙের পাথর খণ্ডগুলিকে প্রভু গণেশ কল্পনা ক’রে পুজো করা হয়।
যুদ্ধশেষে প্রভু গণেশ বিশ্রামের জন্য নর্মদাতীরে একটি শীতল স্থান খুঁজছিলেন। এক নরম ঘাসের জমি দেখে সেখানে তিনি দীর্ঘক্ষণ বিশ্রাম করেন ও সেই ঘাসকে এই ব’লে আশীর্বাদ করেন যে যে ব্যক্তি তাঁকে সেই ঘাস দিয়ে পুজো করবে, তিনি তাতে প্রসন্ন হবেন। এই কারণে প্রভু গণেশের পুজোয় দূর্বাঘাস ব্যবহার করা হয়, যা একপ্রকার বিশেষ ঘাস (এটি শুধুমাত্র প্রভু গণেশের পুজোয় ব্যবহার করা হয়, অন্য কোন দেবতার পুজোয় ব্যবহার করা হয় না)। এইভাবে প্রভু গণেশ সিন্দুরাসুর বধ করে শান্তি ও সম্প্রীতি ফিরিয়ে আনেন। সকল হিন্দু পরিবারে সমস্ত শুভ অনুষ্ঠান তেমন জন্মদিন পালন, বিবাহ, সত্যনারায়ণ পুজো, গৃহপ্রবেশ প্রভৃতির আগে প্রভু গণেশের পুজো হয় কারণ তিনি বিঘ্নহর্তা, সকল বাধা- বিপত্তি বিনাশকারী।
Illustrations by Sai Eashwaran, Sri Sathya Sai Balvikas Student.
[Source: Sri Sathya Sai Balvikas Guru Handbook Group I]