গোবিন্দ হরে গোপাল হরে – বিশদ পাঠ

Print Friendly, PDF & Email
ভাগবত বাহিনী থেকে – চতুশ্চত্বারিংশ অধ্যায়

ঋষিবর কৃষ্ণ অবতারের বাস্তব সত্য উদ্ঘাটনের মহিমান্বিত অধ্যায় বর্ণনা করতে শুরু করলেন। তিনি বললেন,’ ও বসুদেব, যারা কারাগারে দিন অতিবাহিত করছিলেন, তাদের উন্মাদ মানুষদের থেকে পৃথক বলে চিহ্নিত করা যাচ্ছিলো না। তারা আলুখালু কেশে বসে থাকে, তাদের খিদেও নেই ও শরীরকে খাবার জোগান দেবার উপায়ও নেই তাই রোগা লিকলিকে চেহারা হয়েছে। তাদের খাবার ও ঘুমোবার মত মনের অবস্থাও নেই। সন্তানদের হারানোর দুঃখে তারা ক্রমশ ক্ষয়ে যাচ্ছিলেন। তাদের কারাগার জীবন যখন দ্বিতীয় বছরে পদার্পণ করলো, দেবকী অষ্টম বার সন্তান সম্ভবা হলেন‌। ওহ্! কী বিস্ময়কর ঘটনা! কী অদ্ভুত রুপান্তর ঘটে গেলো এই ঘটনায়! দেবকী ও বাসুদেবের মুখ, যা কুঁচকে ও শুকিয়ে গিয়েছিলো, হঠাৎ প্রস্ফুটিত পদ্মের মত বিকশিত ও উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। অদ্ভুত দ্যুতিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠলো তারা।

তাদের শরীর যা জলশূণ্যতায় শুষ্ক ও অস্থিচর্মসারে পরিণত হয়েছিলো, তা অকস্মাৎ স্বাস্থ্যবান নধর মসৃন ও কমনীয় সোনালী আভায় উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। কারাগারের যে কক্ষে দেবকী বন্দী ছিলেন, তা মনোরম সুগন্ধে সুবাসিত হয়ে উঠলো; সেখানে একটা বিষ্ময়কর আলো নিক্ষিপ্ত হল এবং এক অনির্বচনীয় সুমধুর সঙ্গীতে ও নৃত্যরত পায়ের নিক্কনে, ঝংকারে মুখরিত হয়ে উঠলো‌। সত্যিই কী বিষ্ময়কর দৃশ্য, কী বিষ্ময়কর শ্রুতিমধুর শব্দ। দেবকী ও বসুদেব এই সব ঘটনা সম্পর্কে অবগত ছিলেন কিন্তু তারা এই সব ঘটনা কংসকে জানাতে ভয় পেয়েছিলো, পাছে সে তার প্রতিহিংসাপরায়ণ উন্মত্ততায় দেবকীর গর্ভপাত ঘটায়, তা ক্ষতবিক্ষত করে দেয়‌। যে সন্তান জন্মাবে তার অদ্ভুত ভবিষ্যত সম্পর্কে তারা উদ্বিগ্ন হয়ে উঠলেন এবং অদ্ভুত পূর্বলক্ষণ দেখে অস্থির হয়ে পড়লেন‌।

এক রাতে কারাগারের মেঝেতে শুয়ে দেবকী প্রসব যন্ত্রণা অনুভব করলো। তিনি তার মন ঈশ্বর চিন্তায় নিবদ্ধ করলেন এবং ছোট্ট তেলের প্রদীপের আলোর দিকে অভিনিবেশ সহকারে তাকিয়ে র‌ইলেন, উদ্বেগের সঙ্গে নিজেকে প্রশ্ন করলেন, “আমার জীবনে কি ঘটতে চলেছে? ভবিষ্যত আমার অদৃষ্টে কি লিখেছে?” হঠাৎ আলো নিভে গেল এবং কক্ষটি অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে গেলো। ঠিক তখনই সে দেখতে পেলো এক অত্যুজ্জ্বল আকৃতি তার সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে যার শরীর থেকে বিচ্ছুরিত হচ্ছে এক অদ্ভুত দ্যুতি। তিনি অবাক হয়ে ভাবলেন ইনি কে হতে পারেন, তিনি বসুদেবকে ডাকলেন এই ভয়ে যে হয়তো কংস এই চেহারায় এখানে এসেছে‌।তার সামনে ঘটে যাওয়া ঘটনার সত্যতা সম্পর্কে অনিশ্চয়তা ও সন্দেহ তাকে বিভ্রান্ত করে তুললো।

হঠাৎ সেই আকৃতি স্পষ্ট হয়ে উঠলো! ইনি শঙ্খ চক্র গদাধারণকারী ও চতুর্থ হাতে অভয় মূদ্রা প্রদর্শন করে দন্ডায়মান। ইনি মিষ্টি ও কোমল স্বরে বললেন, “দুঃখ করোনা, আমি নারায়ণ। আর কয়েক মূহুর্তের মধ্যে আমি তোমার সন্তান রূপে জন্মগ্রহণ করবো, তোমার সব কষ্ট ও প্রসব বেদনা মুছে দিয়ে। তোমার কঠোর তপশ্চর্যার ফল স্বরূপ যখন তুমি আমার দর্শন লাভ করেছিলে তখন আমি যে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম তা পালন করতেই আমার এই সিদ্ধান্ত। আমার জন্য উদ্বিগ্ন হয়োনা। যে নাটক মঞ্চস্থ হতে চলেছে তার সাক্ষী হয়ে দর্শকের ভূমিকা গ্রহণ করো মাত্র। এই চতুর্দশ ভুবনের মধ্যে এমন কেউ জন্মায়নি বা এমন কেউ জন্মাবে না যে আমার বিন্দুমাত্র ক্ষতি সাধন করে আমায় কষ্ট দিতে পারবে‌। এবিষয়ে তুমি নিশ্চিত থাকো। তোমার গর্ভজাত সন্তানের প্রতি স্নেহের কারণে সামান্যতম উদ্বেগ যদি তোমাকে আক্রান্ত করে এবং মায়াবী বিভ্রমে তোমার মনকে কুয়াশাচ্ছন্ন করে, তুমি তৎক্ষণাৎ দৈব উপস্থিতি বা অলৌকিক ঘটনার সাক্ষী হতে সমর্থ হবে যে ঘটনার মাধ্যমে আমার‌ই স্বরূপ প্রকাশিত হবে‌।

“যে মূহুর্তে আমার জন্ম হবে তোমাদের হাত ও পা থেকে শিকল খুলে পড়ে যাবে, তোমরা মুক্ত হবে, আপনা আপনি নিজের থেকেই কারাগারের দরজা খুলে যাবে। নবজাতক আমাকে সকলের অজান্তে এখান থেকে গোকুলে নন্দর বাড়িতে নিয়ে যাবে এবং তার স্ত্রী যশোদা যে এই মূহুর্তে প্রসব যন্ত্রণায় কষ্ট পাচ্ছে, তার পাশে রেখে আসবে। তার পাশ থেকে সদ্যজাত কন্যা সন্তানকে নিয়ে কারাগারে ফিরে আসবে ও তাকে তোমাদের সাথে রাখবে।তারপর কংসকে খবর পাঠাবে। যতক্ষণ পর্যন্ত না কংস খবর পাচ্ছে, মথুরা বা গোকুলের কেউ তোমায় দেখতে পাবেনা ও সন্দেহ‌ও করবে না। আমি এভাবেই সব ব্যবস্থা করে রাখবো।” এই বলে তিনি দিব্য দ্যুতিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠলেন এবং দেবকী ও বসুদেবকে আশীর্বাদ করে দেবকীর গর্ভে প্রবেশ করলেন এক ধূমকেতুর মত এক আলোকিত কক্ষপথে। কয়েক মিনিটের মধ্যেই সেই দিব্য শিশু ভূমিষ্ঠ হল।

সময়টা ছিলো ভোর সাড়ে তিনটে, ব্রহ্ম মূহুর্ত্তের পবিত্র ক্ষণ। বিষ্ণু মায়া (বিভ্রান্তি সৃষ্টি কারি দৈবশক্তি) হঠাৎই ঘুম নিয়ে আসলো বাধা সৃষ্টিকারি প্রহরী ও নগরে দিনরাত যারা প্রহরায় রয়েছে, সবার চোখে। তারা সবাই স্ব স্ব স্থানে পতিত হল ও গভীর ঘুমে মগ্ন হল। মোটা লোহার শিকল যা দিয়ে বসুদেবের হাত ও পা বাঁধা ছিলো, তা মূহুর্ত্তের মধ্যে খসে পড়লো। দরজা ও প্রবেশ দ্বার সবিস্তারে খুলে গেলো। যদিও সেটা ছিলো রাতের অন্ধকারতম সময়, হঠাৎ আনন্দের উন্মেষ ঘটায় কোকিল তার কূজনে চারদিক মুখরিত করে তুললো, টিয়া চন্দনা পাখিরা যে স্বর্গীয় আনন্দ অনুভব করছিলো তা প্রকাশে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। আকাশে তারারা ঝিকমিক করছে, যেন তারা অন্তরের আনন্দে হাসছে। বৃষ্টির দেবতা পৃথিবীতে বৃষ্টির মত পুষ্প বর্ষণ করছিলেন। কারাগারের চারিদিক ঝাঁক ঝাঁক পাখির মিষ্টি কলকাকলিতে, আনন্দ গানে মুখরিত হয়ে উঠলো।

বসুদেব অনুভব করলন যে এই সব কিছুই ঈশ্বরের মহিমার প্রকাশ। তিনি নবজাতক শিশুর দিকে চোখ ফেরালেন এবং যা দেখলেন তাতে বিস্মিত গেলেন। নিজের মনে ভাবলেন তিনি যা দেখছেন তা কি সত্যি! অথবা এটা কি কোনো মানসিক বিভ্রম! তিনি স্তম্ভিত নিথর হয়ে সেই স্থানে দাঁড়িয়ে পড়লেন, কারণ একটা উজ্জ্বল আলোর বলয় মহারাজার মত এই শিশুকে বেষ্টন করে আছে। পরিস্কার দেখা গেলো শিশুটি মা বাবাকে দেখে হাসলো।মনে হল শিশুটি যেন কিছু বলবে। হ্যাঁ, তারা তার কথা শুনতে পেলো, “আর দেরি না করে এখনই আমাকে গোকুলে নিয়ে চলো।”

বসুদেব আর একটুও গড়িমসি করলেন না। তিনি একটা বাঁশের তৈরি ছোট আসনে একটা পুরোনো ধুতি বিছালেন এবং শিশুটিকে সেখানে রাখলেন। তিনি দেবকীর একটা পু্রোনো শাড়ি ছিঁড়ে সেই কাপড়ের ওড়না দিয়ে শিশুটিকে পেঁচিয়ে নিলেন। তারপর তিনি ঘুমন্ত প্রহরীদের অতিক্রম করে খোলা দরজা ও সিংহদুয়ার দিয়ে বেরিয়ে গেলেন। তিনি লক্ষ্য করলেন আকাশ থেকে ছোট ছোট বৃষ্টির ফোঁটা পড়ছে এবং এটা ভেবে কষ্ট পেলেন যে নবজাতক শিশুটি শীঘ্রই ভিজে যাবে। কিন্তু যখন তিনি পিছন ফিরে তাকালেন, তিনি দেখতে পেলেন, আদিশেষ নাগ শিশুটিকে বৃষ্টির হাত থেকে রক্ষা করার জন্য মাথার ওপর ছাতার মত শিরাযুক্ত তার বিশাল ফণা বিস্তার করে বসুদেবের পদাঙ্ক অনুসরণ করছে। পথ দিয়ে চলার সময় প্রতিটি পদক্ষেপে বসুদেব অনুকূল ও পবিত্র দৃশ্য দেখতে পাচ্ছিলো। যদিও সূর্য এখনও উদিত হয়নি, প্রতিটি সরবরে পদ্মদল প্রস্ফুটিত হয়ে রয়েছে এবং প্রতিটি ফুল ডাঁটি সমেত বসুদেবের দিকে ঝুঁকে রয়েছে। যদিও সেটা ছিলো চন্দ্র বিহীন রাত, চাঁদের আলোর কোনো সম্ভাবনাই ছিলো না, তবুও পূর্ণচন্দ্র মেঘের আবরণ ছিঁড়ে উঁকি দিচ্ছিলো দিব্য শিশুকে দর্শন করার আকুল আকাঙ্খায়, সারাটা পথ ধরে চাঁদের শীতল কিরণ আলোকিত করে রেখেছিলো বাঁশের ছোট মাদুরটি যাতে শিশুটি শুয়েছিলো! সেই শিশুটি যে মঙ্গলকর ও শুভলক্ষণ যুক্ত সবকিছুকে আকর্ষণ করছিলো, তাকে নন্দর গৃহে রেখে আসা হল এবং সেখানে যে শিশুটি সদ্য ভূমিষ্ঠ হয়েছে, তাকে নিয়ে এসে দেবকীর হাতে দেওয়া হল। এই কাজটি সমাপন করতে না করতে বসুদেব কান্নায় ভেঙে পড়লেন। তিনি কান্না থামাতে পারছিলেন না।

কৃষ্ণের আবির্ভাব ঘটেছিল মোক্ষ বা মুক্তি প্রদানের উদ্দেশ্যে

কৃষ্ণ অষ্টমী তিথিতে জন্মেছিলেন। জন্মের পর মূহুর্ত থেকেই তাকে নানা ভাবে সমস্যায় ফেলার চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু যিনি প্রভুর নাম হৃদয়ে ধারণ করেছেন তিনি বন্ধন থেকে মুক্তি পেয়েছেন বা মোক্ষ লাভ করছেন। বসুদেব বন্দী ছিলেন, কিন্তু যে মূহুর্তে দেবকী শিশু কৃষ্ণকে তার স্বামীর মাথায় রাখলেন, তিনি মুক্ত হলেন। যে মূহুর্তে প্রভু তার মস্তক স্পর্শ করলেন, বসুদেবের শৃঙ্খল খুলে পড়ে গেলো। যতক্ষণ তিনি কৃষ্ণকে মাথায় বহন করেছিলেন এবং শিশুটিকে রিপল্লীতে পৌঁছে দেওয়া পর্যন্ত তিনি মুক্ত ছিলেন। তিনি যশোদার বাড়িতে শিশুটিকে রেখে এলেন। তারপর তিনি কারাগারে ফিরে এলেন ও আগের মত শৃঙ্খল বদ্ধ হলেন। এই কাহিনীর অন্তর্নিহিত অর্থ কি? যতক্ষণ পর্যন্ত দিব্যচিন্তা আমাদের মনকে পরিপূর্ণ করে রাখে, ততক্ষণ বন্ধন মুক্ত। কিন্তু যখনই আমরা ঈশ্বরকে ত্যাগ করি, আমরা প্রতিটি ক্ষেত্রে বন্দীত্বের যন্ত্রণা ভোগ করি।

বসুদেবের ভক্তি

দৈব কন্ঠস্বরের নির্দেশ অনুসারে বসুদেব শিশুটিকে একটি বাক্সে রেখেছিলেন এবং তা মাথায় নিয়ে যমুনানদী (যে নদী ভাগ হয়ে তার জন্য পথ তৈরি করে দিয়েছিলো) পার হয়ে গোকুলে গিয়েছিলেন, যেখানে ঠিক সেই সময়ে নন্দর স্ত্রী যশোদা একটি শিশু কন্যার জন্ম দিয়েছিলেন। ঠিক যখন তিনি কারাগার থেকে বার হলেন, একটি গাধা ডেকে উঠেছিলো যা কিনা মঙ্গল বার্তা সূচক। কিন্তু বসুদেব ভয় পেয়েছিলো যে এটা প্রহরীদের জাগিয়ে দিতে পারে; তাই, তিনি দুই হতে গাধাটির পা ধরেছিলো (শিশু বহনকারী বাক্সটি মাটিতে রেখে) এবং প্রার্থনা করেছিলো যাতে সে নীরব হয়। এতটাই তার ভক্তির গভীরতা ছিলো ঈশ্বরের প্রতি যাকে তিনি তার নির্দেশেই এক স্থান থেকে অন্য স্থানে নিয়ে যাচ্ছিলেন। দিব্যবাণী, ২রা সেপ্টেম্বর, ২০১০

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।