হিন্দু ধর্ম

Print Friendly, PDF & Email
হিন্দু ধর্ম

হিন্দুধর্ম সর্বাপেক্ষা প্রাচীন ধর্ম হিসাবে পরিগণিত হয়, জৈনধর্ম ও বৌদ্ধধর্ম-তাদের সূচনা ও মূলেও রয়েছে হিন্দুধর্ম। এজন্যই এই দুটি ধর্মকে বলা হয় হিন্দুধর্মের দুহিতা।

হিন্দুধর্মকে সনাতন ধর্ম নামে অভিহিত করা যথার্থই উপযোগী ও নির্ভুল। ‘ধর্মের’ অর্থ যা ধারণ করে অর্থাৎ যা এই সৃষ্টিকে একত্রে ধারণ করে আছে এবং সমগ্র জগতের সাম্য বজায় রাখছে ও পালন করছে।

‘সনাতন’ অর্থ শাশ্বত অর্থাৎ ‘যা অনন্ত কাল বলবৎ থাকবে এবং চিরদিনের জন্য মঙ্গলদায়ক। সুতরাং সনাতন ধর্ম এমন এক ধর্ম যা চিরন্তন নীতি ও আদর্শগুলিকে ধারণ ও বর্ণনা করে। এই ধর্মের মূল রয়েছে বেদের মধ্যে। বেদ হল সর্বশ্রেষ্ঠ জ্ঞানশাস্ত্র এবং সৃষ্টির সঙ্গেই বেদের সৃষ্টি বলে বিশ্বাস করা হয়। বেদসমূহ থেকে উৎপন্ন হওয়ায় এই ধর্মকে বৈদিক ধর্ম বা বেদান্ত বলা হয়। বৈদিক ধর্ম (সনাতন ধর্ম) কতকগুলি ঐহিক আধ্যাত্মিক নীতি নির্ধারণ করেছে যার দ্বারা মানুষ তার জীবনের যাত্রাপথে সুগঠিত মহাজাগতিক ঐক্যতানে সুর মিলিয়ে চলতে পারে।

সিন্ধু নদের পূর্বতীরের বসবাসকারীদের উদ্দেশ্যে ইন্দু/হিন্দু শব্দটি ব্যবহার করা হত। বাবা সব কিছুরই একটি আধ্যাত্মিক শব্দার্থ স্থির করেন। তিনি তার দিব্য ভাষণে ‘হিন্দু শব্দটিকে বুঝিয়েছেন এইভাবে। ‘হিন অর্থ হিংসা (আঘাত করা বা হিংস্রতা) এবং ‘দু’ অর্থ ‘দূর’ বোঝায়; সুতরাং হিন্দু শব্দে বোঝায় সেইসব লোককে যারা চিন্তা, বাক্য ও কার্যদ্বারা মানুষ, পশু অথবা কোন প্রাণীকে কখনো পীড়ন করে না।

“অহিংসা পরমোধর্ম”:- সর্বজীবে শ্রদ্ধা করা (কারণ প্রত্যেক বস্তু ঈশ্বর দ্বারা অধিকৃত ও আবৃত থাকে) এবং ঈশবাস্যমিদম্ সর্বম- হল মূল নীতি। বাস্তবিক পক্ষে এইগুলিই হিন্দুধর্মের মৌলিক, প্রাথমিক এবং মুখ্য মতবাদ।

ভারত শব্দটির জন্য বাবা বলেন—‘ভা’ অর্থ ভগবান এবং রতি অর্থ প্রেম ও আসক্তি। সুতরাং ভারত কথাটির অর্থ হল ভগবদরতি এবং এর দ্বারা বোঝায় গভীরভাবে ভগবানকে ভালোবাসে যে সকল মানুষ তাদের আবাস স্থল। এই ভাবে ‘হিন্দু’ ও ‘ভারত’ শব্দ দুটির বাবার দেওয়া ব্যাখ্যায় সমগ্র হিন্দু ধর্মের সারমর্ম ও দার্শনিক তত্ত্বকে বুঝিয়ে দেওয়া হয়- ‘সর্বজীবে প্রেম ও ঈশ্বরে প্রেমই হিন্দুধর্মের মর্মকথা; এবং প্রকৃতপক্ষে এটি সর্বধর্মেরও মূলকথা। যেহেতু হিন্দু ধর্ম আদি ও সর্বাপেক্ষা প্রাচীন এবং ধর্মের সর্বজনগম্য পথের সন্ধান দেয়, সেহেতু এই ধর্মকে সঙ্গত কারণেই সর্বধর্মের জননী রূপে আখ্যাত করা হয়।

হিন্দুধর্মের মূল শিক্ষাগুলি হল:
  1. প্রাকৃতিক শক্তিসমূহ ভগবানেরই একটি অভিব্যক্তি:-

    প্রতিটি প্রধান শক্তিকে—সূর্য, বায়ু, অগ্নি, জল, পৃথিবী, বরুণ ইত্যাদিকে ঋষিরা যদিও পৃথক পৃথক দেবতারূপে ধারণা করে পূজার্চনা করতেন, বহু দেবতার ধারণা সত্ত্বেও এটি বিশ্বাস করা হয় যে, “একং সদ, বিপ্রা বহুধা বদন্তি”।

  2. মানুষের আন্তরসত্তা ভগবানের একটি অভিব্যক্তি এবং অংশ:-

    প্রাকৃতিক শক্তির উৎসগুলিকে যেমন ঈশ্বরের অভিব্যক্তি হিসেবে গ্রহণ করা হয়, তেমনই বিশ্বাস করা হয় ঈশ্বরের প্রত্যেকের মধ্যে ‘আত্মা’ রূপে বিরাজমান। আত্মাগুলি একম্ অদ্বিতীয়মের শক্তিনিঃসৃত স্ফুলিঙ্গের মতাে। এইভাবেই মানুষের আত্মার মধ্যেও মহােত্তম শক্তি বা ভগবান অবস্থান করেন। শ্রেষ্ঠ বাক্য “তৎ-ত্বম-অসি” এই সত্যই প্রচার ও প্রকাশ করে। তাই মানুষের পরম লক্ষ্য হল, নিত্য বিদ্যমান ঈশ্বরের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করে এবং পার্থিব বাসনা ত্যাগ করে মোক্ষ প্রাপ্ত হওয়া। মোক্ষ প্রাপ্ত হলে মানুষ জন্ম মৃত্যুর চক্র হতে নিস্তার লাভ করবে।

  3. পছন্দমতো যে-কোনো রূপেই ভগবানের পূজা করা যায়:-

    তাঁর রূপ অনন্ত এবং নামও অনন্ত। যে কেউ আপন রুচিমত ভগবানকে ইষ্টদেবতা রূপে যে-কোনো মূর্তিতে আরাধনা করতে পারে এবং ভগবান সেই রূপেই ভক্তকে সাড়া দেন।

  4. জীব ও সত্তার ঐক্য:-

    ঈশ্বর সর্বভূতে বিরাজমান, তা সে বৃহৎ হোক বা ক্ষুদ্র। তিনি সর্ববস্তুতে ও সর্বত্র বিরাজিত; তিনি সর্বব্যাপী এবং জীবের প্রতিটি কণার মধ্যে রয়েছেন। সেইজন্য তার সৃষ্ট জগৎকে আমাদের ভালােবাসা, শ্রদ্ধা ও পূজা করা উচিত। “ঈশাবাস্যম্ ইদম্ সর্বত্র — এই বিশ্বাসই হিন্দুধর্মের অন্তর্নিহিত সত্তা।

শাস্ত্রসমূহ এবং প্রস্থান ত্রয়

হিন্দুধর্মের প্রামাণিক উৎসগুলি দুটি ভাগে বিভক্ত-(ক) শ্রুতি এবং (খ) স্মৃতি।

শ্রুতি- শ্রুতির আক্ষরিক অর্থ- যা শােনা গেছে। কথিত আছে যে শ্রেষ্ঠ ঋষিরা শাশ্বত সত্যগুলি শুনেছিলেন এবং সেগুলি বেদে লিখিত আছে। হিন্দুধর্মের ভিত্তি হল বেদ। ‘বেদ’ কথাটি ‘বিদ্’ শব্দ থেকে এসেছে, যার অর্থ হল ‘জানা’। বেদ অনন্ত অসংখ্য। ‘অনন্তবৈ বেদঃ’। ব্যাসদেব পরে এইগুলি একত্র সংগ্রহ করে সমগ্র বেদকে চারটি মূল ভাগে সংকলিত করেন এবং তার চারজন শিষ্যকে শেখান।

  1. পৈল্যকে শিক্ষা দেন- ঋগবেদ
  2. বৈশম্পায়ণকে শিক্ষা দেন— যজুর্বেদ
  3. জৈমিনীকে শিক্ষা দেন— সামবেদ
  4. সুমন্তকে শিক্ষা দেন— অথর্ববেদ

এই বেদগুলির প্রত্যেকটির তিনটি প্রধান শাখা আছে,

  1. সংহিতা বা মন্ত্র
  2. ব্রাহ্মণ এবং
  3. আরণ্যক।

আরণ্যকেরই অনেক অধ্যায় নিয়ে উপনিষদগুলি রচিত। উপনিষদ কে ‘বেদান্ত’ও বলা হয়ে থাকে। অর্থাৎ বেদের সমাপ্তি ভাগ। ‘উপনিষদ’ কথাটি একটি মিশ্র সংস্কৃত শব্দ থেকে উদ্ভূত। ‘উপ’ অর্থ কাছে, ‘নি’ অর্থ নিচে এবং ‘ষদ’ কথার অর্থ বসা। অর্থাৎ কোন শিক্ষকের চরণতলে বসা অথবা শিক্ষকের কাছাকাছি বসা। এই অর্থ শ্রদ্ধা এবং সম্মান প্রদর্শন করা বোঝায়। উপনিষদগুলির মধ্যে প্রধান হচ্ছে ঃ(১)কেন (২)ঈশ (৩) কঠ (৪) প্রশ্ন (৫) মুণ্ডক (৬)মাণ্ডুক্য (৭)ঐতরেয় (৮)তৈত্তিরীয় (৯) ছান্দোগ্য এবং (১০)বৃহদারণ্যক।

স্মৃতি– এগুলি অপ্রধান শাস্ত্র।

  1. বিধি-নিয়মের সর্বোচ্চ প্রণেতারা হলেন মনু, যাজ্ঞবল্ক্য এবং পরাশর। তাঁদের প্রণীত এই নিয়ম কানুনগুলি ধর্মশাস্ত্র নামে পরিচিত। বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষের জীবন ও কর্তব্য সম্পর্কে তাঁরা নির্দেশ দিয়েছেন।
  2. ইতিহাস অথবা মহাকাব্য – রামায়ণ ও মহাভারত।
  3. পুরাণ বা উপাখ্যান এবং লােককাহিনী
  4. আগম বা পূজার্চনার বিধি এবং
  5. দর্শন বা দার্শনিক তত্ত্বসমূহ।

দর্শনশাস্ত্রকে তিন ভাগে ভাগ করা যেতে পারে ——

১। দ্বৈত ( মাধবাচার্যের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত )- এই মত অনুসারে জীব ও ব্রহ্ম ভিন্ন। তাঁর গুণগান করে, পূজা করে ভক্ত আনন্দ পায়। ঈশ্বর ভক্তের প্রার্থনা পূর্ন করে তাকে আশীর্বাদ করেন।

২। অদ্বৈত ( শঙ্করাচার্যের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত )- এই মত অনুসারে সমগ্র সৃষ্টি যাঁর দ্বারা ব্যাপ্ত, তিনি এক। বিশ্বে যা কিছু আছে তা সেই একেরই বিচিত্র রূপে প্রকাশ। অদ্বৈতশাস্ত্র যা শেখায় তা হল এই যে সেই একই পরমাত্মা প্রত্যেকের মধ্যে বর্তমান। তাই অন্যকে আঘাত করা মানে নিজেকে আঘাত করা। সকলকে নিজের মতন করে ভালোবাসতে হবে।

৩। বিশিষ্টাদ্বৈত (রামানুজাচার্যের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত)- শঙ্কর যে অদ্বৈত তত্ত্বের কথা বলেছেন, সবাই সেটা গ্রহণ করতে পারেন নি। ঈশ্বরের সঙ্গে একত্ব তাঁদের বুদ্ধিস্থ হয়নি। তাই রামানুজাচার্য বিশিষ্টাদ্বৈতর কথা বললেন। এখানে যা বলা হল তা হচ্ছে ,ভক্তির পথ ধরে মানুষ ঈশ্বরে লীন হয়ে যেতে পারে।

বলা যেতে পারে এগুলি বেদান্ত দর্শনের বিভিন্ন স্তর। উপনিষদ, ব্রহ্মসূত্র এবং ভগবদ্গীতা সকল শাস্ত্রের মধ্যে সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ। এগুলি সর্ববিষয়ক ও প্রামানিক। এই তিনটিকে প্রস্থানত্রয় বলা হয়। এগুলি আমাদের অগ্রগতির পথকে আলোকিত করে এবং নিরাপদে সংসার সমুদ্র পার হতে সাহায্য করে।

হিন্দু ধর্মে নৈতিকতা ও এবং কর্তব্য

হৃদয়ে নৈতিকতা না থাকলে মানুষ আধ্যাত্মিক পথে অগ্রসর হতে পারেনা। মহান ঋষিরা জীবনের চারটি প্রধান লক্ষ্য বা পুরুষার্থের কথা বলেছেন। এগুলি হল:

  1. ধর্ম— সৎ আচরণ
  2. অর্থ— সম্পদ
  3. কাম —বাসনা
  4. মোক্ষ– মুক্তি

অর্থ উপার্জন কালে এবং নিজেদের বাসনা বা চাহিদা পূরণের সময় ধর্মের নীতি মেনে চলতে হবে। সর্বদা মনে রাখতে হবে যে জীবনের চরম লক্ষ্য হল মোক্ষ বা মুক্তি লাভ করা। অসৎ পথে অর্জিত অর্থ যথার্থ সম্পদ নয় এবং একদিন তা দুঃখ নিয়ে আসে। একমাত্র সৎ পথে উপার্জিত অর্থই সত্যকার সুখ দিতে পারে

অর্থ, বাড়ী— এসব সম্পদ নয়। চরিত্রই হল প্রকৃত সম্পদ। যে ধর্মের পথ অনুসরণ করে, ধর্ম তাকে রক্ষা করে।

জীবনের চারটি আশ্রমে পালনীয় কর্তব্যও তাঁরা নির্ধারণ করে দিয়েছেন-

  1. ব্রহ্মচর্যাশ্রম: ছাত্র অবস্থা। শৈশব এবং যৌবন হল জীবনের ভিত্তি। এই পর্যায়ে জ্ঞান অর্জন ও স্বীয় সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচয়, চরিত্রের শুদ্ধতা অর্জন ও স্বাস্থ্যবান দেহ লাভ ,এগুলির প্রতিই মনোযোগ দেওয়া উচিত।
  2. গৃহস্থাশ্রম: গৃহীর জীবন। এই পর্যায়ে কেবল নিজের বা নিজের পরিবারের উন্নতির কথা ভাবলেই চলবে না, সমাজের উন্নতির দিকেও লক্ষ্য রাখতে হবে।
  3. বানপ্রস্থাশ্রম: সংসার জীবন থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়ে অরণ্যে চলে যেতে হবে; অর্থাৎ সাংসারিক কর্ম থেকে অবসর নিয়ে আধ্যাত্মিক সাধনায় নিবিষ্ট হতে হবে।
  4. সন্ন্যাসাশ্রম: সম্পূর্ণ ত্যাগ।

সাধারণভাবে সমাজের মঙ্গলের কথা ভেবে বর্ণাশ্রম ধর্মের, যা আসলে শ্রম অনুযায়ী বর্ণভেদের সমবায় প্রথা–সেটির উৎপত্তি হয়েছিল। এই চারটি বর্ণ হল

  1. ব্রাহ্মণ- সমাজের আধ্যাত্মিক অভিভাবক, যেমন পুরোহিত।
  2. ক্ষত্রিয়- সমাজের শারীরিক অভিভাবক বা রক্ষক, যেমন রাজা, সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি ও রাজকুমার।
  3. বৈশ্য- মানুষের বাণিজ্যিক প্রয়োজন যাঁরা দেখেন, যেমন কৃষক, বণিক ও ব্যবসায়ী।
  4. শূদ্র- প্রধান কর্মীবৃন্দ, তাঁরা সমাজের পেশী শক্তি, যেমন সাফাইকর্মী, জমাদার। তাঁরা তাঁদের কায়িক শক্তি দিয়ে সমাজকে রক্ষা করে থাকেন।

প্রতিটি বর্ণের কাজই গুরুত্বপূর্ণ। কোনো কাজই বড় অথবা ছোট নয়। শুধু যাঁরা স্বার্থপর তাঁরাই ছুৎমার্গ মানতেন। ঈশ্বরের চোখে সবাই সমান। অস্পৃশ্যতা হিন্দু ধর্মের কলঙ্ক।

স্বামী বলেন, পৃথিবীতে একটিই জাতি আছে, তা হল মানবজাতি। “জীবনের প্রতিটি পর্যায়ে প্রতিটি কর্তব্যকে সত্য, ধর্ম, শান্তি,প্রেম ও অহিংসার মতন গুরুত্বপূর্ণ গুণগুলির দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হতে হবে।

হিন্দুদের ধর্মীয় অনুষ্ঠান

কিছু আচরণীয় অনুষ্ঠান ও সংস্কার পালন সকল ধর্মেরই প্রয়োজনীয় অঙ্গ। এর ফলে আমাদের মন নির্মল হয়, হৃদয় পবিত্র হয় এবং মানুষ আধ্যাত্মিক দৃষ্টিভঙ্গি লাভ করেI জন্ম থেকে মৃত্যু অবধি মানুষকে বিভিন্ন সংস্কার পালন করতে হয়। এরমধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সংস্কারগুলি হল :

  1. শৈশবে জাতকর্ম এবং অক্ষর অভ্যাস।
  2. তারুণ্যে উপনয়ন। এর মাধ্যমে বালককে গায়েত্রী মন্ত্রে দীক্ষিত করা হয়। গুরু তখন ছেলেটিকে শিষ্য রূপে গ্রহণ করে তাকে আধ্যাত্মিক জ্ঞান প্রদান করেন।
  3. যৌবনে লগ্ন সংস্কার বা বিবাহ-পবিত্র অগ্নিকে সাক্ষী রেখে হিন্দু বিবাহ সম্পন্ন হয়। পুরোহিতেরা মন্ত্র উচ্চারণ করে থাকেন। পূত অগ্নি পতি ও পত্নীর পবিত্র বন্ধনের সাক্ষী হন। তাঁরা শুধু গার্হস্থ্য জীবনে পরস্পরের সাথী নন,আধ্যাত্মিক পথেও তাঁরা পরস্পরের সহযাত্রী। একত্রে তাঁরা আধ্যাত্মিক পথে অগ্রসর হবার চেষ্টা করবেন।

প্রতিটি মানুষকে প্রতিদিন কিছু আচার পালন করতে হয়। এগুলি হল সন্ধ্যাবন্দনা,পঞ্চ যজ্ঞ ইত্যাদি।

পঞ্চ মহাযজ্ঞ

মানুষ সমাজে বাস করে। সে বেঁচে থাকার জন্য প্রকৃতির কাছে ঋণী। জন্ম এবং বড় হয়ে ওঠার জন্য সে তার পিতামাতার উপর নির্ভরশীল। ঈশ্বরের সৃষ্টি তাকে দিয়েছে তার দেহ,দিয়েছে বাতাস, সূর্যালোক,জল, খাদ্য এবং দৈনন্দিন জীবনে প্রয়োজনীয় সব কিছু। মানুষ ঈশ্বর পিতামাতা, গুরু এবং অন্য সকল সহযোগী মানুষের কাছে ঋণী। এদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করবার জন্য এবং অজান্তে সৃষ্টির ক্ষতিসাধন করার প্রায়শ্চিত্তস্বরূপ মানুষের কর্তব্য পঞ্চযজ্ঞ করা।

এই পঞ্চযজ্ঞ গুলি হল-

  1. ব্রহ্মযজ্ঞ- শাস্ত্র ও ধর্মপুস্তক পাঠ।
  2. দেবযজ্ঞ– দেবতা অথবা ইষ্টদেবতার পূজার্চনা।
  3. দেবযজ্ঞ- দেবতা অথবা ইষ্টদেবতার পূজার্চনা।
  4. পিতৃযজ্ঞ– পিতৃপুরুষদের স্মরণ করা এবং তাঁদের উদ্দেশ্যে শ্রদ্ধাঞ্জলি দেওয়া।
  5. ভূতযজ্ঞ- জীবজন্তু ও পক্ষীকে আহার দেওয়া।
  6. মনুষ্যযজ্ঞ– খাদ্যপানীয় দ্বারা অতিথি, দরিদ্র এবং অভাবগ্রস্তদের আপ্যায়ন ও সেবা করা।
পূজানুষ্ঠান বিধি

পূজা আমাদের সঙ্গে ভগবানের মিলন ও আনন্দের সেতু। প্রথমে ভগবানের আরাধনা করা হত বহিঃসত্তা রূপে; ক্রমশ তিনি আমাদের হৃদয়ে অবস্থিত প্রভুরূপে আরাধিত হতে লাগলেন এবং পরবর্তীকলে মহাজাগতিক শক্তির আধার বিরাট স্বরূপ রূপে এবং সবশেষে অদ্বৈত সর্বব্যাপী সত্তা রূপে। যে ষোড়শোপচারে মূর্তি পূজা করা বিধি, সেগুলি হল:

  1. ধ্যান— মনকে আয়ত্তে এনে একমনা হওয়া
  2. আবাহন— মিনতিপূর্ণ আহ্বান
  3. সিংহাসন— সিংহাসন অথবা আসন প্রদান
  4. পাদ্য— পদধৌতরকণ
  5. অর্ঘ্য— যথাযোগ্য সেবা করা
  6. স্নান— অভিসিঞ্চন
  7. বস্ত্র– বস্ত্র প্রদান
  8. যজ্ঞোপবীত— পৈতা প্রদান
  9. চন্দন– চন্দন প্রদান
  10. পুষ্প- পুষ্প প্রদান
  11. ধূপ— গন্ধদ্রব্য প্রদান
  12. দীপ- দীপ জ্বালানো
  13. নৈবেদ্য— ভোগ নিবেদন
  14. তাম্বুল— পান সুপারি প্রদান
  15. নিরঞ্জন— প্রদীপের সাহায্যে আরতি
  16. সুবর্ণ পুষ্প— কৃতজ্ঞতা প্রকাশের চিহ্ন হিসাব সোনা অথবা অন্য মূল্যবান বস্তু উৎসর্গ করা

—‘কারণ আমাদের যা-কিছু আছে সবই তাঁর দান মাত্র।’ পূজারীর পূজা যখন উন্নতমানের হবে তখন সে উপলব্ধি করবে যে, যে-ঈশ্বরকে সে মূর্তিরূপে পূজা করছে তিনি সর্বব্যাপী ঈশ্বর; তাঁর বিরাট স্বরূপ সৃষ্টির প্রতি অণু-পরমাণুতে মিশে আছে।

হিন্দু সাধনা

সাধনা বলতে বোঝায় মোক্ষ লাভের পথ। তিনটি প্রধান পথ হল

  1. কর্মমার্গ
  2. ভক্তিমার্গ এবং
  3. জ্ঞানমার্গ।
  4. কর্ম যোগ- কর্মফলের আশা না করে, সর্বান্তকরণে, সকল কর্ম নৈবেদ্যরূপে ঈশ্বরের চরণে ঈশ্বরের চরণে সমর্পণ করাই কর্মযোগ। এইরূপ কর্মকে নিষ্কাম কর্ম বলা হয়। যিনি নিষ্কাম কর্ম করেন তাঁকে ঈশ্বর সর্বদা রক্ষা করেন, তিনি জন্ম-মৃত্যুর আবর্ত থেকে মুক্ত হন।

ভক্তি যোগ– নিজের পছন্দ অনুসারে ঈশ্বরের যে কোনো রূপের পূজা করা যায়। ভক্তিমার্গের নয়টি পন্থা আছে।

  1. শ্রবণম্ – এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ রাজা পরীক্ষিৎ, যিনি কেবল ভগবানের কাহিনী (ভাগবৎ পুরাণ) শ্রবণের দ্বারা মুক্তিলাভ করেছিলেন;
  2. কীর্তনম্ – যথা নারদ ও তার তাম্বুরা, যা বাজিয়ে দিবারাত্র ঈশ্বরের মহিমা কীর্তন করতেন;
  3. বিষ্ণু স্মরণম্ – প্রহ্লাদের মতো ঈশ্বরের নাম অবিচ্ছিন্নভাবে স্মরণ করা;
  4. পদসেবনম্ – লক্ষ্মীদেবী যেমন নারায়ণের পদসেবা করেন তেমনি সর্বদা ঈশ্বরের পদে নিজেকে যুক্ত রাখা;
  5. অৰ্চনম্- সর্বদা ঈশ্বরের আরাধনা করা, যেমন ভরত সর্বদাই শ্রীরামের পাদুকা পূজা করতেন;
  6. বন্দনম্ – অক্রুরের মতো সর্বদা ঈশ্বরের অনুগত থাকা
  7. দাস্যম্‌ -ভক্ত হনুমানের মতো সদা সর্বদা ঈশ্বরের সেবা করা;
  8. সখ্যম – ঈশ্বরের সঙ্গে অর্জুনের মতো সখ্যতা স্থাপন;
  9. আত্মনিবেদনম্ – শ্রীরাধার মতো ঈশ্বরের কাছে সম্পূর্ণ অসঙ্কোচ আত্মসমর্পণ

এছাড়া ভক্তির আরো পাঁচটি ভাব আছে, যথা—শান্ত, বাৎসল্য, দাস্য, সখ্য, ও মাধুর্য। এইগুলি ‘ভাব’-এর আদর্শ এবং এইগুলি দ্বারা ভক্ত ঈশ্বরের সঙ্গে বন্ধনের ও সম্পর্কের অনুভূতি লাভ করে; এইগুলির মাধ্যমেই ঈশ্বর আমাদের চৈতন্যের অখণ্ড ও অবিচ্ছেদ্য অংশরূপে পরিণত হন।

জ্ঞানমার্গ – মানুষ ও তাঁর স্রষ্টার সত্তা একই। শাস্ত্রে ঘোষিত হয়েছে ‘তৎ-ত্বম-অসি”। চারটি বৈদিক মহাবাক্য এই পরম সত্যকে প্রচার করেছে।

  1. প্রজ্ঞানম ব্রহ্ম–পরম চৈতন্যই ব্রহ্ম
  2. তৎ ত্বম অসি—তুমিই সেই
  3. অয়মাত্মা ব্রহ্ম- আমার অন্তরস্থ আত্মাই ব্রহ্ম
  4. অহম্ ব্রহ্মস্মি—আমিই ব্ৰহ্ম

    প্রথম দুটি মহাবাক্য গুরু (যিনি পরমাত্মার সঙ্গে তাঁর অভিন্নতা উপলব্ধি করেছেন) তাঁর শিষ্যের কাছে ঘোষণা করেছেন, তবে তা পরামর্শ বা আদর্শ রূপে। তৃতীয় মহাবাক্য শিষ্যের ঐরূপ চিন্তাধারায় অভ্যস্ত হওয়ার সোপান স্বরূপ (অভ্যাসের জন্য); চতুর্থটি শিষ্যের পরমাত্মার সঙ্গে অভিন্নবোধের বিস্ময়সূচক অনুভূতির প্রকাশ। এটিই অনুভব বাক্য। ঋষি যাজ্ঞবল্ক তাঁর স্ত্রী মৈত্রেয়ীকে বলেছিলেন যে এই মহাবাক্য গুলিকে উপলব্ধি করার উপায় হল,

  5. শ্রবনম্‌ – মহাবাক্য গুলি শোনা
  6. মননম্‌ – যা শোনা হল তার অর্থ অনুধাবন করা
  7. নিধিধ্যাসন – একাগ্র চিত্তে সত্যের অভিজ্ঞতা লাভের জন্য অনুসন্ধান।

সত্যানুসন্ধান শুরু করবার আগে আমাদের অন্তরকে পবিত্র করবার জন্য আমাদের যে চারটি সাধনা করতে হবে সেগুলি হিন্দু ধর্মে সাধনাচতুষ্টয় নামে পরিচিত।এগুলি হল, ১) বিবেক ২) বৈরাগ্য ৩) ষট্‌সম্পতি ৪) মুমুক্ষত্ব

সকল সাধনার উদ্দেশ্য মানুষের দৈহিক, মানসিক, আবেগজনিত, নৈতিক এবং আধ্যাত্মিক বিকাশ ঘটানো যাতে সে ঈশ্বর তথা সকল ধর্মের সারমর্ম ও ভিত্তিকে উপলব্ধি করতে পারে।

সর্বাত্ম ভব/ একাত্ম ভব – এই হল সনাতন ধর্মের নীতি। প্রত্যেকের উচিত শুধু নিজের জন্য নয়, সমাজের উন্নতিকল্পে কাজ করা। ‘সমস্ত লোকা সিখীনো ভবন্তু’ এই হল হিন্দু ধর্মের প্রার্থনা। অপর আর একটি প্রার্থনা হল, সর্বে বৈ সুখীনো সন্তু, সর্বে সন্তু নিরাময়া সর্বে ভদ্রাণি পশ্যন্তু, মা কশ্চিৎ দুখমাপ্লুয়াৎ।

হিন্দুধর্মের প্রধান নীতিগুলির সারমর্মঃ

  • একমাত্র অস্তরস্থ আত্মা দ্বারাই সকল প্রাণী পরস্পর আবদ্ধ হয় এবং ঐ আত্মা দ্বারাই সকলে একই ঈশ্বরের সঙ্গে মিলিত হয়। ইহা স্বীকার করে যে সমগ্র সৃষ্টি ও সৃষ্ট প্রাণী ঈশ্বরের প্রতিমূর্তি।
  • ইহা কার্যকারণ সম্বন্ধে বিশ্বাসী অর্থাৎ কর্ম, কার্য ও কারণ নীতিতে বিশ্বাস করে। হিন্দুধর্মের মতে সুখ ও দুঃখ আমাদের দ্বারা সৃষ্ট।
  • ইহা পুনর্জন্মবাদে বিশ্বাসী, যেটি হল কর্মবাদের অনুসিদ্ধান্ত।
  • ইহা যুগে যুগে অবতারের আবির্ভাবে বিশ্বাস করে; যাঁরা বিপথগামী মানুষকে ন্যায় পথে পরিচালনা করার জন্য আগমন করেন।
  • ইহা বিশ্বাস করে যে সকল ধর্মমতই তাদের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী অভ্রান্ত এবং একমাত্র উদ্দেশ্য হল আত্মোপলব্ধি (ভগবদ্ উপলব্ধি) এবং এই উপলব্ধি ব্যতিরেকে মানবজন্ম অসম্পূর্ণ। প্রকৃতপক্ষে ধর্মের মূল অর্থ ও উদ্দেশ্য হল এই উপলব্ধিকরণ।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: