উপমন্যুর গল্প
উপমন্যুর গল্প
মহান ঋষি ধৌম্যের অনেক শিষ্য ছিল। একদিন একটি হৃষ্টপুষ্ট বালক ঋষি ধৌম্যের আশ্রমে প্রবেশ করল। তার সারা গা ধূলো, কাদায় ভর্তি। ছেলেটির নাম উপমন্যু। সে ঋষিকে অনুরোধ করল যাতে তিনি তাকে নিজের শিষ্য বলে গ্রহণ করেন এবং তাকে জ্ঞানের আলোক দান করেন। ঋষি উপমন্যুকে গ্রহণ করলেন এবং অন্য শিষ্যদের সঙ্গে তাকে রাখলেন। একজন ছাত্রের যেসব সৎগুণ থাকা উচিত তার অনেকগুলিই উপমন্যুর মধ্যে ছিলনা। প্রথমতঃ কঠিন মনে হওয়ায় শাস্ত্রপাঠে তার খুব একটা আগ্রহ ছিলনা। তার বুদ্ধি কম থাকায় সে পাঠ মুখস্থ করতে পারতনা। সে যে খুব বাধ্য ছিল এমনটাও নয়। ঋষি ধৌম্য একজন অত্যন্ত জ্ঞানী পুরুষ ছিলেন এবং শব্দের যথার্থ অর্থেই একজন গুরু ছিলেন। এই ছেলেটিকে কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে, সেটা তাঁর জানা ছিল। তার এই সমস্ত দোষ ও ত্রূটি থাকা সত্ত্বেও তিনি তাকে অত্যন্ত স্নেহ করতেন বরঞ্চ অন্যান্য ছাত্রদের চেয়ে বেশিই করতেন।গুরুর কাছ থেকে এতো ভালোবাসা পাওয়ার ফলে, সেও খুবই তাড়াতড়ি গুরুকে ভালোবাসতে শুরু করল। গুরুর প্রতি তার ভালোবাসা এমন জায়গায় গিয়ে পৌঁছলো যে সে গুরুর জন্য সবকিছু করতে প্রস্তুত ছিল। ঋষি ধৌম্য সেটা বুঝতে পারলেন। তিনি বুঝলেন যে বীজ পোঁতার জন্য জমি তৈরী হয়েছে। উপমন্যুর দোষের একটাই কারণ ছিল, সে প্রয়োজনের অতিরিক্ত আহার করত। ফলে তার বুদ্ধি ঠিকমতন কাজ করতনা, স্বাস্থ্য ঠিক থাকতনা এবং তার মধ্যে তমোগুণ বেড়ে যাচ্ছিল। ধৌম্য চাইলেন যে সে তার রসনাকে সংযত করুক এবং দেহের যতটুকু প্রয়োজন ততটুকুই আহার করুক।
ধৌম্য তখন উপমন্যুকে বললেন যে সে যেন ভোরবেলায় গরুগুলি চরাতে নিয়ে যায় এবং সন্ধ্যা হলে তবেই প্রত্যাবর্তন করে। ধৌম্যর স্ত্রী তার অপরাহ্নের খাওয়ার জন্য কিছু রান্না করে তার সঙ্গে দিয়ে দিতেন। কিন্তু উপমন্যুর অনেক বেশী পরিমাণে আহার করার অভ্যাস ছিল। যতটুকু খাবার তাকে দেওয়া হতো সেটা তার পক্ষে যথেষ্ঠ ছিলনা। সুতরাং ক্ষুধা বোধ করলেই সে গরুগুলির থেকে দুধ দুয়ে তা পান করত। কয়েকদিন যাবার পর ধৌম্যে দেখলেন উপমন্যুর দেহ থেকে মেদের আধিক্য যায়নি। তিনি খুবই অবাক হলেন। তিনি যখন উপমন্যুকে তার খাওয়ার কথা জিজ্ঞাসা করলেন, তখন যেহেতু উপমন্যু সত্য কথা বলত, তিনি তার খাওয়ার কথা জানতে পারলেন। এবার ধৌম্য উপমন্যুকে গুরুর অনুমতি ছাড়া দুধ খেতে বা রণ করলেন; কারণ হিসেবে তিনি বললেন যে ঐ দুধ উপমন্যুর নয়। যেহেতু সে গুরুকে অত্যন্ত ভালোবাসত, সে তৎক্ষণাৎ তাঁর কথায় রাজী হয়ে গেল। কিন্তু উপমন্যু কিছুতেই তার ক্ষুধাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারলনা। অপরাহ্নে বাছুরগুলো যখন মায়ের বাট থেকে টেনে দুধ খেতো তখন বাছুরের মুখ থেকে যে দুধ পড়ে যেত অঞ্জলি পেতে উপমন্যু সেই দুধ পান করত। তার মনে হত যে সে তার গুরুর আদেশ লঙ্ঘন করছেনা কারণ সে তো নিজের জন্য গরুর দুধ দুইছে না। কিছুদিন পর ধৌম্য দেখলেন যে উপমন্যুর দৈহিক ওজনের কোনো পরিবর্তন নেই এবং তার কারণটাও জানতে পারলেন। তিনি অত্যন্ত স্নেহের সঙ্গে তাকে বোঝালেন যে বাছুরের মুখ থেকে পড়া দুধ খাওয়া ভালো নয়, এতে তার স্বাস্থ্যের ক্ষতি হবে। উপমন্যু প্রতিজ্ঞা করল যে সে আর এমন কাজ করবেনা।
কিন্তু একদিন দুপুরে তার এমন খিদে পেলো যে সে আর নিজেকে সামলাতে পারলনা।সুতরাং গাছ থেকে যেসব ফল ঝুলছিল তার কয়েকটি সে খেলো। কিন্তু ফলগুলি বিষাক্ত থাকায় ছেলেটি অন্ধ হয়ে গেল। চোখে দেখতে না পাওয়ার ফলে সে একটি কুয়োর মধ্যে পড়ে গেল। যখন অনেকক্ষন হয়ে যাওয়ার পরেও উপমন্যু ফিরলো না কিন্তু গরুগুলি ফিরে এলো, তখন ধৌম্য তাকে খুঁজতে বেরোলেন। কুয়োর মধ্যে তাকে পড়ে থাকতে দেখে ঋষির মনে দয়া হল। তিনি উপমন্যুকে একটি মন্ত্র শেখালেন। সেটি আবৃত্তি করার ফলে অশ্বিনীকুমার দ্বয় সেখানে আবির্ভূত হলেন (দেবতাদের চিকিৎসক) এবং উপমন্যুর দৃষ্টি ফিরিয়ে দিলেন।
এরপর থেকে উপমন্যু বুঝতে পারলো যে লোভ বিপদ ডেকে আনে এবং ধ্বংসের কারণ হয়। ধৌম্য তাকে বুঝিয়ে বললেন যে লোভ তাকে শুধু শারীরিক ভাবে নয়, মানসিক ভাবেও অন্ধ করে রেখেছিল। এতে তার বুদ্ধির ক্ষমতা হ্রাস পেয়েছিল এবং তার ফলে সে কুয়োর মধ্যে পড়ে গিয়েছিল, যা তাকে বিপদের সম্মুখীন করেছিল এবং তার প্রাণসংশয় হতে পারতো। এইবার ছেলেটির এই শিক্ষা পছন্দ হলো এবং সে অধিক আহারের অভ্যাস ত্যাগ করলো। তার ফলে খুব অল্প সময়ের মধ্যেই সে শারীরিকভাবে সক্ষম ,স্বাস্থ্যবান এবং বুদ্ধিমান হয়ে উঠলো।
এইভাবে গুরু ব্রহ্মা রূপে স্রষ্টা ,বিষ্ণু রূপে রক্ষাকর্তা এবং মহেশ্বর রূপে অসৎগুণের নাশকর্ত্তা হয়ে ওঠেন। ঋষি ধৌম্য, সেই বালকের হৃদয়ে গুরুর প্রতি ভালোবাসা সৃষ্টি করেছিলেন, তারপর তাঁর সপ্রেম উপদেশের সাহায্যে তিনি সেই ভালোবাসাকে রক্ষা করেছিলেন এবং তার সাফল্যের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ানো মন্দ অভ্যাসটিকে ধ্বংস করেছিলেন।
Illustrations by Selvi. Danusri, Sri Sathya Sai Balvikas Student.
[উৎস – শ্রী সত্য সাই বালবিকাশ গুরু হ্যান্ডবুক গ্রূপ I]