বিশ্বামিত্রের অনুরোধ
বিশ্বামিত্রের অনুরোধ
বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে রাজা দশরথের চারপুত্র রাম, লক্ষ্মণ, ভরত আর শত্রুঘ্ন–এঁদের চরিত্রে সুন্দরগুণের সমন্বয় দেখা গেল। রাম হচ্ছেন ধর্ম ও সত্যের প্রতীক। লক্ষ্মণ কঠোর অথচ অনুভূতিপ্রবণ। ভরত মহান এবং কর্তব্যনিষ্ঠ। শত্রুঘ্ন দয়ালু ও সহৃদয়। সবকিছু শিক্ষণীয় বিষয়ে এমনকি যুদ্ধ ও ধনুর্বিদ্যা সম্পর্কেও দশরথ তাঁর পুত্রদের জন্যে সর্বশ্রেষ্ঠ শিক্ষার ব্যবস্থা করেছিলেন। পুত্রগর্বে গর্বিত রাজা অত্যন্ত সুখে দিন কাটাচ্ছিলেন।
এইভাবে দিন যায়। একদিন রাজা বসে আছেন রাজসভায়। এমন সময় সংবাদ এল যে ঋষি বিশ্বামিত্র তাঁর দর্শনপ্রার্থী। এ কথা শুনেই রাজা তাড়াতাড়ি সিংহাসন থেকে নেমে পরম শ্রদ্ধাভরে ঋষিকে অভ্যর্থনা জানালেন। তিনি ঋষিকে তার আগমনের কারণ জানতে চাইলেন এবং বললেন যে তিনি যেকোনভাবে ঋষিকে সেবা করতে প্রস্তুত। বিশ্বামিত্র এবার তাঁর ইচ্ছা প্রকাশ করলেন, বললেন—“ধর্মকে রক্ষা করা রাজার কর্তব্য; আমি এক বৃহৎ যজ্ঞ শুরু করেছি। কিন্তু রাক্ষসের বড় উৎপাত। আপনার পুত্র রামই পারবে রাক্ষস দমন করে যজ্ঞ রক্ষা করতে।”
দশরথের বুক কেঁপে উঠলো। রামকে ছেড়ে থাকবেন কি করে? ঋষিকে বোঝাতে চাইলেন যে রামের বয়স বড় অল্প। সে এই কাজের যোগ্য হবে না। তার চেয়ে বরং তিনি স্বয়ং যাবেন রাক্ষসদের সঙ্গে যুদ্ধ করতে অযোধ্যার সমস্ত সৈন্য নিয়ে। বিশ্বামিত্র বিরক্ত হলেন। তৎক্ষণাৎ আসন ত্যাগ করলেন এবং রাজাকে উপহাস করে বললেন যে তিনি কথার খেলাপ করছেন।
উদ্বিগ্ন বশিষ্ঠদেব, অযোধ্যার রাজগুরু, এবার এগিয়ে এলেন; দশরথকে বললেন, “রাজা, বিশ্বামিত্র একজন মহর্ষি। তিনি জানেন যে বয়সে বালক হলেও রামই পারবে রাক্ষসদের হত্যা করে যজ্ঞ রক্ষা করতে। সুতরাং বিনা দ্বিধায় আপনি রাম ও লক্ষ্মণকে ঋষির সঙ্গে পাঠিয়ে দিন। এটি আপনার পুত্রদের কাছে এক পরম আশীর্বাদ”।
বশিষ্ঠদেবের উপদেশে আশ্বস্ত হয়ে রাজা দশরথ রাম-লক্ষ্মণকে ডেকে পাঠালেন। দুই ভাই সভায় এলেন। রাম প্রথমে মাকে, তারপর বাবা, বশিষ্ঠদেব ও বিশ্বামিত্রকে প্রণাম করলেন। রাজা পুত্রদের ঋষির সঙ্গে যাওয়ার এবং তার আদেশ মেনে চলার নির্দেশ দিলেন।
রাজপুত্রদের প্রথম অভিযানঃ
বিশ্বামিত্র রাজপুত্রদের নিয়ে রওনা হলেন, পথে রাত্রি নামলো, ঠিক হলো সে রাত্রে তাঁরা সরযু নদীর তীরে বিশ্রাম নেবেন। সেখানে ঋষি রাম-লক্ষ্মণকে মন্ত্র দিলেন, যাতে তারা দৈহিক ক্লান্তি ও সাংসারিক ক্ষয়ক্ষতিকে তুচ্ছ জ্ঞান করতে পারে; আর এছাড়া কিছু দৈব অস্ত্রের ব্যবহারও শিক্ষা দিলেন। সেখান থেকে তারা অগ্রসর হলেন, গঙ্গা অতিক্রম করলেন, এরপর তাঁরা দণ্ডকারণ্যে পৌছলেন। সেখানে থাকে এক রাক্ষসী, তার নাম তারকা—গায়ে বহু হন্তীর বল। বিশ্বামিত্র রামকে বললেন দেরী না করে তারকাকে বধ করতে। কারণ এই রাক্ষসী সবসময় ঋষিদের যজ্ঞ পণ্ড করে দেয়। রাম তৎক্ষণাৎ ঋষির কথামত তার তীরধনুকের সাহায্যে সেই ভয়ংকর রাক্ষসী তারকাকে বধ করলেন।
তারপর তারা উপস্থিত হলেন সিদ্ধাশ্রমে—ঋষি বিশ্বামিত্রের আশ্রম। পরদিন প্রত্যুষে বিশ্বামিত্র অন্যান্য ঋষিদের নিয়ে তার যজ্ঞ আরম্ভ করলেন। রাম-লক্ষ্মণ পাহারায় রইলেন যাতে রাক্ষসেরা উপদ্রব করতে না পারে। ষষ্ঠ দিনে দেখা গেল—আকাশ ছেয়ে গেছে রাক্ষস সৈন্যে—তাদের পরিচালনা করছে দুই রাক্ষস মারীচ ও সুবাহু। এই দুই রাক্ষস যজ্ঞের পবিত্র আগুনে অপবিত্র মাংস ও রক্ত ছুঁড়ে দিতে উদ্যত হলে রাম ও লক্ষ্মণ তাদের বধ করার জন্য শক্তিশালী অস্ত্রসমূহ প্রয়োগ করলেন—সেই অস্ত্রে সুবাহু নিহত হ’লো আর মারীচ গিয়ে পড়লো শতযোজন দুরে।
এবার বিশ্বামিত্রের যজ্ঞ সুন্দরভাবে সম্পন্ন হ’লো—ঋষি রাজপুত্রদের আশীর্বাদ করলেন। পরদিন সকালে বিশ্বামিত্র তাদের জানালেন যে এবার তারা যাবেন। মিথিলায় রাজা জনকের রাজধানী। লক্ষ্মণ প্রতিবাদ করে বললেন যে তারা এসেছিলেন যজ্ঞ রক্ষা করতে—সে কাজ হয়ে গেছে—এবার তাদের উচিত অযোধ্যায় ফেরা। রাম কিন্তু লক্ষ্মণকে স্মরণ করিয়ে দিলেন যে পিতা তাদের এই মুনির আদেশ পালন করতে বলেছেন কাজেই বিশ্বামিত্রের কথামত চলাই এখন তাদের কর্তব্য।
সুতরাং ঋষি এবার রাম ও লক্ষ্মণকে নিয়ে মিথিলার উদ্দেশ্যে রওনা হলেন।