ধর্ম কি?

Print Friendly, PDF & Email
ধর্ম কি?

একজন তপস্বী বনে গিয়ে তপস্যা করতে শুরু করলেন। দীর্ঘদিন ধরে অতি কঠোর তপস্যায় তিনি নিজেকে নিযুক্ত করে রাখলেন। এমনিভাবে একদিন যখন একটি গাছের তলায় বসে তিনি ধ্যান করছেন, এমনি সময় একটি বক ওপর থেকে তার গায়ে ময়লা ফেলে দিল। তার সাধনায় এরকম বাধা পড়ায় সন্ন্যাসীর খুব রাগ হল। এই রাগ নিয়ে সে বকটির দিকে তাকাল এবং আশ্চর্য! তার তাকানোর সঙ্গে সঙ্গেই বকটি পুড়ে ছাই হয়ে গেল। সন্ন্যাসী একটু পরে বুঝতে পারল যে সাধনা করার ফলে তার মধ্যে শক্তি এসেছে এবং সেই শক্তিতেই তাকানোর ফলেই এই বকটি ভস্ম হয়ে গেল।

তোমৱা নিশ্চয়ই জানো যে সন্ন্যাসীরা ভিক্ষা করে যা পায় তাই দিয়ে তাদের ক্ষিদেতেষ্টা মেটায়। সেই সন্ন্যাসী সেজন্য ভিক্ষায় বেরিয়ে পড়লেন। বেরিয়ে গ্রামের একটি বাড়ীতে ভিক্ষা চাইতে গেছেন, ভেতর থেকে এক মহিলা উত্তর দিলেন, “বাবা, একটু দাঁড়াও, আমার হাতের কাজটি সেরেই যাচ্ছি। খুব মিষ্টি করেই ভদ্রমহিলা বললেন। কিন্তু এই নবীন সন্ন্যাসী ভাবলেন, “আমাকে অপেক্ষা করাচ্ছে।” এমন সময় সেই মিষ্টি গলাটি ভেতর থেকে ভেসে এল, “বাবা আমি বক নই, আমার ওপর রাগ কোরোনা, ওতে কোনো কাজ হবে না।” সন্ন্যাসী অবাক হয়ে গেল। “এ মেয়েটি কি করে জানল যে আমি বকটিকে ভস্ম করেছি।”

A sanyasi talking to the common woman

একটু পরে মেয়েটি ভিক্ষা দিতে এলেন। সন্ন্যাসী জিজ্ঞাসা করলেন, “মা, তুমি কি করে জানলে ঐ বকের কথা। আমি তো কাউকে বলিনি। তুমি নিশ্চয়ই খুব সাধন ভজন করো।” ভদ্রমহিলা উত্তর দিলেন, “বাবা, আমি কোনোদিন যোগ, জপ, তপস্যা—কিছুই করিনি এবং জানিও না এগুলি কি। তবে হ্যা, আমি রুগ্ন স্বামীর সেবা করি, সংসারের যাবতীয় কাজকর্ম করি। এই কর্তব্য পালনই আমার ধর্ম। এই ধর্ম আমি আমার দেহ, মন, প্রাণ দিয়ে পালন করবার চেষ্টা করি। তবে আমিতো লেখাপড়া জানিনা, মুখ্যুসুখ্যু লোক, এর বেশী তোমায় কিছু বলতে পারব না। তুমি যদি এরচেয়ে বেশী কিছু জানতে চাও তো বারাণসীতে ব্যাধের কাছে যাও।” সন্ন্যাসীর প্রথমেই মনে হল এক ব্যাধ সে আমায় কি শেখাবে? কিন্তু এই ভদ্রমহিলার ওপর তার দারুণ শ্রদ্ধা হয়ে গিয়েছিল। ঘুরতে ঘুরতে সে বারাণসীতে ব্যাধের কাছে পৌঁছল। সেখানে গিয়ে দেখল ব্যাধ মাংস বিক্রি করছে।

দেখে তার বিরক্ত লাগল। ভাবল এর কাছে সে কি শিখবে? কিন্তু ব্যাধ তাকে দেখেই বল “বাবা, তুমি গ্রামের ঐ মেয়েটির কাছ থেকে এসেছ। একটু বসো; আমি এই যাচ্ছি। তারপর তোমার সাথে কথা বলব।”

এবারও সেই সন্ন্যাসী চমকাল। ভাবল, “এ কি করে জানল আমাকে ঐ ভদ্রমহিলা পাঠিয়েছে।”

যা হোক একসময়ে ব্যাধের কাজ শেষ হল। সে বলল, “চলো বাবা, আমরা এবার ঘরে যাই। বাড়ী গিয়ে হাত পা ধুলো। তারপর মা বাবার খাওয়ার ব্যবস্থা করল, তাদের সেবা করল, তাদের একটু আরামের ব্যবস্থা করল। এরপর সন্ন্যাসীর কাছে বসল।” সন্ন্যাসী বলল, “তোমার এই অদ্ভুত ক্ষমতা কি করে হ’ল যে জানতে পারলে আমাকে ঐ ভদ্রমহিলা পাঠিয়েছে। নিশ্চয়ই তুমি কিছু তপস্যা করেছ।”

Sanyasi meeting the butcher

ব্যাধ বলল, “বাবা, আমি জীবনে কোনো ধর্মগ্রন্থ পড়িনি, তপস্যাও করিনি, আমি বেদ, উপনিষদও কিছুই জানিনা। তবে আমি সন্তান হিসাবে বাবা, মার ওপর আমার যা কর্তব্য তা আমি দেহ, মন, প্রাণ দিয়ে করবার চেষ্টা করেছি। আমি মাংস বিক্রি করি বেশী রোজগারের আশায় নয়, যাতে বাবা মাকে সেবা শুশ্রূষা করতে পারি, পেট ভরে খেতে পারি। আমি এই ব্যবসা করি নিরাসক্ত ভাবে। কালকে যদি এই ব্যবসা বন্ধ হয়ে যায়, আমার কোনো আপত্তি নেই। আমার কিছু এসে যাবে না। তা তুমি আমার কাছে কি জানতে চাও বলো। আমি কিন্তু তোমাকে এর থেকে বেশী কিছু বলতে পারবনা। শুধু তোমাকে এটুকুই বলতে পারব যে আমি সংসারে কাজ করেছি নিরাসক্তভাবে, দেবতাজ্ঞানে বাবা মাকে সেবা করেছি এবং যে কাজই করেছি তা আমি দেহ, মন, প্রাণ দিয়ে নিষ্ঠাভাবে করেছি। ফাঁকি দিইনি।”

তোমরা গীতার কথা শুনেছ। মহাভারতে এই গল্পটি বলা আছে এবং এই গল্পটিকে ‘ব্যাধগীতা’ বলা হয়। স্বামী বিবেকানন্দ বলেছেন “এটিই হচ্ছে চূড়ান্ত বেদান্ত। বেদান্তের চরম উৎকর্ষ। অর্থাৎ সংসারে নিজের কর্তব্যই হচ্ছে ধর্ম এবং এই ধর্মকে নিষ্ঠাভরে, দেহ, মন, প্রাণ দিয়ে পালন করার থেকে আর বড় কিছু সাধনা নেই।”

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।