যোগক্ষেমং বহাম্যহম্

Print Friendly, PDF & Email
যোগক্ষেমং বহাম্যহম্

এক পণ্ডিত তিনি গীতার ব্যাখ্যায় পারদর্শী, দেশবিদেশে ঘুরে গীতার ব্যাখ্যা করতেন। তিনি খুব গরীব ছিলেন। শেষ পর্যন্ত তিনি এক রাজসভায় এসে রাজাকে গীতার ব্যাখ্যা শোনাবেন বললেন।

গীতার নবম অধ্যায়ের ২২ নং শ্লোক –

অনন্যাশ্চিন্তয়ন্তো মাং যে জনাঃ পর্যুপাসতে।

তেষাং নিত্যাভিযুক্তানাং যোগক্ষেমং বহাম্যহম।।

King questioning the pandit.

তিনি এই শ্লোকটি রাজাকে ব্যাখ্যা করতে লাগলেন। রাজা মন দিয়ে শুনলেন। শোনার পর বললেন, “পণ্ডিত মশাই। আপনার ব্যাখ্যাটা বোধ হয় ঠিক হল না।” তখন এই পণ্ডিত মশাই আবার এই শ্লোকটিকে বিস্তারিত ব্যাখ্যা করতে লাগলেন। রাজা মশাই আবার বললেন, “আমি কিন্তু ঠিক বুঝতে পারলাম না।” পণ্ডিত মশাই আবার আরও বিস্তারিত ব্যাখ্যা করলেন। রাজা মশাই বলেলন, পণ্ডিতমশাই, এ হল না। এ ঠিক বোঝা গেল না। আপনি আবার কালকে আমাকে এটাকে ভাল করে বোঝাবেন।”

এরকমভাবে দু, তিন দিন ধরে পণ্ডিত মশাই যতই বিস্তারিতভাবে বোঝান, রাজামশাই ততই বলেন, “এখনও এর মানে ঠিক পরিষ্কার হল না”। এরকম ক’দিন করার পণ্ডিত মশাই হতাশ হয়ে বাড়ী ফিরে এলেন। নিজের গীতাটি রেখে দিয়ে পন্ডিত মশাই হতাশ হয়ে খাটে শুয়ে ভাবছেন, “এই অহংকারী, মূর্খ রাজা, তার পয়সা আছে, তাই আমার পাণ্ডিত্য বুঝতে পারছে না। কিন্তু যেহেতু সে রাজা, তাই আমাকে বলে দিচ্ছে যে আমি নাকি ঠিকমত ব্যাখ্যা করতে পারছি না। তার মানে আমিই যেন ঠিকমত বুঝতে পারিনি”।

তার স্ত্রী তাকে এরকম শুয়ে পড়তে দেখে তার কাছে এলেন। বললেন, ‘কী হয়েছে?” পণ্ডিতমশাই উত্তেজিত হয়ে বললেন, “ঐ ব্যাটা রাজা, সে আমার ব্যাখ্যার খুঁত ধরছে। বলছে আমি নাকি তাকে গীতা বোঝাতে পারছি না। আমি “অনন্যাশ্চিন্তয়ন্তো মাং যে জনাঃ … এই শ্লোকটি কতরকম ভাবে বোঝাতে চেষ্টা করলাম কিন্তু তিনি বলছেন আমি বোঝাতে পারছি না।” তার স্ত্রী একমনে সবটা শুনলেন। শুনে বললেন, “আপনি রাগ করবেন না। রাজা মশাই ঠিক বলেছেন।”

Wife advising the pandit

পণ্ডিত বললেন, “কী! ঠিক বলেছেন?” স্ত্রী বললেন যে, “হ্যাঁ, তিনি ঠিকই বলেছেন। আপনি বোধ হয় এর পুরো মানেটা বোঝেন নি।”

পণ্ডিত রেগে বললেন, “কী! তুমি এক মুখ্যু মেয়ে মানুষ, ঘরের ভেতর পড়ে থাকো? লেখাপড়া নেই, কিছু নেই, তুমি কিনা আমার দোষ ধরছ। তুমি বলছ, আমি পারি নি।”

স্ত্রী বললেন, “আমি লেখাপড়া করিনি, আমি কিছু জানিও না, আমি আপনার পাণ্ডিত্যের বিচারও করছি না। কিন্তু প্রভু, একটু বিচার করে দেখুন, বোধ হয় এর সব মানেটা আপনি চিন্তা করেন নি।” পণ্ডিত মশাই আরও উত্তেজিত হয়ে গেলেন।

“আমি এর মানে বুঝিনি! এই তো……..“অনন্যাশ্চিন্তয়ন্তো মাং যে জনাঃ পর্যুপাসতে… “…….বলছেন আর নিজের মনে ভাবছেন অন্য সমস্ত চিন্তা ছেড়ে দিয়ে যে আমার আরাধনা করে, “তেষাং নিত্যাভিযুক্তানাং যোগক্ষেমং বহাম্যহম্” যে লোক নিরন্তর আমার চিন্তা করে তার সব ভার আমি বহন করি”। এর তো খুব পরিষ্কার। এর মানের মধ্যে অস্বচ্ছতা কোথায়? আমি এতভাবে করলাম, “যে নিত্য আমার সাথে যুক্ত থাকে, তার সব ভার আমি বহন থাকি”। পণ্ডিত মশাই ভাবতে ভাবতে বললেন, “আরে! এই শ্লোকটিতে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলছেন, “যে অন্য সমস্ত চিন্তা বাদ দিয়ে আমার চিন্তা করে ভার সব ভার আমিই বহন করি।” তাইতো! যখন ভগবান শ্রীকৃষ্ণ এই আশ্বাস দিচ্ছেন, তাহলে আমি কেন রাজা মশায়ের কাছে গিয়েছিলাম? ঠিক, ঠিক, রাজামশাই ঠিক বলেছেন। আমার স্ত্রী ঠিক বলেছে।”

তিনি ডাকলেন স্ত্রীকে। বললেন, “হ্যাঁ, তুমি ঠিকই বলেছ। আমি সত্যিই এর মানে বুঝতে পারিনি।” বলে পরম নিশ্চিন্তে এক গ্লাস জল খেয়ে নিজের বিছানায় শুয়ে পড়লেন।

তারপরের দিন তিনি আর রাজসভায় গেলেন না। রাজা দূত পাঠালেন। দূত এসে বলল, “পণ্ডিত মশাই, আজ আপনি গেলেন না?” পণ্ডিত মশাই বললেন, “না, যাইনি। তুমি রাজা মশাইকে বোলো আমার আর রাজা মশায়ের কাছে যাওয়ার দরকার নেই। শ্রীকৃষ্ণই আমার সব ভার বহন করবেন।”

দূত ফিরে গিয়ে রাজাকে একথা জানালেন। রাজামশাই তখন রাজপ্রাসাদ থেকে পালকী ছেড়ে খালি পায়ে হেঁটে পণ্ডিত মশায়ের কাছে এসে প্রণাম করলেন। পণ্ডিত মশাইও রাজাকে প্রতি নমস্কার করে বললেন, “মহারাজ, আপনারই কল্যাণে আমি এর প্রকৃত অর্থ বুঝতে পেরেছি। আমি দেশ বিদেশে ঘুরে অন্যকে গীতার মানে ব্যাখ্যা করে শুনিয়েছি, শুধু নিজে বুঝতে পারিনি। নিজের জীবনে এটা প্রয়োগ করিনি। তাই আমার গীতার শিক্ষা অসম্পূর্ণ থেকে গিয়েছিল। আপনিই আমায় শেখালেন।”

Maharaja falling at pandits feet

সত্যিই তাই। গীতায় ভগবান যা বলেছেন, তিনি এই শ্লোকে বলেছেন, “যে অন্য কোনো চিন্তা না করে কেবলমাত্র আমার চিন্তা করে, আমি তার সব ভার বহন করে থাকি”। এর শুধু পুঁথিগত মানে জানলেই হবে না। এই শ্লোকটি শুধু মুখস্থ করলেই হবে না, এ কথাটাকে বিশ্বাস করতে হবে, এ কথাটা সত্যি কিনা জীবনে প্রয়োগ করে দেখতে হবে। ভগবানের ওপর সব কিছু ছেড়ে দিলে তিনি সে ভার বহন করেন কিনা তা অনুভব করতে হবে। সেইজন্য ভারতীয় শাস্ত্রকে বলা হয় ‘অনুভবি বিদ্যা।’ যেটা অনুভব করনি, সেটা অন্যকে বলবে না। এগুলি জীবনে প্রয়োগ করবার জন্যে, শুধু সাজিয়ে রাখার জন্য নয়।

প্রসঙ্গত বলে দেওয়া ভাল। সাই বাবা এই শ্লোকটির আর একটি মানে দিয়েছেন। যেটি এর আসল মানে। বলেছেন, “অনন্যা পর্যুপাসতে এর মানে অন্য কিছু চিন্তা না করে আমার চিন্তা করা নয়, এর মানে হচ্ছে যে, অন্য কিছু দেখতে না পাওয়া। সবের মধ্যেই যে ভগবান আছেন, তা দেখ করে এই দৃষ্টি লাভ করা। যখন সবের মধ্যে ঈশ্বর দর্শন হয়, তখন তিনি আপনা হতেই তার ভার বহন করেন।

প্রশ্নঃ
  1. কোন গ্রন্থে এই শ্লোকটি আছে?
  2. এই শ্লোকের অর্থ কি?
  3. রাজা কেন পন্ডিতের ব্যাখ্যায় সন্তুষ্ট হচ্ছিলেন না?
  4. শেষ পর্য্যন্ত রাজা কিভাবে সন্তুষ্ট হলেন?

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।