জরথুশ্‌ত্র ধর্ম

Print Friendly, PDF & Email
জরথুশ্‌ত্র ধর্ম

জরথুশ্‌ত্রীয় ধর্মের প্রবর্তক ছিলেন পার্শী নবী বা মহাপুরুষ জরথুশত্র অথবা জরশতার যিনি ছিলেন প্রায় ৮৫০০ বছর আগে।

ধরিত্রী মাতার (Geusurra) প্রার্থনায় সাড়া দিয়ে তাকে দুষ্ট শক্তির হাত থেকে রক্ষা করার জন্য প্রায় ৬৪০০ খ্রীস্টপূর্বে জরথুশ্‌ত্র জন্মগ্রহণ করেন। ২০ বছর বয়সে তিনি নির্জন জীবনকে বেছে নেন এবং দশ বছর গভীর তপস‍্যায় মগ্ন থাকেন। এই তপস্যা শেষে আহুর মজদার (পরম চৈতন্য )সাথে তার দিব‍্য সংযোগ স্থাপিত হয়। এই দিব‍্য সংযোগের মাঝেই তিনি গাথার প্রকাশ দেখতে পান, ঠিক যেমন আর্য‌ ঋষিদের দিব‍্য অভিজ্ঞতা বা দিব‍্য সংযোগ কালে তাদের কাছে বেদ প্রকাশিত হয়।

তিনি জনগণকে সেই দৈব জ্ঞানই শিক্ষা দিতে শুরু করলেন যে জ্ঞান তার মাঝে প্রকাশিত হয়েছে এবং এই ধর্ম জরথুশ্‌ত্র ধর্ম নামে পরিচিত।

হিন্দু ধর্মের মত জরথুশত্র ধর্মেও সূর্য উপাসনা এবং হোম ও যাগযজ্ঞ সম্পাদনের ওপরই বেশি জোর দিয়েছে। এই ধর্ম বিশ্বাস করে ঈশ্বর এক- তিনি জ্ঞানী আহুর মজদা, সৃষ্টা ও বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের পালন কর্তা, চিরন্তন ধর্ম ও সত‍্য রূপে যিনি মানুষের হৃদয়ে অধিষ্ঠান করেন। পৃথিবীর সব অশুভ শক্তি ও মিথ্যেকে ধংস করার জন্য প্রভু তার শক্তি ব‍্যবহার করেন। শুভচিন্তা, শুভবাক‍্য, শুভকর্ম- হুতম,হুখত, হবর্শত, এই প্রধান শিক্ষাগুলির ওপর ভিত্তি করেই গঠিত হয়েছে জরথুশ্‌ত্র ধর্ম। এই ধর্ম পাঁচটি নৈতিক উৎকর্ষতা বা সদগুণের ওপর জোর দিয়েছে, সেগুলি হল- ভালত্ব বা সদাশয়তা, ঐক‍্য, শান্তি, দানশীলতা ও পবিত্রতা।

পবিত্র আগুন ঈশ্বরের সুন্দর শরীরের প্রতীক। শারীরিক আগুন অন্তরাত্মার আগুনের বাহ‍্যিক প্রকাশ। ঈশ্বর যেমন নিরাকার, আগুনও তাই। জরথুশ্‌ত্রীয়রা প্রকৃতির পবিত্রতায় বিশ্বাস করে।

তারা বিশ্বাস করে যে প্রকৃতি হল ঈশ্বরের এক বিশাল পোশাক। পৃথিবী বা মৃত্তিকা,বায়ু, আলো এবং জল হল চারটি পবিত্র উপাদান। সেই কারণে মনুষ্য জাতির এমন কিছুই করা উচিত নয় যা প্রকৃতির পবিত্রতাকে অপবিত্র করে। তাদের এই বিশ্বাসের দ্বারা তাদের মৃতদেহ সৎকারের সিদ্ধান্তও প্রভাবিত হয়। তারা বিশ্বাস করে যে মাটিতে মৃতদেহ কবর দিলে তা ভূমি দূষণ ঘটায় এবং দাহ আগুনকে অপবিত্র করে। এই কারণে মৃতদেহকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় রৌদ্র স্নাত গগনচুম্বী নিস্তব্ধ মিনারে (tower), শিকারি পাখিদের ক্ষুধা নিবৃত্তির গ্রাস হিসেবে।

জরথুশত্র সাতটি পর্যায়ের নির্দেশ দিয়েছেন যাদের বলা হয় আমেশ স্পেনতস (এগুলো মানুষের অনুসরণের জন্য)। দৈব শক্তি নিঃসৃত পর্যায়গুলি হল-

  1. আহুর মজদাতে বিশ্বাস, অর্থাৎ ঈশ্বর ভক্তি।
  2. নিস্পাপ প্রেমপূর্ণ হৃদয় গড়ে তোলার অনুশীলন বা বেহমান।
  3. বেহমান ভালো ও মন্দকে পৃথকীকরণ করার মত বিচারবুদ্ধি আয়ত্ত করতে মানুষকে সমর্থ করে তোলে এবং তাকে ‘আশা’ র(ভালো কথা ও ভালো কাজে) প্রতি পরিচালিত করে।
  4. ভক্তি ধার্মিকতা ও দানশীলতার মানুষ একটি ভালো সমাজ গড়ে তুলতে পারে।
  5. ভালো চিন্তা, ভালো কথা ও ভালো কাজ মানুষকে দিব‍্য শক্তিতে অলংকৃত করে; অর্থাৎ রাজার মত শাসন করার ক্ষমতায় (দৃঢ় ইচ্ছাশক্তি)ভূষিত করে, যা হ’ল ‘শহরেবর’।
  6. উপরিউক্ত চারটি পর্যায় একজন মানুষকে পরিপূর্ণতা, শান্তি ও সমমনোভাবাপন্ন মনোভাবের (সুখে দুঃখে সমমনোভাবাপন্ন)প্রতি পরিচালিত করে যা হ’ল খোরদাদ।
  7. এই সব কিছুই আমেরেতাত (অমরত্ব) এর উদ্দেশ্যে পথ তৈরি করে দেয়, অর্থাৎ অমরত্ব যা হল মানব আত্মার চূড়ান্ত সুখ বা মোক্ষ।
সদরা ও কশ্‌তী

প্রত‍্যেক পার্শী জোরাষ্ট্রিয়ান সদরা অর্থাৎ ‘পবিত্র পোষাক’ এবং ‘কোমর বন্ধ’ হিসেবে কশ্‌তী অর্থাৎ ‘পবিত্র বন্ধনী’ পরিধান করে। ৭ থেকে ১১বছর বয়সের মধ্যে শৈশবাস্থায় এই দুটি বস্তু হিন্দুদের উপনয়নের মত‌ই পুরোহিত কর্তৃক ন‌ওজোত অনুষ্ঠানের মাধ্যমে ধারনের জন্য দেওয়া হয়। সদরা হল একটি পোশাক যা পবিত্রতা ও পরিচ্ছন্নতার প্রতীক। সদরা মনে করিয়ে দেয় যে প্রতিদিনের সাধিত সকল কর্ম‌ই শেষ বিচারের জন্য লিপিবদ্ধ হচ্ছে। কশতী হল মেষের লোম দিয়ে তৈরি মেখলা জাতীয় পোশাক যা ও আহুর মজাদার সাথে পরিধানকারীকে এক বন্ধনে আবদ্ধ করে। এটি উলে বোনা পোশাক। সদরা ও কশতী পার্শী জোরাষ্ট্রিয়ানদের ধর্মীয় বা আনুষ্ঠানিক পোশাক।

জোরাষ্ট্রিয়ান ধর্মগ্রন্থ

এই ধর্মের পবিত্র ধর্মগ্রন্থগুলি লেখা হয়েছে আবেস্তাতে পাজন্দ ভাষায়। আরব বিজয়ীরা যখন পারস্য আক্রমণ করে, তখন তারা অত‍্যাচারীত নিপীড়িত হয়ে স্বদেশ ছেড়ে পালিয়ে যায়। তারা জলপথে ভারতের গুজরাট প্রদেশের উপকূলে দিউতে অবতরণ করে, সাথে নিয়ে আসে পারস্যের মন্দির থেকে পবিত্র আগুন। দিউ থেকে তারা গুজরাটের সানজান শহরে যায় যেখানে স্থানীয় হিন্দু শাসক তাদের জমি মঞ্জুর করেন ও আশ্রয় দেন এবং তারা এক নতুন জীবন শুরু করে। তারা স্বাধীন ভাবে তাদের ধর্মাচারণের অনুমতি পায় এবং সেখানে তারা তাদের প্রথম পবিত্র সূর্য মন্দির স্থাপন করে। যে ধর্ম তারা অবলম্বন করে তা নির্দিষ্ট করার জন্য তাদের বলা হয় পার্শী।

পরিশেষে বলা যায়, যদিও সংখ্যাগত ভাবে তারা ভারতের খুব‌ই ক্ষুদ্র সম্প্রদায়, তারা এতদিন ধরে যে তাদের অস্তিত্ব রক্ষা করতে পেরেছে তা শুধু তাদের ধর্মের প্রতি অবিচল বিশ্বাস ও বংশগত ও ধর্মগত অবিমিশ্রতা এবং পবিত্রতা দৃঢ়তার সাথে পালন করার জন্য।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।