ঘটনা যা বলে দেয় বাবাই স্বয়ং প্রভু গণেশ
স্বামী অমৃতানন্দ বাবার কাছে এসেছিলেন তার গুরু থিরুভান্নামালাই নিবাসী শ্রী রমন মহর্ষির তিরধানের পর। যখন অমৃতানন্দ প্রথম প্রশান্তি নিলয়ম এসেছিলেন , বাবা তাকে সম্বোধন করেছিলেন ‘ অমৃত’ বলে। অমৃতানন্দ সত্যি সত্যিই আশ্চর্যান্বিত হয়েছিলেন এই বহু
পরিচিত আন্তরিকতা ও স্নেহে সম্পৃক্ত সম্বোধনে। তিনি বলেছিলেন, শুধুমাত্র রমন মহর্ষি, যার সাথে আমি সতেরো বছর কাটিয়েছি, ঠিক এই ভাবে আমায় সম্বোধন করতেন। তার কণ্ঠস্বর ও আচরণ একদম মহর্ষির কণ্ঠস্বরের ও আচরণের মত। পরে বাবা পঁচাশি বছর বয়স্ক অমৃতানন্দকে গণপতি হোম, প্রভু শ্রী গণেশকে নিবেদিত একটি যজ্ঞের কথা জিজ্ঞাসা করেছিলেন যা তিনি সাত বছর বয়সে একচল্লিশ দিন ধরে সম্পাদন করেছিলেন।
প্রতি বার আগুনে কি আহুতি দেওয়া হয়েছিল, কোন দীর্ঘ মন্ত্র স্তবগান করা হয়েছিলো ইত্যাদি সমেত যজ্ঞের বিশদ বিবরণ ভগবান বাবা স্বামী অমৃতানন্দকে দিলেন। সেই মন্ত্র বাবার দ্বারা প্রকাশিত হল, যার শুরু ‘ওম শ্রীম হ্রীম ক্লীম গ্লোউম গম’ দিয়ে। বাবা তাকে বললেন যে একচল্লিশ দিন ধরে দিনে হাজার বার তিনি এই মন্ত্র উচ্চারণ করেছিলেন এবং প্রচুর নারকেল পবিত্র যজ্ঞ বেদীর হোমানলে অর্পণ করেছিলেন। বাবা সেই বৃদ্ধ তপস্বীকে জিজ্ঞাসা করলেন, “কিন্তু সেই ধর্মগ্রন্থে কোন পুরস্কারের প্রতিশ্রুতি ছিলো?” তিনি উত্তর দিয়েছিলেন যে যদি সব আচার বিধি মেনে সতর্কতা নিষ্ঠা ও শ্রদ্ধার সঙ্গে যজ্ঞ সম্পাদন করা যায়, তবে স্বয়ং প্রভু গণেশ, সোনালী বর্ণ বিশিষ্ট অত্যুৎজ্জ্বল দীপ্তিময় হস্তি মস্তকধারণকারী ঈশ্বর, হোমাগ্নি কুন্ড থেকে আবির্ভূত হন। তিনি যজ্ঞের শেষ দান শুঁড় দিয়ে গ্রহণ করেন এবং স্বয়ং দর্শন দিয়ে অপরিসীম ঐশ্বরিক আনন্দ প্রদান করেন। বাবা তাকে জিজ্ঞেস করলেন তিনি সেই দিব্যদর্শন প্রাপ্ত হয়েছেন কিনা। স্বামী অমৃতানন্দ উত্তরে বললেন যে সাত বছর বয়সী একটি ছেলের পক্ষে শুধু মাত্র সংখ্যার হিসেবে নৈবেদ্য বা দান নিবেদন করে ও মন্ত্র উচ্চারণ করে দিব্যদর্শন লাভ করা সহজ সাধ্য ছিল না। বাবা তাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, “না না, সেই সব মন্ত্র উচ্চারণ ও নিবেদনের ফল স্বরূপ আপনি আমার কাছে এসেছেন। আটাত্তর বছর পর আজ আপনি সেই পুরস্কার পাবেন যার উল্লেখ সেই ধর্মগ্রন্থে ছিল।
তিনি স্বামী অমৃতানন্দকে তার দিকে তাকাতে বললেন, এবং অমৃতানন্দ যখনই তাকালেন তিনি দেখলেন তার সম্মুখে হস্তিমস্তক বিশিষ্ট সোনার গনেশ, গণেশের ঠিক যে রূপ প্রাচীন পুঁথিতে বর্ণিত আছে। এই দর্শন লাভ করে তিনি অসীম সুখ ও দিব্যানন্দে অভিভূত হয়ে পড়েন এবং এই দিব্য সুখানুভূতিতে বিভোর হয়ে চারদিন খাদ্য পানীয় ও ঘুম পরিত্যাগ করেছিলেন।
গণেশ তত্ত্বের তাৎপর্য
প্রেমস্বরূপগন! যিনি ঈশ্বরের মাঝে তার অস্তিত্বকে খুঁজে পান বা চিনে নিতে পারেন, তিনি যথার্থ জ্ঞানী (ব্রহ্মজ্ঞানী)। সব ভারতীয় উৎসবই পবিত্র এবং গভীর আধ্যাত্মিক তাৎপর্যপূর্ণ । সেগুলি যান্ত্রিক আচার অনুষ্ঠান হিসেবে উদযাপনের জন্য নয়।
ভারতীয়রা বিঘ্নেশ্বরকে এই ভাবে অভিবাদন করে, “হে পার্বতীপুত্র! গণর প্রভু (গণপতি)।” কে এই পার্বতী? পার্বতী ও গণপতির মধ্যে কিসের সম্পর্ক? মানুষ কখনও এবিষয়ে প্রশ্ন করেনা। সাধারণত পার্বতী গণপতির মা হিসেবেই বিবেচিত ও পরিচিত এবং কেউ বুঝতে পারেনা এই দুজনের অন্তর্নিহিত ঐক্যের রহস্য।
পার্বতী ও গণপতিকে কোথায় দেখতে পাওয়া যায়? তারা কি বহির্জগতে বিরাজ করে না কি তারা প্রতিটি মানুষের অন্তরবাসী। সত্যিটা হল তারা দুজনেই সর্বব্যাপী, সর্বাত্মক এবং একাত্মাভবম (আধ্যাত্মিক ঐক্য) এর বার্তাই তারা প্রেরণ করেন।
গণপতি নামের অর্থ
গণপতি নামের অর্থ কি? গণরা কোথায় ? তাদের আকার কেমন? যখন তোমরা এই বিষয়টি অনুসন্ধান করবে তোমরা দেখতে পাবে যে জ্ঞনেন্দ্রিয় ও কর্মেন্দ্রিয় (উপলব্ধির পাঁচটি অঙ্গ ও কর্মের পাঁচটি অঙ্গ) হল গণ । মন হল এই দশটি ইন্দ্রিয়ের প্রভু। বুদ্ধি হল বিচার বিবেচনা মূলক দক্ষতা যা মনের অনেক উর্ধ্বে অবস্থান করে। দশটি ইন্দ্রিয়, মন এবং বুদ্ধি একসাথে মিলে যা তৈরি হয়েছে তাই হল গণ।
গণ এই শব্দের মধ্যে, গ বুদ্ধিকে নির্দেশ করে। ণ নির্দেশ করে বিজ্ঞান (উচ্চতর পর্যায়ের বিদ্যা বা জ্ঞান) গণপতি হলেন বুদ্ধি ও জ্ঞানের দেবতা। এ প্রশ্ন কেউ জিজ্ঞেস করতে পারে, “বুদ্ধি বা জ্ঞান কি বহির্জগতে বিরাজ করে নাকি তা মানুষের মধ্যে পাওয়া যায়?”
উত্তরটা হল এই যে বুদ্ধি ও জ্ঞানের প্রভু গণপতি প্রতিটি মানুষের মধ্যে বিরাজ করেন। বাইরের জগতে তাকে খোঁজার কোনো প্রয়োজন নেই। বুদ্ধি ও জ্ঞান রূপে গণপতি প্রতিটি মানুষের মধ্যে বাস করেন।
গণপতিকে বর্ণনা করা হয় “পার্বতী তনয়” রূপে। পার্বতী কে? পার্বতী পৃথিবীর প্রতীক। প্রত্যেকেই পৃথিবী মায়ের সন্তান। পার্বতী তনয় মনে হল গণেশ যিনি গণের প্রভু, তিনি পার্বতীর পুত্র, যে পার্বতী ঐশ্বরিক শক্তিকে চিহ্নিত করে। পার্বতী ও গণেশের স্নেহগাথা কোনো সম্প্রতিক উৎসের কথা ঋগ্বেদের বিভিন্ন স্থানে গণপতি প্রশংসিত ও বন্দিত হয়েছেন। এটা পরিস্কার ভাবে বলে দেয় প্রভু গণপতি বেদের মতই প্রাচীন। বেদ ও উপনিষদের বিভিন্ন স্থানে গণপতির উল্লেখ রয়েছে। মহা নারায়ণ উপনিষদে গণপতিকে সম্বোধন করে অনেক প্রার্থনা মন্ত্র রয়েছে। তৈত্তরীয় উপনিষদেও গণপতির অনেক প্রার্থনা রয়েছে। গণপতি গায়ত্রী মন্ত্রও এই উপনিষদে রয়েছে। গণপতি বিনায়ক খেতাবে ভূষিত কারণ তার এমন কোনো প্রভু নে যিনি তার ওপরে রয়েছেন। তিনি সর্বশক্তিমান ও স্বাধীন। বিনায়ক নীতি বা তত্ত্বের গূঢ় তাৎপর্য উপলব্ধি না করে, মানুষেরা কেবল মাত্র বাইরের আকৃতিটাই অবলোকন করে এবং পার্থিব পরিভাষায় পূজা নিবেদন করে।
বিদ্যা হল জীবনের পূর্ণ সচেতনতা
বিনায়ক যার কোনো প্রভু নেই তিনি কোন রূপে মানুষের মধ্যে বিরাজ করছেন ? তিনি সেখানে রয়েছেন আত্মা রূপে। এই আত্মার কোনো প্রভু নেই। মন হল ইন্দ্রিয়গুলির প্রভু । ইন্দ্র হলেন ইন্দ্রিয়গুলির প্রভু। মানুষ ইন্দ্রকে কল্পনা করে তার স্বর্গ রাজ্যের অধিশ্বর হিসেবে। কিন্তু মনের প্রভু হিসেবে তিনি প্রত্যেকের মধ্যে বিরাজ করছেন। বুদ্ধি যা মনের প্রভু, তা জ্ঞান বা চেতনার যথার্থ প্রতিমূর্তি। কি ধরনের সচেতনতাকে আমরা জ্ঞান বলতে পারি? সেটা হল অবিরাম সংহত সচেতনতা। এটা অপরিবর্তিত, এর বৃদ্ধিও নেই ক্ষয়ও নেই। একে বলা হয় বিজ্ঞান। দুর্ভাগ্য বশতঃ আজকাল বিজ্ঞানকে সায়েন্স এর সঙ্গে তুলনা করা হয়। সায়েন্স
বিজ্ঞান নয়। সায়েন্স হল বাহ্যিক বিষয় সংক্রান্ত বিদ্যা।
এর ভিত্তি হল প্রদর্শনযোগ্যতা বা প্রমাণ যোগ্যতা। আজকাল শিক্ষার্থীরা গণেশ পূজো করে কেতাবি বা শিক্ষাগত সাফল্যের জন্য এবং নিজেদের মেধাবী পন্ডিতে পরিণত করার জন্য।
ফলস্বরূপ , এই ধরনের অধ্যয়নের মধ্যে দিয়ে যা শেখা যায় তাকে শিক্ষা বলা যেতে পারে কিন্তু বিদ্যা (সত্যিকারের বিদ্যা বা জ্ঞান) বলা যেতে পারেনা। আধুনিক প্রথাগত শিক্ষার ক্ষেত্রে যদি বিদ্যা শব্দটি প্রয়োগ করা হয়, যে বিদ্যা শব্দটির একটা গভীর অন্তর্নিহিত তাৎপর্য রয়েছে, তবে ভাষার অপব্যবহার হবে। বিদ্যা হল সেই শক্তি সম্পর্কে সচেতনতা যা একজন মানুষের প্রতিটি কোষকে প্রাণবন্ত করে তোলে। এই সচেতনতার মধ্য দিয়ে মানুষ জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত প্রতিটি ঘটনার তাৎপর্য অনুধাবন করতে পারে। এই অর্থে বিদ্যা হল জীবনযাত্রার একটি পথ বা উপায়। তুমি যা কিছুই করো সেটাই বিদ্যার অংশ। এটা হল জীবনের পূর্ণ সচেতনতা। বিদদ্যা পরিপূর্ণ ভাবে সবকিছু অনুধাবন করতে পারে। এই ধরনের পরিপূর্ণ বিদ্যা বা জ্ঞান আহরণের জন্য বিনায়কের কাছে তোমাদের প্রার্থনা করা উচিৎ। শুধুমাত্র শিক্ষাগত বা কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি অধিগত করলেই বিদ্যা আয়ত্ত বা অর্জন করা সম্ভব নয়। একদম শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত কিভাবে অশুভ বা ভূতকে পরিত্যাগ করা উচিত তা জানাই হল বিদ্যা।
একজন মানুষের সম্পূর্ণ জীবনকে এক নিরবচ্ছিন্ন শিক্ষা পদ্ধতি হিসেবে গণ্য করা বা মান্যতা দেওয়া উচিত। একজন আদর্শ বা যথার্থ শিক্ষার্থী হল সেই যে এই মর্মে জ্ঞান অর্জন করে। একজন শিক্ষার্থীকে বলা হয় বিদ্যার্থী (বিদ্যা + আর্থি – জ্ঞান বা বিদ্যার অন্বেষণকারী)। যে বিদ্যা আমাদের অন্বেষণ করা উচিত তা কখনই পুঁথিগত বিদ্যা বাহ্য সংক্রান্ত পার্থিব জ্ঞান হবে না।
সেই জ্ঞান হবে আত্মজ্ঞান (আধ্যাত্মিক জ্ঞান) যা আমাদের অন্বেষণ করা উচিত। আত্মজ্ঞান হল শ্রেষ্ঠ জ্ঞান। গীতা ঘোষণা করেছে, “অধ্যাত্ম বিদ্যা বিদ্যায়ানাম” (সবরকম বিদ্যার মধ্যে আমি হলাম আত্ম বিদ্যা)। জীবনের সত্যিকারের উদ্দেশ্য হল এই জ্ঞান অর্জন করা। বিনায়ক হলেন এই বিদ্যার উপস্থাপক বা গুরু। সেই গুরু তোমাদের মধ্যেই রয়েছে। বিনায়ক নীতি প্রত্যেকের মধ্যেই রয়েছে।
বিনায়কের প্রতি নৈবেদ্য
হিন্দুদের মধ্যে এরকম প্রথা আছে যে যখন তারা গয়ায় যায়, তরকারি এবং ফলের মধ্যে যেটা তাদের সবচেয়ে প্রিয় ছিলো সেটা খাওয়া ত্যাগ করে। আধুনিক যুগে এই প্রথাটা এমন ভাবে বিকৃত হয়েছে যে যেই ফলটা এবং তরকারিটা তারা পছন্দ করেনা, সেটাই তারা ত্যাগ করে। এই প্রসঙ্গে পুরাণের একটি গল্প রয়েছে যা প্রকাশ করেছে কিভাবে গণেশ চতুর্থী চলাকালীন গণপতিকে তাজা সবুজ ঘাস নিবেদন করার প্রথা পালন করা হত।
গল্পে আছে, একদা পার্বতী ও পরমেশ্বর দাবা খেলছিলেন মধ্যস্থতাকারী হিসেবে নন্দিশ্বরকে (পরমেশ্বর বাহন, ষাঁড়) সাথে নিয়ে। যদিও পরমেশ্বর শিব খেলায় হেরেছিলেন, নন্দী তাকে বিজয়ী বলে ঘোষণা করলেন। এই অন্যায় সিদ্ধান্তে ভীষণ রেগে গিয়ে পার্বতী নন্দীকে অভিশাপ দিল যে সে দুরারোগ্য ব্যাধিতে কষ্ট পাবে। নন্দী পার্বতীর ক্ষমা প্রার্থনা করে তার সিদ্ধান্তের স্বপক্ষে এই ভাবে ব্যাখ্যা করে বললেন যে তিনি পরমেশ্বরের পক্ষে রায় দিয়েছেন কারণ পরমেশ্বর তার প্রভু এবং ভৃত্য হিসেবে তার কর্তব্য প্রভুর সেবা করা। তা শুনে পার্বতীর হৃদয় একটু কোমল হল এবং তিনি বললেন যে নন্দী অভিশাপ মুক্ত হবে যদি তার কাছে যা সবচেয়ে প্রিয় ও সুস্বাদু বস্তু তা সে পার্বতী পুত্র গণপতিকে নিবেদন করে। নন্দী এক মুহূর্ত চিন্তা করলেন এবং ঘোষণা করলেন যে ষাঁড় হিসেবে যা তার সবচেয়ে প্রিয় বস্তু তা হল তাজা সবুজ ঘাস। সে সেটাই গণপতিকে নিবেদন করবে। এভাবেই উৎসব চলাকালীন গণপতির নৈবেদ্যে তাজা সবুজ ঘাস দেবার প্রথার প্রচলন শুরু হয়েছিল।
যেসব জিনিস মানুষ অকেজো ও তুচ্ছ বলে মনে করে গণপতি সেইসব নৈবেদ্যও গ্রহণ করে। বিনায়কের আর একটি নাম অর্কদ্রোনাপ্রিয়( এমন একজন যে থাম্মি এবং জিল্লেদি ফুল ভালোবাসে যেসব ফুলের কোনো মূল্যই সাধারণ মানুষের কাছে নেই।) বিনায়কের প্রতি নিবেদিত অন্যান্য নৈবেদ্যর মধ্যে রয়েছে বিশেষ এক ধরনের ঘাস। এই প্রসঙ্গে একটি গল্প রয়েছে।
কেন ঈশ্বর ‘ভোলা শঙ্কর’ নামে পরিচিত
একসময় এক অসুর ছিলো যার নাম গজাসুর। তিনি প্রায়শ্চিত্তের জন্য শিবের তপস্যা করেছিলেন। ঈশ্বর তার তপস্যায় খুশি হলেন এবং তার ইচ্ছে অনুসারে তাকে বর দিতে চাইলেন। ঈশ্বর হলেন সেই দেবতা যিনি সহজেই প্রসন্ন হন। সেই কারণে তাকে ভোলা শঙ্কর বলা হয়। যখন তিনি কোনো ভক্তের ওপর সন্তুষ্ট হন, সেই ভক্ত যা চান তাই তিনি তাকে প্রদান করেন। কোনো কোনো সময় তিনি নিজেই অসুবিধাজনক পরিস্থিতিতে পরে যান, ঠিক যেমন ভষ্মাসুরের ক্ষেত্রে হয়েছিল, যে ভষ্মাসুরকে শিব বর দিয়েছিলো যে সে যার মাথায় হাত রাখবে সেই ভষ্ম হয়ে যাবে। বর পাওয়া মাত্র তৎক্ষণাৎ ভষ্মাসুর তার প্রাপ্ত ক্ষমতা পরীক্ষা করতে চেয়েছিলো শিবের মাথায় হাত রেখে।
শিব গজাসুরকে কি বর দিয়েছিলেন? সেই দৈত্য চেয়েছিলো যে তার শরীর থেকে অবিরাম যেন আগুন নিঃসৃত হয় যাতে কেউ তার কাছে আসতে সাহস না পায়। শিব তার প্রার্থনা মঞ্জুর করেছিলেন। গজাসুর শিবের তপস্যা করেই চললো এবং শিব প্রায়ই তার সামনেআবির্ভূত হত। একদিন শিব তাকে জিজ্ঞাসা করলো যে সে কি চায় । দৈত্যটি বললো, “আমি চাই তুমি আমার পেটের ভিতরে বাস করো।” শিব তার বর মকুব করলেন এবং দৈত্যের পেটের ভিতর নিজেকে স্থাপন করলেন। শিবের স্ত্রী পার্বতী সর্বত্র শিবকে খুঁজলেন কিন্তু কোথাও তাকে পেলেন না। অবশেষে, শেষ অবলম্বন, তাঁর ভাই ভগবান বিষ্ণুর কাছে তিনি গেলেন এবং তাকে আবেদন করলেন তার স্বামী কোথায় আছে তা সনাক্ত করতে। সর্বজ্ঞ ঈশ্বর তাকে আস্বস্ত করে বললেন, “প্রিয় বোন, তুমি চিন্তা করোনা। তোমার স্বামী হলেন ভোলা শঙ্কর। ফলাফল কি হবে না বিচার করেই তার ভক্তদের প্রার্থনা তিনি তৎক্ষণাৎ মঞ্জুর করেন।
আমি সন্দেহ করছি তিনি নিশ্চয়ই কোনো সমস্যায় পড়েছেন। কি হয়েছে আমি তা খুঁজে বার করবো।
কিভাবে বিনায়ক গজাসুরের মাথা পেয়েছিলেন
বিষ্ণু, যিনি এই মহাজাগতিক খেলার পরিচালক, একটা ছোট নাটকের উপস্থাপনা করলেন। তিনি নন্দীকে (শিবের ষাঁড়) একটি নৃত্যরত ষাঁড়ে পরিণত করলেন এবং তাকে গজাসুরের সামনে নিয়ে আসলেন, যখন তিনি নিজে নৃত্যরত ষাঁড়ের সাথে বংশীবাদকের ভান করে বাঁশি বাজালেন। ষাড়ের নৃত্য পরিবেশন পরিদর্শন করে গজাসুর ভাবাবেগে উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠলো। সে বাঁশিওয়ালাকে(বিষ্ণু) জিজ্ঞেস করলো যে সে কি চায়। উত্তরে বাঁশি ওয়ালা পাল্টা প্রশ্ন করলেন, “আমি যা চাইবো তা কি আপনি দিতে পারবেন?”
গজাসুর বললো, “তুমি আমায় কি ভেবেছো? তুমি যা চাইবে আমি তৎক্ষণাৎ তা তোমাকে দেবো ।” বাঁশিবাদক বললেন, “যদি তাই হয়, তবে শিব, যিনি এখন আপনার পেটে বাস করছেন, তাকে আপনার পেট থেকে মুক্তি দিন ।” গজাসুর বুঝতে পারলো যে এই বংশীবাদক স্বয়ং বিষ্ণু ছাড়া আর কেউ নন, কারণ একমাত্র বিষ্ণুই তার উদরে শিবের উপস্থিতির গোপন কথা জানেন। তিনি বিষ্ণুর পায়ে পতিত হলেন ও শিবকে মুক্তি দিলেন এবং বিষ্ণুর কাছে একটি বর প্রার্থনা করলেন। সে বললো, “আপনি আমাকে অনেক বর দিয়ে আশির্বাদ করেছেন । আপনার কাছে আমার শেষ অনুরোধ আমার মৃত্যুর পরে সবাই যেন আমার মস্তক পূজো করে আমার স্মৃতি সযত্নে লালন করে। পরবর্তী কালে শিব সেখানে তার ছেলেকে নিয়ে আসেন ও তার ধরে গজাননের মাথা স্থাপন করেন। সেই থেকে ভারতে এই ঐতিহ্য বজায় রয়েছে যে কোনো ধরনের পবিত্র অনুষ্ঠান শুরু হবে গণেশ পূজোর দিয়ে। শিব যে গজাসুরকে বর দিয়েছিলো এ তারই ফলাফল।
হস্তিমস্তক বিশিষ্ট দেবতাকে পূজো করার অন্তর্নিহিত তাৎপর্য কি?
হাতি হল শক্তি ও বিশালতার প্রতীক। যে কোনো পশুর চেয়ে হাতির পা বড়। গভীরতম জঙ্গলের মধ্য দিয়ে হাতি তার চলাচলের পথ তৈরি করে নিতে পারে। এভাবেই হাতি একজন কর্ণধার বা নেতা যে অন্যদের পথ দেখায়, তার গুণাগুণ সূচিত করে। হাতি অত্যন্ত বুদ্ধিমান । হাতি তার আনুগত্য বিশ্বস্ততা ও কৃতজ্ঞতার জন্য সুবিদিত। কোনো পরিস্থিতিতেই হাতি কখনও তার প্রভুকে ভুলে যায়না। এমনকি জীবনের শেষ মুহূর্তে যদি সে তার প্রভুর গলায় আওয়াজ শুনতে পায়, সে চোখ খুলবে ও তার প্রভুকে খুঁজবে। সে তার প্রভুর জন্য নিজের জীবন বিসর্জন দিতে পারে। এই সব শিক্ষা মানুষের হাতির কাছ থেকে গ্রহণ করা উচিত। কৃতজ্ঞতা হীন বুদ্ধি অর্থহীন । প্রতিটি মানুষের কৃতজ্ঞ থাকা উচিত তাদের কাছে যারা তাদের উপকার করেছে।
গণেশকে ভাপে সেদ্ধ খাবার নৈবেদ্য হিসেবে দেবার তাৎপর্য
গণেশ পূজার কিছু গভীর অন্তর্নিহিত রহস্য আছে যা আমাদের মনে রাখা উচিত। ভারতীয়রা কিছু বিশেষ খাদ্য নৈবেদ্য হিসেবে গণেশকে নিবেদন করে। এই খাবার গুলো সরাসরি স্টোভ বা ওভেনের আগুনের তাপের পরিবর্তে পুরোটাই ভাপে বা বাষ্পে রান্না করা হয়। চালের গুড়ো গুড় ও তিল একসাথে মেখে বল তৈরি করা হয় এবং এগুলো ভাপে সেদ্ধ করা হয়। আয়ুর্বেদে এই খাদ্যকে রোগ নিরাময়কারি বা আরোগ্যক্ষম হিসেবে উচ্চ মর্যাদা দেওয়া হয়েছে। খাবারের মধ্যে গুড় হল অনেক অসুখের নিরাময়কারি উপাদান। তিল ধমনী পরিস্কার করতে সাহায্য করে। এটা দৃষ্টিশক্তির উন্নতি ঘটায়। এই সবকিছুর অন্তর্নিহিত তাৎপর্য হল গণেশকে নিবেদন করা সব খাদ্যেই সাস্থ্য উন্নতির উপাদান রয়েছে। এটাও লক্ষ্য করার মত যে ভাপে সেদ্ধ খাদ্য সহজপাচ্য। সুপার স্পেশালিটি হস্পিটালে রোগীকে সার্জারির পরের দিন ভাপে সেদ্ধ ইডলি দেওয়া হয়। তেলের খাবার দেওয়া হয়না। তাদের ইডলি দেওয়া হয় কারণ তা সহজ পাচ্য।
সংক্ষেপে, বিনায়ক তত্ত্ব সাস্থ্য, সুখ, দিব্যানন্দ, জ্ঞান, সমৃদ্ধি এরকম আরও অনেক কিছুরই প্রতীক। দূর্ভাগ্যবশত এই সত্য বেশিরভাগ মানুষই বুঝতে পারে না। কিছু যান্ত্রিক উপাচার সর্বস্ব অদ্ভুত কিছু মাটির মূর্তি পূজো, যা পরিবেশ কে দূষিত করে, সেরকম পূজা সম্পাদন করেই তারা খুশি। ঈশ্বরকে এমন কিছু নিবেদন করতে হবে যা তাকে আনন্দ দেয়, খুশি করতে পারে। এটাই হল সেই ধরনের পুজো যা পার্বতীর উপদেশে নন্দীশ্বরকে সমৃদ্ধ করেছিলো। সে তাকে বলেছিলো, “আমার ছেলে গণেশকে এমন কিছু নিবেদন কর যা তাকে খুশি করে এবং যা তোমার সবচেয়ে প্রিয় ।” গণেশকে খুশি করতে পারে এরকম কিছু দ্রব্যসামগ্রী বা তার প্রিয় নৈবেদ্য উদযাপন করার জন্যই বিনায়ক উৎসব পরিকল্পিত হয়েছে।
ইঁদুর প্রতীকী
বিনায়ক সম্পর্কে আর একটি উল্লেখযোগ্য বিষয় হল তার বাহন, মূষিক। ইঁদুর কি বার্তা বহন করে? ইঁদুর হল অন্ধকারের প্রতীক এবং অন্ধকার হল অজ্ঞতার প্রতীক। ইঁদুর অন্ধকারে ঘুরে বেড়ায়। অজ্ঞানতার অন্ধকারের নিয়ন্ত্রক হিসেবে গণপতিকে শ্রদ্ধা করা হয়, পুজো করা হয়।
ইঁদুর তার তীব্র বাসনার (ঘ্রাণশক্তি) জন্য পরিচিত। একটা জিনিসের থেকে কিরকম গন্ধ নির্গত হচ্ছে তার ওপর নির্ভর করে সঠিক পথ ধরে সে জিনিসটার কাছে পৌঁছে যায়। মনুষ্যধর্মে বাসনার অন্তর্নিহিত তাৎপর্য হল সেই বাসনা পরম্পরা যা মানুষ তার পূর্ব
জন্মগুলি থেকে বহন করে আনে। এই বাসনাগুলি (জন্মসূত্রে পাওয়া প্রবণতা) মানুষের বর্তমান জন্মের কার্যকলাপ নিয়ন্ত্রিত বা পরিচালিত করে। এই বাসনা আকাঙ্ক্ষাকেও নির্দেশ করে। আকাঙ্ক্ষার এই প্রচ্ছন্ন তাৎপর্য অনুধাবন না করে, মানুষেরা কেবল অবাক হয় এই ভেবে যে কিভাবে বিশালাকার বিশিষ্ট বিনায়ক ইঁদুরের মত ক্ষুদ্র প্রাণীর পিঠে চড়ে যাতায়াত করতে পারেন।
একবার বিনায়ক ও তার ছোট ভাই সুব্রমণ্যমের মধ্যে প্রতিযোগিতা হয়েছিলো যে কে আগে পৃথিবী প্রদক্ষিণ করতে পারে । বিনায়ক অত্যন্ত বুদ্ধিমান এবং অনন্যসাধারন বিচারবুদ্ধির অধিকারী ছিলেন। সর্বোপরি, তিনি যেকোনো ধরনের স্বার্থচিন্তা থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত ছিলেন। এটা হল শ্রেষ্ঠ দৈব বা ঈশ্বরিক গুণ। ঈশ্বর যা করেন তাতে বিন্দুমাত্র স্বার্থ থাকে না। খুব অল্প সংখ্যক মানুষই ঈশ্বরের ভালোবাসার প্রকৃত স্বরূপ বুঝতে পারে। মানুষের একটা প্রবণতা হল নিজেদের ভালোবাসার সাথে ঈশ্বরের ভালোবাসার তুলনা করা। তারা অনুভব করতে পারে না যে তাদের ভালোবাসাটা মূলত তারা যা পছন্দ করে তার প্রতি আকর্ষণ অথবা যা তারা উপভোগ করতে অভ্যস্ত তার প্রতি আকর্ষণ । অন্যথায় যা তারা জন্মসূত্রে তাদের মধ্যে পায়নি কিন্তু সেসবের প্রতি বাসনাই মানুষকে উদ্বিগ্ন করে তোলে।
বিনায়ক নির্দেশ করে অজ্ঞানতার ওপর জ্ঞানের বিজয় ঘোষণা ও আকাঙ্ক্ষার ওপর অহংকারশুণ্যতার বিজয় ঘোষণা।
বিবেকানন্দের আবিষ্কার
বিবেকানন্দ এই সত্য আবিষ্কার করেছিলেন, একই পরিস্থিতিতে বিভিন্ন ব্যক্তির বিভিন্ন রকম প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে। একজন মদ্যপ মানুষকে রাস্তার পাশে পরে থাকতে দেখে দুজন চোর, যারা নিজেরাই মাতাল , মন্তব্য করলো যে লোকটি নিশ্চয়ই তাদের মতই চোর, সারা রাত চুরি অভিযান করে এখন মাতাল হয়ে পড়ে আছে। একজন মৃগী রোগী ভাবলো এ বোধহয় তার মতই মূর্ছা গেছে। একজন সাধু লোকটিকে অচেতন অবস্থায় দেখে ভাবলেন উনি হয়তো কোনো যোগী , নির্বিকল্প সমাধিতে (ধ্যানের চরম বা শ্রেষ্ঠ অনুভূতি) রয়েছেন এবং শ্রদ্ধা ভক্তির সাথে তার পা মর্দন করতে শুরু করলেন। এই ধরনের ভিন্ন ভিন্ন প্রতিক্রিয়া বলে দেয়
যে মানুষ সবকিছু বিচার করে তারা বাস্তবিক যেমন তার ভিত্তিতে নয়, কিন্তু তারা বিচার করে তাদের নিজেদের অনুভূতি ও অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে। বিবেকানন্দ তখন অনুভব করলেন যে স্বামী রামকৃষ্ণ দেবের আধ্যাত্মিক উচ্চতা সম্পর্কে তার সন্দেহ তার নিজেরই বিভ্রান্ত চিন্তা ভাবনার ফল এবং তার সাথে পরমহংসের গুণ ও বৈশিষ্ট্যর কোনোই সম্পর্ক নেই। তিনি অনুভব করেছিলেন রামকৃষ্ণের মধ্যে কোনোই কালিমা নেই, কালিমা বা ভ্রান্তি তার নিজের অনুভূতিতে। তিনি রামকৃষ্ণর কাছ থেকে চলে আসার জন্য অনুশোচনা করেছিলেন ও নিজের মায়ের কাছে তার ভীষণ ভুলের কথা স্বীকার করেছিলেন। তিনি তার মাকে অনুরোধ করেছিলেন তাকে রামকৃষ্ণের কাছে ফিরে যাবার অনুমতি দেবার জন্য । তার মা তাকে অনুমতি দিয়েছিলেন তার ইচ্ছে বা প্রবৃত্তি অনুসারে কাজ করার। বিবেকানন্দ অনুভব করেছিলেন যে মানুষের সেচ্ছাচারী চিন্তাভাবনা ঈশ্বর সম্পর্কে মানুষের মনে সন্দেহ ও বিভ্রান্তির সৃষ্টি করে। কলঙ্ক ত্রুটি অভাব বোধ, এই সবকিছুর অনেক উর্ধ্বে ঈশ্বর।এই কারণেই ঈশ্বর সত্য, পূর্ণ, নিখুঁত হিসেবে বর্ণিত হন, যিনি যে কোনো বৈশিষ্ট্য থেকে মুক্ত, নিরাকার ও নির্গুণ । গণপতিকে বর্ণনা করা হয় অপরামেয় (অলৌকিক সর্বোৎকৃষ্ট এবং সবকিছু বেষ্টন করে রয়েছেন যিনি) হিসেবে। সেই কারণে যে কোনো পদ্ধতিতেই তাকে পুজো করা যায়।
প্রার্থনা ও পরীক্ষা
চিট্টিবাবু, প্রথম দিকে, তার ভাষণে স্বামীকে আবেদন করেছিলেন তোমাদের সদগুণ, সৎ চিন্তা ও শক্তি দিতে যাতে তোমরা ভালো জীবন যাপন করতে পারো। তিনি স্বামীর করুণা পাবার জন্য এরকম বলেই চলেছিলেন কিন্তু স্বামীকে তিনি কি নিবেদন করছেন এ ব্যাপারে তিনি কিছুই বলেননি। তুমি যা চাও তাই দিতে ঈশ্বর সদা প্রস্তুত। কিন্তু তোমাকে অবশ্যই সেই দান গ্রহণের যোগ্য হতে হবে, একজন আমানতকারির মত হতে হবে যে টাকা তুলতে পারে কত টাকা সে জমা করেছে সেই অনুপাতে। কতটা একজন ঈশ্বরের কাছ থেকে গ্রহণ করতে পারবে সেক্ষেত্রেও এই একই নিয়ম প্রযোজ্য। এটা নির্ভর করে ঈশ্বরের কাছে তুমি কি পরিমান গচ্ছিত রেখেছো তার ওপর। তারপর তার প্রার্থনার চেক যথাযথ ভাবে সম্মানিত হবে।
তোমার প্রার্থনাকে ঈশ্বরের কাছে পৌঁছাবার উপযুক্ত করে তুলতে হলে তোমাকে তাতে বিশ্বাসের টিকিট আটকাতে হবে ও ভালোবাসা দিয়ে ঠিকানা লিখতে হবে। যদি তোমার বিশ্বাস ও ভালোবাসা থাকে, তোমার প্রার্থনা ঠিক ঈশ্বরের কাছে পৌঁছে যাবে কোনো দূরত্বের পরোয়া না করে।
তুমি অবশ্যই দেখবে যাতে ঈশ্বরের প্রতি তোমার ভালোবাসা পবিত্র ও বিশুদ্ধ হয় । ঈশ্বরের যে কোনো পরীক্ষার সম্মুখীন হবার জন্য তুমি অবশ্যই নিজেকে প্রস্তুত রাখবে ।তুমি যত তাড়াতাড়ি এই পরীক্ষাগুলি পার হয়ে যাবে, তত তাড়াতাড়ি ঈশ্বরের কাছে পৌঁছোবে।
এই পরীক্ষাগুলির মধ্য দিয়ে না গিয়ে বা এগুলোকে এড়িয়ে গিয়ে আধ্যাত্মিক অগ্রগতি সম্ভব নয়। ছাত্রদের মনে রাখা উচিত যে উঁচু ক্লাসে উঠতে গেলে তাদের নির্ধারিত পরীক্ষাগুলিতে পাশ করতেই হবে।
পৃথিবীর ক্ষণস্থায়ী বস্তুর প্রতি তুমি কতটা আসক্ত এবং ঈশ্বরের জন্য আকুলতা তোমার কতখানি, জীবনে এ পরীক্ষা তোমাকে দিতে হয়। যদি ঈশ্বরের প্রতি তোমার ভালোবাসা পার্থিব বিষয়ের প্রতি তোমার ভালোবাসার কণা মাত্র হয়, তবে তুমি কি করে আশা
করো যে ঈশ্বর তোমার ওপর করুণা বর্ষণ করবেন? (স্বামী জয়দেবের একটি গান গেয়েছিলেন যার মধ্য দিয়ে তিনি মানুষকে উপদেশ দিয়েছেন যে সময়টা তারা তাদের পরিবার ও সম্পত্তির জন্য খরচ করে , তার কণা মাত্র যেন ঈশ্বর চিন্তা ও তার ধ্যানে অতিবাহিত করে, যে ঈশ্বর তার মৃত্যুকালে তাকে উদ্ধার করার জন্য তার কাছে আসবেন।)
জীবন আরও কতই না পবিত্র হয়ে উঠতো যদি মানুষ ঘন্টার পর ঘন্টা যে পার্থিব বিষয় চিন্তা করে অপচয় করছে তার থেকে কিছু মুহুর্ত ঈশ্বর চিন্তায় অতিবাহিত করতো ! মানুষের উচিত এই সত্যের ওপর নিজেদের বিশ্বাস বাড়িয়ে তোলা। নিজেদের ওপর
তাদের যে বিশ্বাস আছে সেই বিশ্বাস ঈশ্বরের ওপর থাকা উচিত। এটাই হল মহত্বের লক্ষণ। যার নিজের ওপরই বিশ্বাস নেই সে কি করে ঈশ্বরের ওপর বিশ্বাস রাখবে ? ক্ষণস্থায়ী পরিবর্তনশীল বিষয় থেকে মনকে সরিয়ে এনে শাশ্বত চিরন্তন সত্যের ওপর স্থাপন কর।
বিশ্বাসের শক্তি
বিশ্বাসের শক্তির বিবরণ পাওয়া যায় যীশুখৃষ্টের জীবনের একটি ঘটনা থেকে। একদিন একটি অন্ধ লোক যীশুখ্রীষ্টের সামনে উপস্থিত হল ও তার কাছে প্রার্থনা করলো, “প্রভু, আমার দৃষ্টিশক্তি ফিরিয়ে দাও।” যীশু তাকে প্রশ্ন করলো।,” তুমি কি বিশ্বাস কর যে আমি
তোমার দৃষ্টিশক্তি ফিরিয়ে দিতে পারবো? “সে নির্দ্বিধায় উত্তর দিলো,” হ্যাঁ প্রভু। “যীশু বললেন ,” যদি তাই হয় তবে চোখ খোলো ও দেখো।” অন্ধ লোকটি চোখ খুললো ও দৃষ্টিশক্তি ফিরে পেলো। এরকম ভাবেই কিছু না কিছু পাবার জন্য স্বামীর কাছে প্রার্থনা করে। স্বামী বলেন, “তুমি কি বিশ্বাস করো তুমি যা চাও তা দেবার শক্তি আমার আছে? তোমার বিশ্বাসের ওপর নির্ভর করেই আমি সাড়া দিই।
এমনকি বিবেকানন্দের মত একজন মানুষও স্বামী রামকৃষ্ণ পরমহংসের সাধুতার ওপর সন্দেহ পোষণ করেছিলেন।সন্দেহপ্রবন টমাসেরা সবসময়ই রয়েছে। ঐশ্বর্য ও সম্পত্তির প্রতি রামকৃষ্ণদেবের বিরাগ পরীক্ষা করার জন্য একদিন বিবেকানন্দ তার বালিশের নিচে কিছু সোনার পয়সা রেখে দিলেন। যেই মূহুর্তে রামকৃষ্ণ বিছানায় শুলেন, তার মনে হল তিনি কাঁটার বিছানায় শুয়েছেন।
তৎক্ষণাৎ বিবেকানন্দ অনুভব করলেন যে তার সন্দেহ কতটা ভিত্তিহীন। তিনি অনুভব করলেন যে মহাত্মাদের উচ্চতায় পৌঁছাতে গেলে তার নিজের আত্মাকে উত্তোলিত করা ও উন্নীত করা উচিত । আজকালকার মানুষেরা হল সেই মানুষের মত যে মাটিতে দাঁড়িয়ে আকাশে উড়ন্ত প্লেনের পাইলটকে দেখতে চায়। পাইলটকে দেখার একমাত্র উপায় হল নিজে সেই প্লেনে আরোহণ করা।
ঈশ্বরকে অভিজ্ঞতায় পেতে গেলে ঈশ্বরের দর্শন লাভের আকুল আকাঙ্ক্ষা থাকতে হবে। আদর্শ ও দৈব আনন্দে পূর্ণ জীবন অতিবাহিত করার এটাই একমাত্র পথ।
এই কারণেই গণেশ পুজো করা উচিত কারণ গণেশ হল ইন্দ্রিয়গণের প্রভু এবং ইন্দ্রিয়ের ওপর প্রভুত্বের মধ্য দিয়েই মনকে ঈশ্বর পথে পরিচালিত করা যায়। তুমি যদি সমস্যা ও অসুবিধা মুক্ত সুখী জীবন অতিবাহিত করতে চাও তবে বিঘ্ন বিনাশক গণপতির কাছে প্রার্থনা করতে হবে। কোনো মন্দিরে যাবার প্রয়োজন নেই।বুদ্ধি ও জ্ঞান রূপে বিঘ্নেশ্বর তোমাদের সকলের মধ্যে বাস করেন।
যখন তুমি তোমার সহজাত বুদ্ধি ও জ্ঞানের সঠিক ব্যাবহার করতে পারো, তুমি জীবনে সফল হবে।
প্রকৃতি ও পুরুষের অপরিহার্য ও মোক্ষম মিলন মানুষকে অবশ্যই উপলব্ধি করতে হবে এবং সেই একাত্ম বোধের ওপর জীবনের ভিত স্থাপন করতে হবে।
মনুষ্যত্ব বা মানবতা হল শরীর ও চেতনার মিলন। আধ্যাত্মিকতার প্রথম পদক্ষেপ হিসাবে মানুষকে আত্মপীরণ ও গভীর
আত্মানুসন্ধানের সাধনায় নিজেকে নিযুক্ত করতে হবে। শুধু মাত্র তখনই সত্যকে উপলব্ধি করা যাবে। কেউ আত্ম সমীক্ষা বা আত্মপরীক্ষা করে না, যদিও প্রত্যেকে অন্যকে নিন্দা করতে সদা প্রস্তুত । শুধু মাত্র সেই ব্যক্তি যে তার ভুল ত্রুটি ও অক্ষমতার জন্য নিজেকে পরীক্ষা ও পীড়ন করতে প্রস্তুত, তারই যোগ্যতা রয়েছে অন্যদের বিচার করার।
কেন গণপতি উৎসব দশদিন ধরে অনুষ্ঠিত হয়
ছাত্রগণ! অনুভব করো তোমাদের প্রত্যেকের একটা বিবেক রয়েছে যে তোমাদের পথ নির্দেশক এবং চেতনা রয়েছে যা তোমাদের দিব্যত্বকে সূচিত করে, প্রকাশ করে। গণপতি যিনি ইন্দ্রিয়গুলি তত্বাবধান করেন ও পরিচালনা করেন , তারই উচিত তোমাদের প্রভু ও পথপ্রদর্শক হয়ে ইন্দ্রিয়গুলির ওপর প্রভুত্ব করার শক্তি অর্জনে তোমাদের সাহায্য করা । দশদিন ধরে গণপতি পূজো করার একটি অন্তর্নিহিত তাৎপর্য রয়েছে। পরিকল্পনাটা হল এই রকম যে এক একটি দিন এক একটি ইন্দ্রিয় সংযমের উদ্দেশ্যে উৎসর্গীকৃত হবে । ছাত্র ও ভক্তদের অনুভব করা উচিত যে ইন্দ্রিয় সংযম খুবই সহজ। যা খুব প্রয়োজন তা হল নেতিবাচক চিন্তা বা অনুভূতিকে কখনই মনে স্থান দেবে না কিন্তু ইতিবাচক মনভাবকে পোষণ করবে। উদাহরণ স্বরূপ, বুদ্ধ, দয়া ও প্রেমের সাথে দানব প্রকৃতির ব্যক্তির সম্মুখীন হয়ে তার হৃদয়ের রূপান্তর ঘটিয়েছেন। আজকাল অনেক ছাত্রছাত্রীই হতাশার শিকার এবং তাদের মন বিভ্রান্ত।
এসবের কারণ হল আত্মবিশ্বাসের অভাব ও মানসিক দূর্বলতা। যেখানে ঈশ্বরের প্রতি পূর্ণ বিশ্বাস রয়েছে সেখানে হতাশার কোনো স্থান নেই।
ছাত্রছাত্রীগণ ! বাহ্যিক সন্তুষ্টির জন্য বিনায়ক চতুর্থী উদযাপনের প্রয়োজন রয়েছে, কিন্তু এর চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ হল বিনায়ক পুজোর অন্তর্নিহিত তাৎপর্য উপলব্ধি করা যা মানুষের মনে এক চিরন্তন দিব্যানন্দ এনে দেয়। অচেতন মূর্তি সূক্ষ্ম আধ্যাত্মিক, পরমার্থিক সত্তার প্রতিনিধিত্ব করে। মূর্তি পূজোর মধ্য দিয়েই আমাদের উচিত সেই পরম সত্তাকে মননে ধ্যানে অনুভব করা। এটাই হল পদ্ধতি যার মাধ্যমে আত্মোপলব্ধি ঘটে।
উপলব্ধি কর ও কাজ করো এই মূলসূত্রকে মনে রেখে যে চলমান ঈশ্বর তোমার মধ্যে রয়েছেন। গণপতি হলেন সেই আদর্শ ব্যক্তির প্রতিনিধি যে ব্যক্তি বুদ্ধি ও জ্ঞান দ্বারা পরিচালিত হন। তুমি নিজেকে সেইসব কাজে নিযুক্ত কর যা ঈশ্বরকে খুশি করবে; যেমন- বাক সংযম, মিতাচার, খারাপ ইচ্ছা ,প্রবনতা, ঘৃনা ত্যাগ করা এবং সবরকম খারাপ চিন্তা বর্জন করা ও বাসনা সীমিত করা । আধ্যাত্মিক অনুশীলন ও সাধনার সাথে স্কুল কলেজের পঠনপাঠনের মেলবন্ধন ঘটিয়ে তোমাদের জীবনকে সার্থক করে তোল।
[দিব্যবাণী, সাইকুলবন্ত হল, ০৭. ১০. ১৯৯৭]
সূর্যালোকে ঈশ্বর উপেক্ষিত হয় । তাকে সবাই চায় যখন আলো থাকে না। ভক্তি অবশ্যই হবে স্থির ও সমৃদ্ধ , সময় কাল ও পরিস্থিতি দ্বারা অপ্রভাবিত।- বাবা