ওম নমো ভগবতে ভজন – কার্যক্রম
কার্যক্রম – রোল প্লে
গুরু মার্কন্ডেয়, প্রহ্লাদ, ধ্রুব ইত্যাদি গল্প বলতে পারেন। শিশুদের বলতে হবে সেগুলি রোল প্লে করে দেখাতে। শিশুরা নিজেরা সংলাপ লিখবে। তারা নিজেরাই চরিত্র, সাজসরঞ্জাম, সেট ইত্যাদি ঠিক করবে।
ভক্ত ধ্রুব:
রাজা উত্তানপাদ মনুর প্রথম পুত্র ছিলেন। তার দুই স্ত্রী ছিল, সুনীতি (নৈতিকতা পূর্ণ) এবং সুরুচি (সুতনু)। সুনীতির ছেলের নাম ধ্রুব এবং সুরুচির ছেলের নাম উত্তম।
একদিন উত্তম তার বাবার কোলে বসে খেলা করছিল। তাই দেখে ধ্রুব – এরও খুব ইচ্ছে হল বাবার কোলে ওঠার। কিন্তু হিংসা ও অহংকারে মত্ত সুরুচি উপহাস করে ধ্রুবকে বলল, ‘তুমি হতে পারো রাজার বড় ছেলে কিন্তু রাজার কোলে বসতে গেলে তোমাকে তপস্যা করে বর প্রাপ্ত হয়ে আমার পুত্র হয়ে জন্মাতে হবে।’ চোখ ভরা অশ্রু নিয়ে ধ্রুব তার বাবার দিকে তাকাল। রাজা উত্তানপাদ সুরুচিকে অসন্তুষ্ট করতে চান না বলে নীরব রইলেন। যদিও ধ্রুবর বয়স তখন মাত্র পাঁচ বৎসর তথাপি প্রকৃতিগত ভাবে সে ছিল অত্যন্ত সংবেদনশীল। সে দৌড়ে গেল তার মা সুনীতির কাছে। মহানুভব সুনীতি তখন অত্যন্ত স্নেহভরে বললেন, “দুঃখ পেয়োনা পুত্র, ঈশ্বর সর্বত্র রয়েছেন এবং তিনি সব দেখছেন। যে যার কর্ম অনুযায়ী ফল ভোগ করবে, তা সে ভাল বা মন্দ যাই ঘটুক। তাই তোমার উচিত তার প্রতি ক্রুদ্ধ না হয়ে বরং দয়াপরবশ হওয়া। তবে একটা খাঁটি কথা কিন্তু সে তোমায় বলেছে তা হল, সাধনার দ্বারা তুমি যদি নারায়ণের আশীর্বাদপ্রাপ্ত হতে পারো তাহলে সব কিছুই সম্ভব।” ধ্রুব তখন জানতে চায়, নারায়ণ কে? আর কোথায় বা তার দেখা পাওয়া যাবে? সুনীতি তখন তাকে বলে, “ঈশ্বরই কেবলমাত্র সকল দুঃখ কষ্ট দূর করে তাদের মনোবাঞ্ছা পূরণ করেন যারা সব কিছু ছেড়ে সেই ঈশ্বরের চরণে নিজেদের সমর্পণ করে। কিন্তু সহজে তাঁর দেখা পাওয়া যায়না। যোগীরা বছরের পর বছর কঠোর তপস্যা করে প্রগাঢ় ভক্তি দ্বারা নিজেদের অন্তরের অন্তঃস্হলে ঈশ্বরকে উপলব্ধি করেন।” একথা শুনে ধ্রুব আর সময় নষ্ট না করে অরণ্য অভিমুখে যাত্রা করল এবং সেখানে গিয়ে ঈশ্বরের দর্শন আকাঙ্খায় ক্রন্দন করতে লাগল। তার আকুল কান্না দেখে দেবর্ষি নারদের ইচ্ছে হল তার ভক্তির দৃঢ়তা পরীক্ষা করার। তিনি এসে ধ্রুবকে বললেন, “বাছা, ঈশ্বর অন্বেষণের পথ বড় কঠিন পথ। তুমি এখন বয়সে বড়ই ছোট। তুমি বাড়ি ফিরে যাও। সুযোগ্য জীবন কাটিয়ে, সমস্ত কর্তব্য – কর্ম সম্পাদন করে বৃদ্ধ বয়সে এসে ঈশ্বরের ধ্যানে মগ্ন হও।“ ধ্রুব তৎক্ষণাৎ করজোরে ভক্তিপূর্বক দেবর্ষিকে বলল, ‘আমি আমার মনকে প্রস্তুত করে নিয়েছি। ঈশ্বর উপলব্ধি ব্যতিত আমার আর কিছুই চাইবার নেই। আপনি দয়া করে আমায় পথ দেখান।‘ দেবর্ষি নারদ তখন এই এত ছোট একটি বালকের স্হির সংকল্প ও আকুতি দেখে অতীব খুশী হয়ে তাকে দ্বাদশাক্ষর মন্ত্র “ওঁ নমো ভগবতে বাসুদেবায়” প্রদান করলেন এবং নির্দেশ দিলেন মনকে অন্য সকল চিন্তা থেকে মুক্ত করে এই মন্ত্রের ওপর গভীর মনোনিবেশ করার জন্য। তবেই ঐ ধ্যানে মূর্ত হবেন ঈশ্বর। একথা শুনে যমুনা নদীর তীরে মধুবনে ধ্রুব শুরু করেন তার অমোঘ তপস্যা। ছয় মাস কঠিন তপস্যা ও অকৃত্রিম ভক্তি দেখে করুণাময় ঈশ্বর দর্শন দিলেন ভক্ত ধ্রুবকে। গড়ুর পাখিতে আরোহণ করে ঈশ্বর ধ্রুবর সামনে আবির্ভূত হলেন। ঈশ্বরের প্রভার ছটায় বিস্মিত বালক ধ্রুব সাষ্টাঙ্গে প্রভুকে প্রণাম নিবেদন করলেন। প্রভুর মুখমন্ডলে ফুটে উঠল স্মিত হাসি। তিনি আলতো করে বালক ধ্রুবর চিবুকে তাঁর শঙ্খটি স্পর্শ করলেন। এতে ধ্রুব এক স্বর্গীয় আনন্দ উপভোগ করে প্রভুর কাছে প্রার্থনা করল, সে যেন সদা সর্বদা ঈশ্বরের শ্রীচরণদুটি স্মরণে রেখে তাঁর দিব্য উপস্থিতির পরম আনন্দ লাভ করে যেতে পারে। ভক্তির এমন নিদর্শনে মুগ্ধ ঈশ্বর তখন বর প্রদান করেন যে, এই বালক ধ্রুব নক্ষত্র রূপে অমর হয়ে থাকবে এবং ভবিষ্যতে মনুষ্যজাতিকে সঠিক পথ-নির্দেশ করবে।
মার্কন্ডেয়র গল্প:
অনেক বছর আগে, ম্রুখন্ডু নামে এক ঋষি থাকতেন। তিনি তাঁর স্ত্রী মায়াবতীকে নিয়ে গভীর অরণ্যের ভিতর এক কুটিরে থাকতেন। তাঁরা তাঁদের মতো করে খুশি ছিলেন, কিন্তু তাঁদের সন্তানাদি ছিল না। ঋষি ভগবান শিবের কাছে প্রার্থনা করেন ও পূজা করেন কিন্তু কোন ফল হয়নি। তখন তিনি ঘর বাড়ি ছেড়ে হিমালয়ে চলে যান তপস্যা করতে। কয়েক বছর তপস্যা করেন। ভগবান শিব ওনার তপস্যায় সন্তুষ্ট হয়ে তার সামনে প্রকট হন। ভগবান ওনাকে জিজ্ঞেস করেন যে তিনি কি চান। ম্রুখন্ডু ভগবানের সামনে মাথা নত করে বললেন যে তার জীবন নিয়ে তিনি খুশি কিন্তু জীবন পরিপূর্ণ করতে তিনি একটি সন্তান চান। ভগবান শিব হাসলেন আর বললেন, ‘তুমি কি একটি এমন পুত্র চাও যে একশো বছর বাঁচবে কিন্তু বোধশক্তিহীন হবে?‘ ঋষি উত্তরে বললেন ‘হে প্রভু, আমাকে এমন একটি পুত্র দিন যে স্বল্পায়ু হলেও ভাল ও দয়ালু হবে।‘ ভগবান শিব ম্রুখন্ডুকে আশীর্বাদ করে অন্তর্ধান করলেন। কিছু দিন পর ঋষি দম্পতির একটি পুত্র সন্তান জন্মাল। তিনি তার নাম রাখলেন মার্কন্ডেয়। মার্কন্ডেয় একজন অসাধারণ সন্তান হয়ে উঠলেন । তিনি তার বন্ধুদের, মাতা পিতাকে ও ভগবানকে অসম্ভব ভালবাসতেন। যখন তাঁর প্রায় ষোল বছর বয়স, তিনি আবিষ্কার করেন যে তার মা সর্বদা কাঁদেন। পুত্র মাকে তার কষ্টের কারণ জিজ্ঞেস করেন। তিনি উত্তরে বলেন তাঁর কষ্টের কারণ এই যে, মাত্র ষোল বছরের আয়ু ভগবান শিব মার্কন্ডেয় কে দিয়েছেন। এই কথা শুনে মার্কন্ডেয় বাড়ি ছেড়ে চলে গেলেন ভগবান শিবের কাছে প্রার্থনা করতে। উনি শিবলিঙ্গ জড়িয়ে গভীর প্রার্থনায় মগ্ন হলেন। তার আয়ু প্রায় শেষ হয়ে আসায়, মৃত্যুর দেবতা, যমরাজ তাঁর দূত পাঠালেন মার্কন্ডেয় কে নিয়ে যেতে। তারা অনেক চেষ্টা করলেন কিন্তু তাঁকে শিবলিঙ্গ থেকে পৃথক করতে পারলেন না। যম নিজে এলেন, কিন্তু তিনিও ছোট্ট ভক্ত কে বাঁধতে সক্ষম হলেন না কারণ মার্কন্ডেয় শিবলিঙ্গ আঁকড়ে ধরে ছিলেন। যদি ফাঁস পরাতে হয় তাহলে যমরাজকে শিবলিঙ্গকেও বেষ্টিত করতে হবে। কোনকিছুই ভক্ত কে লিঙ্গ থেকে আলাদা করতে পারল না। ভগবান শিব আবির্ভূত হলেন এবং মার্কন্ডেয়ের গভীর ও অটল ভক্তিতে সন্তুষ্ট হয়ে তাকে অমরত্বের চিরঞ্জিবী আশীর্বাদ করলেন। মার্কন্ডেয় মৃত্যুঞ্জয় হলেন। তিনি তার ভক্তি ও ভালো জীবন যাপনের দ্বারা মৃত্যুকে জয় করলেন এবং অমর হয়ে গেলেন।
প্রহ্লাদ-চরিত্র:
হিরণ্যকশিপু দৈত্যদের রাজা ছিলেন। দেব ও দৈত্য উভয়েই এক পিতা হ’তে উৎপন্ন হলেও সর্বদাই পরস্পর যুদ্ধ করতেন। সচরাচর মানব-প্রদত্ত যজ্ঞভাগে অথবা পৃথিবীর শাসন ও পরিচালন – ব্যাপারে দৈত্যগণের অধিকার ছিল না। কিন্তু কখনও কখনও তাঁরা প্রবল হয়ে দেবগণকে স্বর্গ থেকে বিতাড়িত করে তাঁদের সিংহাসন অধিকার করতেন এবং কিছুকালের জন্য পৃথিবী শাসন করতেন। তখন দেবগণ সমগ্র জগতের প্রভু সর্বব্যাপী বিষ্ণুর কাছে প্রার্থনা করতেন, তিনিও তাঁদেরকে ঐ বিপদ থেকে উদ্ধার করতেন। দৈত্যগণ পরাস্ত ও বিতাড়িত হলে দেবগণ আবার স্বর্গরাজ্য অধিকার করতেন।
দৈত্যরাজ হিরণ্যকশিপু, এইভাবে তাহার জ্ঞাতি দেবগণকে জয় করে স্বর্গের সিংহাসনে আরোহণ করে ত্রিভুবন অর্থাৎ মানুষ ও অন্যান্য জীবজন্তুদের বাসস্থান মর্ত্যলোক, দেব ও দেবতুল্য ব্যক্তিগণের দ্বারা অধ্যুষিত স্বর্গলোক এবং দৈত্যদের বাসস্থান পাতাল শাসন করতে সমর্থ হয়েছিলেন। হিরণ্যকশিপু নিজেকেই সমগ্র জগতের অধীশ্বর বলে ঘোষণা করলেন। তিনি এও ঘোষণা করলেন যে, তিনি ছাড়া আর কোনো ঈশ্বর নেই, আর চারিদিকে আদেশ প্রচার করলেন যে, কোনও স্হানে কেউ যেন বিষ্ণুর উপাসনা না করে, এখন থেকে সমস্ত পূজা একমাত্র তাঁরই প্রাপ্য। হিরণ্যকশিপুর প্রহ্লাদ নামে এক পুত্র ছিলেন। তিনি শৈশব বেলা থেকেই স্বভাবতই ভগবান বিষ্ণুর প্রতি অনুরক্ত। অতি শৈশবেই প্রহ্লাদের বিষ্ণুভক্তির লক্ষণ দেখে তাঁর পিতা হিরণ্যকশিপু ভাবলেন, আমি সমগ্র জগৎ থেকে বিষ্ণুর উপাসনা যাতে উঠে যায় তার চেষ্টা করছি, কিন্তু আমার নিজের গৃহেই যদি সেই উপাসনা প্রবেশ করে, তবে তাতে সর্বনাশ, অতএব প্রথম থেকেই সাবধান হওয়া কর্তব্য । এই ভেবে তিনি তাঁর পুত্র প্রহ্লাদকে ষণ্ড ও অমর্ক নামে দুইজন কঠোরশাসনক্ষমতা সম্পন্ন শিক্ষকের হতে সমর্পণ করে তাঁদেরকে আদেশ দিলেন যে, প্রহ্লাদ যেন বিষ্ণুর নাম পর্যন্ত কখনও শুনতে না পায়। শিক্ষক দুজন সেই রাজপুত্রকে নিজের বাড়িতে নিয়ে গিয়ে তাঁর সমবয়স্ক অন্যান্য বালকদের সঙ্গে রেখে শিক্ষা দিতে লাগলেন। কিন্তু শিশু প্রহ্লাদ তাঁদের প্রদত্ত শিক্ষা গ্রহণে মনোযোগী না হয়ে সর্বদা অন্যান্য বালকদের বিষ্ণুর উপাসনাপ্রণালী শেখাতে নিযুক্ত থাকলেন। শিক্ষকগণ এই ব্যাপার জানতে পেরে খুব ভয় পেলেন। কারণ, তাঁরা প্রবলপ্রতাপ রাজা হিরণ্যকশিপুকে ভীষণ ভয় করেন; অতএব তাঁরা প্রহ্লাদকে এই শিক্ষা থেকে সরানোর জন্য যত দূর সাধ্য চেষ্টা করলেন। কিন্তু বিষ্ণু-উপাসনা ও সেই বিষয়ে উপদেশদান প্রহ্লাদের কাছে শ্বাস-প্রশ্বাসের মতো স্বাভাবিক হয়ে গিয়েছিল সুতরাং তিনি কিছুতেই তা ত্যাগ করতে পারলেন না। তাঁরা তখন নিজেদের দোষ খন্ডাবার জন্য রাজার কাছে গিয়ে এই ভয়ঙ্কর খবরটি দিলেন যে, তাঁর পুত্র যে কেবল নিজেই বিষ্ণুর উপাসনা করছে তা নয়, অন্যান্য বালকদেরকেও বিষ্ণুর উপাসনা শিক্ষা দিয়ে নষ্ট করে ফেলছে। রাজা ষণ্ড ও অমর্কের কাছে পুত্র সম্বন্ধে এই সকল কথা শুনে প্রচন্ড ক্রুদ্ধ হলেন এবং তাকে নিজের কাছে ডাকলেন। প্রথমতঃ তিনি প্রহ্লাদকে মিষ্টি কথায় বুঝিয়ে বিষ্ণুর উপাসনা করতে নিষেধ করলেন। তিনি বোঝাবার চেষ্টা করলেন, “আমি দৈত্যরাজ, আমিই এখন ত্রিভুবনের অধীশ্বর, অতএব আমিই একমাত্র উপাস্য”; কিন্তু এই উপদেশে কোনও ফল হল না। বালক বারবার বলতে লাগল, ‘সমগ্র জগতের অধীশ্বর সর্বব্যাপী বিষ্ণুই একমাত্র উপাস্য’; আপনার রাজ্যপ্রাপ্তিও বিষ্ণুর ইচ্ছাধীন; আর যতদিন বিষ্ণুর ইচ্ছা থাকবে, ততদিনই আপনার রাজত্ব। প্রহ্লাদের কথা শুনে হিরণ্যকশিপু ক্রোধে উন্মত্ত হয়ে তৎক্ষণাৎ পুত্রকে বধ করবার জন্য নিজের অনুচরদের আদেশ করলেন। আদেশ পেয়েই দৈত্যরা সুতীক্ষ্ণ অস্ত্র দিয়ে তাকে প্রহার করল, কিন্তু প্রহ্লাদের মন বিষ্ণুতে এতটাই নিবিষ্ট ছিল যে, অস্ত্রের আঘাতের বেদনা তিনি কিছুই অনুভব করতে পারলেন না। প্রহ্লাদের পিতা দৈত্যরাজ হিরণ্যকশিপু, যখন দেখলেন যে, অস্ত্রের আঘাতে প্রহ্লাদের কিছুই হল না, তখন তিনি ভয় পেলেন। কিন্তু আবার দৈত্যজনোচিত অসৎ প্রবৃত্তির বশীভূত হয়ে বালককে বিনাশ করবার নানারকম পৈশাচিক উপায় উদ্ভাবন করতে লাগলেন। তিনি প্রথমে তাকে হস্তিপদতলে ফেলে দিতে আদেশ করলেন। উদ্দেশ্য – হস্তী তাকে পদতলে পিষে বিনাশ করে ফেলবে। কিন্তু যেমন লৌহপিণ্ডকে পিষে ফেলা হস্তীর অসাধ্য, প্রহ্লাদের দেহও সেইরকম হস্তি – পদতলে পিষ্ট হলো না। সুতরাং প্রহ্লাদকে বিনাশ করার এই উপায় বিফল হল। পরে রাজা প্রহ্লাদকে এক উচ্চ গিরিশৃঙ্গ থেকে মাটিতে ফেলে দিতে আদেশ করলেন, তাঁর এই আদেশও যথাযথ পালন করা হল। কিন্তু প্রহ্লাদের হৃদয়ে বিষ্ণু বাস করতেন, সুতরাং পুষ্প যেমন ধীরে ধীরে তৃণের উপর পতিত হয়, প্রহ্লাদও সেই রকম অক্ষতদেহে ভূতলে পতিত হলেন। প্রহ্লাদকে বিনাশ করবার জন্য তারপর বিষপ্রয়োগ, অগ্নিসংযোগ, অনশনে রাখা, কূপে ফেলে দেওয়া প্রভৃতি নানা উপায় — একটির পর একটি অবলম্বন করা হলো; কিন্তু সব উপায়ই ব্যর্থ হল! প্রহ্লাদের হৃদয়ে বিষ্ণু বাস করতেন, সুতরাং কোন কিছুই তাঁর কোন অনিষ্ট করতে পারল না। অবশেষে রাজা আদেশ করলেন, পাতাল থেকে নাগদের আহবান করে সেই নাগপাশে প্রহ্লাদকে বদ্ধ করে সমুদ্রের নিচে ফেলে দেওয়া হোক এবং তার উপর বড় বড় পাহাড় স্তূপাকার করে দেওয়া হোক। এই অবস্থায় তাকে রাখা হোক, তাহলে এখনি না হোক কিছুদিন পরে সে মরে যাবে। কিন্তু পিতার আদেশে এই অবস্থায় পতিত হয়েও প্রহ্লাদ ‘হে বিষ্ণো, হে জগৎপতে, হে সৌন্দর্যনিধে’ ইত্যাদি বলে সম্বোধন করে তাঁর প্রিয়তম বিষ্ণুর স্তব করতে লাগলেন। এই ভাবে বিষ্ণুর চিন্তা ও তাঁর ধ্যান করতে করতে তিনি ক্রমে অনুভব করলেন, বিষ্ণু তাঁর অতি নিকটে রয়েছেন; আরও চিন্তা করতে করতে অনুভব করলেন, বিষ্ণু তাঁর অন্তর্যামী। অবশেষে তাঁর অনুভব হল যে, তিনিই বিষ্ণু, তিনিই সকল বস্তু এবং তিনিই সর্বত্র। প্রহ্লাদের যেই এই রকম অনুভূতি হল, অমনি তাঁর নাগপাশ খুলে গেল, তাঁর উপর যে পর্বত রাশি চাপা দেওয়া হয়েছিল তা গুঁড়িয়ে গেল, তখন সমুদ্র স্ফীত হয়ে উঠল ও তিনি ধীরে ধীরে তরঙ্গরাজির উপর দিয়ে নিরাপদে সমুদ্রতীরে পৌঁছোলেন। তিনি যে একজন দৈত্য, তাঁর যে একটা মর্তদেহ আছে, প্রহ্লাদ তখন এ – কথা একেবারে ভুলে গিয়েছিলেন: তিনি উপলব্ধি করছিলেন যে, তিনি সমগ্র ব্ৰহ্মান্ডস্বরূপ – ব্রহ্মান্ডের সমস্ত শক্তি তাহা থেকেই নির্গত হয়েছে। জগতে এমন কিছু নেই — যা তাঁর কোনও অনিষ্ট করতে পারে। তিনিই সমগ্র জগতের – সমগ্র প্রকৃতির শক্তি স্বরূপ। এই উপলব্ধি – বলে প্রহ্লাদ সমাধি অবস্হায় অবিচ্ছিন্ন পরমানন্দে নিমগ্ন রইলেন। বহুকাল পরে তাঁর দেহ জ্ঞান ধীরে ধীরে ফিরে এল, তিনি নিজেকে প্রহ্লাদ বলে বুঝতে পারলেন। দেহ সম্বন্ধে আবার সচেতন হয়েই তিনি দেখতে লাগলেন, ভগবান অন্তরে বাইরে সর্বত্র রয়েছেন। তখন জগতের সকল বস্তুই তাঁর বিষ্ণু বলে মনে হতে লাগল। যখন দৈত্যরাজ হিরণ্যকশিপু দেখলেন যে, তাঁর শত্রু ভগবান বিষ্ণুর পরমভক্ত নিজের পুত্র প্রহ্লাদের বিনাশের সকল উপায়ই বিফল হল, তখন তিনি অত্যন্ত ভীত ও কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়লেন। তখন দৈত্যরাজ আবার পুত্রকে নিজের কাছে এনে নানাভাবে মিষ্টি কথা বলে তাকে আবার বোঝাবার চেষ্টা করলেন। কিন্তু প্রহ্লাদ আগে যেভাবে তাঁর পিতার কাছে উত্তর দিতেন, এখন সেই একই উত্তর তাঁর মুখ দিয়ে বের হল। হিরণ্যকশিপু ভাবলেন, শিক্ষা ও বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এর এই সমস্ত শিশুজনোচিত এ – সব খেয়াল চলে যাবে। এই ভেবে তিনি পুনরায় প্রহ্লাদকে ষন্ড ও অমর্ককে দায়িত্ব দিলেন প্রহ্লাদকে রাজ – ধর্ম শিক্ষা দিতে। ষণ্ড এবং অমর্ক সেইমতো প্রহ্লাদকে রাজ – ধর্ম সম্বন্ধে উপদেশ দিতে লাগলেন, কিন্তু সেই উপদেশ প্রহ্লাদের ভাল লাগত না; তিনি সুযোগ পেলেই সহপাঠী বালকদের বিষ্ণুভক্তি শিক্ষা দিয়ে সময় কাটাতে লাগলেন। যখন হিরণ্যকশিপুর কাছে এই খবর পৌঁছলো যে, প্রহ্লাদ নিজের সহপাঠী দৈত্যবালকদেরও বিষ্ণুভক্তি শেখাচ্ছেন, তখন তিনি আবার ক্রোধে উন্মত্ত হয়ে উঠলেন এবং নিজের কাছে ডেকে এনে প্রহ্লাদকে মেরে ফেলবার ভয় দেখালেন এবং বিষ্ণুকে অকথ্য ভাষায় নিন্দা করতে লাগলেন। প্রহ্লাদ তখনও দঢ়তার সঙ্গে বলতে লাগলেন, “বিষ্ণু সমগ্র জগতের অধীশ্বর, তিনি অনাদি, অনন্ত, সর্বশক্তিমান ও সর্বব্যাপী এবং তিনিই একমাত্র উপাস্য।” এই কথা শুনে হিরণ্যকশিপু ক্রোধে তর্জন গর্জন করে বলতে লাগলেন, “রে দুষ্ট, যদি তোর বিষ্ণু, সর্বব্যাপী হন, তবে তিনি এই স্তম্ভে নেই কেন?” প্রহ্লাদ বিনীতভাবে বললেন, ‘হ্যাঁ অবশ্যই তিনি এই স্তম্ভে আছেন।’ তখন হিরণ্যকশিপু বললেন, ‘আচ্ছা, তাই যদি হয়, তবে আমি এই তোকে তরবারি দ্বারা আঘাত করছি, তোর বিষ্ণু তোকে রক্ষা করুক।’ এই বলে দৈত্যরাজ তরবারি হস্তে প্রহ্লাদের দিকে বেগে এগিয়ে গেলেন এবং স্তম্ভের উপর প্রচণ্ড আঘাত করলেন। তৎক্ষণাৎ সেখানে ভীষণ শব্দ করে নৃসিংহমূর্তি ধারণ করে স্তম্ভের ভিতর থেকে ভগবান বিষ্ণু বেরিয়ে এলেন। সহসা এই ভীষণ মূর্তি দেখে হতচকিত ও ভীত হয়ে দৈত্যরা এধার ওধার পালাতে লাগল। হিরণ্যকশিপু তাঁর সঙ্গে বহুক্ষণ প্রাণপণে যুদ্ধ করলেন। কিন্তু অবশেষে ভগবান নৃসিংহ তাকে পরাভূত ও নিহত করলেন। তখন স্বর্গ থেকে দেবগণ এসে বিষ্ণুর স্তব করতে লাগলেন। প্রহ্লাদও ভগবান নসিংহদেবের চরণে পড়ে পরম মনোহর স্তব করলেন। তখন ভগবান প্রসন্ন হয়ে প্রহ্লাদকে বললেন, “বৎস প্রহ্লাদ, তুমি আমার কাছে যা ইচ্ছে বর প্রার্থনা কর। তুমি আমার অত্যন্ত প্রিয়পাত্র। অতএব তোমার যা ইচ্ছা হয়, তাই আমার কাছে প্রার্থনা করো।” প্রহ্লাদ ভক্তিযুক্তস্বরে বললেন, ‘প্রভু আমি আপনাকে দর্শন করলাম, এছাড়া আমার আর কি প্রার্থনা থাকতে পারে? আপনি আর আমাকে ঐহিক বা পার্থিব কোনরকম ঐশ্বর্যের প্রলোভন দেখাবেন না।’ ভগবান পুনরায় বললেন, “প্রহ্লাদ, তোমার নিষ্কাম ভক্তি দেখে আমি খুব খুশি হলাম। তবুও আমার দর্শন বৃথা হয় না। অতএব আমার কাছে যে কোনও একটি বর প্রার্থনা কর।” তখন প্রহ্লাদ বললেন : ‘অজ্ঞানী ব্যক্তির ভাগ্যে বিষয়ে যেমন তীব্র আসক্তি থাকে, তোমাকে স্মরণ করবার সময় যেন সেইরূপ গভীর অনুরাগ আমার হৃদয়ে থাকে, হৃদয় থেকে তা যেন অপসৃত না হয়।’ তখন ভগবান বললেন, বৎস, প্রহ্লাদ, যদিও আমার পরম ভক্তগণ ইহলোক বা পরলোকের কোনরকম কাম্য বস্তু আকাঙ্ক্ষা করেন না, তবুও তুমি আমার আদেশে সর্বদা আমার মন রেখে কল্পান্ত পর্যন্ত পৃথিবী ভোগ কর ও পুণ্যকর্ম অনুষ্ঠান কর। যথাসময়ে কল্পান্তে দেহপাত হলে আমাকে লাভ করবে। এইভাবে প্রহ্লাদকে বর দিয়ে ভগবান বিষ্ণু অন্তর্হিত হলেন। তখন ব্রহ্মাপ্রমুখ দেবগণ প্রহ্লাদকে দৈত্যদের সিংহাসনে অভিষিক্ত করে স্ব-স্ব লোকে প্রস্থান করলেন।
[Reference : http://www.ramakrishnavivekananda.info/vivekananda/volume_4/lectures_and_discourses/the_story_of_prahlada.htm]