পূর্বং রাম শ্লোক – বিশদ পাঠ
রাম কথা
রামের কাহিনী, যা লক্ষাধিক বছর ধরে পবিত্র মাধুর্যের ধারার মতন নিরন্তর বয়ে চলেছে তা বহু বহু পুরুষ, নারী এবং শিশুদের, দুঃখের দিনে স্বান্তনা, দোলায়মান পরিস্থিতে শক্তি, সংশয়ের দিনে জ্ঞানের আলো, বিষাদকালে প্রেরণা এবং অনিশ্চয়তায় পথনির্দেশ দিয়ে চলেছে। এটি মানবকেন্দ্রিক সুগভীর নাট্যরচনা, যেখানে ঈশ্বর মানুষের মতন আচরণ করেছেন। বিশাল পৃথিবীর এই রঙ্গমঞ্চে তিনি তাঁর চারিদিকে যাদের সমবেত করেছিলেন তারা কেউ ত্রূটিহীন, কেউ ত্রূটিযুক্ত, কেউ মানুষ, এবং কেউ তার চেয়ে অধম প্রাণী, পশু ও অসুরদল। তাদের দেখে এবং তাদের উদাহরণক্রমে আমরা যাতে পরম জ্ঞান লাভ করতে পারি, সেটাই রামের অভীষ্ট ছিল। এই কাহিনী তার কোমল আঙুলগুলি দিয়ে মানুষের হৃদয় তন্ত্রীতে ঘা দেয়। জেগে ওঠে কারুণ্য, সমব্যাথা, উল্লাস, ভক্তি উন্মাদনা এবং শরণাগতি। মানুষের মধ্যে রূপান্তর হতে শুরু করে। পশু ও মানুষ থেকে আমরা আমাদের দিব্য স্বরূপে ফিরে যাই।
মানবজাতির ইতিহাসে আর কোনো কাহিনী, মানুষের মনে এমন সুগভীর প্রভাব ফেলতে পারেনি। রামায়ণের কাহিনী ইতিহাসের মাইলফলক ও ভূগোলের পরিসীমাকে অতিক্রম করেছে। প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে এটি মানুষের অভ্যাস ও দৃষ্টিভঙ্গীকে গড়েছে পরিশুদ্ধ করেছে। সমগ্র বিশ্বে, মানবজাতির শোণিতধারায় এ যেন একটি আরোগ্যকারী কণিকা হয়ে বই চলেছে। মানুষগুলির বিবেকে তার শিকড় চলে গিয়েছে; তারা যাতে, সত্য ধৰ্ম, শান্তি ও প্রেমের পথে চলে, তার জন্য রামকথা তাদের উদ্বুদ্ধ করছে, পিছন থেকে সামনে এগিয়ে দিচ্ছে।
লোককথা, ঘুমপাড়ানী গান, অবিশ্বাস্য সব গল্প ও কাহিনী, নৃত্য ও নাটক, ভাস্কর্য, সঙ্গীত, চিত্রকলা, পূজাপাঠ, কাব্য এবং রূপকের মধ্য দিয়ে অগণিত তাপস ও সাধকের কাছে রাম নিশ্বসিতের ন্যায়। তিনি তাদের অন্তরের পরম শান্তি, পরম ঐশ্বর্য। তাঁরা মনে করেন, রামায়ণের চরিত্রগুলি কৃতিত্ব ও রোমাঞ্চকর দুঃসাহসের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন;যারা সৎপথে স্থির থাকতে পারেনা—-পাপ, হিংসা, অহমিকা এবং ক্ষুদ্রমানসিকতা থেকে দূরে সরে থাকার জন্য তাদের জন্য এই কাহিনীতে সাবধানবাণী উচ্চারিত হয়েছে। কাহিনীর চরিত্রগুলির বিশ্বাসভাজনতা ও কষ্টসহিষ্ণুতা বা দৃঢ় সংকল্প মানুষকে উৎসাহিত করে। মানুষের জিহ্ববা যে যে ভাষায় বা উপভাষায় শ্রেয়কে পাবার বাসনা প্রকাশ করেছে, তার প্রত্যেকটিকে রামায়ণ তার বিশিষ্ট মাধুর্য দিয়ে পুষ্ট করেছে।
সাইরাম তাঁর নিজস্ব সরল, মধুর ভঙ্গিতে রামের কথার পুনর্কথন করে নিজের পূর্ব দিব্য জীবনের কথা বলেছেন। পাঠকের মনে তার লেশটুকু থেকেই যায়। কত মহান সৌভাগ্যের ফলে এমন জিনিস আমরা হাতে পেয়েছি। এই অমৃতকথা আমাদের মনে ও হৃদয়ে মুদ্রিত হয়ে যাচ্ছে। এই বইটি পড়ে আমরা যেন কর্মক্ষম ও উৎসাহী করণ হয়ে তাঁর ব্রতকে সম্পূর্ণ করতে পারি। সেই ব্রত হলো মানবজাতিকে একই পরিবারে সংগঠিত করা। সেই পরিবারের সদস্য হয়ে আমরা প্রতীকে যেন উপলব্ধি করতে পারি যে,’সাইরাম’ ই হলেন সেই সত্য যা ‘এক’ ও যা ‘সৎ’
সাই খুঁজছেন। তিনি তাদের খুঁজছেন যারা পূর্ব, পূর্ব জন্মে তাঁর সাথী ছিল(তেলেগু ভাষায় bantu). বর্তমানে তাঁর ব্রতকে সফল করে তোলার জন্য তিনি তাদের পাশে চান। ধর্মের পুনরুদ্ধার করে তারাই মানুষকে শান্তির স্বর্গের পথ দেখাবে। প্রার্থনা করি যাতে আমরা প্রত্যেকে তাঁর কর্মকান্ডে অংশ নিতে পারি। আর তার পুরস্কার যেন হয় সেই স্বর্গের দর্শনলাভ।
[রামকথারসবাহিনীর জন্য শ্রী কস্তুরী লিখিত মুখবন্ধ থেকে সংগৃহীত]
দেখা যাক এই কাহিনীর আন্তর তাৎপর্য বা অর্থ কি –
শ্রী কস্তুরী – রামকথারসবাহিনী
প্রতিটি দেহে রাম বিরাজ করেন। তিনি আত্মারাম (আনন্দের উৎস) রূপে প্রতিটি জীবদেহে বর্তমান। সেই আন্তর ঝর্ণাধারা থেকে উৎসারিত তাঁর আশীর্বাদ আমাদের শান্তি ও আনন্দ দেয়। তিনি ধর্মের ও সকল নৈতিকতার মূর্ত বিগ্রহ, যা মানবজাতিকে প্রেম ও ঐক্যের বন্ধনে ধরে রাখে। রামায়ণ বা রামকথায় দুটি শিক্ষা দেওয়া হয়েছে: অনাসক্তির মূল্য এবং প্রতিটি জীবে ঈশ্বরের উপস্থিতি উপলব্ধি করা। ঈশ্বরে বিশ্বাস এবং বস্তুমুখিনতার প্রতি বৈরাগ্যই মানুষকে মোক্ষ এনে দিতে পারে। কাম বা কামনা ত্যাগ করলেই রামকে পাওয়া যায়। সীতা অযোধ্যার বিলাসিতা ত্যাগ করেছিলেন বলে তিনি বনবাসকালে রামের সঙ্গ লাভ করেছিলেন। কিন্তু তিনি যখন সোনার হরিণের প্রতি কামনাপূর্ণ দৃষ্টিপাত করলেন এবং সেটি পেতে চাইলেন, তখনই তিনি রামের সঙ্গ হারিয়ে ফেললেন। ত্যাগ আনন্দ দেয়, আসক্তি দুঃখ নিয়ে আসে। জাগাতে বাস করো কিন্তু জগতের হয়ে যেওনা।
শ্রী রামের প্রতিটি ভাই, বন্ধু, সখা, সহযোগী ধার্মিকতার উদাহরণস্বরূপ। দশরথ হলেন দশেন্দ্রিয়নির্ভর দেহ সর্বস্বতার প্রতীক। ত্রিগুণ — শান্তস্বভাব, কর্মব্যস্ততা ও অজ্ঞানতা (সত্ত্ব, রজঃ তমো), হলেন দশরথের তিন রানী। চারপুত্র হলেন চতুর্বগ — ধৰ্ম, অর্থ, কাম ও মোক্ষ। লক্ষণ হলেন বুদ্ধি; সুগ্রীব বিবেক; বালি হতাশা; হনুমান হলেন সাহসিকতার মূর্ত বিগ্রহ।
মোহসাগরের ওপর সেতু নির্মিত হল. তিন রক্ষ সেনাপতি, রাবণ (কর্ম), কুম্ভকর্ণ (অজ্ঞান), বিভীষণ (শুদ্ধতা) হলেন রজঃ, তমো ও সত্ত্ব গুণ। সীতা হলেন ব্রহ্মজ্ঞান, সর্বময় ঈশ্বরের চৈতন্য — যা মানুষকে জীবনের সকল অগ্নিপরীক্ষার মধ্যে অর্জন করতে হবে ও ধরে রাখতে হবে। রামায়ণের মাহাত্ম্য স্মরণ করে নিজেদের হৃদয়কে শুদ্ধ ও দৃঢ় করে তোলো। রামই হলেন তোমাদের অস্তিত্বের সত্যস্বরূপ।
[বাবা —-রামকথারসবাহিনী]
‘রাম’এই নাম হল বেদের সার; রামায়ণের কাহিনী হল দুধের সাগর, নির্মল ও নিরুপম। একথা জোর দিয়ে বলা যেতে পারে যে আজ অবধি এমন মহান ও সুন্দর কাব্য আর কোনো দেশে, কোনো ভাষায় রচিত হয়নি। কিন্তু সকল দেশের সকল ভাষার কবিদের রামায়ণ অনুপ্রাণিত করেছে। প্রতিটি ভারতীয়ের মহা সৌভাগ্য যে তারা এমন মহা ঐশ্বর্যের উত্তরাধিকার লাভ করেছে।
রামায়ণে যে নামের মাহাত্ম্য বর্ণনা করা হয়েছে, তা সকল মন্দকে শুদ্ধ করে। রামায়ণের কাহিনী পাপীর মধ্যে রূপান্তর ঘটায়। রামকথা শুনতে, শুনতে রামের রূপ ও যেন প্রত্যক্ষ হয়ে ওঠে। রামের সে রূপ রামের নামের মতোই মধুর। সমুদ্র যেমন পৃথিবীর সকল জলের উৎস, তেমনি রামের থেকেই সকল জীবের উৎপত্তি হয়ে থাকে। জলহীন সমুদ্র যেমন মিথ্যা, তেমনি রামহীন জীবের কোনো অস্তিত্ত্ব নেই, আর থাকবেনা। নীল সমুদ্র আর সর্বশক্তিমান ঈশ্বরের মধ্যে অনেক সাদৃশ্য।
রামকথার নদী এঁকেবেঁকে অনেক পথ অতিক্রম করে বয়ে চলে। কিন্তু করুণার মাধুর্য (পেলবতা, সমব্যাথা এবং দয়া) সমগ্র কাহিনী জুড়ে একই ভাবে উপস্থিত থেকে যায়,কোথাও তার অভাব থাকেনা। কাহিনী বয়ে চলে, পেরিয়ে যায় দুঃখ, বিস্ময়, পরিহাস, সম্ভ্রম, ভীতি, প্রেম, হতাশা এবং তর্ক; কিন্তু তারই মধ্যে জন্ম নেয় ধৰ্ম, নীতি ও করুণা এবং ফল্গুধারার মতন সমানে বয়ে চলে।
(পৃ ১ও ২–রামকথারসবাহিনী)