সততা ও তার পুরষ্কার
রামুকে গ্রামের সকলেই সৎ গোয়ালা বলে জানে। তার দুই ছেলে-সূর্য আর চন্দ্র। রামু তাদের বারবার বলতো, “দেখ, তোমরা কখনও কাউকে ঠকিও না। সৎ পরিশ্রমেই প্রকৃত শাস্তি ও সুখ আসে।”
একদিন, সূর্য গরু চরাতে মাঠে যায়নি বলে রামুর কাছে ভীষণভাবে বকুনি খেলো। সূর্য তাতে এতো ব্যথা পেলো যে, সে বাড়ী ছেড়ে চলে গেলো, ঠিক করে গেলো যে বড়ীতে আর কোনোদিন ফিরে আসবে না।
বৃদ্ধ রামুর সূর্যের কথা মনে হলেই চিন্তা হতো, শোকে দুঃখে মুহ্যমান হয়ে পড়তো। মারা যাবার কিছুদিন আগে রামু চন্দ্রকে ডেকে বললো, “দেখ বাবা, তোমার ভাই সূর্যকে খুঁজে বার করার যথাসাধ্য চেষ্টা করো। তার কপালে বড়, কালো কাটা দাগ আছে, তাই দেখে চিনতে পারবে। আমাদের যে দশটা মোষ আছে তার থেকে তার ভাগ হিসাবে পাঁচটা মোষ তাকে দিও। রামুর মৃত্যুর পর চন্দ্র কাছাকাছি গ্রামে মেলা বা হাট বসলেই গিয়ে দেখতো—যদি সূর্যকে সেখানে খুজে বার করা যায়। কিন্তু তার সমস্ত চেষ্টাই ব্যর্থ হলো।
একদিন চন্দ্র মোষদের মাঠে চরিয়ে বাড়ী ফিরে আসছে। পথে, গ্রামের মধ্যে এক গাছের নিচে একজন অচেনা লোককে বসে থাকতে দেখে সে এগিয়ে গেল আর অবাক হয়ে দেখলো যে তার কপালে একটা বড় কালো কাটা দাগ আছে। সে তার ভাইকে চিনতে পারে, কিন্তু তার পরনে ময়লা, ছেড়া টুকরো টুকরো কাপড় দেখে বুকটা ফেটে যেতে লাগলো। সে প্রায় কেঁদে ফেলে বললে, সূর্য ভাই, তুমি ছেঁড়া কাপড়চোপড় পরে, এই রকম দুর্দশায় দিন কাটাচ্ছো কেন? আমার সঙ্গে বাড়ী চল। বাবা যে দশটা মোষ রেখে গেছেন, তার থেকে পাঁচটা নাও, দুধ আর মাখন বিক্রী করে সুখে জীবন কাটাও।” সূর্য তার ভাইয়ের সঙ্গে বাড়ী গেল, কিন্তু সে সারাক্ষণ চুপ করে রইলো। খাওয়া-দাওয়া একসঙ্গে সেরে নিয়ে, চন্দ্র একটা বড় কার্পেট পেতে নিল, আর, তার উপরে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়লো।
পরদিন সকালে চন্দ্র ঘুম ভেঙে উঠে দেখে যে, সূর্য পাঁচটা মোষ নিয়ে চলে গেছে। তখন তার মনে একটা সন্দেহ উঁকি মারতে লাগলো, “সূর্য কেন মোষ গুলো নিয়ে পালিয়ে যাবে? কোন দুষ্টু লোক আমাকে ঠকিয়ে নিয়ে গেলো না তো? খানিকক্ষণ এইসব ভাবার পরে। সে নিজেকে সান্ত্বনা দিল, “আমার বাবা আমাকে যে ভাবে উপদেশ দিয়েছেন, আমি সেই ভাবেই কাজ করেছি, সৎ হয়ে থেকেছি; ঈশ্বর তার সাক্ষী আছেন। শুধু শুধু কেন আমি ভেবে মরছি?”।
এর কিছুদিন পরে, চন্দ্রের দরজার সামনে একটা সুন্দর গোরুরগাড়ী থামলো। চন্দ্র উকি দিয়ে দেখলো, একজন লোক তার দিকে এগিয়ে আসছে, তার কপালে বড় একটা কালো কাটা দাগ। কিন্তু এখন, তার পরনে ধোপদুরস্ত পোষাক, বেশ সম্ভ্রান্ত লোকের মতন চেহারা। সে চন্দ্রর কাছে এগিয়ে এসে বলল, “কি ভাই, আমাকে চিনতে পারছো না?” উত্তরে চন্দ্র খুব দুঃখিত ভাবে বললো, “ভাই, আমি তোমাকে চিনতে পেরেছি। কিন্তু, আমি একটা সাংঘাতিক ভুল করে ফেলেছি। ছ সপ্তাহ আগে, একজনকে তুমি ভেবে ভুল করে তোমার পাঁচটা মোষ দিয়ে দিয়েছি। কিন্তু তাই বলে, আমার বোকামির জন্যে তোমাকে কষ্টভোগ করতে দিতে চাই না। আমার যে পাঁচটা মোষ আছে তা আমি তোমাকে দিয়ে দেবো।”
ভাইকে জড়িয়ে ধরে সূর্য বললো, “চন্দ্র, তুমি কোন ভুল করনি। তোমার সততা যাচাই করে দেখার জন্য আমি নিজেই সেই সময়ে। দরিদ্র সেজে এসেছিলাম। সত্যিই, তুমি আমাদের প্রিয় ‘পিতাজী’ র মতনই সৎ হয়েছে। তারই আশীর্বাদ আমিও ফল আর তরিতরকারীর ব্যবসা ভালভাবে চালাতে পারছি। এতে আমি ধনীলোক হয়ে গেছি।
তোমাকে নিতে এসেছি, এখন আমার এই শহরে একটা বড় বাড়ী আছে। একটা ছোট ফলের বাগান আছে। আমি তোমাকে নিতে এসেছি। আমার সঙ্গে শহরে গিয়ে থাকবে। তোমার জন্য বাজারে একটা ঘর কিনে রেখেছি।সেখানে দোহশালা খুলে দুধ, মিষ্টি ইত্যাদি বিক্রী করতে পারবে। তখন দুই ভাই হাত ধরাধরি করে ভিতরে গেল, সেখানে তাদের বাবার ছোট একটা ছবির সামনে দাঁড়িয়ে বললো, “পিতাজী, আপনি আমাদের সৎ হতে শিখিয়েছিলেন। সত্যিই আমরা অত্যন্ত ভাগ্যবান যে, আপনার কাছ থেকে তা শিখতে পেরেছি। আজকে আমরা এই শান্তি আর আনন্দ পেয়েছি আমাদের সততার জন্য; যে কোন পরিমাণ ধন দিয়েও তা পাওয়া যায় না।”
প্রশ্নঃ:
- সৎ হওয়ার জন্য চন্দ্র কি পুরস্কার পেল?
- সৎ হওয়ার জন্য সূর্য কি পুরস্কার পেলো।
- দুই ভাই তাদের বাবার কাছে কি শিখেছিল? তার কাছে কেন তারা কৃতজ্ঞ ছিল?