কোন কিছুই অকাজের নয়
পুরাকালে ছেলেরা গুরুকুলে যেতো ও তাদের বিদ্যাশিক্ষার জন্য অনেক বছর ধরে গুরুর সঙ্গে বসবাস করতো। ছাত্রদের জ্ঞান আহরণের শেষে তারা গুরুর আশীর্বাদ নিয়ে বাড়ী ফিরে যেতো ও জীবনে প্রতিষ্ঠিত হতো। একবার, দুটি শিষ্য গুরুকুল ছেড়ে বাড়ী ফিরে যাবার সময়ে গুরুর কাছে গিয়ে বললো, “গুরুদেব, আমাদের গুরুদক্ষিণা হিসাবে আমরা আপনাকে কি দিতে পারি বলুন।” শিষ্যদের এই ভালবাসা ও কৃতজ্ঞতায় গুরু খুবই সন্তুষ্ট হলেন। তাদের ভক্তি, নিয়মানুবর্তিতা ও কর্তব্যপরায়ণতার জন্য তিনি নিজেও শিষ্যদের ভালবাসতেন। এর বেশী কিছুই তিনি আশা করেননি । যাই হোক, তিনি শিষ্যদের জ্ঞান আরো বাড়ানোর কথা ভেবে তাদের বললেন, “দেখ বাছারা, আমাদের গুরুকুলের পিছনে যে বন আছে সেখানে গিয়ে এমন কতকগুলো শুকনো পাতা নিয়ে এসে যা কারো কাজে লাগবে না।
গুরুর এই অদ্ভুত দক্ষিণার কথা শুনে শিষ্যেরা অবাক হয়ে গেল। কিন্তু তার কথা মেনে নিয়ে তারা বনের দিকে গেল। বনে ঢুকেই তারা এক গাছের নীচে গিয়ে দেখলো যে সেখানে কিছু শুকনো পাতা জড়ো হয়ে আছে। সেগুলি তুলে নিতে আরম্ভ করলে এক বুড়োগোছের চাষী এসে বাধা দিলো। সে বলল, “ওগুলো আমি জড়ো করেছি। যে পাতাগুলো নিয়েছেন, সব রেখে দিয়ে যান। এসব আমি আমার ক্ষেতে নিয়ে যাচ্ছি। এ পুড়িয়ে যে ছাই হবে, তাতে খুব ভালো সার হবে, আর তাইতে, আমার জমিতে প্রচুর ফসল ফলবে।”
শিষ্যরা সেখান থেকে সরে গিয়ে বনের আর একটু ভেতরে ঢুকলো। সেখানে তারা দেখতে পেলো, তিনটি স্ত্রীলোক শুকনো পাতা কুড়িয়ে তাদের ঝুড়ির ভিতরে ভরে নিচ্ছে। ওরা জিজ্ঞাসা করলো, “শুকনো এই সব পাতা নিয়ে তোমরা কি করবে?” একজন উত্তর দিল, “এই দিয়ে আমি জ্বালানীর কাজ করি, তাতে স্নানের জল, কাপড় কাচার জল গরম হয়। দ্বিতীয়া বললো, “ভাল পাতাগুলো একসঙ্গে করে কাঠি দিয়ে। গেঁথে ‘পত্রাবলী’ তৈরী করি, আশ্রমে আর মন্দিরে এতে খাবার থালার কাজ করে। এইভাবে আমি আমার ছেলেমেয়ের খাওয়াপরার জন্য টাকা। রোজগার করি।” তৃতীয়ার উত্তর হলো, “এই নির্দিষ্ট গাছের শুকনো পাতা আমি কুড়িয়ে নিয়ে যাই। আমার স্বামী একজন বৈদ্য; তিনি এগুলি দিয়ে উদ্ভিদ-ভেষজ তৈরী করেন, তাতে অনেকের অসুখ-বিসুখ ভাল করেন।”
এবারে শিষ্য দুজন বনের অনেকটা ভেতরে ঢুকে গেল। সেখানে তারা একটা লম্বা গাছের নীচে কতকগুলি শুকনো পাতা দেখতে পেলো। ঐ দিকে তাকিয়ে দেখতে দেখতে একটা মস্ত বড় পাখি নেমে এলো, আর, একটা পাতা ঠোটে করে নিয়ে উড়ে চলে গেল। এরা দুজন লক্ষ্য করলো যে, পাখিটা কাছাকাছি একটা ছোট গাছের মাথার উপর পাতাটা নিয়ে যাচ্ছে, ওখানে শুকনো পাতা আর ঘাস দিয়ে তারা বাসা তৈরী করছে। পাখির কাজে লাগবে ভেবে, গাছের পাতাতে ওরা হাত দিল না।
অতঃপর ওরা গুরুকুলে ফিরে যাওয়াই ভাল বলে মনে করলে। ফেরার পথে তারা দেখে যে, ছোট একটা পুকুরের জলে এক মস্ত শুকনো পাতা ভাসছে। “এই পাতাটা নিশ্চয়ই কারো কোন কাজে লাগছে না,” এই বলে ঐ পাতাটাকে ওরা তুলে নিল। কি আশ্চর্য! ঐ পাতার উপর দুটো বড় লাল পিপড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে! শিশুদের একজন পাতাটাকে যেই হাতের মধ্যে রেখেছে, পিপড়েরা ঘোরা বন্ধ করে দিলো। যেন বলতে চাইছে, এই শুকনো পাতা আমাদের ‘লাইফ-বোট’ হয়েছিল। এ না থাকলে আমরা পুকুরে ডুবে যেতাম।”
শিষ্যদ্বয় অগত্যা বৃথা খোঁজাখুঁজি ছেড়ে দিয়ে গুরুকুলে ফিরে এলো। দুঃখিতভাবে তারা গুরুকে বললো, “গুরুদেব, শুকনো ঘাস পর্যন্ত এত কাজে লাগে দেখলাম, যে, আপনার জন্যে তা আনতে পারলাম না। যত শুকনো পাতা দেখলাম, সমস্তই কোন না কোন কাজে দরকার হচ্ছে। আপনি আমাদের কাছে যে গুরুদক্ষিণা চাইলেন তা আনতে না পারার জন্য ক্ষমা করুন।”
গুরু উত্তর দিলেন, দেখ বাছারা, আমি যে গুরুদক্ষিণা চেয়ে ছিলাম তা পেয়েছি। আজকে যে জ্ঞান তোমরা আহরণ করলে, সেইটিই আমার আসল গুরুদক্ষিণা। একটা শুকনো পাতা পর্যন্ত কত কাজে আসে, আর সে মানুষ, পাখি, কীটপতঙ্গকে সাহায্য করে। তাহলে, মানুষের দেহকে সৎ কাজে লাগালে সে আরো কত বেশী দামী হতে পারে! সুতরাং দেহের যত্ন নাও। তোমার জীবন, সেই সঙ্গে অন্যের জীবন সুখী করার জন্য তাকে কাজে লাগাও। কারো কোন দরকারে, কিংবা অসুস্থ রোগীকে বা বুড়ো মানুষকে সেবা করার সুযোগ কিংবা অজ্ঞ ও দরিদ্রকে সাহায্য করার সুযোগ পেলে তা হারিও না। আজ যে বিরাট শিক্ষা পেলে তা কখনও ভুলে যেও না।”
প্রশ্নঃ:
- শিষ্য দুজন বনের ভিতরে অকেজো শুকনো পাতার খোঁজ করতে গিয়ে হতাশ হয়ে ফিরে এলো কেন?
- গুরু তার শিষ্য দুজনকে শুকনো পাতা ও মানুষের দেহ সম্বন্ধে কি শিক্ষা দিলেন?
- এমন আর দুটি জিনিসের বর্ণনা দাও যা সাধারণত অকাজের বলে ধরে নেওয়া হয়, কিন্তু যারা ঠিকমতো ব্যবহার করতে জানে তাদের হাতে পড়ে কাজের হয়।