সত্য সাই বাবার জীবনী-প্রথম ভাগ
অন্য ছেলেদের মতন স্কুল থেকে বাড়ি ফিরে বালক সত্য স্কুলে কি শেখানো হয়েছে সেকথা খুব কমই বলত। বরঞ্চ সে তার শ্রেণীর অন্য বালকদের, কখনও বা বড়দেরও, কি শেখাল সেটাই বলত।
পাঁচ থেকে সাত বহরের শিশুরা সত্যের সঙ্গে খেলা করতে ও তার কাছ থেকে ভজন শিখতে আসত। সত্য এই সময়টা তাদের সঠিক আচরণ শেখাতে কাজে লাগাত। সে তাদের বলতো,” অনেক কষ্ট ও অসুবিধা সহ্য করে তোমাদের মা তোমাদের জন্ম দিয়েছেন; তিনিই এই দেহ দিয়েছেন। তোমাদের পিত তোমাদের পালন করছেন। এঁরা দুজনেই তোমাদের জন্য অনেক ত্যাগ স্বীকার করেছেন। তাই তো তোমাদের উচিত ওনাদের ভালোবাসা, ওনাদের কথা মেনে চলা এবং ওনাদের সুখী করা। পরিস্থিতি যাই হোক না কেন,সব সময় সত্যকে ধরে থাকবে। বাবা মা বকবেন বলে মিথ্যা বলে নিজেদের দোষ গোপন করোনা। তাঁদের তিরস্কার করতে দাও। সত্যের শক্তি এটম বোমা বা হাইড্রোজেন বোমার চেয়েও বেশী! সত্যের থেকে শক্তিশালী কোনো অস্ত্র নেই। কিন্তু সত্য কথা কিভাবে বলতে হয় সেটাও তোমাদের জানতে হবে। সত্য কথা এমন ভাবে বলতে হবে যাতে সেটা প্রিয় হয় এবং অন্যের ক্রোধের কারণ না হয় বা অন্যের মনে আঘাত সৃষ্টি না করে।”
এই শিশুরা যখন আরেকটু বড় হল, তখন তারা সঠিক আচরণ সম্পর্কে সত্যকে প্রশ্ন করতো। সত্য তাদের বলতো, “ক্রোধ, ভড়ং এবং ঈর্ষার মতন মন্দ গুণগুলি বর্জন কর। অন্তরে প্রেম নিয়ে এস; প্রেম তোমাদের প্রাণবায়ুর মতন হয়ে উঠুক। প্রেমের সাহায্যে তোমরা ভুবন জয় করতে পারবে।” সত্য ওই শিশুদের বলত,” কখন কোনো জিনিষ চুরি কোরনা। যদি সত্যই তোমাদের খাবারের, কোনো বই এর বা পেন এর দরকার থাকে, তাহলে বন্ধুদের কাছ থেকে চেয়ে নিও; কিন্তু না বলে কখন অন্যের জিনিষ নিও না।
শুধু যে স্বামীই ওই শিশুদের অত্যন্ত ভালোবাসতেন তা নয়, তারাও স্বামীকে খুব, খুব ভালোবাসত। তারা যে স্বামীকে এবং তার উপদেশকে কতটা ভালোবাসত, তা বোঝা যায় তাদের একান্ত আলাপচারিতার মধ্য দিয়ে। কেসান্না, রাঙ্গান্না, সুব্বান্না,রামান্না এবং আরো অনেকে নিজেদের মধ্যে বলাবলি করত,” রাজুর কথাগুলি বড় মধুর; ওকে কি যে ভাল লাগে। “আবার আরেকটি ছেলে বলত, “শুধু তুমি এক নও, আমরা সবাই ওকে ভালোবাসি, তাই নয় কি?” আবার আরেকটি ছেলে বলত,” রাজু আমাদের অনেক ভাল ভাল কথা বলে তার থেকে অন্তত একটা দুটো আমাদের পালন করতে শুরু করা উচিত।” কেসান্না বলত” ঈশ্বর আমাদের মাতা, ঈশ্বরই আমাদের পিতা, তিনি আমাদের জীবন।” আরেকজন বলত।” আমি এখন সর্বদা সত্য কথা বলি।” সেই সময় থেকেই স্বামী বিভিন্ন জাতি ও ধর্মের মধ্যে ঐক্যের বন্ধনকে দৃঢ় করতেন। পুত্তাপর্তি গ্রামে বহু মুসলমান বাস করতেন। সত্য ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের বলত,” কি ভাবে ঈশ্বরের পুজো করছি বা কোন ধর্ম অনুসরণ করছি তার থেকে অনেক গুরুত্বপূর্ণ হল নৈতিকতা। নৈতিকতাই আমাদের প্রাণশক্তি। সুতরাং ধর্ম নিয়ে কখনও পরস্পরের মধ্যে ভেদ কোরনা। সকলের সঙ্গে বন্ধুত্ব রাখ। এই উৎসবে সামিল হও।” একদিন গঙ্গান্না নামে একজন হরিজন বালক (এখন সে নব্বই বছরের বৃদ্ধ এবং তার ছেলে প্রশান্তিনিলয়মে প্রশাসনিক বিভাগে কাজ করে।) সত্যকে তার বাড়িতে খেতে নিমন্ত্রণ করেছিল। সত্যর সঙ্গে তার পালিকা মাতা সুব্বাম্মাও গেলেন। তিনি ব্রাহ্মণ হওয়ায়,তাঁকে দেখে গঙ্গান্না একটু ভয় পেয়ে গেলো। কিন্তু সত্য তাকে বলল,” এরকম চিন্তা মনে রেখনা। এসব ভেদজ্ঞান বর্জন কর। ঐক্যের মানসিকতা নিয়ে আনন্দের সঙ্গে জীবন যাপন কর। একটাই জাতি আছে,তা মানবজাতি। ধর্ম একটাই, সেটা হল প্রেমের ধর্ম।
বুক্কাপত্তনমে একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সত্য পড়াশোনা করত। উচ্চ বিদ্যালয়ে যাবার জন্য ছাত্রদের ELSC নামে একটি পরীক্ষায় পাস করতে হত। পরীক্ষাটি নেওয়া হত পেনুকোন্ডায়। সেই সময় বাস বা ট্রেন ছিলোনা। বস্তুত যখন পেনুকোন্ডা অবধি ট্রেন চালু হল, গ্রামের লোকেদের কাছে সেটা অতি অদ্ভুত ব্যাপার বলে মনে হত। তারা বলত, “লাইন এর ওপর দিয়ে সাপের মতন কি একটা গড়িয়ে আসছে। তার আবার সামনের দিকে ঝকঝক করছে একটিমাত্র চোখ।”
সেই সময় গ্রামবাসীদের কাছে পেনুকোন্ডা যাওয়া আমেরিকা বা রাশিয়া যাবার মতন দীর্ঘ যাত্রার সামিল ছিল। ঈশ্বরাম্মা সত্যর খাবার জন্য কিছু মিষ্টি বা অন্য টুকটাক জিনিষ তৈরী করে একটি কাপড়ের পুঁটলিতে বেঁধে দিলেন। তখনকার দিনে গ্রামে টিফিন ক্যরিয়ার এর চল ছিলো না। অন্য ছেলেদের সঙ্গে সত্য যখন চলে গেলো, তখন তার বাবা মা কেঁদে ফেললেন। তারা গরুর গাড়িতে যাত্রা করল। আটটি বালক এবং তাদের দেখাশোনা করার জন্য একজন শিক্ষক গেলেন।
গ্রামের রাস্তা ছিল উঁচুনিচু। বেশী চোরাই উৎরাই থাকলে শিক্ষক ছেলেগুলিকে গাড়ি থেকে কোলে করে নামিয়ে নিতেন। খানিকটা পথ তারা হাঁটতো,তারপর শিক্ষক তাদের আবার গাড়িতে তুলে দিতেন। এই একই জিনিষ বারবার হতে থাকত। পেনুকোন্ডা পর্যন্ত সাড়ে তিন কিলোমিটার পথ পার হতে তাদের সকাল পাঁচটা থেকে রাত নটা বেজে যেত। সেখানে পৌঁছেও তাদের কোন সুবিধা বা আরাম ছিলোনা, থাকবার জন্য কোনো জায়গাও ছিলো না। তাই গ্রামের সীমানায় তাঁবু খাটিয়ে তাদের তিন দিন থাকতে হত।
প্রতিদিন সত্য দলের সকলের জন্য রান্না করত। সকালের জলখাবার, মধ্যাহ্নের খাওয়া এবং রাতের খাওয়া সব সত্য একহাতে করত। ELSC পরীক্ষায় বসার জন্য সেই যাত্রার ফল হল এই যে সেই ছোট বালকদলের মধ্যে একমাত্র সত্যই পরীক্ষায় পাস করল। অন্যরা এই দীর্ঘ পথযাত্রায় ক্লান্ত হয়ে পড়ল; পরীক্ষার ধরণ দেখে তারা ঘাবড়ে গেল; ফলে তারা পাস করতে পারলোনা। লোকে যখন শুনল যে একমাত্র সত্য প্রথম বিভাগে পরীক্ষায় পাস করেছে, তখন তারা সত্যকে গরুর গাড়িতে বসিয়ে গ্রামের মধ্যে দিয়ে মিছিল করে ঘুরলো। সত্য তারপর থেকে কমলাপুরম উচ্চ বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করত। সেখানে সে তার দাদা শেষাম্মা রাজুর বাড়িতে থাকত। ওই জায়গায় জলাভাব ছিল এবং বিশেষ করে পানীয় জল পাওয়া যেত না।
ফলে সত্যকে প্রতিদিন এক কিলোমিটার দূরের একটি কুয়া থেকে বেশ কয়েকবার গিয়ে জল নিয়ে আসতে হত। সে বাড়ির জন্য বড় বড় মাটির জালা করে জল বয়ে নিয়ে আসত। সকাল নয়টা অবধি তাকে এই কাজে ব্যস্ত থাকতে হত। প্রায় ওই সময়েই তাকে স্কুলের জন্য রওনা হতে হতো। তার প্রাতঃরাশ ছিল নুন জলে ভিজানো বাসি ভাত। সত্য তাড়াতাড়ি একটু আচার দিয়ে সেই পান্তাভাত খেয়ে এক ছুটে স্কুলে চলে যেত।
স্কুলে দুটি বালকের মাঝখানে সত্য বসত। ওই বেঞ্চে তিনজনের বসার মতন জায়গা ছিল। ওই দুটি বালকের নাম ছিল রমেশ ও সুরেশ। সেই সময় ড্রিল শিক্ষক স্কাউট এর কার্যবিধি চালু করেছিলেন। তিনি একটি নিয়ম জারি করলেন যে প্রত্যেককে স্কাউট এ যোগ দিতে হবে এবং এক সপ্তাহের মধ্যে খাকি প্যান্ট, সাদা শার্ট এবং ব্যাজ নিয়ে প্রস্তুত থাকতে হবে। স্কাউট দের পুষ্পগিরির বার্ষিক উৎসবে যোগদান করা বাধ্যতামূলক করা হলো। সেখানে তাদের কাজ হবে সমবেত জনসাধারণের সেবা করা। সত্যর কাছে একটা পয়সাও ছিলোনা।
রাজু পরিবার একটি বড় একান্নবর্তী পরিবার ছিল। তাই শ্রী ভেংকাপ্পা রাজুর আর্থিক সামর্থ্য তেমন ছিলোনা। স্কুলে যোগদান করার সময় তিনি সত্যর হাতে দুআনা পয়সা দিয়েছিলেন। কিন্তু তারপর থেকে ছয় মাস সময় অতিবাহিত হওয়ায় সত্য সেই পয়সা খরচ করে ফেলেছিল। (তখনকার দিনে দু আনা মানে অনেকটাই ছিল) সে ক্লাসের মনিটর এবং স্কাউট এর নেতা হওয়ায়, তার পক্ষে পুষ্পগিরি যাওয়া আবশ্যিক ছিল; কিন্তু কোন পয়সা না থাকায় সেটা কি করে সম্ভব হবে, তা নিয়ে সত্য ভাবিত ছিল।
এখনকার ছেলেদের মতন সত্যর ডজন খানেক পোষাকও ছিলোনা। তার একটা করেই প্যান্ট ও শার্ট ছিল। সেগুলোই সে খুব যত্ন করে ব্যবহার করত। স্কুল থেকে ফিরেই সে জামাকাপড় ছেড়ে ফেলত; তারপর কোমরে তোয়ালে জড়িয়ে সেগুলি ধুয়ে শুকোতে দিত। পরে সে সেগুলি ইস্ত্রি করে নিত একটি তামার পাত্রে একটুকরো জ্বলন্ত অঙ্গার রেখে। সেটাই ছিল তার ইস্ত্রি। ভাঁজ ঠিক রাখার জন্য সেগুলিকে সত্য, সারা রাত একটা ভারী টিনের ট্রাঙ্ক এর তলায় রেখে দিত। এইভাবে সত্য সবসময় তার পোষাক পরিষ্কার ও পরিচ্ছন্ন রাখত। সারা বছর তার ওই এক প্রস্থ পোষাকেই তার চলে যেত।
পরিবারের সম্মান ক্ষুণ্ণ হবার ভয়ে সত্য শিক্ষক কে বলতে চাইলো না যে তার মাত্র একটি করে পোষাক। তার স্কাউট এর ইউনিফর্ম কেনার পয়সা নেই। তাই সত্য ঠিক করল যে সে যাবেনা। রমেশ কিন্তু ঠিক বুঝতে পেরেছিল যে সত্যর কোন সমস্যা হচ্ছে বলে সে স্কাউট দলের সঙ্গে না যাবার চেষ্টা করছে। রমেশ তার বাবার কাছে গিয়ে বললো,” বাবা আমার এই স্কাউট এর পোষাক খুব ভাল লেগেছে। আমার জন্যে একটা নয় দুটো করে পোষাক করিয়ে দাও।”
কয়েকদিন পরে রমেশ সেই বাড়তি পোষাক কাগজে মুড়ে সত্যর ডেস্কে রেখে দিল এবং তার সঙ্গে একটি ছোট চিরকুট রাখল। তাতে লেখা ছিল,” রাজু ,তুমি আমার ভাইয়ের মতন। তোমাকে এই পোষাকটি নিতে হবে। তুমি যদি না নাও,তাহলে আমি বাঁচবোনা।”
চিরকুটটি দেখে সত্য সেটি ছিঁড়ে ফেলল। পরিবর্তে সে আরেকটি চিরকুট লিখল,” তুমি যদি সত্যি আমার বন্ধুত্ব চাও তাহলে এইভাবে উপহার দেবেনা বা আমাকে সেটি গ্রহণ করতে বলবেনা। এটা ঠিক নয়। এতে আমাদের বন্ধুত্ব নষ্ট হয়ে যাবে। যদি তুমি আমার বন্ধু হতে চাও এবং ভাইয়ের মতন সম্পর্ক রাখতে চাও, তাহলে এভাবে উপহার দিওনা। বন্ধুত্ব হল হৃদয়ের সঙ্গে হৃদয়ের সম্পর্ক। উপহার দিলে তার পবিত্রতা নষ্ট হয়ে যাবে। “ইউনিফর্মটি ফেরত নেয়া ছাড়া রমেশের আর কিছু করার ছিল না। পুষ্পগিরির উৎসব শুরু হতে আর মাত্র তিনদিন বাকি ছিল। সব ছেলেরা বলতে শুরু করেছিল, “রাজু তুমি না গেলে আমরাও যাবোনা।” এইভাবে সত্যর ওপর খুবই চাপ সৃষ্টি হচ্ছিল।
যাবার জন্য প্রতিটি ছেলেকে বারো টাকা করে দিতে হয়েছিল; বাস এর ভাড়া দশ টাকা এবং অন্যান্য খরচের জন্য দু টাকা। ছেলেরা নিজেদের খাবার ব্যবস্থা নিজেরাই করবে, এমনই কথা ছিল। সত্যর কাছে যেহেতু বারো টাকা ছিলোনা, দলের সঙ্গে তার যাওয়ারও কোন প্রশ্ন ছিলনা। শেষে সে পেটে খুব ব্যাথা হচ্ছে বলায় শিক্ষক এবং ছেলেদের তাকে বাদ দিয়েই রওনা হতে হল।
তারা যাওয়ার পর, সত্যর মনে হল যে সে তার সব স্কুলের বই বিক্রি করে দেবে এবং হেঁটে পুষ্পগিরি যাবে। সত্যর বইগুলো একদম নতুনের মতন ছিল, কারণ সে বইগুলো খোলেইনি। সত্য একটি হরিজন ছেলেকে চিনত।সত্য যে ক্লাস থেকে পরের ক্লাসে গেছে সে সদ্য সেই ক্লাসে ভর্তি হয়েছিল। তাই সত্য তার কাছে গিয়ে বলল,” যদিও এই সব বই একেবারে নতুন অবস্থায় আছে ,আমি সেগুলি তোমায় অর্ধেক দামে দিতে চাই।” কিন্তু সে এতই গরিব ছিল যে সেই টাকাটা দেওয়ার মতন সামর্থ্যও তার ছিলোনা। তাই দেখে সত্য বলল, “যাকগে, তুমি বইগুলো নাও। আমায় পাঁচটি টাকা দিলেই হবে। তাই যথেষ্ট, তার বেশি আমার চাইনা।” সত্যর মনে হলো যে এই টাকাতে তার খাওয়া এবং রোজের খরচ চলে যাবে, কারণ তার বাস ভাড়া লাগেনি। হরিজন বালকটি এই ব্যবস্থায় অত্যন্ত খুশী হল।
সেই সময় নোটের প্রচলন না থাকায় ছেলেটি পুরো টাকাটাই খুচরো পয়সায় দিল। সত্যর কোন পকেট ছিল না, তামার পয়সা বা মুদ্রা যেখানে রাখা যায়। সুতরাং সে একটা ছেঁড়া শার্টের টুকরোয় সেগুলি বেঁধে নিল। কিন্তু শক্ত করে বাঁধতে গিয়ে ছেঁড়া কাপড়টি একেবারেই ছিঁড়ে গেলো এবং সব পয়সা মাটিতে পড়ে গেল।
সেই মুদ্রাগুলি পড়ার শব্দে গৃহকর্ত্রী সেখানে এলেন এবং সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠলেন,” তুমি কথা থেকে এত পয়সা পেলে? তুমি কি আমার সংসার থেকে এই পয়সা চুরি করেছো?” সত্য তাঁকে অনেক বোঝালো। কিন্তু তিনি তাঁর কথায় বিশ্বাস করলেন না। শেষে সত্য যার কাছে বই বিক্রী করেছিল, সেই ছেলেটিকে ডেকে নিয়ে এল শুধু প্রমাণ করতে যে সে নির্দোষ। তাতেও মহিলার বিশ্বাস হলোনা। তিনি সত্যকে বেশ কয়েক ঘা মারলেন ও বললেন,” তুমি আমার সংসার থেকে এই টাকা নিয়েছ। সুতরাং শাস্তি হিসাবে তোমাকে এ বাড়িতে খেতে দেবোনা।”
সত্য পরিবারের কথা চিন্তা করে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ল। সে চাইল না যে লোকে তাকে জিজ্ঞাসা করুক যে, “কী হয়েছে, তুমি বাড়িতে খাচ্ছ না কেন?” পরিবারের সম্মান রক্ষা করতে সে তখনই পায়ে হেঁটে নয় মাইল দূরে পুষ্পগিরির উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে গেলো।
তখন গ্রীষ্মকাল; পানীয় জলের খুব সংকট। সত্যর খুব তেষ্টা পেয়েছিল, কিন্তু কাছাকাছি, গরু ছাগলকে যে জলে চান করান হয়, সেটা ছাড়া আর কিছু ছিল না। অল্প পরিমাণে এই নোংরা জল পান করেই তাকে তৃষ্ণা নিবারণ করতে হল।
পুষ্পগিরি পৌঁছে সত্য তার বন্ধুদের সঙ্গে যোগ দিল। যে কাজের ভার তাদের ন্যস্ত করা হয়েছিল, সত্য সর্বশক্তি নিয়ে সেই কাজে ঝাঁপিয়ে পড়ল। তার এই কাজ তার বন্ধুদেরও নিঃস্বার্থ সেবায় অনুপ্রাণিত করল। তিনদিন সত্যর খাওয়া হয়নি। সেকথা কেউ জানত না। কিন্তু রমেশের সন্দেহ হল। সে খুব চুপিসাড়ে গিয়ে দোসা বা ঐরকম কিছু নিয়ে এসে সত্যকে দিত(কারণ সে জানত যে লোক জানাজানি হোক, এটা সত্য চাইবে না) I এইভাবে সত্য বাকি দিনগুলি কাটিয়ে দিল।
ফেরার সময় হলে সত্য রমেশের কাছে এক আনা ধার চাইল। সত্য পরিষ্কার করে বলে দিল যে, এটা কিন্তু সে ধার হিসাবে নিচ্ছে, উপহার হিসাবে নয়। এই পয়সা দিয়ে সে বাড়ির জন্য কিছু ফল ও ফুল কিনে, চুপচাপ আবার নয় মাইল হেঁটে বাড়ী ফিরল।
এবার যেহেতু সত্য এত দিন বাড়ীতে ছিল না ,এই সময় বাড়িতে জল এনে দেবার কেউ ছিল না। তাই খুবই অসুবিধের মধ্যে দিয়ে তাদের দিন কেটেছিল। তা ছাড়াও গৃহকর্ত্রী সত্যের নামে শেষাম্মা রাজুর কাছে বেশ কিছু নালিশ করেছিলেন।
সেই জন্য সত্য বাড়ি ফেরা মাত্র শেষাম্মা রাজুর সমস্ত ক্রোধ তার ওপর গিয়ে পড়ল। তিনি সেই সময় চেয়ারে বসে রুলার দিয়ে খাতায় লাইন টানছিলেন। তখনকার দিনে রুলার হিসেবে যা ব্যবহার করা হত ,তা ছিল একটা লম্বা লাঠি। সত্যকে দেখামাত্র তিনি সেই রুলার দিয়ে তার আঙুলে মারলেন। রুলার টুকরো টুকরো হয়ে ভেঙে মাটিতে পড়ে গেল।
শেষাম্মা রাজু বাড়িতে জল না থাকার আক্রোশ, কিভাবে সত্যৰ ওপরে মিটিয়েছেন ,কিছু প্রতিবেশীরা সেটা জানতে পারলেন। এই ঘটনার কিছু পরে, ভেংকাপ্পা রাজু কমলাপুরমে এলে, তাঁরা তাঁকে সেকথা জানালেন।
সত্যকে একলা পেলে ভেংকাপ্পা তার ফোলা ব্যান্ডেজ বাধা হাতের কারণ জানতে চাইলেন। তিনি সত্যকে বললেন যে সত্যের জন্য তিনি খুবই দুশ্চিন্তায় আছেন। সে বরঞ্চ পুত্তাপর্তি ফিরে চলুক। সেখানে তার জীবন এত কঠিন হবেনা। সত্য বাবাকে খুব নরম করে, মিষ্টি করে বোঝালেন।
তিনি বললেন যে যেহেতু ওই পরিবার সদ্য তাদের জ্যেষ্ঠ সন্তানকে হারিয়েছে। এখনই সত্যকে ছাড়া তাদের চলবেনা। বিশেষতঃ এখনই চলে গেলে লোকে এই নিয়ে কথা বলবে এবং তাতে করে পরিবারের সুনাম ক্ষুণ্ণ হতে পারে। কিন্তু সত্য কথা দিল যে সে তাড়াতাড়িই পুত্তাপর্তি ফিরে আসবে।
এখনও স্বামী তাঁর ছাত্রদের সাবধান করেন যে, বাইরে তারা এমন কোন কথা যেন না বলে যাতে পরিবারেরসম্মান হানি হবে বা পরিবারের সুনাম ক্ষুণ্ণ হবে।
সত্য যখন পুত্তাপর্তি ফিরে এলেন তখন ঈশ্বরাম্মা সত্যের বাঁ কাঁধের চামড়ায় একটা কাল দাগ দেখতে পেলেন। তিনি যখন জানতে চাইলেন যে এরকম দাগ কী করে হল, তখন সত্য হেসে উড়িয়ে দিল। কিন্তু ঈশ্বরাম্মা পীড়াপীড়ি করায় সে বলল যে কাঁধে বাঁক নিয়ে জল আনার সময় বাঁকের দুদিকে যে পাত্র থাকে তার জন্যই বোধহয় দাগ হয়ে থাকবে। সত্য বলল,” আম্মা এটা তো আমার কর্তব্য ছিল। ওই ময়লা, বিষাক্ত জল পান করে শিশুরা কতদিন থাকত? আমি আনন্দের সঙ্গে জীবন সঞ্জীবনী জল বহন করি মা; এই সেবা করার জন্যই আমি এসেছি।”