শ্রী সত্য সাইবাবার জীবনী – দ্বিতীয় ভাগ
সত্য বিরাট কবি প্রতিভার অধিকারী ছিলেন এবং দোকানদার ও ব্যবসায়ীরা তার এই ছড়া লেখার যোগ্যতাকে তাদের পণ্যদ্রব্যের বিজ্ঞাপনের কাজে ব্যবহার করতেন। এই কবিতাগুলি এতই আকর্ষণীয় ছিল এবং ছোট ছেলেরা এত সুন্দর ভাবে উদ্দীপনার সাথে সেগুলো গাইতো যে বিক্রয় তৎক্ষণাৎ হু হু করে বেড়ে যেতো এবং সেই কারণে সত্যের কবিতার চাহিদাও ছিলো বিরাট।
সমাজে রূপান্তর ঘটানোর জন্যও সত্য কিছু কবিতা রচনা করেছিলেন। উদাহরণ স্বরূপ, গ্রামের হিসাবরক্ষক কর্ণমের প্রভূত সঞ্চিত সম্পত্তি ছিল এবং এর সাথে তার ছিলো কিছু অনৈতিক ও অনভিপ্রেত অভ্যেস। তার হিটলারের মত গোঁফের প্রদর্শন করে সে তার আড়ম্বর জাহির করতো; ঐতিহ্যগত পোষাক শৈলী পরিত্যাগ করে সে দামী রেশম বস্ত্র পরিধান করতো এবং তার চকচকে স্ট্র্যাপ বিশিষ্ট সোনার ঘড়ির জন্য সে গর্ববোধ করতো।
একদিন সুব্বাম্মা সত্যের কাছে এলো ও একটু হেসে বললো, “রাজু, তুমি কত মানুষকে উপদেশ দাও,- আমার স্বামী (কর্ণম ) ভুল পথে আছে, কেনো তুমি তাকে সঠিক পথে নিয়ে আসছো না?’ কর্ণম রোজ সন্ধ্যায় তার বাড়ির সামনে একটা তুলসী গাছের কাছে বসে থাকতো। সত্য একটি গান রচনা করে তাতে মনোরম সুর দিলেন ও তা ছোট ছেলেদের শেখালেন।
সন্ধেবেলায় ছোট ছেলেরা কর্ণমের বাড়ির পাশ দিয়ে যায় ও এই গান গায়,” আজকাল পুরুষ ও মহিলাদের কি হয়েছে? পুরুষেরা বাঁ হাতে একধরনের চামরার স্ট্র্যাপ বাঁধে ও তারা খুব উদ্ধত হয়ে গেছে। পুরুষ ও মহিলাদের পোষাক ও চেহারা সম্পর্কে আমরা কোনো সম্মানজনক কথা বলতে পারবো না। যদি কেউ অনৈতিকতা বর্জন না করে, তবে সে সমাজের মানুষের দ্বারা সমাজ থেকে বিতাড়িত হবে, বন্ধুরা তাদের চটি দিয়ে তাদের প্রহার করবে।” গানটি যেটি হিটলারের গোঁফের প্রসঙ্গ টেনে শেষ হয়েছে সেটি নিঃসন্দেহে কর্ণমের মনে বিরক্তি উৎপাদন করতো ও সে উঠে ভিতরে চলে যেতো। পরে সে ছোট ছেলেদের ডেকে পাঠালো ও জিজ্ঞেস করলো,” এই গানটা কে লিখেছে? ছোট ছেলেরা বলে ফেললো,” রাজু লিখেছে।” কর্ণম অবশ্য নিশ্চিত ভাবে জানতো যে এই নাটকের নেপথ্যে একমাত্র রাজুই থাকতে পারে।
পরের দিন তিনি সত্যকে ডাকলেন ও তাকে বললেন, “রাজু, দয়াকরে ছোট ছেলেদের এইসব গান শিখিয়ো না।” সত্য বললেন,” মহাশয়, আপনি এই গ্রামের প্রধান। আপনার এইসব কাজ করা উচিত না।” কর্ণম (যিনি ইতিমধ্যেই তার হিটলার গোঁফ কেটে ফেলেছেন) প্রতিজ্ঞা করলেন যে তিনি ভবিষ্যতে ভালো আচরণ করবেন এবং সত্য কথা দিলেন যে তিনি আর কখনও তাকে বিরক্ত করবেন না। এতে সুব্বাম্মা খুব খুশি হলেন।
সত্যের এরূপ বিশেষ ধরনের কবিতা রচনা করার যোগ্যতা নিয়ে আর একটি মজাদার ঘটনা আছে।সেই সময়, যখন দেশে স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম চলছে, তখন বিভিন্ন স্থানে মিটিং ও জমায়েত হত।ব্রিটিশ পুলিশেরা সেই সব মিটিং এ আসতো ও বলপূর্বক মিটিং বন্ধ করে দিতো। দুজন কংগ্রেস কর্মী সত্যের কাছে এলেন ও বললেন,” তোমার ইচ্ছে মত, তোমার নিজের মত করে দেশের বর্তমান পরিস্থিতি বর্ণনা করে, কিছু একটা লেখো, এবং কবিতা গুলো আমাদের দাও যাতে বুক্কাপট্টনমের সভায় আমরা সেগুলো ব্যবহার করতে পারি। সত্য কবিতাগুলি লিখেছিলেন। কংগ্রেস কর্মীরা শুধু কবিতাগুলি নয়, সত্যকেও সাথে করে নিয়ে যেতে চাইলেন। তারা সত্যকে শাড়ি পরিয়ে মেয়ে সাজালো ও একটা ঝোলা বানিয়ে তাতে রাবারের তৈরি শিশু পুতুল রেখে দিলো। সত্য পুতুল শিশুটিকে নিয়ে স্টেজে উঠলেন ও শিশুটির জন্য ঘুম পাড়ানি গান গাইতে শুরু করলো। তিনি গাইতে শুরু করলেন,” কেঁদোনা বাছা, যদি তুমি কাঁদো ও তুমি খুশি থাকতে অক্ষমতা প্রকাশ করো, তবে কি করে একজন তোমায় ভারতের যোগ্য সন্তান বলতে পারবে! এই ভাবে এই গানে শিশুটির উদ্দেশ্যে শিশুটিকে সম্বোধন করে বিভিন্ন ধরনের প্রশ্নের উত্থাপন করা হয়েছে। “বাছা, তুমি কি কাঁদছো হিটলার রাশিয়ানদের আক্রমণ করেছে আর রাশিয়ানরা হিটলারকে আক্রমণ করতে পারছেনা সেই কারণে? কেঁদোনা বাছা, সময় আসবে যখন রেড আর্মিরা আক্রমণ করবে ও প্রতিশোধ নেবে। আমাদের দেশে একতা নেই বলে কি তুমি কাঁদছো? কেঁদোনা। সেই সময় আসবে যখন আমরা সবাই এক হব এবং ভারত একটি ঐক্যের ছবি উপহার দিতে সমর্থ হবে। আরোগ্য লাভের উপায় বা প্রতিকার তো আছে । কেঁদোনা।” পুলিশেরা সেই গান উপভোগ করলো ও আনন্দে হাততালি দিলো। ইংরেজ সাহেবেরা সেখানে এলো ও গান শুনলো– এত সুন্দর এত আকর্ষণীয় ভাবে সত্য তার গানগুলি পেশ করেছিলো যে তেলেগু ভাষার এই গানের মানে না বুঝেও ব্রিটিশ অফিসারেরা হাততালি দিতে শুরু করলেন ও পরিস্কার বোঝা গেল তারা খুব আনন্দের সাথে তারা সঙ্গীতমুখর সময় অতিবাহিত করছেন। সেই মিটিং চুড়ান্ত ভাবে সফল হল।
উরাভাকোন্ডা হাই স্কুলে সত্য একবার সনাম ধন্য নৃত্যশিল্পী ঋষ্যেন্দ্রমনীর ছদ্মবেশ ধারণ করেছিলেন। সেদিন ছিলো স্কুলের বর্ষপূর্তি উপলক্ষে উৎসব পালনের দিন। কয়েকটি নতুন বিল্ডিং নির্মাণের উদ্দেশ্যে স্কুল কিছু অর্থ সংগ্রহ করতে চেয়েছিলো; সেই কারণে টিকিট বিক্রি করা হয়েছিলো ও ঋষ্যেন্দ্রমনীর অনুষ্ঠানের বিজ্ঞাপনও দেওয়া হয়েছিলো। কিন্তু শেষ মুহূর্তে কোনো কারণে নৃত্যশিল্পীর অনুষ্ঠানটি বাতিল করতে হয়েছিলো। স্কুলের প্রধান শিক্ষক লক্ষীপতি ভীষণ বিক্ষুব্ধ ও ব্যস্ত হয়ে উঠলেন, কারণ জেলা বোর্ডের প্রথম মহিলা সভাপতি ও ব্রিটিশ কালেক্টর সাহেবকেও ওই অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ করা হয়েছে। সত্য উদ্বিগ্ন বিভ্রান্ত প্রথম শিক্ষকের কাছে গিয়ে বললেন, “দর্শকদের হতাশ না করে বরং আমিই স্টেজে নৃত্য পরিবেশন করবো, নৃত্যশিল্পী আজ সন্ধ্যায় যে রকম নৃত্য পরিবেশন করতেন, ঠিক সেরকমই।”
ঋষ্যেন্দ্রমানীর কৃতিত্বপূর্ণ নৃত্যশৈলী যা তিনি স্টেজে উপস্থাপন করতেন, তা হল- তিনি মাথার ওপর একটা বোতল রাখতেন, বোতলের মুখে একটা প্লেট রাখতেন এবং প্লেটের ওপর রাখা হত একটি জ্বলন্ত বাতি। তারপর তিনি নাচ করতেন এবং মাথায় যা যা জিনিস রাখা হত সেগুলো না ফেলে নিচে ঝুঁকে পড়ে মেঝে থেকে একটি রুমাল তুলে নিতেন।
সত্য পায়ে ঝুমুর ও শাড়ি পরে নৃত্যশিল্পীর সাজে সুসজ্জিত হলেন। একটা পুরোনো গাড়ি করে তাকে গ্রাম থেকে যখন নিয়ে আসা হল এবং তখন মাইকে ঘোষণা করা হচ্ছে, “ঋষ্যেন্দ্রমনী আসছেন।” সকল দর্শক শ্রোতা, যাদের মধ্যে অনেক ঘুমিয়েও পড়েছিলেন, এখন তারা সবাই উৎসাহের সাথে সজাগ হয়ে উঠে বসেছে।
খুব সুন্দর সুরেলা বাজনার সাথে ঝুমুরের আকর্ষণীয় ঝুমঝুম শব্দে সত্য যখন মঞ্চে প্রবেশ করলেন, তখন তা প্রত্যেকের মনোযোগ আকর্ষণ করলো। একজন শিক্ষক তার মাথার ওপর একটি বোতল রাখলেন, তারপর একটি প্লেট আনা হল ও তা বোতলের ওপর রাখা হল এবং শেষে একটি জ্বলন্ত বাতি তার ওপর রাখা হল। এই সবকিছু দর্শকদের সামনেই করা হল, তা না হলে লোকেরা ভাববে বোতলটা মাথায় আঁটকানো আছে ও প্লেটটা বোতলের মাথায় আঁটকানো আছে। সত্য সুন্দর ভাবে নৃত্য পরিবেশন করে চললেন এবং অবশেষে রুমাল তোলার পরিবর্তে চোখের পাতা দিয়ে মেঝে থেকে একটি সুঁচ তুললেন, তার এই অসাধারণ উপস্থাপনা ঋষ্যেন্দ্রমানীর কৃতিত্বকে অতিক্রম করে চলে গেলো। প্রশংসা ও করতালিতে উৎসব স্থান মুখর হয়ে উঠলো। বৃটিশ কালেক্টর সাহেব স্টেজে উঠে ঋষ্যেন্দ্রমনীর গায়ে একটি মেডেল আঁটকে দিতে চাইলেন। সত্য যে কোনো মূল্যে তা উপেক্ষা করতে চাইলেন। সত্য তার উদ্ভাবনী দক্ষতাকে ব্যবহার করে বললেন, “যেহেতু আমি একজন মহিলা, আমাদের দেশের ঐতিহ্য অনুসারে এই আচরণ গ্রহণযোগ্য নয়, তাই দয়াকরে মেডেলটা আমার হাতে দিন।”
পরের দিন, পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠান চলা কালিন, জেলা বোর্ডের সভাপতি ঋষ্যেন্দ্রমানীর প্রশংসনীয় অনুষ্ঠানের ফলস্বরূপ অর্থসংগ্রহের কারণে নৃত্যশিল্পীকে পুরস্কার স্বরূপ শাড়ি উপহার দিতে চাইলেন। তিনি ডাকলেন, “ঋষ্যেন্দ্রমানী!” প্রত্যেকে চারিদিকে তাকাচ্ছিলো। হাফপ্যান্ট পরা ছোটো একটি ছেলে দর্শকদের মাঝখান থেকে উঠে আসলো। পুলিশ তাকে ধাক্কা দিয়ে একপাশে সরিয়ে বললো, “রাস্তা আঁটকে দাঁড়িয়ো না, ঋষ্যেন্দ্রমানী আসছেন।” তারপর প্রধান শিক্ষক মহাশয় সত্যকে মঞ্চে নিয়ে এলেন এবং ঘোষণা করলেন যে এই ছোট ছেলেটিই গতকালকের ঋষ্যেন্দ্রমানী। মহিলা সভাপতি এতই খুশি হলেন যে তিনি উঁচু করে তুলে ধরলেন ও বললেন, “তুমি শুধু এই স্কুলের বিরাট সুনাম ও সম্মান নও, তুমি আমাদের দেশেরও সুনাম। সেই দিন থেকে তার সত্যের প্রতি এত গভীর শ্রদ্ধা জন্মেছিলো যে তিনি যেখানেই যেতেন সেখানেই এই ঘটনার উল্লেখ করতেন।