মাতা ঈশ্বরাম্মা এবং তাঁর দিব্য পুত্র
মাতা ঈশ্বরাম্মার জীবন ধার্মিকতা ও পবিত্রতায় পূর্ণ ছিল। ভগবান বাবা বলেছেন, আমি যখন আমার জন্ম নেবার সংকল্প গ্রহণ করেছিলাম তখন আমিই স্থির করেছিলাম যে আমার মাতা কে হবেন। বাবা যে মাতাকে মনোনীত করেছিলেন তিনি হলেন ঈশ্বরাম্মা, এবং সে কারণে তাকে মনোনীত মাতা বলা হয়ে থাকে। তিনি ছিলেন দরিদ্র, কোমল-হৃদয়া, ধার্মিক নিরক্ষর গ্রাম্য গৃহবধূ।
অবতার ও পয়গম্বরদের জন্মের পূর্বে সাধারণতঃ অলৌকিক ঘটনা ঘটে থাকে। প্রভু সত্যনারায়ণকে ঈশ্বরাম্মার শাশুড়ী স্বপ্নে দর্শণ করেন এবং তিনি ঈশ্বরাম্মাকে বলেছিলেন যে, কোনও অস্বাভাবিক কিছু যদি তার ক্ষেত্রে ঘটে তাহলে তিনি যেন ভয় না পান। একদিন যখন ঈশ্বরাম্মা কূয়ো থেকে জল তুলছিলেন তখন হঠাৎ উজ্জ্বল আলোকের একটা বড় বল গড়াতে গড়াতে তার দিকে এসে ধীরে ধীরে তার ভিতর প্রবেশ করল এবং তিনি জ্ঞান হারিয়ে ফেললেন….হ্যাঁ, ভগবান বাবা তার মাতাকে এইভাবে মনোনীত করলেন।
সত্য তখন নয় মাসের শিশু, ঈশ্বরাম্মা যে দিন তাকে স্নান করিয়ে নতুন পোষাক পরিয়ে কাজল, বিভূতি ও কুমকুম দিয়ে সাজিয়েছিলেন। ঠিক তার পরের দিনের কথা। তিনি সত্যকে একটি দোলনায় শুইয়ে দোল দিচ্ছিলেন। তারপর তিনি উনানের উপর দুধ ফুটে উথলে উঠছিল। বলে সেদিকে দৌড়ে গেলেন। হঠাৎ তিনি সত্যকে কাঁদতে শুনলেন। তিনি খুবই অবাক হয়ে গেলেন কারণ জন্মাবার পর হতে কোনও দিন- ক্ষুধা, ব্যাথা অথবা অস্বাচ্ছ্যন্দ কোন কারণেই সত্য কাঁদেন নি।
তিনি শিশু সত্যকে দোলনা হতে তুলে কোলে নিলেন। শিশুটির কান্না থেমে গেল এবং ঈশ্বরান্মা অবাক হয়ে সত্যের চারপাশে একটি শীতল, উজ্জ্বল আলোকের জ্যোতির্বলয় দেখতে পেলেন।।
শীঘ্রই সত্য গ্রামের প্রত্যেকের নজর ও শ্রদ্ধা আকর্ষণ করে নিলেন আর ঈশ্বরাম্মা কিছু লোকের ঈর্ষর ও ঘৃণার অশুভ দৃষ্টির ভয়ে ভীত হতে লাগলেন। ঐ অশুভ দৃষ্টির হাত হতে প্রতীকী রক্ষার জন্য ঈশ্বরান্মা নারকেল ঘুরিয়ে এবং কর্পূরের আলোকের আরতি করতেন। কিন্তু সত্য দেখতে পেলে তিনি এসব হতে দৌড়ে পালিয়ে গিয়ে বলতেন, কারও দৃষ্টি আমার কি করতে পারে?” দাম্ভিক ও প্রভুত্বব্যঞ্জক এই উত্তর আমাদের সুপ্রাচীনকালের যশোদার প্রতি শ্রীকৃষ্ণের উক্তিকে স্মরণ করিয়ে দেয়। কিছুটা মাটি মুখে দেবার জন্য যখন যশোদা বকুনি দিয়েছিলেন তখন দিব্য শিশু উত্তর দিয়েছিলেন ভুল করেও ভেবো না যে আমি শুধুই এক দুষ্টু ও পাগল শিশু মাত্র। এক অপরিচিত লোক শ্রীকৃষ্ণকে তার নাম জিজ্ঞেস করলে তিনি উত্তর দিয়েছিলেন, “আমার অসংখ্য নামের ভিতর কোন নামটি আমি বলব?” বাবা বলে থাকেন সকল নামই হল আমার। সকল রূপই হল আমার।” সারাদিন সত্য বহুবার ঈশ্বরাম্মাকে শ্রীকৃষ্ণের কথা স্মরণ করিয়ে দিতেন। সত্যও অষ্টমগর্ভের সন্তান রূপে জন্ম নিয়েছিলেন এবং ঈশ্বরাম্মা আশা করতেন যেন সত্যও ঐ ভূমিকা পালন করেন।
বাড়ীর বাইরে থেকে পাহাড়, তারকা ও আকাশের দিকে নীরব আনন্দে তাকিয়ে থাকতে সত্য ভালবাসতেন। একটু বড় হয়ে অন্য শিশুদের সঙ্গে যখন রাস্তায় খেলা করতেন তখন লুকোচুরি এবং কানামাছি খেলার ভিতরও তার পাশ দিয়ে যাওয়া প্রতিটি গরু এবং মোষ তার উষ্ণ হাতের প্রেমপূর্ণ আদর হতে বঞ্চিত হত না বলে ঈশ্বরাম্মা স্মরণ করে উল্লেখ করেছিলেন। একদিন রাস্তায় খালি গায়ে এক শিশু শীতে কাঁপছিল। তাকে দেখামাত্র সত্য নিজের গায়ের সার্ট খুলে তাকে পরিয়ে দিয়েছিলেন। ঈশ্বরাম্মা বলেছিলেন, “কারও ভিতর কোনও ব্যাথা ও কষ্ট দেখলে সঙ্গে সঙ্গে তিনি তার উপশম করতেন।” ঈশ্বরাম্মার দেখা যে কোনও শিশুর চেয়ে সত্যের কথা বেশী নম্র ও মধুর ছিল।
মাঝে মাঝেই তিনি সত্যকে অনুনয় করে বলতেন। “সত্যম, তুমি কি চাও আমায় বল।” তিনি সত্যকে এই প্রশ্ন করতেন কারণ তার কোনও পছন্দ বা অপছন্দ ছিল না। কিন্তু তিনি যখন দেখতেন যে তার আশেপাশের শিশুরা সুখী হয়েছে সঙ্গে সঙ্গে তার মুখ মৃদু হাসিতে উদ্ভাসিত হয়ে উঠত।
ভগবান বাবা যখন চোদ্দ বছর বয়েসের ছিলেন তখন তিনি তাঁর প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে মাতা ঈশ্বরাম্মাকে পরবর্তী জীবনে যে ভূমিকা পালন করতে হবে তার জন্য প্রশিক্ষণ দেওয়া শুরু করেন। তিনি মাতাকে এই তিক্ত সত্যটি জানিয়ে দেন যে, তার ভক্তরা তাকে ডাকছেন এবং তিনি আর মাতা ঈশ্বরাস্মার কেউ নন। তখন মাতা জিজ্ঞেস করেছিলেন, “তাহলে তুমি কার?” “জগতের এবং তার লোকেদের”, ছিল উত্তর। এভাবেই ঈশ্বরাম্মাকে প্রশান্তিনিলয়মে আগত হাজার হাজার পুত্র এবং কন্যার মাতার ভূমিকা দেওয়া হল। তিনি রুগ্ন ও দুর্দশাগ্রস্তদের বেছে প্রেমের সঙ্গে তাদের দেখাশোনা করতেন।
বালক সত্যের অতুলনীয় প্রজ্ঞা এবং আধ্যাত্মিক বিষয়গুলোতে যে প্রভুত্বব্যঞ্জকভাবে তিনি বলতেন তা দেখে মাতা ঈশ্বরাম্মা সবসময় হতবুদ্ধি হয়ে যেতেন। ঈশ্বরাম্মার সরলতা এতটাই মুগ্ধকর ছিল যে, পরবর্তী বছরগুলোতে ভগবান বাবা যখন বেদবেদান্ত হতে উদ্ধৃতি দিয়ে ভাষণ দিতেন তখন তিনি অধ্যাপক কস্তুরীর কাছে গিয়ে প্রশ্ন করতেন ‘এ সবই কি সঠিক ছিল ?”
মাতা ঈশ্বরান্মার সরলতা নিয়ে ভগবান বাবা ঠাট্টা করতে ও খেলা করতে ভালবাসতেন। উদাহরণস্বরূপ, পূর্ব আফ্রিকায় বাবার যাবার পূর্বে সমুদ্রের উপর দিয়ে বিমানে করে উড়ে যাবার কথা চিন্তা করে মাতা খুবই উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছিলেন। কিন্তু মাতার ভয়কে স্তিমিত করবার কোনও চেষ্টাই বাবা করেন নি। বরং পরিবর্তে তিনি তাকে এই বলে আরও বেশী ভীত করে দিয়েছিলেন যে, আফ্রিকা হল উল্টো একটি জগত যেখানে মানুষখেকো উপজাতি রয়েছে এবং সোনা সেখানে খেজুরের মতই সস্তা। ঈশ্বরাম্মাকে সত্য এই আশ্চর্যজনক খবরটিও দিয়েছিলেন যে ঐ ভ্রমণটি হবে চারঘন্টা অতীতে চলে যাওয়া– অপরাহ্নের চা পান করে তারা তিনটের সময় বোম্বাই হতে রওয়ানা হয়ে ঐ দিনের সকাল ১১টায় আফ্রিকায় পৌঁছে সেখানকার লোকেদের সঙ্গে দুপুরের খাবার খেতে বসবেন। খুবই ভীত হয়ে ঈশ্বরাম্মা অনুনয় করতে লাগলেন ঐ অপার্থিব দেশে যাওয়াটা বন্ধ করে দেওয়াটাই ভাল। কিন্তু বাবা শুধুই মাতার দিগন্তকে প্রসারিত করে দিচ্ছিলেন।
মাতা ঈশ্বরাম্মা ছিলেন পবিত্র চিন্তা ও মহৎ অনুভূতিতে পূর্ণ। একদিন তিনি বলেছিলেন, স্বামী, পুট্টাপর্তী হল একটি ছোট গ্রাম, এখানে কোনও স্কুল নেই এবং পাশের গ্রামে স্কুলে যাবার জন্য এ গ্রামের শিশুদের অনেকটা পথ হাঁটতে হচ্ছে। দয়া করে এখানে একটি স্কুল তৈরী করে দাও। ভগবান বাবা তাই করে দিলেন এবং মাতাকে খুবই আনন্দ দিলেন। তারপর তিনি ভগবান বাবাকে বলেছিলেন যে ঐ গ্রামেই একটি হাসপাতাল তৈরী হোক যা তিনি চান। ঈশ্বরাম্মার তৈরী ভলান্টিয়ারগণ একটা একটা করে ইট বসিয়ে শ্রীসত্য সাই হাসপাতাল নির্মাণ করেছিলেন। পরে একবার বাবা বলেছিলেন যে ঐ যে ভলান্টিয়াররা হাসপাতালটি তৈরী করেছিল তাদের ভালবাসার জন্যই ঐ হাসপাতালে সব অলৌকিক রোগ নিরাময় হয়ে চলেছে। এরপর ভগবান বাবাকে তাঁর মাতা বলেছিলেন, আমার আর কোনও দুশ্চিন্তা নেই। তুমি আমার আকাঙ্খা পূর্ণ করেছ এবং গ্রামবাসীদের কষ্ট বহুলাংশে কমে গিয়েছে।” বাবা মৃদু হেসে বলেছিলেন, “তোমার যদি আরও কিছু বাসনা থেকে থাকে তাহলে এখনই তা আমার কাছ হতে চেয়ে নাও। ঈশ্বরাম্মা অত্যন্ত বিনম্রভাবে বলেছিলেন, “স্বামী! তুমি তো জান যে শুধুমাত্র বর্ষাকালে চিত্রাবতী নদীতে জল থাকে; কিন্তু গ্রীষ্মকালে তা শুকিয়ে ফোঁটা ফোঁটা জলে পর্যবসিত হয়ে যায় এবং গ্রামবাসীরা পানীয় জল পায় না। তাই দয়া করে গ্রামে কয়েকটা কুয়ো তৈরী করে দাও।” ভগবান বাবা বলেছিলেন, এই সকল ছোট ছোট কুয়োতে আমি থেমে থাকব না। সমগ্র রায়েলসীমা অঞ্চলে আমি পানীয় জলের ব্যবস্থা করে দেব।”
অবতারের সঙ্গে থাকার ফলে ও অবতারের সঙ্গ লাভ করে ঈশ্বরাম্মা নারী শিক্ষার গুরুত্ব বুঝতে পেরেছিলেন এবং বাবা যখন অনন্তপুরে মহিলা কলেজ প্রতিষ্ঠা করে দিয়েছিলেন তখন ঈশ্বরাম্মা খুবই আনন্দিত হয়েছিলেন।
মাতার তিনটে ইচ্ছা পূর্ণ করবার ভিতর দিয়ে যা শুরু হয়েছিল তা বর্তমানে শুধুই ঐ পূট্টাপর্তী ও তার আশেপাশের গ্রামের কল্যাণ সাধন করছে না, সমগ্র পৃথিবীর কল্যাণে তা নিয়োজিত। ভগবান বাবা আমাদের স্কুল ও বিশ্ববিদ্যালয় দিয়েছেন যেখানে কে.জি. হতে পি.জি. পর্যান্ত অবৈতনিক শিক্ষা দেওয়া হয়ে থাকে এবং যেখানে মানবিক মূল্যবোধের বীজ বপন করে পালন করা হয় যাতে ছাত্রছাত্রীরা আদর্শ মানব হয়ে উঠতে পারে। তারপর বিশাল দুটো সুপার স্পেসালিটি হাসপাতালে সকল প্রকার চিকিৎসারও সুযোগ বিনা ব্যয়ে দেওয়া হয়। হাজার হাজার গ্রামবাসীদের পানীয় জল প্রদান করা হয়। ছোট ছোট বাড়ী তৈরী করে বিধবাদের আর্থিক সুরক্ষা দানও হল ভগবান বাবার অনন্ত প্রেমের দানের অন্তর্ভূক্ত।
মুক্তিলাভের শেষ কয়টি দিন হোয়াইটফিল্ডের বৃন্দাবন আশ্রমে থাকাকালীন মাতা ঈশ্বরাম্মা পূর্ণ জাগ্রত অবস্থায় ভগবান বাবাকে শ্রীরামরূপে দর্শন করেছিলেন। ৬ই মে, ১৯৭২ তারিখের সকালে। প্রতিদিনের মতই ঈশ্বরান্মা স্নান সেরে নিয়ে সকালের কফি পান করেছিলেন। হঠাৎ তিনি যখন বাথরুমে যাচ্ছিলেন তিনি চিৎকার করে উঠেছিলেন, “স্বামী, স্বামী, স্বামী” এবং বাবা উত্তর দিয়েছিলেন, “আসছি, আসছি, আসছি”। ঐ সময়ে তার পুত্র, পরমেশ্বরের পূর্ণ অবতারের উপস্থিতিতে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছিলেন। বাবা বলে থাকেন, যেভাবে একজন তার দেহত্যাগ করে থাকেন তাই হল তার ধার্মিকতার প্রমাণ।”