প্রথম দিককার কিছু লীলা
পুট্টাপর্তীতে প্রথম দিকে, যখন সদ্য ঘোষিত সাইবাবা উড়ভকোন্ডা হতে সবেমাত্র ফিরে এসেছিলেন, তখন তিনি সুব্বাম্মার বাড়ীতে থাকতেন। সুব্বাম্মা তাকে প্রেম ও স্নেহের সঙ্গে দেখাশোনা করতেন এবং নিজের বড় বাড়ীটিতে সকল ভক্তদের স্বাগত জানাতেন। ভক্ত সংখ্যা বাড়তে থাকায় একটি শেড তৈরী করা হয়েছিল, মাস পার হতে হতেই শেডটিকে ক্রমশঃ বড় করতে হল। যাই হোক, তাঁকে দর্শন করতে যারাই আসত তাদেরই খাওয়াবার জন্য সাইবাবা জোরের সঙ্গে বলতেন। সুব্বাম্মার বাড়ীর এক বৃদ্ধা মহিলা একটি বিস্ময়কর অভিজ্ঞতার কথা বলেছিলেন- প্রায়ই ভক্তদের জন্য রান্না করা খাবার কম হয়ে যাবার সম্ভাবনা দেখা যেত। বাবা তাদের দুটো নারকেল নিয়ে আসতে বলতেন। বাবা একটি নারকেলকে অন্য নারকেল দিয়ে আঘাত করে দুটোকেই সমান দু’ভাগে ভেঙ্গে নিয়ে নারকেলের জল রান্না করা ভাত ও অন্যান্য খাবারের উপর ছড়িয়ে দিতেন। তারপর ঐ খাবার সকলকে পরিবেশন করবার জন্য তিনি আদেশ দিতেন। আর তাতেই ঐ খাবার সকলের জন্য যথেষ্ট হয়ে যেত।
কল্পতরু
ভক্তদের সংখ্যা ক্রমাগত অধিক সংখ্যায় বেড়ে যেতে থাকায় পুরোনো শেডটি তাদের সকলের প্রার্থনা ও ভজনের জন্য খুবই ছোট হয়ে গেল। বাবা ভক্তদের নিয়ে প্রতিদিন অপরাহ্নে চিত্রাবতী নদীর তীরের বালির উপর নিয়ে বসতেন এবং সেখানেই ভজন হত। ঐ সময় চিত্রাবতী নদীর বাঁদিকের তীরে পাহাড়ের উপর একটি মাত্র তেঁতুল গাছ বড় হয়ে উঠছিল। গাছটি “কল্পবৃক্ষ” নামে পরিচিত হয় কারণ বাবা ভক্তদের নিয়ে ঐ গাছটির কাছে যেতেন এবং ঐ গাছটি হতে নানা। ধরনের ফল পেড়ে দিতেন- একটি ডাল হতে আপেল, অন্য ডাল হতে আম, তৃতীয় ডাল হতে কমলালেবু, চতুর্থ ও পঞ্চম ডাল হতে ন্যাসপতি ও ডুমুর পেড়ে নিতেন। সাইবাবা বলেছিলেন যে তিনি যে কোনও গাছকে যে কোনও সময়েই “কল্প-বৃক্ষ” তৈরী করে দিতে পারেন, কারণ তিনি নিজেই হলেন কল্পতরু।
পাহাড়ের উপর এখনও সেই তেঁতুল গাছটি রয়েছে, যেখান হতে বাবা ভাগ্যবান ভক্তদের বহু বিস্ময়কর দর্শন দিয়েছিলেন। কেউ কেউ বাবার মস্তককে ঘিরে গোলাকার উজ্জ্বল আলোক দেখতে পেয়েছিলেন, অথবা কেউ কেউ তার ভ্রযুগলের মাঝখান হতে চোখ ধাঁধানো তীব্র আলোর শিখা দেখেছিলেন, কেউ কেউ আবার বিশাল শিরডি সাইবাবার উজ্জ্বল মূর্তি দেখেছিলেন। কেউ কেউ পূর্ণচন্দ্রের ভিতর সাইবাবার মুখ দেখেছিলেন। কিংবা আগুনের স্তম্ভ দেখতে পেয়েছিলেন। বহু ভক্তকে বাবা দশাবতারের দর্শন দান করেছিলেন।
কৃষ্ণরূপে সাই
একদিন বাবা একটি গাছের ডাল থেকে একটি দোলনা ঝুলিয়ে দিয়েছিলেন এবং তাতে তিনি বসে উপর নীচ করে দুলছিলেন, আর সবাই খুবই আনন্দ পাচ্ছিলেন। হঠাৎ তিনি মাটিতে বসে থাকা ভক্তদের বলেছিলেন, “দেখ”। তারা মুখ তুলে বৃন্দাবনের মনোহর গোপবালক, শ্রীকৃষ্ণকে নানা ফুলে সুসজ্জিত দোলনায় মহিমময় ভঙ্গীতে বসে থাকতে দেখতে পেলেন। ভক্তদের ভিতর কেউ কেউ জ্ঞান হারিয়ে ফেললে বাবা হাত ঘুরিয়ে চাল সৃষ্টি করে তাদের উপর ছড়িয়ে দিয়ে তাদের জ্ঞান ফিরিয়ে আনলেন।
অন্য একদিন শ্রীকৃষ্ণের এক গোঁড়া ভক্তকে জিজ্ঞেস করেছিলেন যে তিনি শ্রীকৃষ্ণের বাঁশীর সুমধুর সুর শুনতে চায় কি না। ভক্তকে তখন সত্যের বুকে কান ঠেকাতে বলা হল এবং কি আশ্চর্য! তিনি শ্রীকৃষ্ণের বাঁশীর মনোমুগ্ধকর সুর শুনতে পেলেন। সাইবাবা আমাদের বলেন যে, বাঁশীর মতই আমাদের সোজা ও ফাঁপা হতে হবে– সকল প্রকার চাতুরী ও ষড়রিপু হতে মুক্ত হতে হবে। একমাত্র তাহলেই আমরা তাঁর হাতের বাদ্যযন্ত্র হতে পারব।
ভেংকাম্মার ছবি
সত্য সাই বাবার দিদি ভেংকাম্মা তাঁর কাছে শিরভি সাই বাবার একটা ছবির জন্য বারবার অনুরোধ করছিলেন, কারণ শিরডি সাইবাবাকে নিয়ে অনেকগুলো ভজন সত্য সাইবাবা রচনা করেছিলেন। বাবা তাকে একটি বিশেষ বৃহস্পতিবার দেবেন বলেছিলেন। কিন্তু বিশেষ ঐ বৃহস্পতিবারের আগেই বাবা উরভকোন্ডায় চলে গিয়েছিলেন। বাবার দিদি ঐ বিষয়টি ভুলে গিয়েছিলেন কারণ তিনি জানতেন যে, একদিন না একদিন তিনি ঐ ছবি পাবেনই। রাত্রি এল এবং সারা পূট্টাপর্তী ঘুমিয়ে পড়ল। সদর দরজার বাইরে কেউ একজন “আম্মাই, আম্মাই” বলে ডাকছিলেন। দিদি উঠে দরজা খোলেননি, কারণ ঐ ডাকাডাকি বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। তিনি ভাবলেন যে, কেউ হয়ত তাদের প্রতিবেশীদের কাউকে ডাকছে। তিনি বিছানায় শুয়ে রইলেন। তিনি সেই ঘরেরই এক কোণে রাখা ধানের বস্তার পেছনে খস্ খস্ শব্দ শুনতে পেলেন। তিনি ভাবলেন যে, শব্দটা হয়ত কোনও ইঁদুর অথবা সাপ করছে। তিনি একটা প্রদীপ জ্বালালেন এবং খুঁজে দেখলেন। কি অবাক কান্ড! তিনি শিরডি সাইবাবার একটি ছবি দেখতে পেলেন। ঐ সময় বাবা উরভকোন্ডায় থেকেও রহস্যজনকভাবে তাকে ছবিটি উপহার দিয়েছিলেন। ছবিটি এখনও সযত্নে রাখা আছে।
কেউই বাবার ক্ষতি করতে পারে না
একবার কিছু লোক বাবার প্রতি ঈর্ষাপরায়ণ হয়ে তিনি যে কুঁড়ে ঘরে ঘুমোচ্ছিলেন তাতে আগুন লাগিয়ে দিয়েছিল। ছয় থেকে নয় বছর বয়েসের প্রায় দশ জন বালক বাইরে বারান্দায় ঘুমোচ্ছিল। দুষ্কৃতীরা বাইরে থেকে সত্যের ঘরে তালা দিয়ে ঘরের ছাদে আগুন লাগিয়ে দিয়েছিল। শিশুরা চীৎকার করতে লাগল, “রাজু! রাজু!” ছোট জানালাটি দিয়ে সত্য উঁকি মেরে মৃদু হেসে বলেছিলেন, “ভয় পেয়ো না।”
ছোট ছেলেরা তাদের চোখ বন্ধ করে এমনভাবে “রাজু! রাজু!” বলে চিৎকার করতে লাগল যেন সেটা হল একটা মন্ত্র। ঘরটির ছাউনি খড় দিয়ে করা হয়েছিল বলে দ্রুত আগুন ছড়িয়ে পড়ছিল। হঠাৎ মেঘ করে প্রবল বৃষ্টি আরম্ভ হল এবং আগুন পুরোপুরি নিভে গেল। ঐ বৃষ্টি ঠিক ঐ কুঁড়ে ঘরের উপর পড়ছিল, আশেপাশে অন্য কোথাও নয়। শিশুদের আনন্দ ছিল অবর্ণনীয়। “রাজু, রাজু, কি অলৌকিক কান্ড! তোমাকে ছাড়া আমরা বাঁচতেই পারব না”, তারা কাঁদতে কাঁদতে বলল, ভগবান বাবা বলেন, এই উপদেশের উপর বিশ্বাস রাখবে ‘ধর্ম এব হতো হন্তি, ধর্মো রক্ষতি রক্ষিতাঃ’ অর্থাৎ তুমি যদি ধর্মকে বিনষ্ট কর, তাহলে ধর্ম দ্বারা তুমি বিনষ্ট হবে, তুমি যদি ধর্মকে রক্ষা কর তাহলে ধর্মই তোমাকে রক্ষা করবে।
পঞ্চভূতের (ভূমি, জল, আগুন, বাতাস ও আকাশ) উপর ভগবান বাবার পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ তাঁর সর্বশক্তিমত্তাকেই আমাদের কাছে তুলে ধরে। পরদিন এই ঘটনা সম্পর্কে সুবাম্মা জানতে পেরেছিলেন। তিনি ব্যাপক অনুসন্ধান করে দোষীদের ধরতে পেরেছিলেন। সুব্বাম্মা ছিলেন খুবই ধনী. গ্রামের সমস্ত জমির মালিক তিনিই ছিলেন। সুতরাং তিনি আদেশ দিয়েছিলেন যে ঐ সমস্ত দোষীদের গ্রাম থেকে বের করে দিতে হবে। তখন সত্য তার হাত ধরে মিনতি করে বলেছিলেন, “আমার জন্য এদের শাস্তি দিও না। দয়া করে এদের ক্ষমা করে দাও। দয়া করে এদের তাড়িয়ে দিও না।” এই হল সাইয়ের প্রেমময় এবং ক্ষমাশীল প্রকৃতি।
বিষ মাখানো বড়া
কিছু লোক তাদের নির্বুদ্ধিতার জন্য কিশোর সত্যকে বিষ খাওয়াবার চেষ্টা করেছিল। এক উৎসবের দিনে সাইবাবা দুজন ভক্তকে সঙ্গে করে গ্রামের কয়েকটি বাড়ীতে গিয়েছিলেন। প্রতিটি বাড়ীতে তিনি কিছু খাবার গ্রহণ করেছিলেন কিন্তু তিনি যে বাড়ীতে বিষ দেওয়া খাবার তৈরী হয়েছিল সেই বাড়ীতে যখন পৌছুলেন তখন তিনি অতিরিক্ত উৎসাহ দেখিয়ে আরও বেশী বেশী করে খাবার খেতে চাইলেন, কিন্তু নজর রাখলেন যেন তার সঙ্গীরা ঐ মারাত্মক খাবার না খায়। সুব্বাম্মার বাড়ীতে পৌছে ঐ বিশেষ বাড়ী হতে তাকে আমন্ত্রণ জানাবার রহস্য বেশ কয়েকজন লোককে জানালেন এবং এসব কিছুর নির্বুদ্ধিতার কথা ব্যক্ত করে ঘটনার জন্য হাসাহাসি করতে লাগলেন।
কিছুক্ষণ পর তিনি আস্ত আস্ত বড়াগুলো বমি করে বের করে দিলেন! আশেপাশের লোকেরা গোপনে পরীক্ষা করে দেখলেন যে বড়াগুলো বিষাক্ত ছিল কিনা। দেখা গেল সত্য সত্যই তা বিষাক্ত ছিল!
এই ঘটনা সম্পর্কে ভগবান বাবা বলেছেন যে এতে তার ক্ষতি করবার চেষ্টা ছিল না, তিনি বিষ খেয়ে বাঁচতে পারেন কিনা তা পরীক্ষা করবার জন্য ঐ কাজ করা হয়েছিল। বাবা শুধু ঐ মহিলাকে ক্ষমা করে দেননি, কিছুদিন পর মহিলাটিকে তিনি প্রভূ কার্তিকেয়র একটি মূর্তি উপহার দিয়েছিলেন। মন্দের প্রতিদানে ভাল ফিরিয়ে দেবার দৃষ্টান্ত এর চেয়ে আর বেশী কিছু হতে পারে না।
একই বাবা
সত্য তাঁর সামনে দাড়িওয়ালা বৃদ্ধ ফকিরের বেশে দেখা দিয়েছেন বলে একবার সুব্বাম্মাকে ঈশ্বরাম্মা বলেছিলেন। আরেকটি রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতার কথাও তিনি ব্যক্ত করে বলেছিলেন যে, বাবা একবার তাকে বলেছিলেন, “শোন, শিরডি বাবার উপস্থিতি এখানে রয়েছে।” তিনি এবং ঐ ঘরের প্রত্যেকেই কাঠের খড়মের শব্দ তাদের দিকে এগিয়ে আসতে শুনতে পেয়েছিলেন। বাবা যেখানে বসেছিলেন সেখানে যখন তারা পৌছে গেলেন তখন ঐ পায়ের শব্দ বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। যখন প্রথম শব্দটি শোনা গিয়েছিল তখন মাতা ঈশ্বরাম্মা রাগের সঙ্গে বলেছিলেন, “পায়ে চটি পরে কে এখানে আসছে?” …..ঐ অনুভূতি এতটাই বাস্তব ছিল, ঐ দর্শন এতটাই সত্য ছিল।
মাতা ঈশ্বরাম্মার অভিজ্ঞতা যখন এইরকম ছিল তখন পিতা পেড্ডা ভেংকাপ্পা রাজু অন্য একটি ঘটনার কথা বলেছিলেন। একদিন অপরাহে কৃষ্ণমাচারী নামে এক উকিলসহ কয়েকজন পেনুকোন্ডা হতে এসে ভেংকাপ্পাকে প্রতারণার দায়ে অভিযোগ করে বলেছিল যে তিনি সাইবাবা সম্বন্ধে নানা বানানো গল্প বলে সরল গ্রামবাসীদের ভুল পথে চালনা করছেন। এতে ভেংকাপ্পা খুবই দুঃখ পেয়েছিলেন এবং ভগবান বাবার দিব্যত্ব সম্পর্কে সন্দেহবাদীদের বিশ্বাস করার জন্য তিনি সত্যকে বলে ছিলেন। এই সকল সন্দেহবাদীদের সুবাম্মা শ্রী পেড্ডা ভেকাপ্পা রাজুর বাড়ীতে নিয়ে গিয়েছিলেন কারণ ঐ সময় সত্য ঐ বাড়ীতেই ছিলেন।
সেখানে ঐ বাড়ীর ভেতরের একটি ঘরে সুব্বাম্মা ও পেনুকোন্ডার দলটিকে সত্য শিরডি সাইবাবার সমাধি ও তার চারিপাশের দৃশ্য দেখালেন। তাদের কাছে মনে হচ্ছিল যে সেখানে এক বিশাল এলাকা জুড়ে, প্রায় মাইলের পর মাইল এলাকা জুড়ে, শিরডির নানা দৃশ্য দেখাযাচ্ছিল। সমাধিস্থলের ফুল, সুগন্ধি, আগরবাতি এবং তার ধোঁয়া এবং একজন লোককে একপাশে বসে আপন মনে জপ করতে তারা দেখেছিলেন। বাবা তাদের হনুমান মন্দিরটি দেখালেন এবং অনেকটা দূরের নিমগাছটির প্রতি তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করলেন। শ্রীপেড্ডা ভেংকাপ্পা রাজুকে সবশেষে ভিতরে নেওয়া হয়েছিল এবং তিনিও একেবারে পরিবর্তিত লোক হয়ে বাইরে এলেন। সন্দেহবাদী লোকেরা ক্ষমা প্রার্থনা করলেন। ঈশ্বরাম্মা ও পেড্ডা ভেংকাপ্পা রাজু স্থির নিশ্চিত হলেন যে, ষোল বছরের বালক সত্য বাস্তবিকই শিরডির সাইবাবার অবতার।
মাদ্রাজের এক মহিলা মরিয়া হয়ে উঠেছিল কারণ তার ছেলে মারাত্মক রোগে আক্রান্ত ছিল। নিজের ছেলেকে সে শিরডি সাই বাবার ছবির সামনে শুইয়ে দিল। বেশ কয়েক বছর পরে সে সত্য সাইবাবার কথা শুনতে পেল। ছেলেকে নিয়ে সে পূট্টাপর্তীতে এল, তখন ছেলেটি বেশ লম্বা বলিষ্ঠ যুবক। তাদের দেখা মাত্র বাবা ছেলেটির মাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, পনের বছর আগে তুমি তোমার ছেলেকে আমার প্রযত্নে সমর্পন করেছিলে, তাই না?
বাস্তবিকই একই বাবা আবার এসেছেন। উভয় অবতারের ভিতর একই সরলতা, প্রগাঢ় প্রজ্ঞা, সর্বপরিবেষ্টক প্রেম এবং একই সর্বব্যাপীতা, সর্বশক্তিমত্তা আর সর্বজ্ঞতা দেখতে পাওয়া যায়।