কর্মণ্যেবাধিকারস্তে – বিশদ পাঠ
কর্মে তোমাদের অধিকার আছে। তার ফলের জন্য উদগ্রীব হয়োনা। ফলটাই যেন তোমার কর্মের উদ্দেশ্য না হয়ে ওঠে। কিন্ত ঈশ্বর এটাও চাননা যে আমরা এই নির্দেশের কারণে কর্ম ত্যাগ করে নিষ্ক্রিয় হয়ে যাই। ফলের আশা করে কাজ করা উচিৎ নয় কারণ তা বন্ধনের সৃষ্টি করে।
একমাত্র মানুষকেই ইচ্ছার স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছে। যদি সে তার কর্তব্য পালন করে, ঈশ্বরের নির্দেশ মেনে চলে, ফলের প্রতি অনাসক্ত হয়ে কর্ম করে,এবং সবটাই ঈশ্বর উপলব্ধির জন্য করে, তাহলে সে সহজেই সফল হতে পারে। কর্মেই মানুষের অধিকার আছে,কর্ম ত্যাগের অধিকার মানুষের নেই। অবশ্য করণীয় কাজগুলিকে অবহেলা করা উচিৎ নয়। কর্তব্য না করা তামসিক আচরণ। আরামপ্রদ নয় বলে কর্তব্য না করা রাজসিক আচরণ।
কর্ম যোগীর শ্রেষ্ঠ উদাহরণ রাজা জনক। তিনি রাজা হিসাবে সকল কর্তব্য পালন করতেন কিন্ত মনে, মনে জানতেন যে তিনি ঈশ্বরের হাতের যন্ত্র মাত্র। তাঁর সব কাজ তিনি অনাসক্ত হয়ে করতেন বলে, তিনি সারাজীবন শান্তিতে কাটিয়েছিলেন এবং মৃত্যুর পর তিনি মোক্ষ লাভ করেছিলেন।
এই শ্লোকে কর্মযোগের পিছনে যে দর্শন রয়েছে, তার কথা বলা হয়েছে। কৃষ্ণ এই শিক্ষাই দিয়েছেন যে অন্তরকে শুদ্ধ করার জন্য আমাদের নিষ্ঠার সঙ্গে, কিন্তু ফলের আশা না করে কাজ করতে হবে।
জাগতিক জীবনে অনেক সময়েই দেখা যায় যে যত ভাল ফল লাভের আশা করা যায় তত ভাল ফল না হওয়ার আশংকায়, আমাদের মধ্যে অনেকেই সমাজের উন্নতির জন্য করণীয় মহান কাজে হাত দিতে ভয় পাই। কিন্ত আমাদের ভাগ্যে যদি সেরকম কোনও কাজের সুযোগ আসে, তাহলে আমাদের শ্রেষ্ঠ পারদর্শিতা দিয়ে, সর্ব শক্তি নিয়ে সেই কাজে ঝাঁপিয়ে পড়া উচিৎ। আমরা যদি যতটা পারি ভাল করে কাজটা করতে পারি, তাহলে ফলের জন্য আমাদের চিন্তা করা উচিৎ নয়। ফল অবশ্যই ভাল হবে। কিন্ত ঈশ্বরের ইচ্ছা যদি অন্যরকম হয়, সেক্ষেত্রে যেহেতু ঈশ্বর কর্মফল দাতা, আমাদের সেটা মেনে নিতে হবে এবং তাঁর চরণে নতি স্বীকার করতে হবে। সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে, আমাদের সর্ব শক্তি নিয়ে, সর্বোৎকৃষ্ট ভাবে কর্ম করার অধিকার আছে। বাকিটা ঈশ্বরের হাতে ছেড়ে দিতে হবে। সবসময় ফলের জন্য ব্যস্ত হলে ও ফলভোগের জন্য লালায়িত হলে শক্তি ক্ষয় হয়। বাসনা ও চাহিদার ফলে হাতে যে কাজ থাকে, তার প্রতি মনোসংযোগ নষ্ট হয়।
দ্বিতীয়তঃ আমাদের কারোরই এমন ভাবা উচিৎ নয় যে আমাদের কর্ম ত্যাগ করে অলস হয়ে বসে থাকার অধিকার আছে। কিছু কর্মের ফল পাওয়ার আশা নেই বলে বা ফল পাবার সময় যখন হবে তখন পাওয়া যাবে, তার হয়তো বিলম্ব আছে বলে, কারো চেষ্টা বা কর্ম ছেড়ে বসে থাকা উচিৎ নয়।
বর্তমানই ভবিষ্যত নির্মাণ করছে। চাষী যদি ভবিষ্যতে তার শস্যের ক্ষতি হতে পারে এই ভয়ে, বর্তমানে তার কাছে চাষ করার এবং বীজ বপনের যে সুযোগ আছে তা নষ্ট করে,তবে এটা সুনিশ্চিত যে ভবিষ্যতে ঘরে তোলার মতন কোন ফসলই তার থাকবেনা। তাই ভবিষ্যত উজ্জ্বল হোক চাইলে বর্তমানকে সম্যক ভাবে ব্যবহার করতে হবে।
কিন্ত কোন কাজ নিষ্ঠাভরে করতে গেলে পরে কী হবে তা নিয়ে অহেতুক মাথা ঘামালে চলেনা। আমরা যদি ভয় বা দুশ্চিন্তা নিয়ে কোনমতে কাজ না সেরে,সম্পূর্ণ দেহ ও মন দিয়ে, নিঃস্বার্থ ভাবে কোন কাজ করি তার অর্থ দাঁড়ায় এই যে আমরা আপাততঃ বর্তমানেই বাস করছি। পরে ভবিষ্যত তার সম্পূর্ণতা খুঁজে নেয়।
ধর্মের জন্য যুদ্ধ করার মতন মহান কাজ করতে অর্জুন কৃষ্ণের দ্বারা উদ্বুদ্ধ হন। তাঁকে এই উপদেশ দেওয়া হয়েছিল যে তিনি যেন এই কাজে তাঁর সর্বোত্তম শক্তির প্রয়োগ করেন। তার জন্য নিজের আত্মীয়স্বজনকেও যদি বধ করতে হয়,তাতেও কোন ক্ষতি নেই কারণ উদ্দেশ্য মহৎ এবং জয় সুনিশ্চিত।
সুতরাং আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, কর্ম কখনও মন্দ হয়না কিন্ত বাসনার সঙ্গে যুক্ত হওয়ার ফলে, সেটি আমাদের কর্ম ও তার ফলের চক্রে জড়িয়ে পুণর্জন্মের দিকে ঠেলে দেয়।
ভাল কর্মী হবার জন্য আমাদের চারটি নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। সেই কর্মযোগী হতে পারে যে কঠিন পরিশ্রম করে, যার কর্ম ফলের প্রতি কোন আসক্তি নেই, কোনো কর্মের ফল না পেলে যে হতাশ হয় না, রেগে যায়না বা বিষণ্ণ হয়না। নিজের কাজ না করে অলস হয়ে বসে থাকেনা।
আমাদের স্বামী বলেন যে একাগ্র কঠিন শ্রম; মানুষকে উদ্বুদ্ধ করে. আনন্দ ও ভাবমত্ততায় মানুষ তখন নিজেকেই ভুলে যায়। ভাল কর্মীর কাছে তার কাজটাই পুরস্কার হয়ে যায়। তিনি আরও বলেন যে ঈশ্বরের কাছে পৌঁছনোর জন্য যে কোনো সাধনা, নিজেই নিজের পুরস্কার।
পৃথিবীর সেরা কর্মযোগী হলেন সূর্য, ধনী, দরিদ্র, সৎ, অসৎ–‘তাঁর আলো সবার জন্য, ভেদাভেদহীন। তিনি নিষ্কাম কর্ম করেন। আমাদের সব কাজকে মনে করতে হবে, ঈশ্বরের মহিমার জন্য সম্পাদিত যজ্ঞ আর তাই কর্ম ফলের প্রতি কোন আসক্তি থাকা চলবেনা। চেষ্টা ও পরিশ্রম মানুষের কর্তব্য। সফল হওয়া বা না হওয়া ঈশ্বরের কৃপার ওপর নির্ভর করে।’‐– বাবা
গীতাবাহিনীর দিব্য ভাষণ–বাবা
যে কোন কর্মেরই ফল বা পরিণতি থাকে। প্রত্যেকে কর্মের ফল আছে। সেই ফল থেকে আবার আর একটি কর্মের উৎপত্তি হয়। বীজ ও গাছের মতন এই কর্ম ও তার ফল , ফল ও কর্মের চক্র চলতেই থাকে। এগুলি পৃথিবীর স্বাভাবিক চক্র। তাই যদি হয় তাহলে কর্মফলের বিষয়ে বিশেষ ঔৎসুক্যের কারণ কী?
অতীতে অসৎ কর্ম করেছি বলে এই জন্মে দুঃখ, কষ্ট ভোগ করছি। কিন্ত তার জন্য কর্ম না করা ঠিক নয়। কর্মের গুরুত্ব উপলব্ধি করে সৎভাবে কর্ম করা উচিৎ। যে বীজটি বপন করা হল তার ওপর কর্মটি সুখ দেবে না দুঃখ, তা নির্ভর করবে। অতীত কর্মের ফলে যে দুঃখ আসে তার থেকে কীভাবে মুক্তি পাওয়া যাবে? বর্তমানে সৎ কর্মে নিযুক্ত হয়েই সেই দুঃখকে দূর করা সম্ভব।
স্বামী বলেন, “যদি ৬০টি সৎ কর্ম কর তাহলে একটি সৎ ভাবনা তোমার মধ্যে আসবে। দেহকে ঘড়ির সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে। কর্ম হল ঘড়ির সেকেন্ডের কাঁটা। অনুভূতি হল মিনিটের কাঁটা আর তোমার আনন্দকে ঘন্টার কাঁটার সঙ্গে তুলনা করা হয়। যদি আমরা ৬০ টি ভাল কাজ করি তাহলে মিনিটের কাঁটা একটি সৎ অনুভব দেবে; এইভাবে ৬০টি সৎ অনুভব লাভ করলে ঘন্টার কাঁটা আমাদের সুখ দিতে একঘর সরে যাবে।”
ভগবদ্গীতা কখনই কর্ম ত্যাগ করে সন্ন্যাস নিতে বলেনা। গীতা আমাদের অনাসক্তির শিক্ষা দেয়। অর্থাত কর্ম ফলের প্রতি অনাসক্তি বাড়াতে বলে।
স্বামী প্রায়শই বলে থাকেন যে আমরাই আমাদের ভাগ্যের জন্য দায়ী। তিনি একথাও বলেন,
“কর্মের বীজ বপন করে, প্রবণতার ফসল ঘরে তোল;
প্রবণতার বীজ বপন করে অভ্যাসের ফসল ঘরে তোল;
অভ্যাসের বীজ বপন করে চরিত্রের ফসল ঘরে তোল;
Sচরিত্রের বীজ বপন করে ভাগ্যের ফসল ঘরে তোল।”
সুতরাং আমরা যদি সৎ কর্ম করি, আমাদের ভাগ্যও ভাল হবে।