জন্ম এবং প্রথম শৈশব
জন্ম এবং প্রথম শৈশব
কালক্রমে ভগবানের পছন্দ করা মাতা, ঈশ্বরাম্মা আরেকটি পুত্র চাইলেন এবং সে কারণে তিনি সত্য নারায়ণ ব্রত পালন করতে লাগলেন। শীঘ্রই স্পষ্ট হয়ে উঠল যে তিনি আরেকটি সন্তান লাভ করে আশীর্বাদধন্য হতে চলেছেন।
ঠাকুর্দা এবং তাঁর দুই পুত্র মহাকাব্য ও পৌরাণিক গল্পের উপর রচিত গ্রামীন যাত্রা পালায় আগ্রহী ছিলেন বলে, তাঁদের বাড়ীতে মহড়া চলত এবং দেওয়ালের পেরেকে একটি বিশাল তানপুরা ঝুলত এবং তারই নীচে মেঝের উপর মাদল রাখা থাকত। সাধারণত এদুটো চুপচাপই থাকত, কিন্তু আকাঙ্খিত পুত্রের জন্ম এগিয়ে আসছে বলে যখন বোঝা যাচ্ছিল তখন মাঝরাতে অথবা ভোরে তানপুরার সুমধুর সুরের সঙ্গে মাদলের মৃদু সঙ্গীতের শব্দে পরিবারের লোকেরা জেগে উঠত, মনে হত যেন কারো নিপুণ হাতে এগুলো বাজছে।
এই সকল রহস্যজনক ঘটনার উত্তর খোঁজার জন্য শ্রীপেড্ডা ভেঙ্কাপ্পা রাজু বুক্কাপটনমে ছুটে গেলে সেখানকার এক বিরাট শাস্ত্রীয় পন্ডিত তাঁকে জানায় যে এটি হল মৈত্রী, শৃঙ্খলা, আনন্দ ও আধ্যাত্মিক উন্নতি বর্ষণকারী এক “কল্যাণকর শক্তির” উপস্থিতি ঘোষণা করছে।
এভাবেই দিন চলবার পর ২৩ শে নভেম্বর, ১৯২৬ তারিখে সূর্যোদয়ের কালে এক পুত্র সন্তানের, আমাদের সাই বাবার জন্ম হয়। ঈশ্বরাম্মা সত্যনারায়ণ ব্রত পালন করতে করতে এক সময় বুঝতে পেরেছিলেন যে সন্তানের জন্ম হবার সময় উপস্থিত হয়েছে, তখন তাঁর শাশুড়ী, লক্ষাম্মার কাছে খবর পাঠানো হল। তিনি তখন সত্য নারায়ণ ব্রত করবার জন্য পুরোহিতের বাড়ীতে ছিলেন। সত্যনারায়ণ দেবতার কৃপালাভে তিনি এতটাই আস্থাবান ছিলেন এবং ঐ বৃদ্ধা এতটাই অটল ও নিয়মানুগ ছিলেন যে, নিজের পূজা ও প্রার্থনায় ছেদ ঘটাতে তিনি রাজী হলেন না এবং পুরো পূজো অনুষ্ঠান শেষ হবার পরই তিনি কিছু ফুল ও বিগ্রহের স্নান-জল নিয়ে বাড়ি ফিরেছিলেন। ফুলটিকে সশ্রদ্ধ চিত্তে গ্রহণ করে ঈশ্বরাম্মা নিজের চুলে গুঁজে নিলেন, স্নান জল পান করলেন এবং কয়েক সেকেণ্ডের ভিতর শিশুর জন্ম হল।
দিনটি ছিল পবিত্র কার্তিক মাসের সোমবার, শিবপূজার জন্য নির্দিষ্ট, তাই গ্রামবাসীরা তখন শিব স্তোত্র পাঠ করছিল। লগ্নস্থ নক্ষত্র ছিল আর্দ্রা, দিনটি ছিল বিশেষভাবে শুভ এবং শিবপুজোর জন্য নির্দিষ্ট মাস, দিন ও নক্ষত্রের দুর্লভ মিলন ঘটেছিল। বছরটি ছিল অক্ষয়-বর্ষ। ক্ষয়হীন, সদাপূর্ণ।
ছোট্ট শিশুটি ছিলেন বর্ণনাতীতভাবেই স্নেহ-ভালবাসার পাত্র এবং শাস্ত্রে অবতারের যে আধ্যাত্মিক শক্তির কথা বলা হয়েছে তার সবটুকু নিয়ে তিনি জন্মেছিলেন – আজকের দিনেও তিনি নিজের দিব্য সংকল্পের সাহায্যে অলৌকিক লীলা প্রদর্শন করে থাকেন।
ঘরের এক কোণে একটি মাদুর পেতে তার উপর চাদর বিছানো ছিল। ঠাকুরমা ঐ বিছানায় শিশুটিকে শুইয়ে দিলেন। সহসা ঘরে উপস্থিত মহিলারা লক্ষ্য করলেন যে শিশুটি উপরে উঠছে আর নামছে – শিশুটির দুইধারের বিছানার চাদরটি উঠছে ও নীচে নামছে। রুদ্ধশ্বাসে কয়েক সেকেণ্ড ধরে ঘটনাটি লক্ষ্য করে শিশুটিকে হঠাৎ করে তুলে নিলে তারা আশ্চর্য হয়ে লক্ষ্য করলেন যে, বিছানার চাদরের নীচে একটি সাপ কুণ্ডলী পাকিয়ে রয়েছে। আদি শেষনাগের ভূমিকায় একটি সাপ কুণ্ডলী পাকিয়ে নবজাতক বিষ্ণুর অবতারকে একটি বিছানার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন! শিশুর নাম রাখা হয়েছিল সত্যনারায়ণ, কারণ সত্যনারায়ণ দেবতার কাছে প্রার্থনার ফলেই আরেকটি পুত্র সন্তান লাভের জন্য তাদের আকাঙ্খা পূর্ণ হয়েছে। নামকরণ অনুষ্ঠানে তার কোমল কানে যখন নামটি বলা হল তখন তিনি মৃদু হেসেছিলেন, কারণ বাস্তবিকই তিনি হলেন স্বয়ং সত্যনারায়ণ, এই ছোট মানব রূপে স্বয়ং পরমেশ্বর, তিনিই ত’ এই নামটি রাখবার কথা তাদের মনে ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন।
সত্য বলতে বোঝায় ঋত, যথার্থ এবং নারায়ণ, ‘মানুষের ভিতর ঈশ্বর’ কারণ মানুষকে সত্যের পথ দেখাবার জন্য এবং তার নিজের ভিতরকার ঈশ্বরকে জানাবার জন্য বাবা এসেছেন।
পারিবারিক বাড়ীটির পাশেই ঠাকুর্দা আশ্রমের মতই একটি ছোটো নির্জন ঘর তৈরী করে নিয়েছিলেন। ঠাকুরমা শিশুটিকে নিয়ে ঐ ঘরে যেতেন, যাতে শ্রী কোন্ডাম্মা রাজু তাকে নিজের কোলে শুইয়ে আদর করতে পারেন, শিশুটিকে নিয়ে তিনি পূজোর ঘরে যেতেন।
শিশুটি কখনই তার পূজোতে বিরক্ত করত না, বরং বৃদ্ধ উপলব্ধি করতেন যে শিশুটির উপস্থিতি তার মনকে শান্তি দিয়ে পূর্ণ ঈশ্বরমূখী করে দেয়।
শীঘ্রই শিশুটি সারা গ্রামের প্রিয় হয়ে উঠল। তার মনোহর হাসি সকলকে আকৃষ্ট করত, সবাই তাকে আদর করতে ও খাওয়াতে চাইত। ফলে পেড্ডা ভেংকাপ্পার বাড়ীটি সবসময় আগন্তুকদের দ্বারা ভর্তি থাকত, যারা শিশুটির দোলনার চারপাশে ভীড় করত, মনে হত শিশুটি তাদের একঘেয়ে জীবনের দিনগুলোকে ভুলিয়ে দিচ্ছে।
রাজুদের বাড়ির পাশের বাড়িটি ছিল কর্ণমদের বাড়ি, যারা বংশানুক্রমে গ্রামের হিসাব রক্ষক। কর্ণমরা ছিলেন জাতিতে ব্রাহ্মণ। তার স্ত্রী সুব্বাম্মা শিশুটিকে কোলে তুলে আদর করতেন, বুকে জড়িয়ে ধরতেন। শিশুটি আনন্দে খিল খিল করে উঠত আর সুব্বাম্মা বিজয়িনীর মত তাকে আবার নিজের বাড়ীতে নিয়ে যেতেন। সুব্বাম্মা বৃদ্ধা ও নিঃসন্তান ছিলেন বলে ঈশ্বরাম্মার কোমল হৃদয় কোনও বাধা দিত না। যে তৎপরতার সঙ্গে সত্য নিজেকে সুব্বাম্মার বাড়ীতে কোলে করে নিয়ে যেতে দিতেন তাতে অন্য মহিলারা ঠাট্টা করে বলত, “এ হল ব্রাহ্মণ শিশু”। সুব্বাম্মার বাড়িতে শিশুটি যেরূপ স্বতঃস্ফূর্তভাবে পরম উল্লাসে ফেটে পড়ত তেমন কিন্তু নিজের বাড়ীতে করত না। এই ঘটনা স্বাভাবিকভাবেই ঈশ্বরাম্মাকে “দেবকী” এবং সুব্বাম্মাকে “যশোদা” বলে ডাকতে গ্রামের মহিলাদের উৎসাহিত করেছিল। প্রতিদিনই শিশুটি একটু একটু বেশী করে মধুর হয়ে উঠবার ফলে প্রত্যেকের ভালবাসা ও মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠছে দেখে ঈশ্বরাম্মা খুবই আনন্দিত হতেন।
ছোট্ট সত্য একটু একটু করে বড় হবার সঙ্গে সবাই অবাক হয়ে লক্ষ্য করল যে, বয়স্কদের মতই সেও কপালে চওড়া বিভূতির দাগ দিতে খুবই পছন্দ করে এবং সেগুলো মুছে গেলে আবার বিভূতির দাগ দিতে বলত। শিশুটি আবার কপালের মাঝখানে কুমকুমের টিপ দিতে চাইত, আর তার জন্য মাঝেমাঝেই তার বোনের কুমকুম বাক্স নিয়ে নিত।
শিশুটি ছিলেন শিব, তিনি ছিলেন শক্তি দেবী, অর্থাৎ ‘ঈশ্বর এবং ঈশ্বরের শক্তি।’ সুতরাং তিনি শিবের পবিত্র বিভূতি এবং শিবপত্নীর লাল টিপ পড়তে চাইতেন।
আমিষ ভোজনের প্রতি তার অপছন্দতা এতটাই গভীর ছিল যে, যে সকল স্থানে পাঁঠা, ছাগল কিংবা অন্য পশু বধ হত অথবা পাখী বা মাছ ধরা হত সে সব স্থান হতে তিনি স্বাভাবিকভাবেই নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখতেন। মাছ বা আমিষ খাবার রান্নার জন্য ব্যবহৃত রান্নাঘর ও বাসনপত্রকে তিনি এড়িয়ে চলতেন এবং যখন শুনতে পেতেন যে রান্নার জন্য কোন পাখিকে মারা হবে, তিনি সঙ্গে সঙ্গে দৌড়ে গিয়ে পাখীটিকে কোলে তুলে নিয়ে বুকে জড়িয়ে আদর করতেন। যেন প্রাণীটিকে তিনি বাড়তি ভালবাসায় ভরিয়ে দিচ্ছেন, তার ফলে বয়স্করা ঐ পাখীটিকে হত্যা করা থেকে বিরত হতেন। কখনও কখনও তিনি কর্ণমদের বাড়িতে ছুটে যেতেন, কারণ তারা নিরামিষভোজী ছিলেন এবং তার যশোদা, – সুব্বাম্মা যে খাবার দিতেন তাই তিনি গ্রহণ করতেন।
সৃষ্টির সকলের প্রতি তার ভালোবাসা স্পষ্ট হয়ে উঠলে পড়শীরা তাকে “ব্রহ্মজ্ঞানী” বলে ডাকত। তিন-চার বছরের কোমল বয়েসেই বাবা দেখাতেন যে মানব দুঃখ দেখলেই তাঁর হৃদয় গলে যেত। দরজায় কোনও ভিক্ষুক দেখতে পেলেই তিনি দৌড়ে ভিতরে গিয়ে কোনও খাবার তৈরী করতে তার বোনেদের বাধ্য করতেন। বোনেরা রেগে যেত এবং মাঝে মাঝেই ভিক্ষুককে তাড়িয়ে দিত। এতে সত্য এত জোরে কাঁদতে ও বিলাপ করতে শুরু করতেন যে তাকে শান্ত করার একমাত্র উপায় ছিল ভিক্ষুককে আবার ডেকে ফিরিয়ে নিয়ে আসা! দরজায় ভিখিরীদের মেলা বসে যেত বলে সত্যের মাতা তাকে এই বলে সতর্ক করে দিয়েছিলেন, “দেখ, তাদের তুমি খাবার দিতে পার, কিন্তু তাহলে তোমায় না খেয়ে থাকতে হবে।” কিন্তু এ কথাও তাকে দমিয়ে দিতে পারল না। তারপরেও তিনি গরীবদের জন্য খাবার নিয়ে আসতেন এবং তারপর তিনি দুপুরের বা রাতের খাবার হতে দূরে থাকতেন। কেউই তাকে খাবার খাওয়াতে রাজী করাতে পারত না, তিনি খাবার স্পর্শ পৰ্য্যন্ত করতেন না।
সত্যের কাছে এক রহস্যজনক অতিথি এসে তাঁকে খাইয়ে যেত। দিনের পর দিন ধরে তিনি খাবার খেতে অস্বীকার করলেও তার চেহারায় অনাহারের কিংবা তার কাজে ক্লান্তির কোনও লক্ষণ ফুটে উঠত না। তাঁর মাকে তিনি বলতেন যে এক বৃদ্ধ তাকে দুধ, ভাত ইত্যাদি ভুরিভোজ খাইয়ে গেছেন। একথার প্রমাণস্বরূপ নিজের হাত বাড়িয়ে মায়ের নাকের কাছে ধরতেন, মাতা দুধ, ঘি ও দইয়ের তৈরি খাবারের এমন সুগন্ধ পেতেন, যা তিনি নিজে কখনও উপভোগ করেন নি!
রাস্তায় গিয়ে খেলবার মত যখন বড় হয়ে উঠলেন, তখন সত্য খুঁজে পেতে অন্ধ, বিকলাঙ্গ, রোগাক্রান্ত এবং কর্মে অক্ষম ব্যক্তিদের বাড়ীতে ডেকে আনতেন। বাধ্য হয়ে তার বোনেদের কিছু খাবার বা চাল ইত্যাদি এনে ভিখিরীদের থলিতে দিতে হত, আর ছোট শিশু সত্য আনন্দের সঙ্গে তাকিয়ে থাকতেন।
একজন শিশুর আচরণ কিরকম হওয়া উচিৎ তার এক নিখুঁত উদাহরণ হিসেবে সত্যনারায়ণকে গ্রামের পিতা-মাতারা গণ্য করতে লাগল। আর সত্যের ছোট বন্ধুরা তাঁকে তাদের গুরু বলে মনে করতে লাগল।
এক অতি অদ্ভুতভাবে তার নিজের পরিবারের লোকেরা এই বিষয়ে উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। এক রামনবমীর গভীর রাত্রে অতি বর্ণাঢ্য একটি মিছিল গ্রামের ভিতর পরিক্রমা করছিল।
ফুলে ঢাকা একটি গরুর গাড়ির উপরে শ্রীরামচন্দ্রের এক বিরাট ছবির পাশে পুরুত ঠাকুর বসেছিলেন। ঢাক, ঢোল, শিঙ্গা ও বাঁশির আওয়াজে যে সকল গৃহস্থরা জেগে উঠে ফুলের মালা ও কর্পূর নিবেদন করতে এগিয়ে আসছিলেন তাদের কাছ হতে পুরুত ঠাকুর ঐগুলো গ্রহণ করেছিলেন।
সত্যের বাড়ীতে লোকেরা জেগে উঠে সত্যকে দেখতে পেলেন না। মাঝরাত পার হয়ে গেছে বলে তারা উদ্বিগ্ন হয়ে তাঁকে খুঁজতে লাগলেন। শ্রীরামচন্দ্রের ছবি নিয়ে গরুর গাড়িটি তাদের দোরগোড়ায় এলে তাদের দৃষ্টি ঐ দিকে পড়লে তারা অবাক হয়ে গেলেন। ভেবে দেখুন, পাঁচ বছর বয়সের বালক সত্য রামচন্দ্রের ছবির ঠিক নীচে স্পষ্টতই আধিপত্যের সঙ্গে বসে আছেন। তাঁর সমবয়স্ক সঙ্গীদের যখন জিজ্ঞেস করা হল যে, সত্য কেন তাদের সঙ্গে হেঁটে না গিয়ে ওখানে বসে আছে, তারা সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিয়েছিল, “সত্য হল আমাদের গুরু।” বাস্তবিকই তিনি হলেন সকল যুগের বিশ্বের সকল লোকেদের গুরু!
পুট্টাপর্তী গ্রামে একটি ছোট স্কুল রয়েছে। শিশু বয়সে বাবা অন্য সব শিশুদের সঙ্গে ঐ স্কুলে যেতেন। সময় নিষ্ঠা চালু করবার জন্য একটি কঠোর শাস্তির উপায় বের করা হয়েছিল। দেরীতে আসা প্রথম যে দুজন ছাত্র স্কুলে ঢুকে শিক্ষককে সম্ভাষণ জানাত, সেই দুজনকে ছেড়ে দেওয়া হত। কিন্তু তার পরে আসা প্রতিটি ছাত্রকে বেত মারা হত, বেতের ফলে হাতের উপর কাটা দাগের সংখ্যা নির্ভর করত দেরীতে আসা ছাত্রদের তালিকায় তার স্থানের সংখ্যার উপর। এই নির্যাতন হতে বাঁচবার জন্য শিশুরা বৃষ্টিতে ভিজে কিংবা কুয়াশার ফলে কাঁপতে কাঁপতে সূর্যোদয়ের অনেক আগেই স্কুল ঘরের চালের ছাঁইচ অর্থাৎ চালের বেরিয়ে থাকা প্রান্তটুকর নীচে দাঁড়িয়ে থাকত। ছোট্ট শিশু সত্য তাদের অবস্থা দেখে বাড়ি থেকে শার্ট, তোয়ালে ইত্যাদি এনে একটু আরাম দিতে চেষ্টা করতেন। ফলে তার বাড়ীর বয়স্করা সমস্ত কাপড় জামা তালা বন্ধ করে রাখতে লাগলেন, যাতে হারাবার ভয় আর না থাকে।
সত্যনারায়ণকে জ্ঞানবৃদ্ধ বলে মনে হত, কারণ অন্য শিশুদের অনেক আগেই নিজেই নিজের পাঠ শিখে ফেলতে পারতেন। তাঁদের বাড়ীতে গ্রামের যাত্রা ও নাটকের জন্য যে মহড়া হত তার প্রত্যেকটি গান তিনি গাইতে পারতেন। মাত্র সাত বছর বয়েসেই জনসমক্ষে গাইবার জন্য তিনি গান রচনা করে দিতেন।
সুতরাং মাত্র আট বছর বয়েসেই সত্য আড়াই মাইল দূরের বুক্কাপটনমের উচ্চবিদ্যালয়ে ভর্তি হবার যোগ্য বলে বিবেচিত হলেন। প্রখর রৌদ্রে কিংবা বর্ষাকালে পাথরের কুচির উপর দিয়ে কিংবা কাদায় ভর্তি ক্ষেতের উপর দিয়ে কখনও বা হাঁটু জল ভেঙ্গে বইয়ের ব্যাগটিকে মাথার উপর তুলে ধরে তাঁকে এতটা পথ হেঁটে যেতে হত। দই কিংবা চাটনী দিয়ে ঠান্ডা ভাত খেয়ে ও দুপুরের খাবার ব্যাগে নিয়ে ভোর বেলায় তার ছোট বন্ধুদের সঙ্গে ঐ পথ হেঁটে যেতেন।
সাদাসিধে, অনাড়ম্বর, সৎ ও ভদ্র আচরণ প্রয়োজনের অতিরিক্ত কথা না বলা ও ক্লাসঘরে সময়ের আগে এসে তিনি সকলের সামনে একটা ভাল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন। ক্লাস শুরু হবার আগেই ক্লাসে ঢুকে তিনি ভগবানের কোনও ছবি রেখে পূজো করতেন ও একটা না একটা প্রসাদ বিতরণ করতেন।
তার খালি ব্যাগটি থেকে তিনি যে সমস্ত জিনিষ বের করতেন সেগুলোর জন্য ছেলেরা তার চারপাশে ভিড় করত। জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলতেন যে, তিনি যা চান তা দিয়ে দেবদূত তার আদেশ মেনে চলে।
ঐ দেবদূতের শক্তি অর্থাৎ সত্যের দিব্য ইচ্ছার ক্ষমতার অভিজ্ঞতা একবার এক শিক্ষক লাভ করেছিলেন। একদিন এক শিক্ষক লক্ষ্য করলেন যে, অন্য ছাত্রদের মত সত্য পড়ার নোোট লিখছেন না, তিনি শুধুই প্রার্থনা গীত রচনা করে, তার কপি করছেন আর সহপাঠীদের ভিতর তা বিতরণ করছেন। এ বিষয়ে তাঁকে প্রশ্ন করা হলে সত্য বলেছিলেন, “স্যার, আমার নোট নেওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই, লিখবার জন্য আপনি যা বলেছেন, তা বুঝে নিয়েছি। তার উপর যে কোনও প্রশ্ন করুন আমি সঠিক উত্তর দেব।” কিন্তু শিক্ষক এসবের কোনটাই করলেন না। তিনি ভাবলেন সত্যকে শাস্তি দিতে হবে আর তার জন্য সত্যকে ঐ দিনের শেষ ঘন্টা না বাজা পর্যন্ত বেঞ্চের উপর দাঁড়িয়ে থাকতে আদেশ দিলেন। সত্য আদেশ মান্য করলেন। তাদের গুরুকে বেঞ্চের উপর দাঁড়িয়ে কষ্ট পেতে দেখে সহপাঠীরা ব্যাথা পেল।
জনাব মেহবুব নামে আরেকজন শিক্ষক সত্যকে খুবই স্নেহ ও শ্রদ্ধা করতেন। এত ভাল করে তিনি ইংরাজী পড়াতেন যে, প্রতিটি ছাত্রই খুবই ভাল করে প্রতিটি পাঠ শিখে নিত। অন্য ছাত্রদের সামনে সত্য যে ভাল দৃষ্টান্ত তুলে ধরত তার থেকে তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে, এক বিরাট শক্তি তার ছাত্র হয়ে এসেছেন এবং সে জন্য অতি দুর্লভ স্নেহের সঙ্গে তিনি সত্যের সঙ্গে আচরণ করতেন – এমন কি নিজের বাড়ীতে খাবার জন্য সত্যকে নিমন্ত্রণ করলে তিনি সারা বাড়ী পরিষ্কার করতেন, কারণ তিনি জানতেন যে, আমিষ ভোজনের সঙ্গে সত্য কোনও সংশ্রব রাখেন না। সত্যের চুলে হাত বুলোতে বুলোতে মেহবুব খান তাঁর পাশে নীরবে বসে থাকতেন, কখনও বা তাঁর কানে ফিসফিস করে বলতেন, “ওগো সত্য, তুমি এক বিস্ময়কর বালক, হাজার হাজার লোককে তুমি সাহায্য করবে, তুমি হলে বিরাট শক্তিধর।”
পরের ক্লাসের সময় ক্লাসঘরে ঢুকে ছোট সত্যকে বেঞ্চের উপর দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে মেহবুব খান খুবই ব্যাথা পেলেন, তিনি লক্ষ্য করলেন, যে শিক্ষক সত্যকে শাস্তি দিয়েছেন তিনি পরের ক্লাসের শিক্ষকের জন্য চেয়ার ছেড়ে না দিয়ে তখনও বসে আছেন। সেই শিক্ষক মেহবুব খানের কানে ফিসফিস করে বলেছিলেন যে তিনি উঠতে পারছেন না, কারণ উঠতে গেলেই চেয়ারটাও তার সঙ্গে উঠছে!
ঐ ফিসফিস করে বলা কথাটি যে ছেলেরা বুঝতে পেরেছিল তারা এই ভেবে শান্তভাবে হেসেছিল যে, সত্যের দেবদূতের জন্যই ঐ শিক্ষকের এই অবস্থা ঘটেছে। মেহবুব খানও একই ধারায় চিন্তা করে শিক্ষকটিকে পরামর্শ দিলেন সত্যকে নেমে বসতে বলবার জন্য। তিনি তাই করলেন, আর চেয়ারও তাকে ছেড়ে দিল।
বহু বছর পর এই কাহিনীর বিবরণ দেবার সময় বাবা বলেছিলেন, এমনটা হোক তা তিনি রাগ করে বা ইচ্ছা করেন নি – কারণ তাঁর ভিতর কোনও রাগ নেই; শুধুমাত্র নিজেকে স্পষ্ট করে তুলে ধরবার জন্য এবং তাঁর মিশন ও পরিচয় সম্পর্কে ঘোষণা করবার জন্য লোকেদের মনকে ধীরে ধীরে তৈরী করবার জন্য তিনি তেমন করেছিলেন।
নিজের জ্ঞান ও পবিত্রতার দ্বারা সত্য যে ব্রহ্মজ্ঞানী নাম অর্জন করেছিলেন তার সঙ্গে সংগতি রেখে তিনি উপদেশ ও নিজের জীবনের দ্বারা দেখিয়েছিলেন যে, এই সীমিত জগতের স্বল্প আনন্দ হল, প্রার্থনা এবং ভজন, ভক্তি এবং তৃপ্তির মাধ্যমে যে পরম আনন্দ লাভ হয় তার তুলনায় অনেক নিম্নমানের। এই সকল গুণ রয়েছে এমন মুনি-ঋষিদের কাহিনীর দ্বারাই শুধু তিনি আনন্দ পেয়ে থাকেন।
ঐ অল্প বয়েসেও তাঁর সঙ্গে থাকবার জন্য, যে কোনও শিশুকে সত্যের সম্মতি এবং খালি ব্যাগ হতে সত্য যে মিষ্টি বের করতেন তা পাবার জন্য নির্মল ও সৎ হওয়াটা প্রয়োজন হত।
[Source : Lessons from the Divine Life of Young Sai, Sri Sathya Sai Balvikas Group I, Sri Sathya Sai Education in Human Values Trust, Compiled by: Smt. Roshan Fanibunda]