গাছেরও প্রাণ আছে
গাছেরও প্রাণ আছে
আজকে তোমাদের একটি অদ্ভুত ছেলের কথা শোনাবো। এই ছেলেটি একটি বাংলা মিডিয়াম স্কুলে পড়ত। এই স্কুলে সে সবার সঙ্গে মিশত। এই স্কুলের অধিকাংশ ছেলেই ছিল খুব গরীব। এই ছেলেটির বিশেষত্ব হচ্ছে তার ভেতরে একটা ভীষণ কৌতূহল ছিল, একটা ভীষণ জানার আগ্রহ ছিল। সে সবকিছুর কারণ খুজে বার করবার চেষ্টা করত। সে অবাক হয়ে ভাবত, এই জোনাকী কেন জ্বলে? তার মনে প্রশ্ন আসত, এই বাতাস, জল কেন একদিক থেকে আর একদিকে চলে যায়? সে অন্যদের সঙ্গে খেলাধুলা না করে অবাকভাবে তাকিয়ে দেখত কি করে মাছেরা জলের মধ্যে ঘোরাফেরা করে? তাদের স্বভাব চরিত্র বোঝবার চেষ্টা করত। তাকে সবচেয়ে বেশী আকৃষ্ট করত গাছ। এই গাছগুলো কি করে একটু একটু করে বড় হচ্ছে, ছোট গাছ, তাতে কি রকম করে পাতা হচ্ছে, শাখা হচ্ছে, ফুল হচ্ছে, ফল হচ্ছে আবার সেই ফল থেকে বীজ হচ্ছে, সেই বীজ থেকে গাছ হচ্ছে।
এই ছেলেটির নাম ‘জগদীশ চন্দ্র বোস’। যাঁকে আমরা সবাই আচার্য জগদীশ চন্দ্র বসু বলে জানি। এর বাবা ছিলেন ‘ভগবান চন্দ্র বোস’। তিনি একজন জজ ছিলেন। মা ‘অবলা দেবী’, একজন নরম স্বভাবের, কোমল হৃদয়া মা।
তাদের বাড়ীতে একজন কাজ করতেন, তিনি জগদীশ চন্দ্রকে দুঃসাহসিক অভিযানের কথা বলে, তাঁর মনে রোমাঞ্চ জাগাতেন। আর মা তাকে শোনাতেন, রামায়ণ, মহাভারতের গল্প।
এরপরে জগদীশ চন্দ্রকে পাঠানো হয় ইংল্যাণ্ডে পড়বার জন্য। ইংল্যাণ্ড থেকে পাশ করে এসে তিনি প্রেসিডেন্সি কলেজে যোগ দেন। যখন তিনি প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়তেন, তখন তিনি টাকা জমাতেন। কি জন্যে জানো? তিনি টাকা জমাতেন, যাতে তিনি একটা ল্যাবরেটরী তৈরী করতে পারেন এবং সেখানে তিনি তাঁর নিজস্ব পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে পারেন।
জগদীশ চন্দ্রের এই স্বপ্ন সফল হল, তিনি একটা ছোট্ট ল্যাবরেটরী করলেন। সেখানে তিনি অনেক জিনিস নিয়ে পরীক্ষা করলেন।
তাঁর বিশেষ আগ্রহ ছিল ইলেকট্রিসিটি। তার পড়াশোনার বিষয়ও ছিল ইলেকট্রিসিটি, আর দ্বিতীয় ছিল গাছ, উদ্ভিদ। তিনি একদিন হঠাৎ দেখলেন যে গাছের মধ্যে দিয়ে যদি বিদ্যুতের মৃদু তরঙ্গ প্রবাহিত করান যায় তাহলে গাছের মধ্যেও একটি স্পন্দন হয়। বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক ম্যাগাজিনে এই সব তথ্য প্রকাশিত হল। নানা জায়গায় তিনি তাঁর বক্তৃতার মধ্যে এইসব কথা বলতেন। ফলে পৃথিবীর বৈজ্ঞানিক মহলে একটা সাড়া জাগলো।
এক সময় তাঁকে লন্ডনের রয়েল একাডেমী অফ সায়েন্স থেকে আমন্ত্রণ জানানো হল, এই বিষয়ে বলবার জন্য। সেখানে গিয়ে জগদীশ চন্দ বসু দেখালেন যে গাছের মধ্যে তড়িৎ প্রবাহে কি রকম স্পন্দন জাগে। তিনি আরো প্রমাণ করে দেখালেন যে, গাছ যে শুধু তার শেকড় দিয়ে জল টানে তা নয়, গাছের যে কোন অংশে জল দিলে সে জল টানতে পারে।
আমাদের যেমন হৃদপিন্ড একবার বড় হয়, আর একবার ছোট হয়। এমনি করে আমাদের রক্তপ্রবাহ সচল থাকে। তেমনি গাছর মধ্যে যে কোষ আছে, সেই কোষ একবার বড় হয় আর একবার ছোট হয়, এ রকম করে জলকে শোষণ করে। জগদীশ চন্দ্র বোসের খ্যাতি চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে। তিনি পুরস্কৃত হন, সম্মানিত হন, কিন্তু যখন তাঁকে এই সম্মান দেওয়া হয় তখন তিনি বলেছিলেন, “আমি নতুন কিছু বলছি না। ভারতবর্ষের প্রাচীন মুনি ঋষিরা উদ্ভিদের প্রাণ আছে এটা জেনেছিলেন। আমি সেই সত্যটাকেই তুলে ধরেছি।”
তাঁর গভীর শ্রদ্ধা এবং অনুরাগ ছিল ভারতের প্রাচীন সংস্কৃতির প্রতি। জগদীশ চন্দ্র বোসের জীবনে স্বপ্ন ছিল, যে তিনি যেমন ল্যাবরেটারী করেছেন শুধু নিজের পরীক্ষার জন্য, এই ল্যাবরেটরী আর একটু বড় করবেন, যাতে আগ্রহী ছাত্র-ছাত্রীরা তাদের বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা করতে পারে। ভগবান হচ্ছেন সৎ-এর সহায়, কাজেই জগদীশচন্দ্রের সেই স্বপ্ন তার জীবিতকালেই পূর্ণ হয়েছিল।
স্বামী বিবেকানন্দ, বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ জগদীশচন্দ্রকে পরম শ্রদ্ধা করতেন। এই জগদীশচন্দ্রের সঙ্গে তোমাদের একটাই তফাৎ, জগদীশচন্দ্র জানতে আগ্রহী ছিলেন, তার ঔৎসুক্য ছিল খুব বেশী। তোমার ভেতরেও যদি জানার আগ্রহ জেগে ওঠে, তাহলে তুমিও কিন্তু জগদীশচন্দ্র বোসের মত হবে।
জগদীশ চন্দ্র আরও একটি তত্ত্ব পরীক্ষা দিয়ে প্রমাণ করে দেখিয়েছিলেন। তোমরা হয়ত লক্ষ্য করেছ যে, কোনো গাছ সোজা হয়, কোনো গাছ বেঁকে যায়, দেখবে বিশেষ করে কোনো গাছ যদি জানালার ধারে রাখা হয় তাহলে এ গাছ যেন বেঁকে গিয়ে জানালা দিয়ে উঁকি মারতে চায়।
জগদীশ চন্দ্র বোস পৃথিবীকে প্রমাণ করে দেখালেন যে গাছেরও একটা আলোর পিপাসা আছে, এই আলোর পিপাসাই, তাকে অন্ধকার ঘর থেকে আলোর দিকে মুখ বাড়াতে সাহায্য করেছে, অনুপ্রাণিত করছে। এই যে আলোর পিপাসা জ্ঞানের পিপাসার মতো। এই জ্ঞানের পিপাসা থেকেই কিন্তু জগদীশ চন্দ্র বসু, আচার্য জগদীশ চন্দ্র বসু হয়েছিলেন।
এই পিপাসা যদি তোমার থাকে, তাহলে তুমিও এই আলো অন্যকে দেখাতে পারবে।
প্রশ্নঃ
- জগদীশচন্দ্রের বাবার সম্বন্ধে কি জান?
- জগদীশচন্দ্রের প্রিয় বিষয় কি ছিল?
- তিনি গাছপালা সম্পর্ক যা বলে গেছেন সে গুলি লেখ।