গল্প
গল্প
অনেক কাল আগে, বিনাশপুরম নামে এক রাজ্যে রাজা ধীরাজ রাজত্ব করতেন। তাঁর এক অপরূপ সুন্দরী রাণী ছিল নাম মানসরাণী। কিন্তু রাণীর একটা দুর্বলতা ছিল। হায়! তিনি ছিলেন অস্থির মস্তিষ্কের আর তাই নিজে কোন সিদ্ধান্ত নিতে পারতেন না। তিনি তার দুই মন্ত্রী রজোদত্ত ও তমোদত্তের ওপর নির্ভরশীল ছিলেন। তারা দুজনই খুব দুষ্ট বুদ্ধির ছিল আর সবসময় ওরা রাণীকে ভুল পথে চালিত করত। রাজা রাণীকে এতটাই ভালবাসতেন যে রাণী যা চাইতেন তিনি তাই করতেন আর রাণী রাজার হয়ে সব সিদ্ধান্ত নিতেন।
সেই রাজ্যের প্রজারা খুব পটু ও দক্ষ ছিল। কিন্তু তারা সম্পূর্ণভাবে রাজা ও রাণীর ওপর নির্ভরশীল। এদিকে রাজা ও রাণী তো রজোদত্ত ও তমোদত্ত দ্বারা পরিচালিত হয়ে মন্দ কাজ করতেন। যার ফলে রাজ্যে বিপর্যয় নেমে আসে। মানুষজন শুধু যে দুঃখে ছিল তা নয় তাদের পারিপার্শ্বিক পরিমন্ডল ও অন্ধকারময় ও বিষন্ন হয়ে ওঠে। ফলে সমগ্র রাজ্য দুর্দশায় নিমজ্জিত হয়।
যাই হোক, একদিন একটি ভালো ও সৌভাগ্যপূর্ণ দিনে গুরুসেন নামে একজন জ্ঞানী ব্যক্তি, সেই রাজ্যে এসে উপস্থিত হন। তিনি রাজ্যবাসীদের দুর্দশা দেখে তৎক্ষণাৎ দুর্দশার মূল কারণ অনুধাবন করতে পারেন। যদিও রাজার ভান্ডার ধনসম্পদে পরিপূর্ণ তবুও সর্বদা তার একটা ধারণা ছিল যে তিনি দেউলিয়া। তার দুই মন্ত্রীর কুপ্ররোচনায় তিনি প্রজাদের ওপর প্রচুর করের বোঝা চাপিয়ে দেন। এর ফলে রাজার বকেয়া মেটাবার জন্য তাদের অসাধু পথ অবলম্বন করতে হয়। গুরুসেন কি করলেন? তিনি কেবলমাত্র রাজাকে তাঁর লুকানো ধনভান্ডারটির সন্ধান দিলেন। সত্য উদ্ঘাটিত হল। এ যেন তিনি রজোদত্ত ও তমোদত্ত দ্বারা ঢেকে রাখা আবরণ সরিয়ে দেওয়া। এক মুহুর্তের মধ্যে রাজা সম্পূর্ণ পরিস্থিতি বুঝতে পারলেন। রাজা গুরুসেনের সঙ্গে আলোচনা করে দুই মন্ত্রীকে কারাগারে নিক্ষেপ করলেন। তাদের সকল কর্মকান্ড বন্ধ হয়ে গেল। এর পর রাজা রাণীর ওপর সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ আনলেন। উনি রাণীকে তার সকল আদেশ পালন করতে বাধ্য করলেন। তৎক্ষণাৎ প্রজারাও শুধরে গেল। যেই মুহূর্তে ওরা সঠিক দিশা পেল, সেই মুহূর্তে ওরা সঠিক কাজ করতে শুরু করল। অচিরেই বিনাশপুরম হয়ে উঠল অবিনাশপুরম — যার কোন বিনাশ নেই। এবার আর বাইরের কোন শত্রু এসে কোন ক্ষতি করতে পারবে না। প্রজারা এখন খুব আনন্দিত ও উৎফুল্ল। তারা তাদের পারিপার্শ্বিক পরিমন্ডল আনন্দে ও সুখে ভরিয়ে তুলল।
- আমাদের গল্পের প্রত্যেকটি চরিত্র আসলে এক একটি প্রতীক।
- বিনাশপুরম নামক রাজ্য হল আমাদের শরীর। বুদ্ধি হল রাজা। মন হল রাণী – যা সর্বদাই অস্থির, চঞ্চল, দ্বিধাগ্রস্থ আবার কখনও খুব দৃঢ়।
দুষ্ট মন্ত্রীরা হল আমাদের রজোগুণ ও তমোগুণ। প্রজারা হল আমাদের পাঁচটি কর্মেন্দ্রিয় ও পাঁচটি জ্ঞানেন্দ্রিয়। জ্ঞানী ব্যক্তিটি হলেন আমাদের সদগুরু বা আমাদের শুভ চেতনা / বিবেক। লুকানো ধনরাশি হল সত্য আর আমাদের ভিতরে অবস্থিত ঈশ্বর।
যখন সদগুরুর প্রবেশ ঘটে আমাদের জীবনে, অজ্ঞতার রাত্রির অবসান ঘটে আর পবিত্র ভোরের উদয় হয়। তিনি আমাদের মধ্যে সুপ্ত দিব্য চৈতন্যকে সাধনার বিভিন্ন স্তরের মধ্যে দিয়ে, জাগিয়ে তোলেন।
প্রত্যহ, দৈনন্দিন জীবনযাপন শুরু করার আগে সুপ্রভাতম পাঠ হল এমনই একটি সাধনা। সবচেয়ে ভালো ফল পাওয়া যায় যখন আমার প্রত্যেক পংক্তির আন্তর তাৎপর্য্য চিন্তা করে পাঠ করি। আমাদের শরীর হল ভগবানের মন্দির — যেখানে অবস্থিত দেবতা হল আমাদের আত্মা। এই নশ্বর সৌধ্যের ইট হল স্থূল শরীর, যা ‘অন্নময় কোষ’ দিয়ে তৈরী,। সুক্ষ শরীর যা ‘প্রাণময় কোষ’, ‘মনোময় কোষ’ ও ‘বিজ্ঞানময় কোষ’ দিয়ে তৈরী। সেটি প্রার্থনা গৃহের সঙ্গে তুলনীয়। আর কারণ শরীর / হৃদয় যা ‘আনন্দময় কোষ’ দিয়ে তৈরী তা পবিত্রস্থান/মন্দিরের গর্ভগৃহের সাথে তুলনীয়। ২০ বার ওঁকারের সাথে আমরা আমাদের পঞ্চ জ্ঞানেন্দ্রিয়, পঞ্চ কর্মেন্দ্রিয়, পঞ্চ কোষ এবং পঞ্চ প্রাণকে শুদ্ধ করি আর ২১তম ওঁকারের মাধ্যমে আমাদের আত্মাকে আহ্বান করি। এর পর আমরা প্রতিটি পংক্তির অভ্যন্তরীণ মানে চিন্তা করে সুপ্রভাতম পাঠ করা শুরু করি।
যে মুহুর্তে একজন ভগবানের সত্যিকারের অস্তিত্ব উপলব্ধি করবে, তখন সে নিজেকে সন্তুষ্ট ও সমৃদ্ধ মনে করবে। তখন আমরা বুঝব যে আমরা সত্য, ভাল ও সুন্দর। আমরা চাহিদা হীন হয়ে গেছি। যখন বুদ্ধি মন আর ১০টি কর্মেন্দ্রিয় ও জ্ঞানেন্দ্রিয় কে চালনা করে– তখন সকল চিন্তা, বাক্য ও কর্ম নৈতিকতা ও ক্ষমতায় পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে। যখন মন বুদ্ধিকে চালনা করে – তখন সেখানে বিশৃঙ্খলা ও অশান্তি দেখা দেয় কারণ মন চঞ্চল, অন্তরে বিরাজিত আমূল্য শান্তি, যা হল পরম সত্য, সেটি গুণ এবং সংস্কারের আবরণে আচ্ছাদিত।
যখন সুপ্রভাতাম পাঠ করব, তখন আমাদের মনে রাখতে হবে আমাদের প্রত্যেকের মধ্যে ঈশ্বর বসবাস করেন। তিনি সকল আনন্দ এবং সুখের উৎস। সাধনা এবং প্রচেষ্টার দ্বারা আমাদের অন্তরস্থ ঈশ্বরকে অর্থাৎ দিব্যত্বকে উপলব্ধি করতে হবে। ঈশ্বরই আমাদের ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে (খাওয়া, ঘুমানো, আনন্দ করা প্রভৃতি) আমাদের কাজগুলো করে থাকেন। তিনিই প্রকৃত কর্তা। যতক্ষণ না এই কথা বুঝতে পারব, ততক্ষণ প্রতিটি কাজ করার আগে আমাদের ভেবে দেখতে হবে আমরা যে কাজটি করতে যাচ্ছি সেটিকে প্রভু সাইয়ের উপযুক্ত কাজ? তিনি কি এই কাজটা পছন্দ করবেন? তিনি কি আমাদের মধ্যে দিয়ে এই কাজটি করবেন? তিনি কি এই ভাবে চিন্তা করবেন?
এইভাবে শিশুদের সদাচারের পথে পরিচালিত করতে হবে। প্রত্যেকটা দিন একটা নতুন অঙ্গীকারের সঙ্গে শুরু হবে। আমরা প্রত্যেক দিন “আমি থেকে তিনি” এই যাত্রা পথে একধাপ করে এগিয়ে যাব। তাঁর অস্তিত্ব অনুভব করতে করতে এক পা এক পা করে ধীরে ধীরে আমরা তীর্থযাত্রীদের মতো নির্দিষ্ট গন্তব্যে অর্থাৎ আমাদেরই অন্তরস্থ পূজার বেদীতে পৌঁছে যাব।
( টেপ রেকর্ডারে সুপ্রভাতম ক্যাসেট চালিয়ে ক্লাসে শোনালে মন্ত্রের সৌন্দর্য — সুর ও লয় অনুভূত হবে)।