ত্রিবিধং – বিশদ পাঠ

Print Friendly, PDF & Email
ত্রিবিধং – বিশদ পাঠ

ত্রিবিধিং নরকেস্যেদং দ্বারিং নাশনমাত্মনঃ।
কামঃ ক্রোধস্তথা লোভস্তস্মাদেতত্রয়ং ত্যজেৎ।।

কাম,ক্রোধ ও লোভ হল নরকের তিন দ্বার। এরা আত্মবিনাশের কারণ হয়। সুতরাং এগুলি ত্যাগ করা উচিত।

রাবণের পতনের কারণ ছিল কাম। তার জন্য তাকে তার আত্মীয়স্বজন , তার রাজ্য ও সমগ্র লঙ্কার ধ্বংস দেখতে হয়েছিল। সেটাই তার কাছে নরকের তুল্য ছিল।

নিজের ক্রোধকে জয় করতে বিশ্বামিত্রের হাজার, হাজার বছর লেগেছিল। শেষে যখন তিনি তাঁর শত্রুদের অর্থাৎ ক্রোধ, কাম, অহংকার, লোভ,ঈর্ষা ও মোহকে জয় করতে সমর্থ হলেন, তখন তিনি হলেন ব্রহ্মর্ষি।

যখন কাম( ভোগবাসনা) হৃদয়ে জায়গা করে নেয়,তখন তার প্রিয়পাত্রেরা অর্থাৎ ক্রোধ, লোভ, মদ, আড়ম্বর,ও ঘৃণাও সেখানে ঢুকে পড়ে রাজ শুরু করে। রাবণ একজন মস্ত পন্ডিত ও মহাবীর হওয়া সত্ত্বেও কাম বা লালসা তাকে ধ্বংস করেছিল। এটি মানুষের মধ্যেকার সকল সৎ গুণকে অভিভূত ও অসাড় করে দিতে পারে। তাকে পশুর স্তরে নামিয়ে আনতে পারে।

লোভ এটি হল যেকোন উপায়ে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব প্রভূত অর্থ উপার্জন করার লোভ। আজকের সমাজে যে মন্দ জিনিষগুলি দেখা যাচ্ছে,সেগুলি এরই ফল। ক্রোধ জ্ঞান ভান্ডার বাজেয়াপ্ত করে তাকে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কণায় ভেঙে দিতে পারে। এই সবকিছুর মূল উৎস হল অহঙ্কার অথবা নিজেকে জড়ের সঙ্গে এক করে দেখা। তার কারণ হল অজ্ঞান। আত্মতত্ত্বকে বোঝার জন্য আমাদের সৎ গুণের বিকাশ করতে হবে। কাম,ক্রোধ, লোভের মতন অসৎ গুণ কীটের মতন বৃক্ষের মূল শিকড়ে প্রবেশ করে তাকে খেয়ে ফেলে। বাবা বলেন একবার যদি তোমরা জাগতিক বস্তর খুঁতগুলি চিনতে পারো, তাহলে খুব তাড়াতাড়ি সেগুলি পাবার ইচ্ছা তোমাদের ভিতর থেকে চলে যাবে।

একজন সাধকের জন্য বৈরাগ্য গুণ থাকা খুবই জরুরি।এই গুণটি থাকলে মানুষ নিজের মনকে অন্তর্মুখী করে তুলতে পারে এবং আন্তর দৃষ্টি গড়ে তুলতে পারে।

বাবা বলেন যে জীবন একটি লিমিটেড কম্পানি। সীমাযুক্ত বা লিমিটেড কম্পানিতে সীমাহীন বা আনলিমিটেড ব্যবসা করা যায়না। ঠিক তেমনই আমাদেরও নিজেদের আচার আচরণে সীমারেখা টানা উচিত। আমাদের বাসনার একটি সীমা থাকা উচিত। আমার আমার ভাব বা মমত্ব বোধ ত্যাগ করা উচিত। তাহলে পার্থিব বা বাহ্যবস্তু আর কোন সমস্যার সৃষ্টি করবে না।

ব্যাখ্যা:

ভগবান বাবা আমাদের ব্যাখ্যা করে বুঝিয়েছেন যে মনই স্বর্গ ও নরকের মতন অবস্থা সৃষ্টি করে থাকে।

যখন কাম (ভোগবাসনা) আমাদের হৃদয়কে অধিকার করে,তখন তার অনুচরেরা অর্থাত ক্রোধ, লোভ, অহংকার, আড়ম্বর ও ঘৃণাও সেখানে দল বেঁধে ঢুকে পড়ে। রাবণ ছিলেন মহা পন্ডিত, সম্রাট ও মহাবীর তবু কাম তার বিনাশ ঘটায়।

কাম বা বাসনা কি? তা হল মানুষের চিন্তার বিরামহীন ভাবে বাহ্যবস্তুর দিকে ছুটে যাওয়া। যখন সেই বস্তুটি পাবার জন্য নিরবচ্ছিন্ন চিন্তার ধারা কোন বাধার সম্মুখীন হয়ে নিজের পথ থেকে বিচ্যুত হয়, তখন তার ফলে জন্ম নেয় ক্রোধ। নৈরাশ্য নিয়ে আসে বিদ্রোহ ও চিন্তার ঝড় এবং তা ক্রোধের রূপ নিয়ে আছড়ে পরে।

এইভাবে কোন বাসনা না পূর্ণ হলে, তা ক্রোধে পরিণত হয়।কিন্ত বাসনা পূর্ণ হলে তার থেকে আরো আরো পাবার তৃষ্ণা জন্ম নেয়। একটি বাসনা কখনও কখনও নতুন নতুন বাসনার জন্ম দিয়ে থাকে। একজন বিশৃঙ্খল মানুষের জীবনে কখনোই সন্তোষ থাকেনা।তার বাসনা পূর্ণ হলেও, সে আরো আরো আনন্দ চায় ও তার ক্ষুধা তীব্র আকার ধারণ করে। যদি মানুষটি দরিদ্র হয় এবং কোনোভাবে কয়েক লক্ষ টাকা পায়,তবুও সে আরো পেতে চায় এবং যতক্ষণ না সেই টাকা বিনিয়োগ করে আরো অর্থ লাভ করে, ততক্ষণ সে অস্থির ও অসুখী বোধ করে। একে বলে লোভ, যা কখনও মনের শান্তি দেয় না।

বাবা ‘গীতাবাহিনীতে’ বলেছেন যে এই তিনটি গুণ সকল দানবিক প্রকৃতির ভিত্তি গঠন করে। কাম,ক্রোধ ও লোভ মানুষের মনুষ্যত্বকে বিনষ্ট করে তাদের মধ্যে দানবিকতাকে জাগিয়ে তোলে। বৈরাগ্য, শান্তভাব ও ত্যাগের মতন দিব্য গুণের সাহায্যে তাদের পরাস্ত করে আমাদের জয়ী হতে হবে।

কাহিনী:

আমরা আমাদের কর্মের দ্বারা এখানেই স্বর্গ অথবা নরক সৃষ্টি করি। আমাদের স্বার্থপরতা ছাড়া অন্য কোনও নরক নেই। আমাদের নিঃস্বার্থ প্রেম ছাড়া আলাদা কোনও স্বর্গও নেই। একবার এক দল লোক জানতে চাইল যে নরক কীকরে তৈরী হয় আর কোন শর্ত পূরণ হলে স্বর্গ সৃষ্টি হয়। যেখানে সবাই কষ্ট পায়,সেটা নরক আর যেখানে সকলে আনন্দে থাকে, সেটা স্বর্গ।

তো এই দলটি নরক কি করে তৈরী হয় সেটা জানতে প্রথমে নরকে গেল। সেখানে সকলেই কষ্ট পাচ্ছিল। নরকে তারা যা দেখল তাতে তারা খুবই অবাক হয়ে গেল। দেখে মনে হচ্ছিল যে নরক একটি খুব সমৃদ্ধ জায়গা।সেখানে ভোগের প্রতিটি বস্তু প্রচুর পরিমাণে রাখা ছিল। তারা অবাক হয়ে ভাবল যে এখানে সবাই কষ্ট পাচ্ছে কেন?

নরকে তখন মধ্যাহ্ন ভোজনের সময়। সব নরকবাসী খাবার ঘরে সমবেত হয়েছেন। দলটি খাবারের কোনও সমস্যা আছে কিনা দেখতে গেল। আবার তারা যা দেখল তাতে বিস্ময়ে তাদের বাকরোধ হয়ে গেল। খাবার টেবিলে থরে থরে সুস্বাদু খাবারের সম্ভার সাজানো ছিল। কারো খাবারের কোন অভাব থাকার কথা নয়। কিন্ত অবাক কান্ড এটাই যে সমবেত সকল নরকবাসীকে দেখে মনে হচ্ছিল যে তারা ক্ষুধার্ত ও ক্রুদ্ধ। তারা একে অপরের সঙ্গে ঝগড়া করছিল ও চীৎকার করছিল। একে অপরকে অপমান করছিল ও দোষারোপ করছিল।

যারা ঝগড়া মারামারি করছিল,দলের সদস্যরা তাদের খুব খুঁটিয়ে দেখছিল। তারা লক্ষ্য করল যে নরকবাসীদের কনুই নেই। সেই জন্য তারা হাত বেঁকাতে পারছেনা এবং নিজেরা খেতে পারছেনা। যদিও তাদের সামনে প্রচুর খাবার ও তারা সহজেই সেগুলি পেতে পারে। তাই তারা সকলেই উপোস করে আছে এবং তাদের মনে কোন আতারপর তাঁরা স্বর্গে গেলেন সেখানকার অবস্থা পর্যবেক্ষণ করার জন্য। তাঁরা ঠিক সময়ে পৌঁছলেন। স্বর্গবাসীরা তখন মধ্যান্হ ভোজনের জন্য বসেছেন। তাঁরা দেখলেন যে স্বর্গও ঠিক নরকের মতন,খুবই সমৃদ্ধ,জীবনের সব আনন্দের উপকরণই সেখানে রয়েছে। যতই তাঁরা খাওয়ার ঘরের দিকে এগোলেন,তাঁরা শুনলেন সেই ঘরে উচ্চ স্বরে সবাই সন্তোষ ও আনন্দ প্রকাশ করছে। তাঁরা অবাক হয়ে তাড়াতাড়ি সেইদিকে ছুটে গেলেন দেখতে যে এদের এত আনন্দের কারণ কি? দলটি সেখানে গিয়ে এক আশ্চর্য ঘটনা প্রত্যক্ষ করলেন। ঠিক নরকের মতন,এখানেও খাবার টেবিল ভাল ভাল খাবারে ভরা। লোকেদের দেখে মনে হল তারা সুখী,তাদের পেট ভর্তি ও তারা সন্তুষ্ট এবং তারা খাচ্ছিল। চারিদিকে আনন্দ উপছে পড়ছে। এবার দলের সদস্যরা ভাল করে দেখলেন তাদের হাতের অবস্থা কেমন। তাঁরা দেখলেন, এখানেও লোকেদের কনুই নেই। তারাও নিজেদের খাবার জন্য হাত বেঁকাতে পারছিল না। কিন্ত তবুও তারা অসুখী নয়। তারা বুঝতে পেরেছিল যে তাদের সামনে যে সুখাদ্য রয়েছে, তা নিজেরা খাবার জন্য নয়, অন্যের সেবা করার জন্য।তেই না পারে, তাহলে রতাদের অত খাবার দেওয়া কেন?

তারপর তাঁরা স্বর্গে গেলেন সেখানকার অবস্থা পর্যবেক্ষণ করার জন্য। তাঁরা ঠিক সময়ে পৌঁছলেন। স্বর্গবাসীরা তখন মধ্যান্হ ভোজনের জন্য বসেছেন। তাঁরা দেখলেন যে স্বর্গও ঠিক নরকের মতন,খুবই সমৃদ্ধ,জীবনের সব আনন্দের উপকরণই সেখানে রয়েছে। যতই তাঁরা খাওয়ার ঘরের দিকে এগোলেন,তাঁরা শুনলেন সেই ঘরে উচ্চ স্বরে সবাই সন্তোষ ও আনন্দ প্রকাশ করছে। তাঁরা অবাক হয়ে তাড়াতাড়ি সেইদিকে ছুটে গেলেন দেখতে যে এদের এত আনন্দের কারণ কি? দলটি সেখানে গিয়ে এক আশ্চর্য ঘটনা প্রত্যক্ষ করলেন। ঠিক নরকের মতন,এখানেও খাবার টেবিল ভাল ভাল খাবারে ভরা। লোকেদের দেখে মনে হল তারা সুখী,তাদের পেট ভর্তি ও তারা সন্তুষ্ট এবং তারা খাচ্ছিল। চারিদিকে আনন্দ উপছে পড়ছে। এবার দলের সদস্যরা ভাল করে দেখলেন তাদের হাতের অবস্থা কেমন। তাঁরা দেখলেন, এখানেও লোকেদের কনুই নেই। তারাও নিজেদের খাবার জন্য হাত বেঁকাতে পারছিল না। কিন্ত তবুও তারা অসুখী নয়। তারা বুঝতে পেরেছিল যে তাদের সামনে যে সুখাদ্য রয়েছে, তা নিজেরা খাবার জন্য নয়, অন্যের সেবা করার জন্য।

সুতরাং তারা টেবিল থেকে পর্যাপ্ত খাবার নিয়ে অন্যদের খাওয়াচ্ছিল। সবাই অন্যকে খাওয়ালে,সবারই অনেক খাওয়া হচ্ছে। কারোকে উপবাস করতে হচ্ছেনা। সবাই আনন্দে থাকায় সেই জায়গা সত্যিই স্বর্গ হয়ে উঠছে। অপরদিকে নরকে,তারা জানেনা যে অন্যের সেবা করার জন্যই তাদের হাত দেওয়া হয়েছে। তারা স্বার্ধপরের মতন আচরণ করে নিজেদের সেবা করার চেষ্টা করছে কিন্ত কনুই না থাকায় সেটা সম্ভব হচ্ছেনা। তাই তাদের কাছে জায়গাটা কান্না, কষ্ট, ক্ষুধা ও ক্রোধে পূর্ণ নরকভূমি হয়ে উঠেছে।

প্রশ্ন:

১) নরকের ত্রিবিধ দ্বারগুলি কি কি?

২) আমরা রাগ করি কেন?

৩) রাগ সংবরণ করার জন্য আমাদের কি করা উচিত?

৪) একথা কি ঠিক যে অতিরিক্ত বিলাস ও আরামের বাসনা অলসতা ও রোগ বয়ে আনে?

৫) সৎ ও মহৎ বাসনা বলতে কি বোঝায়?

৬) লোভ ও আসক্তি আমাদের কোন পথে নিয়ে যায়?

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: